বনসাই

শঙ্কর তারা

নার্সারিতে যেয়েই মাহতাবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ওর কাজের ঘরের দরজাটা হাট করে খোলা। ‘মিন্টু, মিন্টু’ বলে হাঁক পাড়তে পাড়তে ঘরে ঢুকল ও। মিন্টু পেছনের বাগানে গাছে পানি দিচ্ছিল। চিৎকার শুনে দৌড়ে এল তাড়াতাড়ি।

—মামা ডাকছেন?

—এই ঘরে কে ঢুকছিল?

—আমি।

ঠাস করে গালে এক চড় বসিয়ে দিল মাহতাব।

—কদ্দিন কইছি হারামজাদা, আমারে না কইয়া এই ঘরে ঢুকবি না। কথা কানে যায় না?

মিন্টু অপরাধীর মত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।

—কেন ঢুকছিলি? দরদ দেহাস গাছের উপরে? আর একদিন কইলাম কথা না

শুনলে চাকরি করন লাগব না তোর। যা ভাগ এহন!

মিন্টুর কিশোর চোখগুলো জলে ভাসে। পায়ে পায়ে সরে যায় দরজার সামনে থেকে।

ঘরের বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরায় মাহতাব। মাথা তার এমনিতে বেশ ঠান্ডা, সহজে রাগ হয় না। সারাক্ষণ প্রকৃতি আর সবুজের মাঝে থাকলে মনটাও ওদের মতই নরম থাকে। মিন্টুকে ও সে যথেষ্টই আদর করে। কিন্তু ওর কাজের ঘরে অন্য কেউ ঢুকলে তার সহ্য হয় না। পুরো নার্সারিতে ওই জায়গাটাই ওর সবচে’ প্রিয়, রীতিমত পবিত্র জ্ঞান করে সে। কিন্তু কিছুদিন থেকেই দেখছে মিন্টু সুযোগ পেলেই ওখানে ঢুকে যায়। সারি সারি সাজানো বনসাইগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে, কাছে যেয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলে, গাছগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। কয়েকবার ধমক দিয়ে ওকে বের করে দিয়েছে মাহতাব, পইপই করে বলে দিয়েছে ওখানে না ঢুকতে, তারপরেও যদি সে ছেলের আক্কেল হয়! সকালে আজ বাসা থেকে বেরই হয়েছিল মন খারাপ করে, রাগের ঝাঁঝ তাই পুরোটা গেছে মিন্টুর ওপরে। এখন খারাপ লাগছে নিজের কাছেই।

—মিন্টু! ওই মিন্টু!

কোন কথা না বলে চুপচাপ পাশে এসে দাঁড়ায় মিন্টু।

—সকালে খাইছস?

মিন্টু দুপাশে মাথা নাড়ে। অভুক্ত ছেলেটাকে বকেছে ভেবে অপরাধ বোধ আরো বাড়ে মাহতাবের। পকেট থেকে ২০ টাকার একটা নোট বের করে মিন্টুর হাতে গুঁজে দেয়।

—যা দেহি, কেরামতের হোটেলে যা। ডাইল-রুটি খাইয়া আয়।

মিন্টুর চোখে আবার পানি চলে আসে। বিব্রত মাহতাব তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে পড়ে। মাহতাবের বয়স ত্রিশের কোঠা ছাড়িয়েছে। বিয়ে করেছে প্রায় ৫ বছর হলো, কিন্তু এখনো ঘরে অতিথি আসে নি। এটা নিয়ে মাহতাবের মনে বেশ দুঃখ। ইয়ার-দোস্তরা মাঝে মাঝেই অবশ্য একটুঠেসে কথা বলে, কেউ কেউ আরেকটু মেকি সমবেদনা দেখিয়ে আবার বিয়ে করার পরামর্শও দেয়। তারও যে সে কথা মাথায় আসে নি একবারও, এমন কথা সে বলবে না। বাচ্চাকাচ্চার ভীষণ শখ তার। একটা জীবন্ত পুতুল ঘরজুড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে, খেলছে, কাঁদছে, তার কোলে উঠে ঘুমিয়ে পড়ছে, এমন স্বপ্ন সে প্রায়ই দেখে।

