
কৃষ্ণচূড়া
হলের খাবার খেয়ে পেটের নানা রকম ব্যাধি বাঁধিয়ে ফেলেছে জামাল। গত সাড়ে তিন বছর যাবত সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলের বাসিন্দা। মোটামুটি তিনবেলায়ই এই হল ঐ হল করে খাওয়া হয় তার। তাও সকালের নাস্তা দুপুরে, দুপুরের খাবার বিকালে আর রাতের খাবার রাতেই। ফলশ্রুতিতে তার পেটে জমেছে গ্যাস্ট্রিক। বুকে চিনচিন ব্যথা আর হল লাইফের বড় উপহার অনিদ্রা তার নিত্য সঙ্গী।এই সকল কিছুর মূলেই হলো তার রাজনৈতিক জীবন যাপন। সাড়ে তিন বছর আগে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ভর্তির মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখে মো. জামাল সিকদার। তার নামের সাথে তার জন্মভূমি জেলার নামের বড়ই মিল। ঠিক ধরেছেন, তার জেলা জামালপুর।
জামালপুরের ছেলে জামাল- দারুন না শুনতে! তার বাবা একজন অদরিদ্র কৃষক আর মা গৃহিণী। ঢাকা শহরে তাদের কোন আত্মীয় স্বজন নেই। বাধ্য হয়েই ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে। দেশের কেন্দ্রীয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কম কষ্টে অপার রাজনৈতিক ক্ষমতা হাসিলের লিপ্সা তার চক্ষুগত হলো। এরপর থেকেই তাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। মাঠে ময়দানে বিপ্লবে শ্লোগানে একডাক, এক নাম— জামাল ভাই, জামাল ভাই! এখন সে চতুর্থ বর্ষেপড়ছে। যতই সে বর্ষপার করছে, ততই তার রাজনৈতিক পদোন্নতি বাড়ছে, ততই তার খাদ্যগ্রহণ অনিয়মিত হচ্ছে আর ততই তার পেটের ব্যাধি বাড়ছে। একদা এক বন্ধুর কাছ থেকে সে শুনেছিলো কমলার খোসা রোদে শুকিয়ে খেলে নাকি পেটের ব্যামো দূর হয়। সাথে সাথে এক কেজি কমলা কিনে ভেতরের কোয়া গুলো রুমমেটদের দিয়ে খোসাগুলো রোদে শুকাতে দিলো। প্রথম প্রথম টোটকা কাজে দিলেও, পরে আর কাজে দিলো না। শুকনো কমলার খোসার দুই-তৃতীয়াংশই নষ্ট হলো। এতোসবের মাঝেও তার দুটি গুণ হলো সে দেখতে সুন্দর আর বই পড়ার মন বেশ ভালো। অন্যান্য বন্ধুদের মত সে মদ সিগারেটও খায় না। একবার এক মজলিসে বসে এক ঢোক মদ গলায় ঢেলেই বমির বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছিল সবাইকে। এরপর থেকে আর কেউ তাকে মদ খাওয়ার আহ্বান করার বোকামি করেনি। এখন তার রাজনৈতিক পদও ভালো হয়েছে।
সাথে সাথে এমপি মন্ত্রীদের বাড়িতেও তার আনাগোনা বেড়েছে। এসব লাইনে লবিং এর গুরুত্ব অপরিসীম। তার সবচেয়ে কাছের গুরুজন হলেন, মন্ত্রী সাবের শমসের। মন্ত্রী সাহেবের বাড়িতে এখন হরদম যাতায়াত জামালের। মন্ত্রী সাহেবের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে মেয়ে দুটোই যে বজ্জাতের হাড্ডি, তা দেখলেই বোঝা যায়। মেয়ে বড়, পড়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর ছেলে ছোট, পড়ে উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে। মেয়েটার দিকে জামালের প্রেমাতুর দৃষ্টি ছিলো বলে তাকে এতটা বদ লাগতো না জামালের কিন্তু ছেলেটা বদের হাড্ডি।
জামাল একদিন সরল মনে জানতে চেয়েছিলো, কোন কলেজে পড়ো ছোটভাই?
