এপিঠ ওপিঠ

অরণ্য রাত্রি

কমলাপুর রেলস্টেশনটা আজ একদম নির্জন। বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। আমি চিটাগাং যাব। আমার ৪০ বছরের জীবনে এই প্রথম স্টেশন এত নির্জন দেখছি। মানুষের কোলাহল তেমন একটা শোনা যাচ্ছে না। আমার কামরায় যেয়ে দেখি একজন ভদ্রমহিলা বসে বই পড়ছেন। বয়স আমার চেয়ে কম হবে।

“শুভ সকাল”— আমি মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বললাম। মহিলা তার ভারী কাঁচের চশমার ভিতর দিয়ে আমাকে দেখলেন। হেসে জবাব দিলেন।

আমি হাসলাম। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, আমি অঞ্জন । অস্ট্রেলিয়ায় থাকি। বহুদিন পর বাংলাদেশে এলাম।

মহিলা বললেন, আমি লিমা। লেখালিখি করি।

—বাহ ভালো। আজকের ভ্রমণ ভালো কাটবে। আজ আপনার লেখা গল্পগুলো সম্পর্কে শুনতে পারবো। ভ্রমণের সঙ্গী ভালো না হলে ভ্রমণের মজাই শেষ হয়ে যায়।

লিমা হাসলেন।

ট্রেন চলা শুরু করলো। আমি আর লিমা শুধু কামরায়।

লিমা বই পড়ছেন। আমার খুব বোর লাগতে শুরু করলো। আমি মোটামুটি জোর করেই কথা বলা শুরু করলাম, আপনি তো লেখালিখি করেন। আপনার কোন উপন্যাস বা বই আছে সাথে? পড়ে দেখতাম।

—হ্যাঁ আছে। আমার প্রিয় ৩টি গল্প নিয়ে একটি বই আছে।

বইটা আমার হাতে দিলেন। বইটির মলাটে ঔপন্যাসিক হিসেবে নাম রয়েছে নুসরাত জাহান।

—আরে আপনি সেই নুসরাত জাহান। কত নাম শুনেছি আপনার। আপনার লেখা টিভির নাটকগুলো খুব সুন্দর।

লিমা হেসে বললেন, ধন্যবাদ। কিন্তু আর প্রশংসা করবেন না। বেশি করলে আমি খুব বিব্রত হই।

বই এ তিনটি গল্প। এর মাঝে শেষ গল্পটির নাম দেখে চোখ সরাতে পারলাম না।

গল্পের নাম সমপ্রেম। আমি সমকামী। তাই এই গল্পটি সবার আগে পড়বো বলে ঠিক করলাম। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। ট্রেনের ঝিঁক ঝিঁক শব্দ। আমি বই পড়া শুরু করলাম—

সমপ্রেমী

নুসরাত জাহান

আঁধার নেমে আসছে। পশ্চিম আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। আমি নীলা। ভার্সিটির পুকুরঘাটে বসে আছি। অনেক দিন পর আজ শাড়ি পরেছি। কপালে লাল টিপ। হাতে কাচের চুড়ি। পায়ে রূপার নুপুর। বহুদিন পর সেজেছি। আমাকে অনেক সুন্দর লাগছে আমি জানি। আমার সৌন্দর্যনিয়ে কত অহংকার ছিল। আজ বহুদিন পর পুকুরে নিজের অবয়ব দেখলাম। কই ঠিক একদম আগের মত রয়েছি। হাতে আমার সেই কালো ডায়েরিটি।

কত বছর পর পেলাম এই ডায়েরটি। হারিয়ে ফেলেছিলাম। লেখা রয়েছে আমার জীবনের সেই কালো অধ্যায়ের কথা। অর্ণবের কথা।

আমার এই ডায়েরিটি ২০০৬ সালের। আমি তখন ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। সেদিন থেকেই আমার ডায়েরি লেখা। আমি আমার মনের সব কথা এই ডায়েরিতে লিখতাম।

জানুয়ারি ১০

আজ আমি খুব খুশি। এমন একটা দিনের জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম। আজ আমাকে অসম্ভব সুন্দর লেগেছে। আমি সেজেগুজে যখন আয়নার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

আমি নিজেই চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। আজ ভার্সিটির ওরিয়েন্টেশন ক্লাসে যখন আমি নতুন ছাত্রদের মাঝে বক্তৃতা দিলাম তখন ক্লাসের সব ছেলেই আমাকে মুগ্ধ হয়ে দেখছিল।

জানুয়ারি ১৬

আজ আমাদের নবীনবরণ হয়েছে। আমি সেই প্রোগ্রামে নেচেছি। আমার নাচের সময় সবচেয়ে বেশি হাততালি পড়েছিল। আর ছেলেরা চিৎকার করছিল, শিস দিচ্ছিল। খুব মজা হয়েছে।

জানুয়ারি ২০

আজকাল ক্লাসের সব ছেলেরা আমার পিছন পিছন ঘুরে আর আমার বন্ধু হতে চায়।

আমার বন্ধু হওয়ার জন্য তারা কি না করে। ক্লাসে প্রক্সি দেয়া থেকে শুরু করে ক্যান্টিনে কফি আনা পর্যন্ত। আমার মাঝে মাঝে তা দেখে খুব হাসি পায়।