এসব চিন্তা থেকেই নার্সারির ব্যবসাটা একটু জমতেই বিয়ে করেছিল সে। বৌটাকে বেশ ভালবাসে মাহতাব। আরেকটা বিয়ের কথা তাই সে ভাবে না। তাছাড়া মনের মাঝে গেঁথে থাকা ছোটবেলার দুঃসহ স্মৃতি গুলো ভোলেনি সে এখনো। তার বাপের ছিল তিন বৌ।

সারাক্ষণ বৌদের মধ্যে কাজিয়া লেগেই থাকতো, আর বাপ বাড়ি আসলেই তিনজনকেই সমানে পেটাত। সেই কাজিয়ার মধ্যে ছেলে মেয়েদের দিকে কারো খেয়াল ছিল না। বয়স পনের না হতেই তাই মাহতাব ঘর ছাড়ে। নিজের ছেলেমেয়ের জন্য এমন ভবিষ্যৎ ওচায় না। কিন্তু বৌটা আজকাল কেমন মুখরা হয়ে গেছে। নিজ থেকে কথা বলে না, প্রশ্ন করলে ঝামটা মেরে উত্তর দেয়। ছোট খুঁতেই গজগজ করতে থাকে। আজ সকালেই বাজার থেকে আসার পথে ছোট মাছ দেখে পছন্দ হওয়ায় কিনে ফেলেছিল কিছুটা। তাই নিয়ে তুলকালাম চলেছে পুরোটা সকাল। মাহতাব দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, একটা বাচ্চা ছাড়া ওর সংসারে আর কেউ শান্তি আনতে পারবে না মনে হয়।

কাজে মন বসানোর চেষ্টা করে মাহতাব। ওর প্রধান পেশা ও নেশা এখন বনসাই বানানো। খুব পরিশ্রম আর ধৈর্যের কাজ এটা। প্রথমে বিশেষভাবে টব বানিয়ে নিতে হয়। এগুলোর চারপাশে কয়েকটা ফুটো থাকে। তারপর পছন্দমত জাত আর সাইজের গাছ বাছাই করা। তার দিয়ে কাণ্ড আর ডালপালা পেঁচানো, তারপর সেই তার টবের ফুটোয় আটকে টানা দিয়ে রাখতে হয় অনেকদিন। ভীষণ যত্ন নিতে হয়। অনেকটা সুস্থ মানুষকে অসুস্থ বানিয়ে তারপর আইসিইউ-এর লাইফ সাপোর্টদেয়ার মতন। কিন্তু কাজটায় মাহতাব মজা পায়। বনসাই এর দাম অনেক, বিক্রিও ভালো। যে কাজে টাকা আছে, মাহতাব তার জন্যে খাটতে রাজি। সেই ১৫ বছর বয়স থেকে, যখন সে ঘর ছেড়েছে, তখন থেকেই সে জানে দুনিয়ায় চলতে গেলে টাকার কত দরকার।

বাড়ি থেকে পালিয়ে শহরে এসে সে নানারকম কাজ করেছে। তারপর এসে জুটেছিল এক নার্সারিতে। ভীষণ খাটতে পারত ও, উদ্যমী লোক, শেষমেষ নিজেই একটা নার্সারি খুলে বসেছে। একবার বৃক্ষ মেলায় গিয়ে সে বারো হাজার টাকার গাছ বিক্রি করেছিল।

আর তার পাশের দোকানে একটা বনসাইই বিক্রি হয়েছিল বারো হাজারে। তখন থেকে মাহতাব উঠে পড়ে লাগে বনসাই বানানোয়, এখন তার রোজগার বেশ ভালই। কিন্তু এই টাকায় ওর পোষায় না। যে দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে সে বড় হয়েছে, সন্তানের শরীরে তার বিন্দুমাত্র ছোঁয়া সে লাগতে দিতে চায় না। তাই রোজগার বাড়লেও সে এখনো কষ্ট করে চলে, বাড়ি থেকে হেঁটে আসে প্রতিদিন নার্সারীতে আর দিনরাত চিন্তা করে একদিন সে এমন বনসাই তৈরি করবে যেগুলো লাখ টাকায় বিক্রি হবে। চিন্তা করতে করতে ভবিষ্যত সুখের কল্পনায় মাহতাবের মনে ফুর্তি আসে, সকালে বৌয়ের মুখঝামটার কথা ভুলে যায়। হাত চালায় সে, আরো অনেকগুলো টব রেডি করতে হবে আজকে, যত বনসাই তত টাকা!