ছেলেটি উত্তর দিয়েছিলো, কেন? আপনি জেনে কি করবেন? আপনার ছেলেকে ভর্তি করাবেন?
ভাবা যায় কত বড় বদ! মন্ত্রীর ছেলে না হলে কখন এই ছেলের গালে ঠাস ঠাস করে
দুটো চড় মেরে দিতো জামাল! জামাল ছেলেটিকে সমীহ করে দুটি কারণে— এক, সে মন্ত্রীর ছেলে আর দুই, সে ঐ মেয়েটির ভাই। এই বদের নাম শান্ত (নাম রাখা সার্থক হয়নি) আর বদের সুন্দরী বোনের নাম শান্তি। জামালের দৃঢ় ধারণা, শান্তিও জামালকে পছন্দ করে। মাঝে মাঝেই ছোট ভাইকে দিয়ে বিভিন্ন জিনিস পাঠায়। চকোলেট, বাসায় রান্না খাবার আরো কত কি! জামালের মনে তখন আনন্দ হয়। শান্তি নিজে এসে দিয়ে গেলে সে আরো খুশি হতো। বদের হাত দিয়ে পাঠালে তো কিঞ্চিত মন খারাপ হয় জামালের!
একদিন শান্ত এক খামে কি যেন নিয়ে এসে বললো, এতে একটি চিঠি আছে, আপা দিয়েছে। বলেছে বাসায় যেয়ে দেখতে। আর কাল আমার সাথে কাল বিকাল পাঁচটায় ধানমন্ডি লেকে দেখা করে উত্তর দিতে বলেছে। বাসায় এসব চালাচালি করা খুবই বিপদজনক। জামাল তো খুশিতে গদগদ। সে মোটামুটি নিশ্চিত চিঠিতে কী লেখা আছে।
কত গভীর প্রেম নিবেদন তাতে রয়েছে, তা জানতে সে রুমে যেয়ে জামা কাপড় না ছেড়েই চিঠি পড়তে বসে গেলো। খুবই সংক্ষিপ্ত চিঠি।
প্রিয়,
আমি তোমাকে পছন্দ করি। তুমি করো কি? আজ ভেবো না। কাল ভেবে উত্তর দিও।
ইতি-
তোমার হতে চাওয়া প্রিয়তমেষু।
এই চিঠি পড়ার পর এমন জোরে চিৎকার দিলো সে, রুমের সবার পিলে চমকে গেলো। সবাই ভয় পেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। সে বললো, আজ রাতে তোমাদের সবাইকে খাওয়াবো তাই চিৎকার দিলাম। সবাইকে নিজের টাকায় রাতের আহার করালো জামাল। খাওয়া শেষ করে এসে সেও ‘ভালোবাসি’ লিখে একটি চিরকুট তৈরি করলো। তাতে পাশের রুমের বড়লোক বন্ধুর থেকে আনা পারফিউম ছোঁয়ালো।
রাতে তার আর ঘুম হলো না। সকাল থেকেই সে নিজেকে সাজানোর প্রয়াস করতে লাগলো। কোনরকমে দুপুরে খেয়েদেয়েই দুপুর তিনটার মধ্যে যেয়ে হাজির হলো ধানমন্ডি লেকে। অপেক্ষার মধুপান করতে লাগলো সে। পাঁচটায় শান্ত তার সামনে হাজির হলো। আজকে এই বদ ছেলেকে দেখতেও তার ভীষণ ভালো লাগছে।
সে তার চিরকুট বের করে দিয়ে বললো, এটা তোমার আপাকে দিবে। রাস্তায় খুলে পড়বে না দয়া করে। শান্ত বললো, এতো কঠোর সুগন্ধি মাখিয়েছেন কেন? তবে উত্তর লেখার জন্য ধন্যবাদ।
আপনাকে একটা কথা বলার ছিলো। আসলে আমার আপা আপনাকে পছন্দ করে না, আপনাকে সহ্যই করতে পারে না।
জামাল যেন আকাশ থেকে পড়ে বললো, মানে কি?
