
শুভ্র ভাই
-ভাইয়া কিছু লাগবে?
ঢাকা শহরে মামা ডাকের প্রচলন বেশী। হঠাৎ ভাইয়া ডাক তাও খুলনা অঞ্চলের টানে, আমি ফিরে তাকালাম। আট দশ বছরের একটা ছেলে। পরণে ফুল পাতা আঁকা শার্ট, রংচটা থ্রি কোয়াটার প্যান্ট ময়লাটে হয়ে আছে। ঘড়িতে আটটা, সাড়ে আটটা বেজে গেছে। বহুদিন ঘড়িই ব্যবহার করা হয় না মোবাইল আসার পর থেকে। প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পরে রমনা পার্কে হাঁটতে আসা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমি অবশ্য ব্যায়াম করা টাইপ পাবলিক নই, নই ফিগার সচেতন। সেরকম বডিও নেই।
একেকজনের একেকটা শখ থাকে। কেউ লিখতে ভালো বাসে, কেউ পড়তে, কেউ খেতে আর কেউবা ঘুরতে। আমার ভালো লাগে মানুষ দেখতে। বড় অদ্ভুত কিছিমের শখ। আর রমনা পার্কবিচিত্র ধরণের মানুষের মিলন মেলা। জগিং করতে আসে কেউ, ফেরীওয়ালা,চাওয়ালা, হাঁটতে আসে, বসতে আসে মানুষ, অলস শুয়ে থাকা মানুষ, রাতের বেলা দেহপসারিনীদের চাহনি, গার্ডদের ভাবলেশহীন হেটে যাওয়া সব কিছুর মাঝেই আমি আনন্দ খুঁজে পাই।
বাচ্চা ছেলেরা এসে খুব উৎপাত করে। মামা ড্রিংক্স লাগবো, মামা সিগ্রেট লাগবো, মামা চা-কফি খান। একদম কানের পোকা বের করে ফেলে। তাই সন্ধ্যা পার হলেই আসি। তখন এদের উৎপাত কমে যায়। আজকে এমনিতেই লোকের সমাগম অন্যদিনের তুলনায় কম মনে হচ্ছে। আমি ছেলেটার দিকে ফিরে বললাম, কি আছে তোর কাছে?
ছেলেটার মুখে হতাশ ভাব ফুঁটে উঠলো। ‘আপনি বুঝতে পারেননি’?
—কি বুঝবো?
—যাউকগা। যাই অন্য কোথাও দেখি।
—আরে শোন শোন
—ফাউ প্যাঁচালে কাম নাই ভাই। আমার এই করেই দিন চলে। ধান্দা করতে হয়।
—খুলে বল। পার্কে এসেছি। বুঝতেই পারছিস। অতটা সাধু সন্ন্যাসী টাইপ নই।
—আমি চুষি। চুষাবেন? পঞ্চাশ টাকা আউট করা পর্যন্ত। আর লাগাইতে চান। তাহলে একশো টাকা।
—বস। এখানে। পঞ্চাশ টাকা দেবো। আমার সাথে বসে গল্প কর কিছুক্ষণ।
—আমার টাইম নষ্ট কইরেন না। প্যাঁচাল পাড়া শেষ কইরা বলবেন যে কিয়ের টাকা।
মানুষ খুবই খারাপ। কতদিন হইছে করার পরে টাকা দেয় নাই। চেঁচামেচি করলে থাপ্পড় লাগাইছে। কাউরে কিছু কইতে পারি নাই। কইলে তো উলটা তারা আমারেই দুষবো। যে চোষায় তার দোষ নাই। যে চোষে সব দোষ তারই যেন।
—আচ্ছা আমি তোকে পঞ্চাশ টাকা দিলাম। কিন্তু পাঁচ মিনিট পরে যে তুই উঠে যাবিনা তার গ্যারান্টি কি?
—জীবনের গ্যারান্টি নাই। আপনেরে ক্যামনে গ্যারান্টি দিমু। আইজকা কাস্টমার পাইতাছি না। আজকে মনে হয় কারো রস বেরোনির লাইগা উথাল পাথাল করতাছে না।
বসলাম না হয় আধাঘন্টা।
পকেটে অনেকগুলো পঞ্চাশটাকার নোট। বললাম, চকচকে নোট নিবি নাকি?