নার্সারিতে মাহতাব না থাকলেই বনসাই এর ঘরটায় চুপি চুপি ঢুকে পড়ে মিন্টু। পুরো নার্সারিটাই তার প্রিয়, এই ঘরটাতে আসলেই শুধু তার কেমন মন খারাপ হয়ে যায়।

তবুও সে বারবার আসে। বনসাইগুলোর জন্য তার বড় মায়া লাগে। কত বড় হওয়ার কথা ছিল এদের। বিশাল বিশাল ডালে কত পাখি, কত ছায়া। অথচ এখন সারা শরীর জুড়ে তার পেঁচিয়ে কেমন জবুথবুলাগছে ওদের। ছোটবেলায় ওদের গ্রামে এক বামন ছিল। গ্রামেরা ছেলেরা খুব জ্বালাত ওকে। রাস্তায় পেলেই কেউ ঢিল ছুঁড়ত, কেউবা টান দিয়ে কাপড় খুলে দিত। মিন্টু অবশ্য এসব করত না কখনো। ওর কষ্ট লাগত ওই লোকটার জন্য। একদিন মাকে জিজ্ঞেস করেছিল লোকটার কথা। মা বলেছিল, কিসের নাকি অভিশাপে লোকটা এমন হয়ে গিয়েছে। আচ্ছা, এই গাছগুলোকে কে অভিশাপ দিয়েছিল? মিন্টু ভাবে। কোনো কিনারা করতে পারে না। কিন্তু এটুকু সে জানে, এরকম করলে গাছগুলোর কষ্ট হয়। গাছ তো বোবা, কষ্টের কথা বলতে পারে না। অবলা প্রাণীদের কষ্ট নাকি অভিশাপ হয়ে যায়! মিন্টুর হঠাৎ ভয় করে, মাহতাব মামাকে গাছগুলো কোন অভিশাপ দেবে না তো? মামা যেভাবে গাছগুলোকে খোঁচায়, কাটে, তার দিয়ে পেঁচায় সেসময় নিশ্চয় গাছগুলো অভিশাপ দেয়। মাহতাব মামার কি এইজন্য বাচ্চা হয় না? নাহ, মানুষটা মাঝে মাঝে একটু রাগারাগি করলেও এমনিতে বড়ই ভালো। তার কোনো ক্ষতির কথা মিন্টু চিন্তাও করতে পারে না।

আজকে মিন্টুর পেট যে তিনবেলা ভরা থাকে, রাতে যে ঘুমানোর একটা জায়গা আছে, এই যে মাঝে মাঝে শখ করে বিড়িতে টান দেয় তার পয়সা আছে, এসব তো মাহতাব মামা ছাড়া হত না। নিজের অতীতকে দুঃস্বপ্ন মনে হয় এখনো মিন্টুর। সেই ছোটবেলায় কবে গঞ্জের হাটে হারিয়ে গিয়েছিল সে। বাবা-মা’র চেহারা ওভাবে আর মনে করতে পারে না এখন। গিয়ে পড়েছিল একদল ভিক্ষুকের হাতে। পথে পথে ওদের সাথে ভিক্ষা করে বেড়াত। নিষ্ঠুরতা কাকে বলে সে দেখেছে জীবনে। ছোট ছোট বাচ্চাদের হাত পা কেটে, হাঁড়ির ভেতরে রেখে পঙ্গু বানিয়ে বেশি ভিক্ষে পাওয়ার ঘটনার সাক্ষী সে। সব সময় ভয়ে থাকত, কখন না জানি তার অবস্থাও ওরকম হয়। তারপর একদিন সুযোগ বুঝে পালিয়ে আসে। এখানে ওখানে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে মাহতাবের সাথে পরিচয় হয়। যার আশ্রয়ে তার দ্বিতীয় জন্ম, এমন লোকের খারাপ মিন্টু সহ্য করতে পারবে না। বনসাইগুলোকে দেখলে তার সেইসব বাচ্চাগুলোর কথা মনে পড়ে। আচ্ছা, মাহতাব মামাটা এত বোকা ক্যান? হে নিজের ভালা নিজে বুঝেনা? মনে মনে নিজেকেই প্রশ্ন করে মিন্টু। উত্তরটাও নিজেই দিয়ে দেয়, ভালা মাইনষের আসলে বুদ্দি কম। কাইল আমিই বুঝায় কমু মামারে। গাছ বেইচাই তো অনেক টাকা হয়, খালি খালি বুন্সায় বানায় গাছগুলানরে কষ্ট দেওনের দরকার কি!