জানুয়ারি ২২

এখন ক্লাসের ছেলে রা আমাকে মুডি বলে। আমি কি করবো? আমি যার তার সাথে

মিশতে পারবো না।

জানুয়ারি ২৫

আজ একটা নতুন ছেলে এসেছে। ছেলেটার নাম অর্ণব। অনেক হ্যান্ডসাম কিন্তু ছেলেটাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল খুব আঁতেল। কোন মেয়ের দিকে তাকিয়ে পর্যন্ত দেখে না। কিন্তু আমি জানি আমাকে দেখলে যে সে সব কিছু ভুলে যাবে। আমার ভুবন ভুলানো হাসি থেকে সে নিজেকে রক্ষা করবে কি করে।

জানুয়ারি ৩০

আজকাল অর্ণব কে নিয়ে অনেক আলোচনা হয় মেয়েদের মাঝে। সবাই তাকে নিয়ে মুগ্ধ। কিন্তু ছেলেটি যেন কেমন। কোন মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব দূরের কথা ভালো মত তাকায় না পর্যন্ত। আমি শুধু হাসি তাদের আলোচনা শুনে। মনে মনে বলি একবার শুধু অর্ণব আমাকে ভাল করে দেখতো তাহলে তার মেয়েদের প্রতি উদাসীনতা কোথায় যেতো!

ফেব্রুয়ারি ৫

আজ খুব কষ্ট পেয়েছি। আমার একটা স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। আমি ভেবেছিলাম ভার্সিটিতে বিউটি কনটেস্টে আমি চ্যাম্পিয়ন হবো। কিন্তু আমি রানার্সআপ হয়েছি। চ্যাম্পিয়ন হয়েছে শিলা। কিন্তু আমি ভার্সিটির সবার থেকে সুন্দরী আর স্মার্ট। এটাই সত্য। ধ্রুব সত্য।

ফেব্রুয়ারি ৬

আজ শিলার সামনে আমি এতটা অপমানিত হয়েছি যে মনে হচ্ছিল ধরণী দ্বিধা হোক।

শিলা হাসতে হাসতে আমাকে বলেছে যে আমি নাকি ফাঁকা কলসি বাজে বেশি। তাই আমার এত রূপের অহংকার। শেষ পর্যন্ত শিলা আমাকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে যে আমার ছেলেদের গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন অর্ণবকে যদি প্রেমের জালে ফেলতে পারি তাহলেই সবাই মেনে নিবে যে আমি ভার্সিটির সেরা সুন্দরী।

ফেব্রুয়ারি ৭

আজ ক্লাস থেকে ফেরার পথে অর্ণবের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আগে তাকে ভালো মত অবসারভ করতে হবে। তারপর কৌশল। ছেলেটা দেখতে আসলেই অনেক সুন্দর।

কিন্তু আমি তার থেকে অনেক ভালো কাউকে পাওয়ার যোগ্যতা রাখি। তার সাথে তো শুধু অভিনয় আর প্রেমে একবার ফেলতে পারলে বাই বাই বলে চলে আসবো।

ফেব্রুয়ারি ৮

আজ খুব বোকামি করেছি। রাগে নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছা করছিলো। আর তার থেকে বেশি চড় মারতে ইচ্ছা করছিলো অর্ণবকে। আমি ভেবেছিলাম অর্ণব বোকা ছেলে।

পড়াশোনার বাইরে কিছুই বুঝে না। কিন্তু আমার ভুল ধারনা। আমি ভেবেছিলেম পুরনো দিনের সিনেমা গুলোর মত তার সাথে ধাক্কা খাবো। আমি পড়ে যাবো মেঝেতে আর সে আমাকে টেনে তুলবে। তখন আমার চোখে তার চোখ পড়বে। কিন্তু কী হল আমাকে ধমক দিয়ে বলল আমার কি চোখ নেই? আমি কি দেখে চলতে পারি না?

ফেব্রুয়ারি ১০

আমি একটা নতুন কৌশল নিয়েছি। এখন প্রেম করবো না। বন্ধু হব। বন্ধুত্ব থেকেই প্রেম জন্মাবে।

ফেব্রুয়ারি ১১

শুনেছি অর্ণব খুব ভাল অংক বুঝাতে পারে। ক্লাসের অনেকেই তার কাছে অংক বুঝে। আমি ভাবলাম তাকে আমি আমার অঙ্কের টিচার হওয়ার প্রস্তাব দিব। আর তারপর প্রেম।

ফেব্রুয়ারি ১২

আমার সব আশা শেষ। আমি আর অর্ণবকে আমার প্রেমের জালে ফাঁসাতে পারবো না। আমি অর্ণবকে বলেছিলাম আমার অঙ্ক কঠিন লাগে। সে কি আমাকে বাসায় এসে অঙ্ক বুঝিয়ে দিতে পারবে কিনা আর টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা করতে না করেছিলাম। সে বলল যে সে শুধু বন্ধুদে র অংক বুঝিয়ে দেয় আর কাউকে না।

