
মেঘ রাজ সাইমুন
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম।
অফিস থেকে ছুটি নেওয়া ছিলো, তবুও যাচ্ছি। হয়তো ভালো লাগবে কিছুটা।
শহরটাকে আজ কেমন জানি অপরিচিত লাগছে।
এই চেনা রাস্তা।
চেনা গলি।
চেনা ফুটপাত।
সব অচেনা। সকালে কিন্তু অচেনা ছিলো না এই শহর। এখন খুব অচেনা, অজানা
মনে হচ্ছে। শহরের গড়াই মোড়ে সেই পরিচিত পাগলটাকে আজ দেখতে পেলাম না।
মনটা কেমন করে উঠল।
হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম।
মাহিন ফোন করছে।
কিন্তু আমার ধরতে ইচ্ছা করছে না। ছেলেটা আমাকে বড্ড ভালোবাসে। যদিও আমার এত ভালোবাসা চাই না, তবুও সে অনেক ভালোবাসে আমায়। ফোনটা দেখে সুইচ অফ করে দিলাম।
অফিসে ঢুকতেই শিমুল ভাই প্রশ্ন ছুড়ে দিল, কি রে অফিসে এলি যে? ডাক্তারের কাছে যাস নি?
আমি হালকা হেসে বললাম, গিয়েছিলাম তো। তারপর ভাবলাম বাসায় গিয়ে কি আর করবো? অফিসেই আসি।
—কি বলল ডাক্তার?
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে হেসে বললাম, কি আর বলবে বলো তো? বলল ঠিক মত
খাওয়া দাওয়া করতে আর রেস্ট নিতে।
—তো অফিসে আসতে গেলি কেন? বাসায় গিয়ে একটু শুয়ে থাকতি! আর খাওয়া-
দাওয়া যা করিস সেটা তো ডাক্তার জানেই না।
—ছাড়ো তো।ঐসব শুয়ে থাকা টাকা আমার হয় না।
—ফোন কি করছিস? মাহিন নাকি ফোনে পাচ্ছে না। শেষে আমাকে ফোন দিয়ে অস্থির করে তুলছে। যা ফোন ওপেন করে ওকে কল দে।
—তুমি ছাড়ো তো। ও এমনই। আচ্ছা আমি ফোন করে নেবো।
—না, তুই একখানি কর। ছেলেটার কি না কি দরকার।
—আচ্ছা করছি।
অফিসে সচরাচর ফোন ব্যবহার করা নিষেধ। উপায় না দেখে অফিসের ক্যান্টিনে
গেলাম।
মাহিনকে ফোন দিলাম।
কেটে দিল।
হয়তো ক্লাসে আছে।আমি কিছুক্ষণের জন্য বসে রইলাম। খুব খারাপ লাগছে কেন জানি! অসহায় অসহায় লাগছে। কান্না পাচ্ছে কিন্তু কাঁদতে ইচ্ছা করছে না। আমার এমন হয়। অবুঝ বয়স থেকেই দেখছি আমার চোখে জল আসে না! মায়ের কাছে শুনেছি ছোটবেলায়ও খুব একটা কাঁদিনি। খুব কষ্টে বুকটা ফেটে গেলেও কোনদিন কাঁদিনি।
মাহিনের মিসড কল এল।
আমি ফোন ব্যাক করলাম।
ওপাশ থেকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন।
—কি ব্যাপার ফোন বন্ধ রাখছো কেন? ডাক্তার কি বলল? তুমি কোথায় এখন? আমি আসবো?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আরে বাবা। আমি ঠিক আছি। তুমি টেনশন করো না।
—আমি টেনশন করব না তো কে করবে শুনি?
—কেন তুমি কি আমার বউ?
—ফাজলামো করো না প্লিজ।
—ওকে, আমি সিরিয়াস। বলো কি বলবে?
—ডাক্তার কি বলেছে?
—আরে ছাড়ো তো। ডাক্তারদের আর খেয়ে কাজ কি? শুধু উল্টোপাল্টা কথা। এসব রাখো। তুমি কি করছো?
—এইতো ক্লাস শেষ করলাম। তুমি কিন্তু কথা এড়িয়ে যাচ্ছো!
—আচ্ছা তোমার কি খাওয়া হয়েছে?
—না মেসে গিয়ে খাবো। তুমি খাবে তো না কি?
—হ্যা! আমি ক্যান্টিনে খেয়ে অফিসে ঢুকবো।
—একটা কথা ছিলো। যদি…..!
—মাহিন! তুমি কি পাগল হলে? এত দ্বিধার কি আছে! কি লাগবে বলো!
—ভার্সিটির জন্য কিছুটাকা লাগতো।
আমি না হেসে পারলাম না।
হাসতে হাসতে বললাম, এটা বলতে এতো দ্বিধা তোমার। মাহিন, তোমার দায়িত্ব যখন নিয়েছি তখন ঠিকই পালন করবো। আচ্ছা আমি তোমার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিচ্ছি। যখন লাগবে ডেবিট কার্ডদিয়ে তুলে নিও। কেমন?
—থ্যাংকস।
—পাগল কোথাকার। আপনজনকে কেউ ধন্যবাদ দেয়?