রাতের খাওয়া সেরে বিছানায় গড়াচ্ছিল মাহতাব। শুয়ে শুয়ে টিভি দেখতে দেখতে কখন জানি একটু চোখ লেগে এসেছিল। হঠাৎ পায়ে কিছুর স্পর্শ পেয়ে চটকা ভেঙে গেল। চোখ মেলে দেখে ওর বৌ পায়ে হাত দিয়ে সালাম করছে। খুব অবাক হয়ে গেল মাহতাব। নতুন কোন নাটক শুরু করল আবার সালেহা? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বউয়ের মুখের দিকে। সালেহা ততক্ষণে এসে ওর পাশে বসেছে। “নেন, পান খান”— মাহতাবের হাতে এক খিলি পান ধরিয়ে দিল সালেহা। নিজেও মুখে পুরল একটা। পান চিবুতে চিবুতে বউকে ভাল করে দেখতে লাগল মাহতাব। সালেহা আজকে সুন্দর করে শাড়ি পড়েছে, চুল আঁচড়ানো, মুখে কেমন লজ্জা লজ্জা ভাব। যেন সেই শুরুর দিকের সালেহা সে।

—কিছু কইবা বৌ?

নরম স্বরে জিজ্ঞেস করে মাহতাব। সালেহার চোখেমুখে লজ্জা যেন ভীড় করে। মাথা নিচু করে সে।

—কও না কি কইবা।

মাহতাব বৌয়ের হাত নিজের মুঠোয় নেয়।

—আপনে আমারে মাফ কইরা দিয়েন। আপনার লগে কিছুদিন অনেক খারাপ ব্যাভার করছি। মাথার ঠিক আছিল না আমার।

সালেহা কেঁদে ফেলে। মাহতাব ব্যস্ত হয়ে যায় এসব সময়ে কি বলতে হয় তার ঠিক জানা নেই।

—আরে কাইন্দো না। আমি কিছু মনে করি নাই। একলা মাইয়া মানুষ, সারাদিন বাসাত থাকো, তোমার মন মেজাজ তো খারাপ হইবই।

—একটা খবর আছে।

সালেহা হাসে। মাহতাব চোখ কুঁচকায়।

—আমারে আর একলা থাকন লাগবো না। আল্লায় আমাগো দিকে মুখ তুইল্লা চাইছে।

—তুই পোয়াতি?

মাহতাব উত্তেজনায় উঠে বসে। সালেহা লজ্জায় ভেঙে কুটিকুটি হয়।

—কহন জানছো? আমারে কও নাই ক্যান আগে?

—আইজি জানছি। মৌসুমির মা দোহান থাইকা কাঠি আইনা দিছিল। সেই দিয়া পরীক্ষা করছি।

মাহতাব সালেহাকে জড়িয়ে ধরে। এতদিনের এত স্বপ্ন, এত আশা, এত প্রার্থনার উত্তর এসেছে। কেমন জানি একটা দম বন্ধ আনন্দ হচ্ছে। চোখ ভরে পানি চলে আসছে। বৌকে আরো গাঢ় করে চেপে ধরে ও।

মিষ্টির প্যাকেট হাতে নার্সারিতে ঢোকে মাহতাব। কর্মচারী সবাইকে ডাকে, মিন্টুকে নিজের হাতেই খাইয়ে দেয়। মাহতাবকে এতটা খুশি এর আগে কখনো দেখেনি মিন্টু।