ফেব্রুয়ারি ১৭

আমি পুকুরপারে বসে ভাবছি কিভাবে অর্ণবকে পটানো যায়। এর মাঝে অর্ণব পুকুরপারে এসে হাজির। আমাকে দেখেই অর্ণব ঘাট থেকে উঠে চলে যাচ্ছিলো। আমার খুব ইগোতে লাগলো। আমাকে দেখে কেউ উঠে যাবে এটা আমি মানতে পারবো না। বরং আমি উঠে এসে বললাম যে আমাকে দেখে উঠে যাওয়া লাগবে না। এই কথায় অর্ণব খুব লজ্জা পেলো। বলল যে একসাথেই দুজন বসি। আমি তো পুরো তাজ্জব। এতো দেখি মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। তারপর অনেক গল্প হল। তার সাথে বন্ধুত্ব হল। আর একটা কথা আমার তার সঙ্গ এতো ভাল লাগছিল। আমি কি প্রেমে পড়ে যাচ্ছি? মন কে বুঝালাম এত সহজে প্রেম করার মানুষ আমি না।

ফেব্রুয়ারি ২০

প্রতিদিনই অর্ণবের সাথে দেখা হয়। কথা হয়। অনেক ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে আমাদের মধ্যে। অর্ণব অন্যরকম। সে আমার রূপের প্রশংসা তো দূরের কথা। আমার দিকে ভালো মত তাকায় না। আমার খুব অপমান লাগে। আর আমি চ্যালেঞ্জের কথা ভুলেনি। তাকে আমি শাস্তি দিব। আমি তাকে বিয়ে করার অভিনয় করে বিয়ের দিন সকলের সামনে অপমান করবো। তাহলে চ্যালেঞ্জ জয় হবে। শাস্তি দেয়াও হবে।

মার্চ ২০

অনেক দিন পার হল। আমার আর অর্ণবের মাঝে বন্ধুত্ব ছাড়া কিছুই হয় না। লেকের ধারে বসেছি আমরা। অথচ আমার হাত পর্যন্ত ধরে নাই। সিনেমাহলে সিনেমা দেখলাম। একবারও ঘাড়ে মাথা রাখে নাই। রিকশায় চললাম। কিন্তু কিস করার চেষ্টা করে নাই। আর কিভাবে চেষ্টা করবো?

মার্চ ২০

আজকে অর্ণবের সাথে লেকে গিয়েছিলাম। আকাশ মেঘে ঢাকা। তারপর ঝুম বৃষ্টি। দৌড়ে একটা গাছের নিচে আশ্রয় নিতে যেয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। আমাকে টেনে তুলল অর্ণব। আমি তার চোখের দিকে তাকালাম। তার চোখ ভর্তি আমার জন্য মায়া।

এরপর একশোটা প্রশ্ন। আমি ব্যথা পেয়েছি কিনা? হাঁটতে পারবো কিনা? আমার ভিতরে কেমন যেন একটা সুখের অনুভূতি হল। মনে হচ্ছিলো পৃথিবীতে অন্তত একজন আছে যে আমাকে কেয়ার করে। আমায় হাত ধরে রিকশায় উঠালো। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই ছেলে কে কষ্ট দিয়ে আমি ভাল থাকতে পারবো তো ?

মার্চ ২৯

আজ শিলা আমাকে টিটকারি মেরেছে। না এইবার অর্ণব কে মিথ্যা প্রেমের ফাঁদে ফেলতেই হবে। আমার মনে হয় এখন অর্ণব যথেষ্ট দুর্বল হয়েছে আমার প্রতি। কিন্তু আমার মন কিছুতেই সাড়া দিচ্ছে না। বরং কেমন একটা কষ্ট বুকে অনুভব করছি।

মার্চ ৩০

আজ আমি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি আজ তাকে আমার ভালোবাসার কথা বলবো। মিথ্যে ভালবাসা। মনের সকল দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে আমি প্রস্তুত। চ্যালেঞ্জ আমার জিততেই হবে।

মার্চ ৩১

আজ আমার সবচেয়ে দুঃখের দিন। আমি কল্পনা করি নাই যে আমার মত এত সুন্দরী মেয়ের ভালবাসার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে পারে। আমি অর্ণবকে ঘৃণা করি আর চ্যালেঞ্জের খেতাপুরি। না হলাম আমি ভার্সিটির সবচেয়ে সুন্দরী।

এপ্রিল ৭

আজও ভার্সিটি গেলাম না। সারাদিন অর্ণবের কথা ভাবি। প্রেমের জালে অর্ণবকে ফালাতে যেয়ে নিজেই প্রেমের জালে আটকা পড়েছি। আমার এই রূপ দিয়ে কি হবে? এত দিন কল্পনার জগতে ছিলাম। এখন বাস্তবে জগতে এসেছি। অর্ণব আমার জীবনের এক মাত্র সত্য। অর্ণবকে আমার জীবনে লাগবেই।