আমি ফোনটা কেটে দিলাম।
ভাবতে লাগলাম, স্যালারি পেতে এখনো বেশ কয়দিন বাকি। মাহিনের টাকা কই পাই! দেখি শিমুল ভাইকে বলে দেখবো। না হলে জমানো টাকা থেকে তুলতে হবে! স্বপ্নের ঘরবাঁধতে হয়তো কিছুদিন দেরি হবে! খুব ক্ষুধা পেয়েছে কিন্তু খেতে ইচ্ছা করছে না। তাই উঠে চলে গেলাম নিজের ডেস্কে।
না খেয়ে খেয়ে অভ্যাসটাই খারাপ হয়ে গেছে। গত তিন বছর তো রাতের বেলায় খাওয়া হয় না।
মাহিনের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে গিয়ে বেশ রাত হয়ে গেল। আজ কেমন বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। ভাবলাম মাহিনের মেসে যাবো কিন্তু আমি গেলে মাহিনের পড়া হয় না। অগত্যা উপায় না দেখে বাসায় ঢুকলাম।
এ বাসার কেউ আমার সাথে কথা বলে না। গত তিন বছরে আমি কোনদিন বাসায় এক মুঠো ভাত খেতে পারিনি। সকাল, দুপুর অফিসের ক্যান্টিনে চালিয়ে দেই। রাতে বাসায় ফিরলে দেখি ডাইনিং টেবিলের এক কোনে অবহেলায় দু’টো ভাত পড়ে আছে।
আমি খাই না।
কোনদিনই খাই না।
শেষে সকালে বেণু মাসি তার নাতির জন্য নিয়ে যায়।
মা-বাবা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
মাঝে মাঝে জিসানও ঘুমিয়ে যায়। কোনদিন হয়তো আবার তার এই অভাগা ভাইয়ের সাথে লুকিয়ে কথা বলার জন্য জেগে থাকে।
জিসানের রুমে আলো দেখে এগিয়ে গেলাম। ভাইটা বিছানায় আমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে। আমি ওকে ঠিক করে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। বা হাত দিয়ে চুলে বিলি কাটতেই ও আমার দিকে তাকিয়ে পড়ল।
আমি হালকা হাসি দিয়ে বললাম, কি রে দুষ্টু! ঘুমাসনি?
—ঘুমিয়েই তো পড়েছিলাম। তোমার আদর পেয়েই তো জেগে উঠলাম। ভাইয়া?
—বল সোনা!
—তোমার কি হয়েছে? ডাক্তার কি বলেছে?
হঠাৎ বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো।
আমি অবাক হয়ে জিসানকে প্রশ্ন করলাম, এসব কথা তোকে কে বলছে?
—স্কুল থেকে ফিরবার পথে মাহিন ভাইয়ার সাথে দেখা হল। ভাইয়াই বলল, তুমি নাকি কয়েকদিন ধরে ডাক্তারের চেম্বারে যাচ্ছো!
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আরে ওটাতো আরেকটা পাগল। কি না কি বলে! তুই দেখ আমার শরীর কেমন সুস্থ! আমি জিসানের হাতটা টেনে নিজের কোলের মধ্য নিয়ে বললাম, ভাই প্লিজ, তুই যেন আবার মা-বাবাকে বলতে যাস না আমি ডাক্তারের কাছে গেছিলাম!
—আচ্ছা বলবো না। তুমি খেয়ে নাও।
জিসানকে তুলে জড়িয়ে ধরে বললাম, পাগল! তুই আবার কবে দেখলি যে আমি বাসায় খেলাম?
ওকে বুক থেকে তুলে দেখলাম ও কাঁদছে।
—আরে পাগল কাঁদিস কেন?
আমি মৃদু হাসি দিয়ে বললাম, জিসান! আচ্ছা তুই কি কখনো দেখেছিস তোর ভাইয়া কেঁদেছে?
—তুমি কাঁদো না কেন? কাঁদলে তো হালকা হতে পারো!
—আরে পাগল! আমার কিসের কষ্ট যে আমি কাঁদতে যাবো! আমার মা-বাবা আছে, তোর মত লক্ষ্মী একটা ভাই আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা সম্পদ আমার কাছে, আমি কত সুখি বল?জিসান চোখ মুছতে মুছতে বলল, মা-বাবা যে কেমন আছে সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি।
নিষ্ঠুর কোথাকার!
—ছিঃ ওভাবে বলতে নেই ভাই। তারা আমাদের মা-বাবা, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আপনজন।
আমরা ছাড়া তাদের কে আছে?
জিসান আমার গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেটে একেবারে ফুলে ফেঁপে বলতে লাগল, তুমি এতো ভালো কেন ভাইয়া!
আমি ওর পিঠে হাত ঘষতে ঘষতে বললাম, অনেক পাকামো হয়েছে! যা এবার ঘুমা। সকালে কোচিং আছে।
ও সেভাবেই আমার গাঁয়ের সাথে লেপ্টে থেকে বলল, আরেকটু থাকি না! দিনের বেলা তো কথা বলতে পারি না ভাইয়া!
আমি হাসতে হাসতে ওর চুলে হাত বুলিয়ে বললাম, অনেক ভালোবাসিস তোর এ ভাইয়াকে?