শান্ত বললো, মানে খুবই জটিল। এই চিঠি লিখেছিলাম আমি। আমার বোনের নামে চকোলেট, খাবারগুলোও আমিই পাঠাতাম— আপনি জানতেন আমার আপা পাঠাতো।
আমি আপনাকে পছন্দ করি মো. জামাল সিকদার। একটু বেশিই পছন্দ করি। একজন ছেলের মুখ থেকে ভালোবাসার কথা শুনবে এমনটি কোনদিন কল্পনাও করেনি জামাল। আদতেও কেউ কাউকে করতে পারে এটা সে ভাবতেই পারে না। কিভাবে সম্ভব এটা! প্রকৃতির উল্টো পথে কিভাবে মানুষ হাঁটতে পারে? খুবই বিব্রত হয়ে জামাল বললো, মাথা ঠিক আছে তোমার? কি বলো এসব? প্লিজ মজা করো না। চিঠিটা তোমার আপাকে দিয়ে দিও।
শান্ত বললো, সত্যি বলছি, আমার আপা আপনাকে পছন্দ করে না। আমি আপনাকে পছন্দ করি। চিঠিটা আমিই লিখেছিলাম। জামাল কি করবে বুঝতে পারছিলো না।
মন্ত্রীর ছেলে ভুলে গিয়ে ধমক বললো, এগুলো কিভাবে সম্ভব? প্রকৃতি, ধর্ম এগুলোকে সমর্থন করে না। আমার তো শুনেই গা ঘিনঘিন করছে। দয়া করে আমার সামনে আর এসো না কোনদিন। তুমি মন্ত্রী সাহেবের ছেলে তাই সম্মান রক্ষা করলাম। নাহলে অপমানের চরম শিখর বুঝিয়ে দিতাম— বলেই পিছন ফিরে চলে গেলো জামান। তার মনটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। সে কোনদিন ভাবতেও পারেনি কোন ছেলে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেবে, তার জন্য চিঠি লিখবে, তার জন্য খাবার পাঠাবে। কালো মুখ করে সে রুমে গেলো। রুমমেটরা কালো মুখ দেখেই প্রশ্ন করলো, কি ভাই, ভাবীর সাথে রাগারাগী হলো নাকি? রুমমেটদের মুখে ‘ভাবী’ শব্দটি শুনেই জামালের মনে একটি দৃশ্য ভেসে উঠলো— বিয়ের জমকালো অনুষ্ঠানে সে বর বেশে বসে আছে আর তার পাশে বধূ বেশে বসা শান্ত। সাথে সাথে সে ভূত দেখা চিৎকার করছ বলে উঠলো ‘নাআআআআআ’! রুমমেটরা ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে ভাই? ভাবীর সাথে সিরিয়াস কিছু? বলতে দেরী, সাথে সাথে জামাল গিয়ে কষিয়ে চড় মেরে দিলো দ্বিতীয় বর্ষেপড়া রুমমেটকে। সে নিয়ে তো বাঁধলো বিশাল ঝামেলা। এ নিয়েই কাটলো দুটি দিন। দুইদিন পর মন্ত্রীর সাথে দেখা করার জন্য ফোন আসলো। সাথে সাথে জামালের মনে বধূ শান্তর মুখ ভেসে উঠলো। অনেক কষ্ট চেপেও সে মন্ত্রী নিবাসে গেলো। এখন না যেয়ে উপায়ও নেই। খুবই নিকটতম বছরগুলোতেই সে চাকরির পরীক্ষা দেবে। এখন কোনভাবেই রাজনৈতিক অভিভাবকের রক্তচক্ষুর কারণ হওয়া যাবে না। মন্ত্রীর বাড়ির ড্রয়িং