এপ্রিল ১০

আমি ঠিক করেছি আজ শেষ বারের মত অর্ণবের কাছে যাবো। তাকে আমার ভালোবাসার নৈবদ্য দিব। আমি আমার রূপ মেধা ভালবাসা সব কিছুর বিনিময়ে তাকে চাই। তাতে আমাকে কেউ বোকা ছ্যাঁচড়া মনে করলে করুক।

এপ্রিল ১১

বাসায় আসার পর থেকে আমি কেবল হাসছি পাগলের মত। একি শুনলাম। অর্ণব আমাকে, বলেছে সে সমকামী। আমি হাসি থামাতে পারছি না। আমাকে উপেক্ষা করার জন্য এই রকম মিথ্যা কথা বলার দরকার ছিল কি? কিন্তু কেন উপেক্ষা করছে আমাকে? আমার কি নেই? হাসতে হাসতে আমার চোখে পানি এসে গিয়েছে। দুই চোখ ভরা পানি।

এপ্রিল ১২

আমি শেষ বারের মত এস এম এস পাঠালাম।

আমি জানি অর্ণব সমকামী নয়। সে যখন আমাকে কথা গুলো বলছিল তখন তার

দু’চোখ থেকে পানি পড়ছিল। আমি দেখেছিলেম তার চোখে আমার জন্য তার ভালোবাসা রয়েছে। এস এম এস এ লিখেছি,

‘আমি কালকে মগবাজার কাজি অফিসের সামনে অপেক্ষা করবো। আমরা বিয়ে করবো। যদি তুমি না আসো তাহলে তোমার সমকামী হিসেবে স্বীকারোক্তি আমাকে যা বলছো তা তোমার বাবা মাকে জানাবো আর তোমার সব কথা মোবাইলে রেকর্ড করে রেখেছি। সেটাও সময়মত ছাড়া হবে।’

এপ্রিল ১৩

এখন কাজি অফিস যাবো। অপেক্ষা করবো অর্ণবের জন্য। আমি জানি সে আসবে। অসংখ্য বার সে ফোন করেছে গতকাল। আমি রিসিভ করি নাই। আমাকে কষ্ট দেয়ার মজা বুঝুক। আমি তো জানি সে আমার কাছে আসতে বাধ্য। না হলে তো তার মিথ্যা ছলচাতুরী বের হয়ে আসবে। এখন সে আমাকে বিয়ে করুক। বিয়ের পর আমি তাকে শিখাবো কিভাবে ভালোবাসতে হয়।

অসম্ভব সুন্দর করে সেজেছি আজকে। আজ আমি অনেক খুশি। জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হবে আজকে। অর্ণবকে পাবো। আজকে আমার রূপ নিয়ে আর কোন অহংকার নেই। বরং রূপের অহংকারের কথা ভাবলে হাসি পায়। কি বোকাই না ছিলাম। আজ আমার রূপ শুধুমাত্র অর্ণবের জন্য।

ডায়েরির পরবর্তী পরের পাতা গুলো খালি। জানালা দিকে তাকিয়ে আছি। মেঘের গর্জন শুনি। বৃষ্টি নামবে। আমি ছাদে গেলাম। ভিজলাম মনের সুখে। বৃষ্টিতে আমার সাজ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। নষ্ট হলে হবে। যার জন্য এই সাজ। সেই তো নেই।

ঘরে ফিরতেই নস্টালজিক হয়ে গেলাম। আমি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।

অনেকদিন মানসিক হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। এখন আমি সুস্থ। শুধুমাত্র সেইদিন পর্যন্ত ঘটনা আমার মনে আছে। পরের ঘটনা গুলো মনে করতে চাইলেই আমার প্রচণ্ড মাথা ধরে। খালি একটি লাশ দেখি চোখের সামনে। রক্তাক্ত লাশ। আর দেখি আমি কাঁদছি।

অনেক কাঁদছি। তারপর শূন্যতা শুধু। কার লাশ দেখি? আমি কেন এত কাঁদছি ?

আমাকে সেই সময়ের ঘটনা কেউ কিছু বলে না। শুধু আমার পরম শত্রু শিলাই আমাকে সাহায্য করলো। একমাত্র তার মুখ থেকেই কিছু কথা বের করতে পেরেছি। তাহল অর্ণব ছাদ থেকে লাফ দিয়ে সুইসাইড করেছিল। সুইসাইড করার আগে একটি নোট লিখে রেখে গিয়েছিলো। লিখা ছিল—

“পৃথিবীতে কেউ যেন আমার মত সমকামী না হয়ে জন্মায়। আর আমার পাপের সাজা আমি নিজেকেই দিলাম। প্রকাশ করে গেলাম আমার আসল পরিচয়। কাউকে কষ্ট করে প্রকাশ করতে হবে না। বিদায়।”

