
ইনজেব
আস্তে আস্তে মোহ কাটতেই সময়ের গুরুত্ব বাড়লো। অফিস, কাজ সব একসাথে লাইনে দাঁড়িয়ে সুখের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে।
সুনজুক চাঙমা। আমার খুব কাছের বন্ধু। এতক্ষণ যার কথা বলছিলাম।
অফিসে পৌঁছে চেয়ারে বসতেই ঘড়ির দিকে দেখে প্রায় দশটা বাজে। সবাই যারবযার মতো কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিদিনের মতো যেই কাজ শুরু করবে ঠিক এমন সময় খেয়াল করলো সবাই কেমন যেন অদ্ভুতভাবে তাকাচ্ছে তার দিকে। সে বুঝেও না বুঝার ভান করে কাজে মন দিলো।
সে বুঝতে পারে কলিগরা তাকে নিয়ে তার অবর্তমানে নানা কথা বলে। তার চুপচাপ স্বভাব, কথা বলার ধরণ, গলার হালকা মেয়েলি স্বর, আর তার নিখুঁত কাজ তাদেরকে হাসায় হয়তো।
মাঝেমাঝে ভাবে চাকরিটা ছেড়ে দেবে। প্রতিনিয়ত যে কথাটির সম্মুখীন হতে হয় সেটা শুনতে আর ভালো লাগে না তার। বিরক্ত হয়ে গেছে “কবে বিয়ে করছো?” এই প্রশ্নটার সম্মুখীন হতে হতে। গুটিকয়েক মানুষ আছে যাদেরকে উত্তর না দিয়ে পারা যায়না। সুনজুক তাদের উত্তর দেয়— আমার এখনও বিয়ের বয়স হয়নি রে। এখনও কত জায়গা, দেশ ঘুরা বাকি! আমি পায়ে শেকল পরে কোথাও যেতে চাই না।
ইচ্ছেগুলো পূরণ হোক। তারপর ভেবে দেখব। আর হ্যাঁ, বিয়ে করাটাকে জন্ম-মৃত্যুর মতো আমি চিরায়ত মনে করি না। এটা ঐচ্ছিক। যার ইচ্ছে হবে সে করবে। যার ইচ্ছে হবে না সে করবে না। বেশ। বাসায় বিয়ের ব্যাপারে এখনও কিছু বলেনা অবশ্য। তবে পাড়া-প্রতিবেশী, অফিস কলিগ, বন্ধু-বান্ধব প্রায় সবার মুখে ওই একটা প্রশ্ন। তাই এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া থেকে বাঁচতে সে যথাসম্ভব পরিচিতদের এড়িয়ে চলে।
একটা দিন যাওয়া মানে ঐ প্রশ্নের দিকে একধাপ ধাবিত হওয়া। কারণ বয়স যে বেড়ে যাচ্ছে সে হিসাব সুনজুক না রাখলেও চারপাশের লোকজন হিসাব রাখে। আর প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিতে ভোলে না। এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছে তার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।
মাতৃগর্ভেজন্মলগ্ন থেকেই লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হয় সুনজুক। পৃথিবীতে আসার আগেই ওর বাবা নাকি ঠিক করে রেখেছিলো সে মেয়ে হয়ে জন্মালে মাটিতে পুঁতে ফেলবে। জন্ম হলো পুরুষাঙ্গ নিয়ে। ভাগ্যের কি পরিহাস দেখো, সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েও রেহাই পেলো না সুনজুক। ছেলে হয়ে ছেলেকে ভালোবাসে। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার!
কল্পকাহিনীতেও যা শোনা হয়নি কখনও। ছোটবেলা কেটেছে একাকিত্বে। মেয়ে বন্ধুরাই ছিলো তার একমাত্র খেলার সাথী।
সমবয়সী ছেলেদের সাথে মিশতে পারতো না তাদের দুর্বৃত্ত স্বভাবের কারনে। সুনজুক বেশ শান্ত, চুপচাপ এবং শান্তিপ্রিয় ছেলে। তাই সমবয়সী ছেলেদের অত্যাচারসমান সঙ্গ থেকে নিজেকে দূরে রাখতো সে। তাছাড়া মেয়ে বন্ধুদে র সঙ্গ বেশ ভালোই লাগতো তার।
এজন্য তাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে পরিবার থেকে শুরু করে পাড়ার লোকের কাছ থেকে। একবার হয়েছে কী, তখন ক্লাস সিক্স কি সেভেনে পড়তো। বন্ধুদে র সাথে নদীতে গোসল করতে গিয়ে ওকে ন্যাংটা করেছিল সবার সামনে। দুই রানের মাঝখানে কি আছে সেটা দেখার জন্য। কাঁদতে কাঁদতে সেদিনের মতো বাড়িতে চলে গিয়েছিল সুনজুক।
কিন্তু সেই দিনটার কথা মনে করে এখনও কান্না করে আমার সামনে। কতটা দুঃখ পেলে এত বছর পরও সেই ঘটনার কথা মনে করে কান্না করে বলো তো?