রুমে বসেই এদিক ওদিক খোঁজা শুরু করলো হারামজাদাটা আছে কিনা! কিছুক্ষণ পরই তার জন্য নাস্তা নিয়ে রুমে ঢুকলো শান্তি। শান্তিকে দেখে তার মন আরো খারাপ হয়ে গেলো। কত স্বপ্ন দেখেছিলো সে এই মেয়ে কে নিয়ে! মেয়েটি ফুচকা খাওয়ার আবদার করবে, দেখা করার সময় এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দেবে, রেস্টুরেন্ টে বসে পায়ে পা রেখে বসে থাকবে পুরোটা সময়, বাসে হাত ধরে মাথা রেখে ঘুমোবে, একটু বেশী খরচ করতে গেলেই তার অপারগতার কথা ভেবে ধমক দিয়ে খরচ করতে বাধা দেবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব ভগ্নস্বপ্নের কষ্টগুলো শান্তিকে দেখার সাথে সাথে হু হু করে বেড়ে গেলো। নাস্তা টেবিলে রেখেই চলে গেলো শান্তি। এ যাত্রায় জামাল বেঁচে গেলো। শান্তর সাথে এ যাত্রায় দেখা হলো না। জামাল মন্ত্রীর বাসায় যাওয়া কমিয়ে দিলো। দুই সপ্তাহ পর জামাল একদিন সেই বাসায় গেলো। এবার ড্রয়িং রুমে নাস্তা নিয়ে এলো শান্ত। শান্তর চেহারা দেখার সাথে সাথে জামালের মুখ রাগে লাল হয়ে গেলো।
তার মনে হচ্ছিল থাপ্পড় দিয়ে শান্তর গাল লাল করে দিতে।
শান্ত খুবই শান্ত ভঙ্গিতে বললো, এই কয়েকদিন আপনি অনেক ঝড়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন বুঝতে পারছি। আপনি কি আমার প্রোপোজের ব্যপারে কিছুভেবেছেন? আমার মনে হচ্ছে আপনি কিছুই ভাবেননি। জামাল কণ্ঠে সব রাগ ঢেলে দিয়ে বললো, তোমার সমস্যা কি রে ভাই! তোমার কথা চিন্তা হলেই আমার বমি এসে পড়ে । মন্ত্রীর ছেলে বলে তোমাকে কিছু বলি না। তারমানে এটা মনে করো না যে এগুলো আমি সহ্য করবো।
শান্ত বললো, আপনাকে যে সহ্য করতেই হবে। শুনুন মি. জামাল, আপনি চান বা না চান, আমার সাথে প্রেম করতে হবে আপনার। মন থেকেই করবেন নাকি অভিনয় করবেন তা একান্তই আপনার বিষয়। কিন্তু আমার সাথে প্রেম করতেই হবে। জানেন তো, আমি মন্ত্রীর ছেলে। সামনের পদ বন্টনের তালিকায় নিজের নাম দেখতে চান নাকি সারাজীবনের জন্য ক্যারিয়ার প্রতিবন্ধী হয়ে থাকতে চান তা নির্ভর করছে আপনার ওপর— কথাগুলো বলেই চলে গেলো শান্ত। জামালের মাথা ভনভন করে ঘুরছে। রুমে যেয়েই কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো সে। মাথায় তার চিন্তায় ভরপুর। একদিকে আগামীর পুরো ক্যারিয়ার অন্যদিকে এক নষ্ট কাজের আহ্বান। কিন্তু কোনটা বেছে নেবে সে?