আমি স্পষ্ট বুঝলাম আমাকে উদ্দেশ্য করেই এই সুইসাইড নোট লিখা। আমি বিশ্বাস করি নাই যে সে সমকামী। তারপর ভয় দেখিয়েছিলাম যে আমাকে বিয়ে না করলে তার বাবা-মাকে সব বলে দিব। কিন্তু আমি তো শুধু ভয় দেখিয়েছি। আমার একটি ভুলের জন্য আজ অর্ণব নেই। জীবন থেকে একটি কথা শিখেছি জোর করে কারোর ভালোবাসা পাওয়া যায় না। ভালোবাসা মন থেকে আসে। মনের উপর জোর খাটে না বরং হিতে বিপরীত হয়। আমার জন্য আজ অর্ণব নেই। আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে।

আমার ভুলের তো কোনো ক্ষমা নাই।

তারপর আমার নতুন জীবন শুরু হল। আজ আমি একটি এনজিও তে কাজ করি।

আমাদের এনজিওটি সমকামী ছেলেদেরকে নিয়ে কাজ করে। আজ অর্ণব থাকলে নিশ্চয় সে খুশি হত।

আমার মন এখনও অর্ণবকে খুঁজে বেরায়। মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা আমি অর্ণবের কাছ থেকে শিখেছি। সে মরে যেয়ে আমার বিবেককে জাগ্রত করেছে। আমি প্রায় ভার্সিটি যাই। বসে থাকি পুকুর পাড়ে। পুকুরে নিজের ছায়া দেখি। মনে পড়ে সেইদিনের কথা যেদিন আমাদের বন্ধুত্বে র সূচনা। জীবনে একবারও গভীরভাবে ভালোবেসে অর্ণবের হাত ধরতে পারলাম না।

কেন চলে গেল আমাকে রেখে অর্ণব।

অভিমানে চোখে পানি এসে যায়। মনে হয় এই তো অর্ণব আমাকে দেখছে। সেই আকাশের মেঘের আড়ালে। হাসছে আর বলছে দূর বোকা আমি আছি তো। তোমার জন্য অপেক্ষা করছি মেঘের রাজ্যে। আসবে তো?

সমাপ্ত

গল্পটা পড়ার পর আমার কেমন জানি কষ্ট লাগতে লাগলো। মনে পড়লো অর্ণবের মত একজন তো আমার জীবনেও ছিল। আমি তাকে ধরে রাখতে পারিনি। আমার ভালোবাসার এতো শক্তি ছিল না আর আমার বোধ হয় ভালোবাসার সংজ্ঞাটাও জানা ছিল না।

লিমা বই থেকে চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, কোন গল্পটি পড়লেন?

—সমপ্রেমী

কথাটা শুনে লিমা কিছুক্ষণের জন্য আনমনা হয়ে গেলো। চশমাটি খুলে চোখ মুছলেন।

তারপর বললেন, এটা আমার জীবনের গল্প। নীলা আমার নিজের চরিত্র।

কথাটা শুনে আমার জীবনের এক কালো অধ্যায় এর কথা আমার মনে পড়লো।

আমি বললাম, আমার জীবনটা একটি গল্পের মত। আমিও সমকামী।

লিমা কথাটি শুনে চুপ হয়ে গেলো। তারপর হেসে বলল, আপনার গল্প আমাকে বলেন তাহলে। হয়তো আপনার জীবন এর গল্প শুনে আমি একটা গল্পই লিখে ফেলতে পারবো।

আমি গল্প শুরু করলাম।

আমি তখন এইচএসসি পাশ করেছি। চিটাগাং-এ ফুপুর বাড়ি এসেছি বেড়াতে। ফুপুর একটি মাত্র সন্তান। আমার ফুপাতো ভাইয়ের নাম শিশির। ক্লাস টেন-এ পড়তো। আমি তার সাথেই ঘুমাতাম রাতে। আমি তখন বুঝি নাই যে আমি সমকামী। আমার তার সাথে ঘুমাতে গেলেই নানা খারাপ ইচ্ছা মনে জাগ্রত হত। ইচ্ছা করতো শিশিরকে জড়িয়ে ধরতে। ইচ্ছা করতো চুমু খেতে। আমার নিজেকে দোষী মনে হত। কেন আমার এমন লাগবে?

একদিন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো। শিশির খুব ছোট একটি হাফ প্যান্ট পরা। আমি তার থেকে চোখ ফিরাতে পারছিলাম না। কি সুন্দর তার দেহ। তখন শিশিরের মাত্র ১৬ বছর। কিন্তু তার গ্রোথ বেশি ছিল। তাই তাকে লাগত ১৮ বছরের তরুণ।

আমি এক পর্যায় তাকে জড়িয়ে ধরলাম। ও ঘুমচ্ছিলো। ঘুম ভেঙ্গে গেলো। খুব অবাক হল আমাকে এই অবস্থায় দেখে। কিন্তু কিছু বলল না। আমি আস্তে আস্তে ওর পুরুষাঙ্গেহাত দিলাম। শক্ত হয়ে আছে। আমি যা বুঝার বুঝে গেলাম।

এরপর যে কয়দিন থাকলাম সবকটা রাত তার সাথে আমার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিলো। আমি ওকে ভালোবেসেও ফেললাম। ওকে ছাড়া চলে যাবো ভাবতে কষ্ট লাগছিলো। বিদায় বেলা আমি শিশিরকে ডাকলাম। দেখলাম তার দুচোখে জল। আমি বুঝলাম সেও আমাকে ভালবেসেছে। আমি ভাবলাম একটু বড় হলেই আমি তাকে ঢাকায় নিয়ে আসবো।