অনেকে লিঙ্গান্তর করে নাম ডাকতো ‘সুজি’ বলে। কেউ ভালোবেসে ডাকতো কেউ আবার টিজ করে। খারাপ লাগতো তার। যদিও মাঝেমাঝে জবাব দিয়ে এবং খুব বেশি পাত্তা না দিয়েই ফেলে এসেছে সে সময়গুলো। অভ্যাসবসত এখনও অনেকে ডাকে। এখন অবশ্য তেমন গায়ে লাগায় না এসব।
প্রাইমারি শেষ করে ভর্তি হয়েছিল তার বড় ভাই যে স্কুলে পড়তেন সে স্কুলে । প্রায় চার কিলোমিটার দূরত্ব বাড়ি থেকে স্কুলে র। গাড়িতে যাওয়ার সুযোগ ছিলো কিন্তু একদম নতুন হওয়ায় একা যেতে পারতো না গাড়িতে। তাই ভাইয়ের সাথে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতো রোজ। বেশিরভাগ সময়ই হেঁটে স্কুলে গিয়েছিলো অনেকটা ভাইয়ের কাছে অস্বস্তির কারণ হয়েছে বলে..এভাবে বড় হতে হতে নিজেকে আবিস্কার করতে লাগলো সে। কিন্তু বুঝে উঠতে পারে না কেন এমন হয়। কেউ ছেলে হয়ে ছেলের প্রতি আকৃষ্ট হয়? এমনটা তো কখনো শুনিনি? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে সে। পাছে কেউ ব্যাপারটা বুঝতে পারে এজন্য ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখতো সে। এটা তার কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত এবং অস্বাভাবিক এক অনুভূতি ছিলো তখন।
সুনজুক এখন মোটামুটি নিজের সম্পর্কেজানে। নিজের মতো অনেক মানুষের সাথে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব তার।
সুনজুকের সাথে আমার বন্ধুত্ব সেই কলেজ থেকে। আমিই হলাম তার প্রথম বন্ধু যাকে তার এতবছর ধরে লুকিয়ে রাখা আলাদা সত্তার ব্যাপারে বলেছে। আমি মোটামুটি মুক্তমনা হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছি ব্যাপারটা। আমাদের আরেক কলেজ সহপাঠীকেও নাকি বলেছে বললো। সেও আমার মতো নাকি বেশ সমর্থন করে। কিন্তু ওর এক স্কুল সহপাঠী নাকি এটা জানার পর খুব বাজে আচরণ করেছিল।
এরপর ওর সাথে সম্পর্কচুকিয়ে দিয়েছে সে। আমি বললাম বেশ, এরপর বুঝে শুনে তবে ব্যাপারটা বলতে যেও।
তাকে জানার জন্য বেশ কিছুপ্রশ্ন জিজ্ঞেস করি যা যা মাথায় আসে। অনেক নতুন জিনিস জেনেছি, বুঝেছি। ইন্টারনেট থেকে পড়েও বেশ কিছু জেনেছি হোমোসেক্সুয়ালিটি ব্যাপারে। যদিও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আমাদের দেশে এটাকে চরম অপরাধ হিসেবে দেখে।
সুনজুকের পরিবারের সাথে আমার বেশ ভালো সম্পর্ক। আমাকে সুনজুকের মতই
পরিবারের একজন হিসেবে স্নেহ করে। সেই সূত্রে আমাকে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেসও করেছিল সুনজুক কারো সাথে সম্পর্ক করে কিনা। আমি বরাবরের মতই না বলে যাই। তারপর বলি, সে হয়তো বিয়ে করবে না। বিয়ে, সংসার ওর ভালো লাগে না। চুপ করে থাকে ওরা।
অথচ সুনজুক একটা বাঙালি ছেলের সাথে সম্পর্কে আছে জানি। ছেলেটা খুব ভাল। আমার সাথেও কথা হয়েছে ফোনে। তবে সামনাসামনি দেখা হয়নি আমার সাথে।