ভাবলো আর কয়দিন পরই তো ফাইনাল পরীক্ষা, এর মাঝে পলিটিক্যাল পোস্টও পাকা হবে। চাকরি পাওয়ার পর তো আর শান্ত কে কোন দরকার হবে না। এক দেড় বছর কোন রকমে কাটিয়ে দিবে শর্তেসে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো সে শান্তর কথায় রাজি হবে। তখনই ভেসে আসলো সেই আগের দৃশ্যটি— বর কনে হিসেবে পাশাপাশি বসা শান্ত-জামাল। ভাবতেই কান্না পেলো তার। জীবনের এ কি খেলায় জড়িয়ে গেলো সে!
ভাবতে ভাবতেই সে ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে জামালের ঘুম ভাঙলো একটি অপরিচিত ফোন কল পেয়ে। ফোন ধরেই বুঝলো ওপাশে শান্তর কণ্ঠ।
শান্ত কল রিসিভের সাথে সাথে বলতে শুরু করলো, ১২ টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেখা করবে। দুপুরে একসাথে খাবো আমরা।
জামাল উত্তর না দিয়েই ফোন কেটে দিলো। এমনিই তার মাথা ব্যথা তার ওপর এই ফোনকল! ১২টার মধ্যেই সে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেয়ে হাজির হলো। যেয়ে দেখে শান্তর দেখা নাই। সাথে সাথে ফোন দিলো শান্তকে।
শান্ত ফোন ধরেই বললো, আমার আর পাঁচ মিনিট লাগবে— বলেই ফোন রেখে দিলো।
দশ মিনিট পর শান্ত এলো। এসেই অভিযোগের সুরে বলা শুরু করলো, তুমি প্রেম করতে এসেছো, হাতে ফুল নেই কেন?
জামাল কোন উত্তর দিলো না। শান্ত বলতেই থাকলো, তোমার মাথায় কি কখনো চিরুনি লাগাও না— বলেই পকেট থেকে চিরুনি বের করে জামালের মাথা আঁচড়াতে শুরু করলো। জামাল ইতস্তত হয়ে শান্তকে সরিয়ে দিলো।
মুখ রাগি করে বললো, এটা আমার বিশ্ববিদ্যালয়। কেউ এ দৃশ্য দেখলে আমার কি পরিণতি হবে বুঝতে পারছো? তোমার পায়ে ধরি, তোমার কোন আচরণে আমার মান সম্মান নষ্ট করো না।
শান্ত বললো, আচ্ছা করবো না। এখন খেতে চলো। আমার ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে।
লালবাগ যাই, ওখানে ভালো রেস্তোরাঁ আছে। বিল নিয়ে ভাবতে হবে না তোমায়, আজ বিল আমি দিবো।
তারা রিক্সা নিয়ে লালবা গকেল্লার বিপরীতে একটি রেস্তোরাঁয় গেলো। খাবার অর্ডার করে দু’জন চুপ করে বসে রইলো। হঠাৎ জামাল অনুভব করলো তার পায়ে কেউ পা রাখছে। সাথে সাথে সে পা সরিয়ে নিলো।
শান্ত আবার পা রেখে বললো, পা সরানোর চেষ্টা করবেন না প্লিজ।
জামালের পায়ের ওপর দুটি নরম পা। জামাল অনুভবের চেষ্টা করছে এটা ছেলের পা নাকি মেয়ের পা।
সে শান্তকে বললো, তোমার বাবাকে আমার ব্যাপারে সুপারিশ করবে তুমি। সামনে আমার ভালো পোস্ট চাই।
শান্ত বললো, আপনি এখন মন্ত্রীর ছেলের প্রেমিক। যেন তেন পোস্টে তো আপনাকে মানাবে না— বলেই হাসা শুরু করলো।
জামালের পিত্তি জ্বলে গেলো এই হাসি শুনে। কোনরকমে খাবারগুলো খেলো জামাল। এ যাত্রা শেষ হতেই শান্ত বললো, এখন আমাকে বাসা পৌঁছে দাও। ভয় নেই, উবার ক্যাবে চড়াতে হবে না। আমি বাসেই যেতে পারবো।