ঢাকা গিয়ে সব ভুলে গেলাম। তার মাঝে আমি বুঝলাম আমি সমকামী। এর সাথে ওর সাথে প্রেম হল, সেক্স হল। জীবনে আসলো ফেসবুক। ফেসবুকে নতুন মানুষের সাথে পরিচয়। তারপর সেক্স।

একদিন আমি অফিসে কাজ করছি। আমার রিসিপসোনিস্ট ফোন দিয়ে বলল একটি ছেলে এসেছে। আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি আসতে বললাম।

এ আর কেউ নয় শিশির। শিশিরকে দেখে আমি ঠিক চিনতে পারছিলাম না। লম্বা সুদর্শন একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আমি চোখ ফেলতে পারছিলাম না। ছেলেটা আমাকে ডাকলো— ভাইয়া আমাকে চিনতে পারছো না? আমি শিশির।

আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, আমি চিনতে পারলাম না? যার সাথে আমার প্রথম প্রেম।

আমি আবার নতুন করে তার প্রেমে পড়ে গেলাম।

শিশিরের কথায় জানলাম ফুপা বেঁচে নাই। ফুপার চিকিৎসা করতে গিয়ে ফুপু সব জমিজমা বিক্রি করে দিয়েছেন। আমি বুঝলাম অর্থকষ্টে পড়ে শিশির এসেছে।

আমার বাড়িতে একটাই খাট। প্রথম দিন শিশির সোফায় ঘুমাতে চাইলো। আমি ভাবলাম লজ্জা পাচ্ছে। আমি বুঝলাম তার মনের অবস্থা। আমি আর জোরাজোরি করলাম না। কিন্তু এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। কিন্তু সে আমাকে স্পর্শতো দূরের কথা সবসময় এক হাত দূরে থাকে। তাহলে কি সে আমাকে ভুলে গিয়েছে? আগের সম্পর্কের কথা স্বীকার করতে চায় না?

ফুপু একা গ্রামে। সংসার চালানোর মত টাকা পয়সা নেই। শিশির চাচ্ছে আমি যেন কিছু করি আর আমি চাচ্ছি শিশিরকে নিজের মত করে পেতে।

আমি জিদ ধরলাম। শিশির কে আমার পেতেই হবে। সেদিন থেকেই আমার অধঃপতন শুরু। আমি বললাম, শিশির তুই তো আমাকে আপন ভাবতে পারছিস না। তুই বরং গ্রামে ফিরে যা। আমি তোকে কিছুটাকা দিচ্ছি তুই চাষবাস কিছু একটা কর।

আমি শিশিরের দিকে তাকালাম। তার চোখে ভয়। এই কয়টা টাকা দিয়ে এক সপ্তাহ চলবে তারপর?

শিশির বলল, ভাইয়া আমি তোমাকে আপন ভাবি না এটা কি বল?

তাহলে তুই আমাকে দূরে ঠেলে সোফায় ঘুমাস যে?

শিশির মেকি হাসি দিয়ে বলল, এক খাটে ঘুমলে যদি তোমার ঘুমের অসুবিধা হয়?

ওকে এখন থেকে তোমার সাথে ঘুমাবো।

সেদিন রাতে সে আমার সাথে ঘুমালো। আমাদের মাঝে সব হল কিন্তু কি যেন ছিল না তার মাঝে।

পরের দিন শিশিরকে দেখিয়ে দেখিয়ে ফুপুকে অনেক ভাল অঙ্কের টাকা পাঠালাম।

শিশিরের মুখে হাসি ফুটলো। শিশিরের হাসি দেখে আমার বুকটা জুড়িয়ে গেলো কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমি যে শিশিরের সব সুখ কেড়ে নিয়েছি সেটাই বুঝলাম না।

সেদিনের পর থেকে রেগুলার আমাদের সেক্স হত। আগের মত অতটা নির্লিপ্ততা না থাকলেও আমি বুঝতাম ওর মাঝে একটি অনিচ্ছা কাজ করে। আমার রাগ লাগতো। আমার মাঝে কি নাই? টাকা পয়সা, রূপ সব আছে। তারপরও কেন শিশির আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে।

ধীরে ধীরে আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পরলাম। শিশির এর এই নির্লিপ্ততা আমাকে কুরেকুরে মারতে লাগলো। কেন শিশির আমাকে ভালোবাসতে পারছে না?