ওর খুব ভাল লাগে। কাল থেকে যে কথাটা মাথায় ঘুরছে সেটা বলার সুযোগ খোঁজে।

দুপুরের দিকে একা পাওয়া গেল মাহতাবকে। নিজের ঘরে বসে একটা বটের চারায় তার পেঁচাচ্ছে। মিন্টু দরজার সামনে এসে গলা খাঁকারি দেয়। মাহতাব চোখ তুলে একবার ওকে দেখে আবার কাজে মন দেয়।

—মামা একটা কথা ছিল।

—কি কথা? ভিত্রে আয়।

মিন্টু চারদিকের বনসাইগুলোর দিকে একবার তাকায়, যেন বা কথা বলার আগে ওদের অনুমতি নিয়ে নিচ্ছে।

—আইচ্ছা মামা, বুন্সায় বানাই লাভটা কি?

—ক্যান? তুই জানস না? এইগুলার দাম পাওয়া যায় ভালো।

মাহতাব কিছুটা বিরক্ত এ ধরনের বোকার মত প্রশ্নে।

—আইচ্ছা মামা, এইগুলানরে যে এমনে তার দিয়া পেঁচায় রাহেন, আপনের খারাপ লাগে না?

—ক্যান? খারাপ লাগব ক্যান?

—গাছগুলান দুঃখ পায় না এই রহম করলে? আমি কইছিলাম না আপ্নেরে, ভিক্কা করনের লাইগা পোলাপাইনরে কেমনে হাত পা লুলা কইরা দিত? আমার কাছে এইসব বুন্সাই করা এরহমই লাগে। গাছেরে পুতিবুন্দি বানাইন্যা কাম। আমার কষ্ট লাগে। মাহতাবের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। এমন করে সে কোনদিন ভাবে নি যদিও, কিন্তু মিন্টুর সরল সোজা কথাগুলোর যুক্তি সে খণ্ডন করতেও পারছে না। এটা তার রাগ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।

—অই হারামজাদা, খুব পটরপটর শিখছস? আমারে তর কসাই লাগে নি? আমি কি চোর না বাটপার? তরে আমি কুত্তার জীবন থাইকা তুইলা আনছি আর তুই ওগো লগে আমার তুলনা দিস?

মাহতাবের অগ্নিমূর্তি দেখে মিন্টু ভয় পেয়ে যায়। সহসা ওর মুখে কথা যোগায় না। চুপ করে থেকে সাহস সঞ্চয় করে সে।

—মামা সেই কথা কই নাই। কিন্তু আমার ডর করে। অবলা জীবরে কষ্ট দিলে হেরা নাকি অভিশাপ দেয়। আপনের লিগাই তো আমি ডরাই।

—তরে এত টেনশন নিতে কে কইছে বান্দীর পুত? কামকাইজে মন নাই, সারাডাদিন খালি এই ঘরে ঘুরঘুর করিস আর এইসব বদ চিন্তা।

—কিন্তু মামা…

—চোউপপপ! ভাগ এখান থাইকা।

মিন্টু ভয়ে দৌড়ে পালায়। রাগে গজগজ করতে করতে মাহতাব আরো টাইট করে তার পেঁচাতে থাকে।

মাহতাবের ব্যবসা বেশ ভাল জমে উঠেছে। বন্ধুরাও আড়ালে আবডালে স্বীকার করতে থাকে, এই পুরষ্কার মাহতাবের প্রাপ্য ছিল, যে খাটুনিটাই না সে খাটে! আসলে পরিশ্রম করলে আল্লাহ তাকে ফিরিয়ে দেন না। এই তো এ বছরের বৃক্ষ মেলায় মাহতাব শুধু বনসাই-ই বিক্রি করেছে ৩ লাখ টাকার মতো। ঘরে নতুন অতিথি আসছে সামনে, টাকার প্রয়োজন এখন আরো বেশি। সালেহাকে সে কোন কাজ করতে দেয় না। টাকা দিয়ে কাজের লোক রেখেছে। পরিশ্রম আরো বাড়িয়ে দেয় সে, আরো নতুন নতুন গাছ তাদের তাদের বেড়ে ওঠার আনন্দ বিসর্জন দেয় মাহতাবের সুনিপুণ দক্ষতার কাছে।