জিসান আমার কাধেই মাথা নাড়িয়ে আরো জোরে জড়িয়ে ধরল।
ডাক্তারের কাছে গেছি শুনলে মা-বাবা হয়তো আরো বেশি ঘৃণা করবে আমায়। তিন বছর আগের সেই বৃষ্টি ভেজা ভয়াবহ রাতের চেয়েও বেশি। সে রাতে এ বাড়ির এক কোণে পড়ে থাকব বলে যে শর্তে এখনো পড়ে আছি সেটাও আর থাকবে না। তারা ভাববে তাদের বড় কুসন্তান হয়তো এবার কোন লজ্জাজনক রোগ বাধিয়ে এসেছে। তখন রাতের আঁধারে লুকিয়ে আমাকে পৃথিবীতে আনা শ্রেষ্ঠ দুটো মানুষের সুন্দর দু’টি মুখ আর দেখতে পাবো না।
জিসান ঘুমিয়ে গেছে আমাকে জড়িয়ে ধরেই।
পাগল একটা।
আমি ওকে বালিশে শুইয়ে বাতি নিভিয়ে বেরিয়ে এলাম।
দক্ষিণের ঘরে এখনো আলো জ্বলছে। হয়তো বাবা বই পড়ছে। প্রতি রাতের মত লুকিয়ে আজ তাদের দেখা হবে না। তবুও কাঁধের ব্যাগটা রেখে দুরুদুরু পায়ে এগিয়ে গেলাম। দরজা ভেজানো নেই, কোন রাতে থাকেও না। দরজায় চোখ দিতেই দেখলাম বাবা বুকের উপর বই নিয়ে ঘুমিয়ে গেছে, বাতি জ্বালানো। আমি বুকে ভীরুতা নিয়ে বাবার বুকের থেকে বইটা টেবিলে রেখে, বাতি নিভিয়ে চলে এলাম।
আসার সময় লক্ষ্য করলাম মা নড়েচড়ে উঠলো।
(২)
“আজকাল ছেলেটা কেমন দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। এতদিন তো এমন দেখি নি।”
ডাইনিং হতে মায়ের কথা কানে এলো।
—তুমি আবার কবে থেকে কুলাঙ্গারের দিকে তাকিয়ে বেড়াচ্ছো?
—আমি মা! ছেলের কষ্টে আমারও বুক ফাটে!
বাবা বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলল, মা? তিন বছর আগে যখন ছেলে অপকর্ম করে
বেড়াচ্ছিল তখন কই ছিলো তোমার মাতৃত্ব?
—সন্তান কি শুধু আমার একার? তোমার কি কোন দায়িত্ব ছিল না?
বাবা চিৎকার করে উঠল।
খাবার প্লেট ঠেলে উঠে দাড়িয়ে বলল, এ ঘরে ওর কোন কথা হবে না। সেটা আমি তিন বছর আগেই বলে দিয়েছি। দয়া করে থাকতে দিয়েছি সেটাই অনেক।
বাবা টেবিল ছেড়ে চলে গেলো।
মা কান্না চেপে চেয়ারে বসে পড়লো।
আমি দ্রুত ব্যাগ কাঁধে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলাম। যাওয়ার সময় দেখলাম খাবার টেবিলে জিসান জড়সড় হয়ে বসে আছে।
বেরোতে বেরোতে শুনতে পেলাম মা জিসানকে বলছে, ওভাবে হা করে বসে না থেকে গেলো, গিলে স্কুলে যাও, আমাকে উদ্ধার করো।
সেদিন বিকালে অফিস শেষে খুব ঘুরতে মন চাচ্ছিল। মাহিনকে ফোন দিলাম।
সে নাকি একটু ব্যস্ত কি নিয়ে!
কি আর করা! শেষে উপায় না পেয়ে টিএসসির দিকে হাঁটা ধরলাম।
আজকের বিকেলটা খুব সতেজ।
ফুরফুরে হাওয়া বইছে।
এত সুন্দর পরিবেশে হয়তো আমি সুন্দর কাউকে মিস করছি। আমার পাশে কাউকে অনুভব করছি। যেন শুকনো পাতার মর্মর শব্দ হচ্ছে তার দুটো সুন্দর পায়ের নিচে।
আমার মাহিন দেখতে অস্বাভাবিক সুন্দর আমার চোখে। ছেলেটার একমাত্র মাকে নিয়েই জীবন। দু’বছর আগে যখন দু’জন দু’জনকে ভালোবাসলাম তখন থেকে ওর দায়িত্ব নিলাম। অসচ্ছল সংসারে তার লেখাপড়ার সব খরচ আমি মাথা পেতে নিয়েছি। ও এমনটি চায়নি। তবুও আমি সেদিন জোর করে ওর মুখটা টেনে তুলে ওর ছলছল চোখে চোখ রেখে হেসে বলেছিলাম, আজ আমি তোমার দায়িত্ব নিচ্ছি! তুমি যখন লেখাপড়া শেষ করে বিরাট বড় চাকরি করবে তখন না হয় আমার দায়িত্ব নিও। আমি তখন বড় সুখে দিন কাটাবো। মাহিন খুব করে কেঁদেছিল সেদিন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। সুন্দর ছেলেটির কান্না মুখটিও ছিলো বড্ড সুন্দর, বড় বেশি মায়াময়।
রাস্তার পাশে বড় কয়েকটা গাছ সারি সারি। পুরো রাস্তা ছায়া ঘেরা করে রাখে। আমি ফুটপাতের উপর বড় রাস্তার দিকে মুখ করে বসে পড়লাম সেই ছায়ায়। এ রাস্তায় কত মানুষের চলাচল। হাজারো মানুষের অজানা কত গল্প।
সুখের।
দুঃখের।
আনন্দের।
বা বেদনার।
খুব জানতে ইচ্ছে করে সেসব অজানা গল্প।
হঠাৎ কাঁধে কচি হাতের স্পর্শপেলাম। ফিরে তাকিয়ে দেখলাম শান্ত।
আমি হেসে ওর হাতটা ধরে আমার পাশে বসিয়ে বললাম, কিরে টোকাই! কি কি টোকালি আজ?