ভাবলাম টোপ ফেলতে হবে। কিন্তু কি টোপ ফেলবো? টাকা পয়সার টোপ আগেই ফেলেছি। আমি ভেবে দেখলাম শিশির পড়তে ভালবাসে। আমি যদি তাকে ভার্সিটিতে পড়ার লোভ দেখাই। হয়তো ওর জন্য এত ভাবি এটা ভেবে তার ভাল লাগবে। হয়তো আমাকে ভালোবেসে ফেলবে।

সেদিন রাতে শিশির কে ডেকে বললাম, দেখ শিশির তোকে আমি ভার্সিটিতে পড়াতে চাই। কিন্তু তুই তো এখনো আমাকে আপন ভাবিস না।

শিশির অবাক হয়ে আমার চোখের দিকে তাকাল। তার চোখে লোভ দেখতে পেলাম আমি।

তাকে বললাম, তুই আমাকে আপন ভাবিস নাকি তা জানি না কিন্তু আমি তোকে আপন ভাবি। তাই আমি চাই তুই জীবনে উন্নতি কর। তাই যত টাকা লাগে, আমি তোকে ভার্সিটিতে পড়াবো।

আমার কথা শুনে শিশিরের চোখে আনন্দ দেখলাম। এতো খুশি আমি কোনদিন হতে দেখি নাই। ভাবলাম যাক শিশিরকে আর কেউ কেড়ে নিবে না। আমি তাকে ভার্সিটিতে ভর্তি করে দিলাম।

তার সব আনন্দ ভার্সিটি আর পড়াশোনা। যত বই দরকার আমি কিনে দিয়েছি।

মোবাইল ল্যাপটপ, ট্যাব কী না কিনে দিয়েছি। শিশির আমার ভালোবাসার মানুষ। তার জন্য খরচ করতে বিন্দুমাত্র খারাপ লাগতো না। আমি চাই শুধু তার ভালোবাসা। সেটাই আমার জন্য মরীচিকা। তবে আগের থেকে সে বেশ বদলে গিয়েছে। আমার সাথে গল্প করে। নিজে থেকেই কিস দেয়। আমার ভাল লাগে। মনে হয় তাও তো কিছুপেলাম।

কিন্তু একদিন দেখলাম ভার্সিটিতে সে একটি মেয়েকে কোলে তুলে রিকশায় উঠিয়ে দিল। আমি দেখলাম তার চোখে মেয়েটির জন্য ভালোবাসা। তাহলে কি শিশির বাইসেক্সুয়াল? আর এজন্য কি আমার প্রতি ভালোবাসা জন্মাচ্ছে না?

আমি সেদিন রাতেই শিশিরকে বললাম, তুই নতুন বাসা খোঁজ। আমি আর তোকে আমার বাসায় রাখবো না।

দেখলাম শিশির সানন্দে রাজি হয়ে গেলো। বুঝলাম সে কোন পার্টটাইম জব করে টাকা জমিয়েছে আর ইউনিভারসিটি থেকে স্কলারশিপ। এখন আর আমাকে দরকার নাই তার।

আমি ভয় পেয়ে গেলাম। শিশির কি সত্যি চলে যাবে?

এইবার আমি হুমকি দিলাম। আমি পশুর অধম হয়ে গেলাম। যে কোন মূল্যে আমার শিশিরকে চাই।

বললাম তোর সাথে আমার সেক্সের ভিডিও আমি করে রেখেছি। তুই এই বাসায় না থাকলে আর তোর সাথে যে মেয়েটাকে দেখলাম তাকে না ছাড়লে আমি এই ভিডিও তোর মাকে দেখাবো। এই কথা শুনে শিশির হতবাক হয়ে গেলো। কিছু বললও না। শুধুচোখ থেকে পানি পড়তে লাগলো। ওর কষ্ট দেখে আমারও খারাপ লাগছিল কিন্তু আমি নিরুপায়।

পরের দিন মেয়েটা কে সে বলে আসলো যে সে সমকামী কিন্তু মেয়ে টা বিশ্বাস করলো না। ভাবলো তাকে উপেক্ষা করার জন্য শিশির এই কথা বলেছে।

বেশ কিছুদিন পার হল। শিশির সব সময় মন মরা থাকে। বুঝলাম সে আমাকে ঘৃণা করে। জোর করে এক বিছানায় ঘুমায়। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। কেন ওই কথা বললাম। আমি তো আসলে কোন ভিডিও করি নাই।

আজকাল আমি শিশিরের মোবাইল চেক করি। একদিন দেখলাম মেয়েটি মেসেজ দিয়েছে যে মেয়েটি শিশিরকে বিয়ে করার জন্য কাজি অফিসে দাঁড়িয়ে থাকবে আর শিশির না গেলে ফুপুকে সে বলে দিবে যে শিশির তাকে ধোঁকা দিয়েছে আর শিশিরের সব কথা সে মোবাইলে রেকর্ড করে রেখেছে। আমার মাথায় রক্ত উঠে গেলো। এই মেয়ে কে আমি বাঁচতে দিবো না। মস্তান দিয়ে কাজি অফিসে সামনেই তাকে খুন করা হবে।

শিশির সব শুনলো। অনেক বার মেয়েটি কে ফোন করলো। সারা রাত চেষ্টা করলো কিন্তু কেউ ধরলো না।

হঠাৎ করে কি হল। এতো দ্রুত সব কিছু হল। কেউ একজন এসে আমাকে খবর দিলো শিশির নেই। তার লাশ নাকি রাস্তায় পড়ে আছে। রক্তে ভিজে গিয়েছে রাস্তা।