—দ্যান যা দিবেন। চকচকে লইয়া করুম ডা কি? সাজাইয়া রাখুম? তাইলে খামুকি?
—কেন তোর কেউ নেই?
—আছে। সব আছে। মা আছে, বড় ভাই আছে, ভাবী আছে। কিন্তু তারা কেউই আমার নেই।
—কোথায় তারা?
—সে এক লম্বা ইতিহাস।
—সেটাই শুনতে চাচ্ছি।
—আরো পঞ্চাশ টাকা দিতে হবে।
—নিজের গল্প বিক্রি করবি?
—সব বড় বড় ল্যাখকেরাই তাই করে। বিনি পয়সায় লেখেডা ক্যাডা? ঐযে ঐপারে বইমেলা হয়। ঐখানে যাগো লেখা গল্প বিক্রি হয় তারা তো নিজেদেরই গল্প বিক্রি করে পয়সার জন্যি। আমি করলে কি দোষ!
—তাহলে বল। কিভাবে এলি এই পথে? তোর বাড়ি মনে হচ্ছে খুলনা?
—ক্যামনে বোঝলেন স্যার? খুলনা না। সাতক্ষীরা।
—ওহ সাতক্ষীরা। কাছাকাছি। তাই ভাষাটাও একই রকম। আমার বাড়ি খুলনা।
—খুলনা। খুলনার কনে?
—খুলনার কোথায় চিনিস? আর আমার বাড়ি দিয়ে কি হবে! তোর গল্প শোনার জন্য
কিন্তু পয়সা দিচ্ছি। আর আমাকে স্যার বলতে হবে না।
—আমার গল্প খুব অল্প ভাই। যখন আব্বা বাইচে ছিলো তখন আমাদের অনেক সুখের দিন ছিলো। আব্বা রিস্কা চালাতো সাতক্ষীরে টাউনে। সন্ধ্যাবেলা ফিরবার সময় বড় বড় মাছ কিনে আনতো। আমার জন্য মিষ্টি কিনে আনতো। আমি তহন প্রাইমারী স্কুলে যেতাম। সব ভালো চলতেছিলো। একদিন মা কানতে কানতে কইলো আব্বারে ট্রাকে চাপা দিছে। হাসপাতালে ভর্তি করছে। আমরা হাসপাতালে ছুইটা গেলাম। বারান্দায় আব্বারে ফালায়া রাখছে। এক তাল মাংস য্যান। রক্ত আর রক্ত। তহনো নড়তাছে।
বৈকেল বেলা আব্বা মইরা গেলো। রাত্রেই গোর দিয়ে দিলো। এরপর আমাগে খুব কষ্ট হচ্ছিলো চলতে। বড় ভাইয়ের বয়স তহন চৌদ্দ কি পনেরো। এক গেরাজে কাম করতো।
টাহা পয়সা সব নেশা কইরা উড়াইতো। খাওয়ার কষ্ট সহ্য করতে না পাইরা মা আবার নিকা করলো সদরুল ডেরাইবাররে। আমারে সাথে নিয়া গেছিলো। প্রথম কদিন কিছু কয় নাই। একদিন মারে কইলো, তুমারে বে করছি। ভালো কথা। কিন্তু আমি ঐ আইজ্জার আওলাদরে পালতে পারুম না। ওরে বিদায় করো।
মা আমারে বিদায় করে নাই। সদরুল হারামি আছিলো। আমারে মারতো। মারে মারতো। আমি ভাইয়ের কাছে চইলা গেলাম। ভাই দেখি নিকা করছে। ভাবী দেখতে খুবই সুন্দর। সারাক্ষণ সিনেমার নাইকাগো লাহান সাইজাগুইজা থাকে। কিন্তু ব্যাবহার শিরাম খারাপ। আমারে খাইতে দিতো না। ভাই দেইখাও দেখতো না। আইজ থেকে তিন বছর আগের কথা। অনেক ছোটো ছিলাম। কেউ কাজে নিতো না। এক চার দোকানের ছিলাম। সে মাইনে দিতো না। শুধু খাইতে দিতো। একজন কইলো খুলনা শহরে গেলি মাইনে দেবেনে। সাহস করে চলে গেলাম খুলনা শহরে। কিন্তু কাজ পাইলাম না।