ও মুখ ভেংচিয়ে বলল, ধ্যাত! আর ভালো লাগে না।
—কেন রে? কি হলো আবার?
—এ জীবন রাখতে ইচ্ছা করে না!
—খুব পাকা হয়েছিস! কোন টোকায়িনীর প্রেমে পড়লি নাকি?
শান্ত লজ্জা পেয়ে বলল, তুমিও না!
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কি মন খারাপ?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ঐ তুই কোনদিন দেখেছিস আমার মন খারাপ?
—তা দেখি নি। তবে আজ কেমন জানি লাগছে তোমাকে। আচ্ছা মাহিন ভাইয়া কই?
—আছে কোথাও। বকবক বন্ধ কর। চা খাবি?
—খেতে পারি যদি তুমি খাও।
—আচ্ছা! চল।
শান্ত টোঙের দোকানে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে চা খাচ্ছে। এসব পথকলি ছেলেরা অল্পতেই কত খুশি হয়। সামান্য একটা চা তে রাজ্যের খুশি যেন তার চোখে-মুখে। জল চিকচিক করছে ছোট্ট ছেলেটির অবুঝ দু’টি চোখে।
আগে মাহিন আর আমি প্রায় এদিকে আসতাম। একদিন শান্ত তার কচি দু’টি হাত বাড়িয়ে টাকা চাইলো ক্ষুধা র জন্য। সেদিন তাকে পাশে বসিয়ে তার দুঃখের গল্প শুনেছিলাম আমরা দু’জন শ্রোতা। এরপর যখনই আসতাম শান্তকে খুঁজে তিনজন মিলে আড্ডা দিতাম।
আজকাল আর বেশি আসা হয় না এদিকে।
হঠাৎ শান্ত চেচিয়ে বলল, ঐ দেখ মাহিন ভাইয়া।
দেখলাম মাহিনকে।
একটা ছেলের সাথে রিক্সায় ওদিকে কোথাও যাচ্ছে। মাথাটা ঘুরতে লাগল কেমন।
মনে হয় ক্লান্তিতে।
চোখ খুলে দেখলাম আমি হাসপাতালে। শান্ত কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে।
আমি উঠে পড়লাম।
বেশ রাত হয়ে গেছে।
হাসপাতালে ডাক্তারদের সাথে কথা বলে শান্তকে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। ওকে বস্তিতে রেখে আমার বাসায় যেতে হবে।
বাসায় আর যাওয়া হলো না। মাহিনের ফোন এল। ওর মা মারা গেছে। পা যেন আর চলছে না। তবুও গেলাম মাহিনের কাছে। গত তিন বছরের অনাদর এই মায়ের আদরে পূরণ করেছি। আজ তার মৃত্যুতে ও চোখে একফোঁটা জলের দেখা নেই। মাহিন একাধারে কেঁদে যাচ্ছে। ওকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিলাম ভোর রাত অবধি। ফজরের আযান দিলে ওকে নিয়ে নামাজ পড়ে এসে মায়ের দাফন সারলাম।
—তুমি আমাকে বলোনি কেন মা এতো অসুস্থ ছিলো?
—তুমি এতো করো আমার জন্য,তাই আর ঝামেলায় ফেলতে চাই নি।তাছাড়ারা জন্য ছিলো তাই তোমাকে দরকার……
কথাটা শেষ করলো না মাহিন।
আমি বললাম, সেদিন রিক্সায় দেখলাম যাকে? ও রাজন্য?
—হ্যাঁ! ওই তো সারা দিন দৌড়াল হাসপাতালে।
আমি হেসে বললাম, ওহ।
মাহিন বলল, ও জাস্ট বন্ধু।
প্লেটে করে খাবার এনেছিলাম মাহিনের সামনে ধরে বললাম, মাহিন কিছু খেয়ে নাও।
কাল সারা দিন-রাত কিছু খাও নি তো।
—তুমিও তো তাই।
—আমার কথা ছাড়ো। গত তিন বছরে বেশ অভ্যাস করে ফেলেছি।
—আমার খেতে ইচ্ছা করছে না।
আমি খাবারের টুকরো ওর মুখের কাছে নিয়ে বললাম, সেটা বললে হবে? মা-বাবা
কারোর চিরদিন থাকে না। খেতে তো হবে, বাঁচার জন্য।
মাহিন আমাকে জড়িয়ে ধরে আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
আমি রাগ দেখিয়ে বললাম, এবার কিন্তু আমি মারবো। সারা রাত কেঁদে কেঁদে গলাটা ভেঙ্গে ফেলেছো এখন আবার!