মাহতাব এখন খুব সুখী। শুধু মাঝে মাঝে মিন্টুর কথা একটু মনে পড়ে, ছেলেটা সেদিনই পালিয়েছে। “হারামজাদা এক নাম্বারের অকৃতজ্ঞ”— মনে মনে গাল দেয় মাহতাব। মাঝে একদিন কেরামত এর কাছে শুনেছিল, সে নাকি মিন্টুকে স্টেশনে কুলিগিরি করতে দেখেছে। “যেহানে ইচ্ছা যাউক গা”— সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে আপনমনেই বলতে থাকে মাহতাব।

যথাসময়েই পুত্রগর্বে গরবিনী হল সালেহা। যদিও বাচ্চা ডেলিভারির সময় সালেহা মরতে বসেছিল, মাহতাব হাসপাতালে নিতে রাজি ছিল না প্রথমে। বাচ্চা জরায়ুমুখে এসে আটকে ছিল অনেকক্ষণ। পরে শেষ পর্যন্ত এলাকার রহিমা দাই এসে বাচ্চা বের করেছে।

মাহতাবের খুশি আর দেখে কে! পাড়ার সব লোককে ডেকে খাওয়ানো হল। বাড়িতে যতটুকু সময় থাকে, ছেলেকে নিয়েই মেতে থাকে মাহতাব। সালেহা মাঝে মাঝে হেসে অনুযোগের সুরে বলে, পোলা পাইয়া আপনে দেখি আমারে ভুইলাই গেছেন। মাহতাব হাসে, তোর লাইগা এমুন চান্দের টুকরা পোলা পাইছি। তরে ভুলুম ক্যাম্নে? ছেলের জন্য নিত্যনতুন খেলনা আর কাপড়চোপড়ের কোন কমতি রাখলো না মাহতাব। স্বপ্ন দেখে, ছেলে বড় হবে, তার হাত ধরে গুটুর গুটুর করে স্কুলে যাবে। খেলতে গিয়ে পড়ে ব্যথা পেলে বাপের কাছে দৌড়ে আসবে। লেখাপড়া করবে, অনেক বড় কিছু হবে তার ছেলে, যা সে হতে পারে নি। মাহতাব প্রতিজ্ঞা করে, ছেলের কোন আবদার সে অপূর্ণ রাখবেনা, যে জীবন তার ছিল, তার ছায়াও যেন ছেলের আশেপাশে না আসে। সালেহার সাথে সে গলা উঁচু করে কথা পর্যন্ত বলে না, পাছে ছেলে তার মায়ের কষ্টে কষ্ট পায়! লোকে মাহতাবের পাগলামি দেখে হাসে, মাঝে মাঝে সালেহাও যোগ দেয়। মাহতাব এসব কিছুতেই আনন্দ পায়। মাঝে মাঝে সালেহার সাথে এসব নিয়ে আপোষে তর্কবিতর্কও করে।

—এমুন কইরা যে আমারে খুঁচাও, পোলা বড় হইলে তো ভাগ তুমিও নিবা।

—নিমুনা ক্যান? পোলা কি খালি আপনের একার?

—তাইলে আমারে এইসব কস ক্যান?

—আপনের কাম দেইখা বেবাকতে হাসে। খালি আমি হাসলেই দোষ!

—আমার পোলার মতন পোলা আর কারো আছে নি ক দেহি?