সুনজুকের পরিবার বছর দুই পর হয়তো চাইবে সুনজুক বিয়ে করুক। সুনজুক করতে না চাইলে আমি নিশ্চিত আমাকে দিয়ে জিজ্ঞেস করাবে। আমি ঠিক কী বলবো বুঝে উঠতে পারিনা এখনও। তবে আমার মনে হয় বাঙালিদের তুলনায় পাহাড়ীরা অনেকটা উদার এবং স্নেহময়ী। বিয়ের ব্যাপারে পরিবার থেকে বাঙালিরা যেভাবে চাপ দেয় সে তুলনায় আমাদের সম্প্রদায়ে কম বললেই চলে। এমনকি কারো ঘরে ইন্টারসেক্স এর কেউ জন্মালেও আজ পর্যন্ত কখনও দেখা বা শোনা যায়নি যে তাকে ঘর বা সমাজ থেকে বের করে দিয়েছে। কিংবা তাকে নিয়ে সমাজে লজ্জা বহন করতে হচ্ছে বা তার জন্য অন্য ভাই-বোনের বিয়ে দিতে সমস্যা হচ্ছে এমন। অন্যসব স্বাভাবিক ছেলেমেয়ের মতই বড় হতে দেখেছি আমি। তাই সুনজুক এবং আমিও মনে করি তার সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন কখনও তার পরিবার কিংবা সমাজ জানলেও ত্যাগ করবে না। তাই সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে বিয়ে করবে না। তবে বিয়ে না করলে একটু কথা শুনতে হবে এই আরকি। আমাদের দেশে বিয়ের বয়স হয়ে বিয়ে না করলে কথা শুনতে হয় এটা স্বাভাবিক।
ইদানিং সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে হোমোসেক্সুয়ালিটি ব্যাপারে অনেকেই জানে।
পাহাড়ী আদিবাসী সম্প্রদায়ের খুব কম সংখ্যাক লোক এই বিষয়গুলো নিয়ে জানে, বুঝে এবং গ্রহণ করে। অনেকেই জানেনা বিষয়টা আসলে কী। তাই গ্রহণ করা না করার কথা আসেই না। যদি ব্যাপারটা শুনেও থাকে তবে তাদের কাছে অস্বাভাবিক লাগলেও কারোর দ্বারা অত্যাচার হবে বলে মনে হয় না যেমনটা বাঙালি সমাজ বিশেষ করে মুসলিম পরিবারে এরকম হতে শুনেছি। কারন আমাদের সমাজ কিংবা ধর্মীয় ব্যবস্থায় এই ব্যাপারে বিধি-নিষেধের কোনো উল্লেখও নেই।
সুনজুকের জন্য কষ্ট হয়। এটা ভেবে যে, এতটা বছর একা একা এতকিছু সামলে
আসলো কিভাবে। আমাদের মতো অন্যসব সমস্যা তো আছেই সাথে আলাদা সত্তার চাহিদা, যন্ত্রণা যা কাউকে দেখানোর বা বোঝানোর মতো না।
তার সামনের পথে কী অপেক্ষা করছে সেটাও অনিশ্চিত। দিন যত যায় বয়স বেড়ে চলেছে। অথচ হাজার বছরের পুরনো সেই রীতি এখনও সেই আগের জায়গায় পড়ে আছে। জন্মালে কবে বড় হবে? বড় হলে কবে পড়াশোনা শেষ হবে? পড়াশোনা শেষ হলে কবে চাকরি পাবে/করবে? চাকরি পেলে কবে বিয়ে করবে? বিয়ে করলে কবে বাচ্চা হবে?— ইত্যাদি চলমান সেই চিরন্তন রীতি যার যাতাকলে পিষ্ঠ হয়ে আজ পর্যন্ত কত ছেলে-মেয়ে নিজেকে শেষ করে দিয়েছে তার সঠিক কোনো হিসেব নেই। সুনজুকের শেষ পরিণতিও কী এমন হবে? ভাবতেই আমার শরীর হিম হয়ে জমে যায়। তবে সুনজুক যথেষ্ট ধৈর্যশীল আমি জানি। কতটা ভেঙ্গে পড়লে কেউ এমনটা করতে পারে আমার জানা নেই। আমি শুধুজানি আমার বন্ধু সুনজুকের আমাকে বড্ড প্রয়োজন।
প্রথম প্রকাশ: সমারূঢ়
(মন্দ্র প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রথম কুইয়ার ছোটগল্প সংকলন)