—আমি কাকে নিয়ে বাঁচব?
আমি খাবার প্লেট সাইডে রেখে মাহিনকে জড়িয়ে ধরে হেসে বললাম, কেন আমার উপর বিশ্বাস নেই? আমি আগলে রাখব সারাজীবন তোমাকে!
—আমাকে যদি তুমিও ছেড়ে চলে যাও মায়ের মত।
—আরে পাগল আমি কই যাবো।
মাহিন আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, কথা দাও আমাকে একা ফেলে যাবে না!
কথা?
কথা আমি কিভাবে দিবো?
মাহিনকে জোর করে ছাড়িয়ে খাইয়ে দিতে লাগলাম। ওর ফর্সা মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে। মাহিন কিছুটা খাবার নিয়ে আমার মুখের কাছে ধরল।
আমি হেসে বললাম, পাগল!
ওর হাতটা টেনে মুখের মধ্যে খাবার নিলাম। খুব ইচ্ছা করছিল ওকে আদর করতে কিন্তু সেটা করে আর কি লাভ মিছে মায়ায় জড়িয়ে। মাহিনকে খাইয়ে ওকে মেসে রেখে আমি বাসায় চলে আসলাম। মেসে থাকলে বন্ধুবান্ধবদের মাঝে মায়ের কথা কম মনে পড়বে। আমার বাসায় যে আনব তারও কোন উপায় নাই।
রুমে আসতেই বেণু মাসি জিজ্ঞাসা করল, বড় বাবা সারারাত কই ছিলেন?
—আমার এক বন্ধুর মা মারা গেছিল, সেখানে ছিলাম।
বেণু মাসি কথা না বাড়িয়ে মায়ের রুমে চলে গেল।
ঘুমে চোখ বুজে আসছিল। শিমুল ভাইকে ফোন দিয়ে বসকে সামলাতে বললাম।
কিছুক্ষণ পরে ঘুম নেমে এল দু’চোখ জুড়ে।
বহুদিন পর আজ মাহিনকে নিয়ে বেরিয়েছি। মাহিন এখন অনেকটা স্বাভাবিক। শহরে বিকেলের ভীড় থাকে অনেক। আমি নিরিবিলি একটা জায়গায় নিয়ে গেলাম মাহিনকে।
ওকে বসিয়ে ওর কোলের মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম।
মাহিনকে বললাম, কাল তোমার অ্যাকাউন্টে দুই লক্ষ টাকা দিয়ে দেবো আমি। আমি না থাকলে এটা দিয়ে অনেক দিন চালাতে পারবে। পরে তুমি নিজে কিছু করে নিও।
তোমার কিছুদিন পর ইন্টার্নি। তারপর নিশ্চয়ই একটা ভালো জব পেয়ে যাবে।
—এতো টাকা দিয়ে আমি কি করবো? আর তুমি কই যাবে?
—আরে কোথাও যাবো না, তোমাদের মাঝেই তো থাকবো। তবুও মরনের কথা তো বলা যায় না। তাই তোমাকে দিয়ে রাখছি। দায়িত্ব নিয়েছিলাম তোমার যদিও ঠিকঠাক ভাবে পালন করতে পারলাম না।তুমি মাফ করে দিও আমায়!
মাহিন আমার মুখটা তার চোখের সামনে নিয়ে বলল, কি হয়েছে তোমার? পাগলের মত বকছো কেন?
আমি একগাল হেসে বললাম, আমার কিচ্ছু হয় নি পাগল। টাকাটা থাকলে খরচ হয়ে যাবে তাই সেফ জায়গায় রাখব। আমি জানি তুমি বুঝে শুনে নিজের দরকার মত খরচ করবে।
—সারাজীবন তুমি হাসি ঠাট্টায় সব কষ্ট উড়িয়ে দিলে। কখনো বুঝতেই দিলে না কিছু।
মাহিনের কোমর জড়িয়ে ধরে বললাম, আমার আবার কষ্ট কই দেখলে তুমি?
মাহিন একটা দীর্ঘশ্বাস নিল।
মাহিনের গায়ের গন্ধ আমায় পাগল করে তোলে। তবুও কোনদিন মাহিনকে কামনায় স্পর্শ করি নি। মাহিন কোনদিন জিজ্ঞাসাও করে নি কেন আমি ওকে ছুঁই না। আমার খুব ভয় লাগে যদি সেই রাতের ভয়াবহতা ফিরে আসে।
যখন যৌবনে জোয়ার আসে তখন রাতের পর রাত বালিশ কামড়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
কাউকে জানতে দেই না আমার যৌবনের গুঞ্জন।
(৩)
কয়েকমাস আগে যখন ডাক্তার রিপোর্টদেখে আমার কাছে জিজ্ঞাসা করল, আপনার সাথে কেউ আসে নি?
তখন আমি অবাকই হলাম।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, জি না স্যার! যা বলার আমাকে বলুন।
—কেউ একজন থাকলে ভালো হতো। ডাকুন না কাউকে!