সারাদিন ঘুরলাম। কেউ নিতে চায় না। সবাই দুরদুর করে খেদায় দেয়। রাইত অনেক হইছিলো। ট্রাক স্ট্যান্ডের পাশে শুইয়া ঘুমাই গেছিলাম। হঠাৎ মনে হইলো কারা য্যান মুখ চাইপা ধইরা আমারে কই নিয়া যাইতাছে। এক খালি ট্রাকের উপর নিয়া আমারে প্রথম লাগাইছিলো ওরা। চারজন ছিলো। অনেক ব্যথা পাইছিলাম। অজ্ঞান হইয়া গেছিলাম।
রক্তও বাইর হইছিলো। রাস্তায় ফালায় রাইখা চইলা গেলো। ব্যথায় আমি নড়তে পারিনা। কারা য্যান আমারে খুলনা মেডিক্যালে ভর্তি কইরা দিছিলো। এরপর আমি শিখা যাই ডেরাইবার রা টাকা দিয়া এই কাম করে। প্রথম প্রথম কষ্ট হইতো। এরপর অভ্যেস হইয়া গেলো। একবারে একশো টাকা। অনেকে আছে পরপর তিনবার লাগায়। দুইশো টাকা দেয়। সব ব্যবসাতেই কমিশন দিতে হয় ভাই।
—তা ঢাকা এলি কিভাবে?
—ঢাকা ক্যান ভাই! আমি পুরা বাংলাদেশ ঘুরছি।
—কিভাবে?
—ঐ যে ট্রাক ডেরাইবাররা আছে না। সব ডেরাইবার ইরহম না। কিন্তু আমি দেখলে বুঝতে পারি কারা কেমুন। তাগো কই আমারে ঢাহা নামাই দিয়ো। নামায় দিয়া যায়।
তয় ফ্রিতে তাগো শখ আহ্লাদ পুরন করতে হয়। এই কবছরে আমি বরিশাল গেছি,রংপুর গেছি, রাজশাহী গেছি, চট্টগ্রাম গেছি, ককশোবাজার গেছি, বান্দরবান গেছি। যাইনি কোথায়। আমার আর কিছুদেখতে বাকি নেই ভাই। পাহাড়ের উপর দাঁড়ায়ে সুয্য উঠতি দ্যাখলাম। আসলেই দেখতি সুন্দর। আল্লা এত সুন্দর কইরে বানাইছে আমাদের দ্যাশটারে। না দেখলি বুঝবা না। সব দেখছি আমি। কিন্তু ঢাকা শহরের বড় বড় হোটেলগুলোর মদ্যি দেখতি পালাম না। আমারে ঢুকতেই দেয় না।
—চল।
—কনে?
—আমি তোমাকে একটা বড় হোটেলের ভিতর দেখাবো।
—আমারে ঢুকতে দেবে না।
—এই পোষাকে দেবে না। আগে চল তোর জন্য এক সেট কাপড় কেনা যাক।
মার্কেটের সব দোকান হয়তো এখনো বন্ধ হয়নি। জলদি চল।
ছেলেটার চোখে অবিশ্বাসের চাহনি। আমাকে হয়তো পাগল ভাবছে। সুযোগ না নিয়ে তার জন্য এটা কেউ করতে পারে। সে শুধুজানে এই পৃথিবীতে কিছুপেতে হলে তাকে দিতে হবে। তার যেটুকু দেওয়ার আছে সেটুকুই দিচ্ছে। কিন্তু অন্য আর দশজনের থেকে সে আলাদা। অন্যেরা তো এভাবে টাকা আয় করে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। শিশু দেহব্যবসায়ী আমি আরো দেখেছি। অল্প বয়সেই সব হেরোইন ফেনসিডিলে আসক্ত হয়ে যায়। আর এ আসক্ত হয়েছে বেড়ানোয়। নিজে থেকেই কখন একজন ইবনে বতুতা হয়ে গেছে সে নিজেও টের পায় নি। ইবনে বতুতার কথা ওকে বলে লাভ নেই। ও বুঝবে না।
যদি লিখতে পারতো তবে ওর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বর্ণনা করতে পারতো জীবনকে, বলতে পারতো কেমন দেখেছে সে তার বাংলাদেশকে।
প্রথম প্রকাশ: সমারূঢ়
(মন্দ্র প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রথম কুইয়ার ছোটগল্প সংকলন)