শান্তকে নিয়ে বাসে উঠলো জামাল। পাশাপাশি বসে আছে তারা। শান্ত ঘুমে জামালের কাঁধে ঢলে পড়লো। মাথা সরাতে যেয়েও সরাতে পারলো না জামাল। ঘুমন্ত শান্তকে বড়নিষ্পাপ লাগছে। জামাল শান্তকে বাড়ির গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিলো।
এভাবেই কয়েক মাস কেটে গেলো। জামাল-এর মধ্যে ভালো একটি রাজনৈতিক পদের অধিকারী হয়েছে। এখনো শান্তর সাথে তার প্রেম প্রেম খেলা চলছে তবে আগের মত এত ঘৃণাবোধ কাজ করে না। মাঝে মাঝেই সে ভাবে সে শান্তিকে নিয়ে যে স্বপ্নগুলো দেখেছিলো তার সব পূরণ হয়েছে শান্তর মাধ্যমে। দেহের পার্থক্য থাকলেও অনুভূতির কোন পার্থক্য নেই আসলে। আসলে ভালোবাসাকে পায়ে মাড়াতে হয় না। এই পৃথিবীতে খুব বিরল জিনিসগুলোর একটি হলো ভালোবাসা। একজন মানুষকে খুব কম মানুষই ভালোবাসে। অবহেলা করলে অল্প ভালোবাসাগুলোকেও হারাতে হয়। আর দুইদিন পরই ভালোবাসা দিবস। এই দুইদিন জামাল অনেক চিন্তা করলো। কোনো অমূল্য সম্পদকেই সে অগ্রাহ্য না করার সিদ্ধান্ত নিলো। ভালোবাসা দিবসে এই প্রথম সে শান্ত কে কল দিলো।
কল দিয়েই সে বললো, আজ বিকাল তিনটায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেখা করো।
জামাল ৩০ মিনিট আগে থেকেই অপেক্ষা করা শুরু করছে। তবে আজ কেমন মধুর লাগছে। তিনটা পনেরোতে আসলো শান্ত। আজ জামালের হাতে গোলাপ ছিলো।
জামাল ফুলগুলো শান্তর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, চলো আজ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসি।
শান্তর মনের মধ্যে যে প্রচণ্ড আনন্দ হচ্ছে, তা মুখে প্রকাশ পাচ্ছে না। দু’জন একটি গাছের নিচে বসলো।
জামাল শান্তর বাম হাত নিজের দু’হাতের মাঝে নিয়ে বললো, তারপর বলো,
পড়াশোনা কেমন চলছে?
শান্ত বললো, ভালোই, তবে বাংলা ২য় পত্রে সমস্যা। নাম্বার উঠছে না ভালো।
জামাল বললো, ভালো করে পড়ো। সামনের সপ্তাহ থেকে দেখা করার সময় বই নিয়ে এসো, আমি বুঝিয়ে দেবো। ভালো করে পড়াশোনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হও।
দূরে চলে গেলে প্রেমিকের কষ্ট হবে।
শান্তর মুখে এখনও আনন্দের ছাপ পড়েনি। সে কোন কথা না বলেই জামালের কাঁধে মাথা রাখলো। আজ জামালের মনে ভীষণ ভালোলাগা কাজ করছে। কোনদিন কল্পনাও করেনি সে এই অপার আনন্দ পাবে। মানুষ অনেক সুখ না চাইতেই পেয়ে যায়, জামালও পেয়েছে। সুখখানা উপকারি নাকি অপকারি, বৈজ্ঞানিক নাকি অবৈজ্ঞানিক তা জামাল জানে না। তবে সে জানে সেটি বড়ই মধুর।
প্রথম প্রকাশ: সমারূঢ়
(মন্দ্র প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রথম কুইয়ার ছোটগল্প সংকলন