আমি হালকা হেসে বললাম, লাগবে না স্যার! আমার কেউ নাই। ভালো মন্দ যাই হোক না কেন আমাকেই বলতে হবে।
—দেখুন আপনার একটু শক্ত হতে হবে! আপনার হাতে সময় খুব কম। বড়জোর ছয়মাস।
—কেন কি হয়েছে আমার?
—ব্রেইন ক্যান্সার।
শুনে খুব হাসি পেল আমার। কি আজব খেলা সৃষ্টিকর্তার। একটা ছেলেকে তিনি এতটা অসহায় কিভাবে করে?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, মাত্র ছ’মাস। কোন ব্যাপার না। ততদিনে সব স্বপ্নপূরণ করে ফেলব আমি।
-কি ব্যাপার আপনি হাসছেন কেন? শুনন ব্রেইনের ক্ষতটা বেশ মারাত্মক, ছড়িয়ে গেছে পুরো মস্তিষ্কে। আপনি দ্রুত মেডিকেলের জন্য শিফট হয়ে যান।
ডাক্তারের পরবর্তী কথাগুলো আমার কানে গেল না।
ভাবতে লাগলাম এ কয়মাসে সব করতে পারবো তো? ডাক্তারকে নিষেধ করলাম ব্যাপারটা কাউকে না বলতে। অবশ্য বলবেই বা কাকে! আমাকে ছাড়া তো তিনি আর কাউকে চেনেনই না।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করেছিলাম। যদিও অফিস থেকে ছুটি নেওয়া ছিলো তবুও গিয়েছিলাম। হয়তো ভালো লাগবে তাই। ভালোও হয়তো বা লেগেছিল। এভাবে গল্পে-অগল্পে চলে গেল আমার পাঁচ পাঁচটা মাস।
সবসময় স্বপ্ন দেখতাম সুন্দর একটা বাড়ির। শহরের কোন নিরিবিলি জায়গায় আমার একটা সুন্দর বাংলো বাড়ি হবে। নীল রংয়ের নীল আকাশ ঘেরা বাড়ির চারদিকে থাকবে হলুদ সরিষাক্ষেত, হাজার গন্ধে বিলীন ফুলের মেলা। আমি আর আমার মনের মানুষ সেই সরিষাক্ষেতে হাত ধরাধরি করে হাঁটবো। আমার পরনে থাকবে সাদা ধবধবে পাঞ্জাবী আর তার লাল টুকটুকে পাঞ্জাবী। কোন এক কুয়াশা ঘেরা ভোরে সরিষার ফুল মাড়িয়ে আমরা ছুটবো অচেনা, অজানার কোন দেশে।
বাবা সারাজীবন সৎ পথে থেকে চাকরি করে গেছে, অবসর শেষে কিছুটাকা আর পেনশনের টাকায় ভাড়া বাড়িতে থেকে সংসার সংগ্রাম করলো। আমার বড় স্বপ্ন বাবাকে একটা তার নিজের বাড়ি উপহার দেওয়ার। আমার স্বপ্নের বাড়ির দলিল পেয়ে গেছি।
বাবার নামে দিলাম বাড়িটি,বাড়ির নামও ঠিক হয়েছে “জুনায়েত ভিলা”।
চাকরি থেকে অবসর নিলাম, বসকে বলে কিছুটাকা পাওয়ার ব্যবস্থা হলো। জিসান আর মাহিনের নামে বিশ লক্ষ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট করা হলো। এখন আমার সব দায়িত্ব শেষ।
মেডিকেল ভর্তির জন্য যেতে হবে আমায়। কিছুদিন যদি বেশি বাঁচা যায়। জানি বৃথা চেষ্টা তবুও আপন মানুষগুলোকে বড্ড সময় নিয়ে দেখতে ইচ্ছা করে।
চাকরি ছাড়ার পর বেশ কয়দিন অল্প রাতেই বাসায় ফিরছি। মা আড়চোখে দেখেছে কিন্তু কিছু বলে না। আজকাল মাহিনের কাছে ঘনঘন যাচ্ছি ভালোবাসা পাওয়ার আশায়।
কিন্তু না পারছি ভালোবাসা দিতে, না পারছি ভালোবাসা নিতে! কিছু সময় বসে থেকে যখন বলি, আমি আসি মাহিন, ভালো থেকো!
মাহিন নির্বাক চোখে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
কিছু বলে না।
আমি জানি মাহিন সেদিন রিক্সায় দেখা ছেলেটার সাথে ঘন ঘন বিছানায় যাচ্ছে। তবুও কিছু বলার নেই আমার।
বলিও না।
বুঝতেও দেয় না।
যাক না! যৌবনের ঢেঁকুর তো সবার থাকে। মাহিনকে দেখে মুগ্ধতায় চোখটা জুড়িয়েযায়, মৌবনের মধুঝরিয়ে ভয়ঙ্কর সুন্দর হয়েছে আজকাল।
সেদিন আসার সময় মাহিনের কপাল জোড়া চুলে ফুঁ দিয়ে বললাম, তুমি খুব বেশি সুন্দর হয়ে যাচ্ছো।খুব লোভ হয় আমার!