সালেহা মাহতাবের গলায় উত্তেজনা টের পেয়ে হাসে।

—হ, পোলা তো শুধু আপনের একারই হইছে।

মাহতাব হাসে। সন্তানের আসন্ন নিশ্চিত সাফল্যে গর্বিত বাবার হাসি।

বছর ঘুরে আসে। মাহতাব আর সালেহার আনন্দের মাঝে চিন্তারা ছাপ ফেলতে শুরু করে। বাচ্চা গায়ে গতরে তেমন বাড়ে নি। মাহতাব ছেলের জন্য নানা রকম খাবারের অভাব রাখেনি কিন্তু তেমন কোন পরিবর্তন নেই। তার চেয়েও বড় সমস্যা, এক বছর পার হয়ে গেলেও বাচ্চা হাঁটা তো দূরের কথা, এখনো নিজে নিজে বসতেও পারে না।

কোন কথাও বলে না, খেলেও না। আশেপাশের লোকজনের ফিসফাস কানে আসে, “ওই জানস, সালেহার পোলাডা মনে হয় পাগল হইব। কেমুন মুখ দিয়া সারাক্ষণ লালা পড়ে।” আতঙ্ক ঘিরে ধরে মাহতাবকে। সেও একটু একটু বোঝে সব কিন্তু মন যে সেটা মানতে চায় না! মরুভূমিতে ঝড় উঠলে উটপাখি যেমন বালিতে মাথা গুঁজে ভাবে, কোন বিপদ নেই, মাহতাবও নিজেকে প্রবোধ দেয়। অবশেষে সালেহার চাপাচাপিতে একদিন ডাক্তারের কাছে যায় ওরা। ডাক্তার যা জানালো, তাতে মাহতাবের সব স্বপ্নই যেন এক নিমিষে মিলিয়ে গেল বাতাসে। না পাগল বলা যাবে না ওর বাচ্চাকে। কিন্তু জন্মের সময় অনেকক্ষণ জরায়ুমুখে আটকে থাকায় বাচ্চার ব্রেইনের ক্ষতি হয়েছে। এটা আর কোনদিন ভালো হবে না। মাহতাবের ছেলে কোনদিনই বড় হয়ে উঠবে না, ঠিকভাবে কথা বলবে না। যে ‘বাবা’ ডাক শোনার জন্য মাহতাবের এত আকুলতা, সেই ডাক হয়ত আর তার কোনদিনই শোনা হবে না। নিজের ভাগ্য ছাড়া আর কারো দোষ খুঁজে পায় না সে।

কয়েকদিন নার্সারিতে যায়নি মাহতাব। আজ এসেই দেখে কাজের ঘরের দরজাটা আবার খোলা। রাগ হতে যেয়েও হয় না ওর। ধীর পায়ে ঘরে ঢোকে। সারি সারি সেলফে সাজানো ওর এতদিনের পরিশ্রমের ফসলগুলো। ওয়ার্কবেঞ্চে এখনো কয়েকটা টব আর কিছু তার পড়ে আছে। মাহতাব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। আজ ওর কাজ করতে ইচ্ছে করে না। এই ঘরে সে যেন ওর ছেলের না বলতে পারা কথাগুলোর দীর্ঘশ্বাস শুনতে পারছে। হঠাৎ ওর মিন্টুর কথা মনে পড়ল, মনে পড়ল মিন্টু ওকে কি বলেছিল। তবে কি? কিছুটা অনুতাপ হতে লাগল ওর। যদি সেদিন মিন্টুর কথা শুনত, হয়ত আজ তার ছেলের এমন পরিণতি হত না। কত কিই তো ঘটে এই পৃথিবীতে! মাহতাব ঠিক বুঝে উঠতে পারে না তার এই কথাগুলো বিশ্বাস করা উচিৎ কিনা।

তাকিয়ে থাকে বনসাইগুলোর দিকে, ছেলের মুখটা চিন্তা করে কিছুক্ষণ। ক্ষীণ একটা হাসি ফোটে, স্বস্তির হাসি। অভিশাপ দিক আর না দিক সে এই কারাগার থেকে মুক্তি দেবে এই অসহায় প্রাণগুলোকে। তার ছেলে বেড়ে না ওঠুক, অন্যদের বেড়ে উঠতে দেখেই সে মেটাবে তার সাধ। তার আগে মিন্টুকে খুঁজে বের করতে হবে।

নার্সারি থেকে বের হয়ে হাঁক পাড়ে মাহতাব— এই রিকশা, ইস্টিশান যাইবা?

প্রথম প্রকাশ: সমারূঢ়
(মন্দ্র প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রথম কুইয়ার ছোটগল্প সংকলন)

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.