ছেলেটা চোখের জল ছেড়ে দিল। এই যা! কি এমন বললাম।
হাসতে হাসতে বললাম, কাঁদলেও কিন্তু তোমাকে মারাত্মক সুন্দর লাগে।
মাহিন আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি ছাড়িয়ে চলে এলাম। জানি ওখানে থাকলে আমার লোভ হবে। সুন্দরকে পাওয়ার লোভ। আমি চাইনি সেটা।
শিমুল ভাইকে ফোন দিলাম।
খুব দরকার ওনাকে আজ আমার। রাতে যাবো বলে রাখলাম। শিমুল ভাইয়ের বউটা খুব সুন্দর। স্বভাব অমায়িক। আমাকে বেশ ভাই ভাই করে।
জিসানের রুমে গেলাম। ভাইটা আজ ঘুমিয়ে পড়েছে। বিছানার কিনারায় বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, খুব মিস করবো তোকে। ভালো থাকিস।
মা-বাবার রুমে গেলাম। কেউ জেগে নেই। আজ বাতিটিও অফ। দু’টি সুন্দর মুখ আর দেখা হলো না। ধীর পায়ে তাদের পায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। বহুদিন আমি এ দু’টো শরীরের স্পর্শ, গায়ের গন্ধ পাইনি। মেঝেতে বসে পড়লাম খাটের কিনারা ধরে।
অনেকক্ষণ কেটে গেল।
স্পষ্ট স্বরে বললাম, আমি সমকামী ঠিক আছে বাবা কিন্তু সেদিন বৃষ্টির রাতে তুমি বাইরে যা দেখেছিলে সেটা নিছক তোমার দেখার ভুল ছিল। সবুজ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো। ভালোবেসে জড়িয়ে ধরে একটা চুমুই তো দিয়েছিল। তাতে আমাদের দু’জনের মনে কোন পাপ ছিল না, কোন অন্যায় আমি করি নি। আজ তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে আমায় তুমি শাস্তি দিয়ে যাচ্ছো। আর কাকে শাস্তি দেবে তুমি? আমি তো থাকবো না বাবা।
দু’জনের পায়ের স্পর্শনিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলাম।
বেরোনোর সময় কানে এলো মা শিউরে কেঁদে উঠলেন। কান্না আমার আসে না! কেন যেন আমি কাঁদতে শিখি নি। কষ্টে পড়লেও আমার কেমন হাসতে ইচ্ছা করে। শিমুল ভাইয়ের বাসায় এলাম। দেখলাম ভাবীও জেগে আছে। আমাকে দেখে হাসল।
মিষ্টি করে বলল, আমার দেবরটার আজকাল এত তাড়া কিসের?
আমি ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বললাম, আছে একটু তাড়া।
শিমুল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, শিমুল ভাই, এই বাড়ির দলিলটা আমার বাবাকে দিও। মাহিন আর জিসানের ফিক্সড ডিপোজিটের কাগজপত্র রইল আর আমার অ্যাকাউন্টের বাকি টাকাগুলো বাবার অ্যাকাউন্টে দিও যাতে জিসানের লেখাপড়াটা থেমে না যায়।
—সব তো বুঝলাম কিন্তু তুই যাবি কই?
—আমার একটু কাজ আছে শিমুল ভাই। ভাবী একটু পানি দেবে? মাথাটা ঘুরছে কেমন!
চোখ খুলে দেখলাম আমি হাসপাতালে। শিমুল ভাই ডাক্তারের সাথে কথা বলছে।
একজন নার্সজিজ্ঞেস করলো, আপনার কেমন লাগছে এখন? সারারাত আপনি বেহুঁশ ছিলেন!
আমি ধড়ফড়িয়ে ঠেলে উঠলাম।
নার্স বলল, উঠবেন না প্লিজ!
—আমি বাসায় যাবো। বাবা-মাকে দেখবো।
শিমুল ভাই এগিয়ে এসে বলল, থাপ্পড় মেরে আরো অসুস্থ করে দেবো। মহান সাজা
হয়েছে। কাকা-কাকি আসছে। আমি খবর দিয়েছি।
শিমুল ভাই কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই এমন করলি কেন?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমি আবার কি করলাম?
—দাঁত বের করে হাসা হচ্ছে?
শিমুল ভাই আমাকে জোরে ঝাঁকি দিয়ে বলল, এখনো হাসছিস তুই? তুই একটু কাঁদতে চেষ্টা কর ভাই!
মা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেই কান্না শুরু করল।
আমি অবাক হয়ে বললাম, মা! মা! কি হলো কাঁদছো কেন?
দেখলাম বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে জিসান ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার মানে ডাক্তারের কাছে শুনে শিমুল ভাই সব বলে দিয়েছে। ভাইকে চোখের ইশারায় কাছে ডাকলাম। জিসান না সূচক মাথা নাড়ালো।
মাকে ছাড়িয়ে হেসে বলল, মা! বহুদিন আমি ঘরের ভাত খাই না। দু’টো ভাত খাইয়ে দিবে ঘর থেকে এনে, প্লিজ! খুব ক্ষুধা লাগছে।
মা ডাক্তারের দিকে তাকালো। ডাক্তার চোখের ইশারায় সম্মতি দিলো।
মা পাগলের মত দৌড়ে বেরিয়ে গেলো।
বাবা এসে কাছে বসে বলল, আমাকে ক্ষমা করে দিস আব্বু!
—বাবা তুমি কাঁদছো কেন? আমার কান্না একদম পছন্দ না তুমি তো জানো।
জিসানকে টেনে কাছে বসালাম। আমাকে জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না।
আমি ওকে জড়িয়ে রেখেই বললাম, বাবা, আমার কিছু কথা ছিলো।
বাবা আমার হাতটা ধরে বলল, বল আব্বু!
শিমুল ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, মাহিনকেও কি জানিয়েছো?
সে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
—তুমি পারোও বটে।
বাবার হাতটা আরও শক্ত করে ধরে বললাম, তুমি রাগ করবে না তো! বলো।
—না! বল।
—মাহিনকে আমি খুব ভালোবাসি। আমি ছাড়া ওর আর কেউ নাই। তুমি কথা দাও
ওকে তুমি দেখে রাখবে আর শান্তকে ভালো একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবে। শিমুল ভাইয়ের কাছে সব আছে, তোমাকে সারা জীবন কষ্টই দিলাম তাই শেষে তোমাকে সামান্য কিছুদিয়ে গেলাম। তোমার নিজের ঘর, সংসার সব সুন্দর করে বাঁধিয়ে দিয়ে গেলাম। জিসান বড় হলে ওকে বিয়ে সুন্দর লাল টুকটুকে একটা বউ এনো তোমার ঘরে।
বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলল, তুই চুপ কর আব্বু। একটু ঘুমা।
আমি অমলিনভাবে হেসে বললাম, চিন্তা করো না একেবারে ঘুমিয়ে যাবো।
বাবা হাতটা শক্ত করে ধরে রাখল।
দেখলাম মাহিন শান্তকে নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, মরার সময়ও পর করে রাখবে?
মাহিন কান্না চেপে কাছে এসে দাঁড়াল।
—আব্বু একটু বাইরে যাবে? ওকে ক’টা কথা বলবো!
—আচ্ছা।
শান্তকে বললাম, কিরে স্কুলে যাবি তো ঠিক মতো?
ছোট ছেলেটি কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। জিসানকে বললাম, যা ভাই, একে নিয়ে বাইরে যা। আমি একটু তোর মাহিন ভাইয়ার সাথে কথা বলি।
ওরা সবাই চলে গেল।
মাহিন মাথা নিচু করে আছে। কাছে বসতেই জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো।
ধরা গলায় বলল, আমাকে মাফ করে দিও।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, রাজন্য কিন্তু খুব ভালো ছেলে। রাজন্যকে বলে গেলাম, ও আমাকে কথা দিয়েছে তোমাকে সুখে রাখার। ওকে ধরে রেখো। বাবাকে বলে গেলাম তোমাকে তার ঘরে বড় সন্তান করে রাখবে। তুমি শান্তকে একটু দেখে রেখো প্লিজ।
মাহিন একমনে কেঁদে যাচ্ছে। ছেলেটা খুব কাঁদতে পারে। আচ্ছা মানুষ কাঁদে কেন?
মা ভাত নিয়ে চলে এসেছে।
আমার কাছে এসে বলল, হা কর আব্বু।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, কি দিয়ে এনেছো?
মা জিহ্বা কেটে বলল, হাঁসের ডিম!
—মা! তুমিও না। আমি হাঁসের ডিম খাই? আমার এর্লাজি আছে তো। তিন বছরে
সব ভুলে গেছো?
মা অশ্রুজলে মন খারাপ করল।
আমি বললাম, কোন ব্যাপার না। আজ সব খাবো। মরেই তো যাচ্ছি।
মাহিন হাত ধরে বসে ছিল। হাতে চাপ অনুভব করলাম তার।
মা মুখ চেপে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, নে হা কর আব্বু!
বড় আদরের ভাত খেলাম আমি। হয়তো শেষবারের মত। আজ খুব বাঁচতে ইচ্ছা
করছে আমার কিন্তু মরণকে হারিয়ে অপরাজিত হওয়ার সাধ্য আমার নেই! কি আশায় ঘর বাঁধলাম আমি? এই পৃথিবী নামক খেলাঘরে আমার জায়গা কই?
সারা দিন রাত শেষে, ভোর রাতে শত চেষ্টা করেও শরীরকে নাড়াতে পারলাম না।
মাহিনের হাতের সাথে আমার শক্ত হাতটা জড়িয়ে আছে।
মা ঘুমাচ্ছে।
শান্ত চলে গেছে কাল দুপুরে।
জিসান আর বাবা একে-অপরকে আশ্রয় করে হাসপাতালের বাইরে ঘুম জড়সড়।
শিমুল ভাইকে শেষবারের মত কোথাও দেখতে পেলাম না।
শুভ্র সাদা বিছানায় আমার দেহ পড়ে রইল।
হাসপাতালের করিডোর পেরিয়ে আমার আত্মা মুক্তির সন্ধান করতে লাগল। তখনও আমার লাশটায় আমার হাসি মুখ শোভা পাচ্ছে।
“ছেলেটি শুধু হাসল, একটিবারও কাঁদল না,
ছেলেটির নাম? আমি তোমাদের বলব না!”
প্রথম প্রকাশ: সমারূঢ়
(মন্দ্র প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রথম কুইয়ার ছোটগল্প সংকলন)