হাসপাতালে নিয়ে লাভ নেই। বেঁচে নেই শিশির। আমি কাঁদতে পারি নাই জানেন। এক ফোঁটা চোখের পানি পড়ে নাই। কিন্তু আমি জানি আমার মনের ভিতর কি চলছিলো।

আমার অনেক বার মনে হয়েছে মরে যাই। আমার জন্যই তো আমার ভালোবাসার মানুষ আত্মহত্যা করলো। আমি এক পর্যায় ভাবলাম এখানে থাকলে আমি শিশিরের কথা ভুলতে পারবো না। পাড়ি জমালাম অস্ট্রেলিয়া। দশ বছর পর এইতো কাল দেশে ফিরলাম।

আমি ভুলে গিয়েছিলাম শিশিরের কথা। আপনার গল্প আবার মনে করিয়ে দিলো।

আমার চোখে পানি এসে গিয়েছে। টিস্যু দিয়ে মুছলাম।

—আচ্ছা আপনি যার কথা বলছেন তার নাম কি সত্যি শিশির?

—না। ওর আসল নাম হিরণ।

—কি বলছেন?

—কেন?

—হিরণ কি রেড ইউনিভার্সিটি তে পড়তো ?

—হ্যাঁ।

—তার বাড়ি কি চিটাগাং?

—হ্যাঁ?

—বুঝেছি।

—কি বুঝেছেন?

অর্ণব আর কেউ নয়। অর্ণবই হিরণ। আপনি যাকে ভালোবেসেছেন আমিও তাকে ভালোবেসেছি। আপনি যার মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করেন আমিও নিজেকে তার মৃত্যুর জন্যই দায়ী করি।

—কি বলছেন!

—দেখেন সবকিছু মিলে যাচ্ছে।

এরপর আমরা দুইজনই চুপ। দু’জনের মনের ভিতরে একই কষ্ট। একই দুঃখ।

দুইজনের ভিতর এতদিন পর আবার সেই ঝড় শুরু হয়েছে। নীরবতা ভেঙ্গে লিমা বললেন, আচ্ছা একটা কথা কি কখনও ভেবেছেন? আমরা নিজেরা এতো কষ্ট পেয়েছি।

নিজেদের দুঃখ কষ্ট নিয়ে এত কনসার্ন অথচ একবার কি ভেবেছি হিরণের মা কেমন আছেন? তার তো একটাই ছেলে ছিল আর হিরণ শুধু তার মায়ের গল্প করতো। আমার মাঝেই মাঝেই মনে হত হিরণের মায়ের সাথে দেখা করে আসি কিন্তু সাহস হয় নাই।

চলেন দুজন মিলে হিরণের মায়ের সাথে দেখা করে আসি। কিছুটা হলেও প্রায়শ্চিত্ত হোক। আমি তো চিনি না জায়গাটা। আপনি নিশ্চয়ই চিনবেন?

—চলেন। আসলেই আমাদের অনেক আগেই হিরণের মায়ের সাথে দেখা করা উচিৎ ছিল। চিটাগাং থেকে তিন ঘণ্টার পথ। তারপর আধাঘণ্টা হেঁটে যেতে হয়। পারবেন যেতে?

—কেন পারবো না?

—না অবশ্যই পারবেন। আপনি ইয়াং।

—এরপর আর কথা হল না। দুজনই চুপ হয়ে গেলাম।

চিটাগাং নেমে বাসে উঠতে হল না। লিমা ফোন করে একটা প্রাইভেট কারের ব্যবস্থা করলো। গাড়ি থেকে নামার পর মাটির পাহাড়ি রাস্তা। হাঁটছি। কিছুক্ষণ হাঁটার পর লোকালয় আর নেই। একদম নির্জন হয়ে গিয়েছে রাস্তা।

কিছুক্ষন হাঁটার পর লিমা বিশ্রাম নিতে চাইলো।

পাহাড়ের এক পাশে পাহাড়ি নদী। খরস্রোতা নদী। আগে হলে অসম্ভব উপভোগ করতাম। কিন্তু এখন মনের অবস্থা সেরকম না। লিমা একপাশে একটা গাছের ছায়ায় বসেছে। আমার অসম্ভব ঘৃণা হচ্ছে। লিমার জন্য হিরণ মারা গিয়েছে। ওকে বাঁচতে দেয়া যাবে না। ধাক্কা মেরে নদীতে ফেলে দিবো আর এই জন্য ওকে ডেকে এনেছি এই নির্জন রাস্তায়। হিরণের বাসা মোটেও এখানে নয় আর ফুপুকে আমি অনেক আগেই আমার সাথে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে গিয়েছি। ওখানেই এখন তিনি। কিন্তু লিমা গেলো কই। এইমাত্র না দেখলাম এখানে বিশ্রাম নিচ্ছে। সুযোগ না পেলে জোর করে ধরে নিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিবো নদীতে। কিন্তু তার আগে লিমাকে খুঁজে বের করতে হবে।

হঠাৎ পিছনে একটা ধাতব নলের অস্তিত্ব অনুভব করলাম। পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম লিমা আমার পিঠে একটা পিস্তল ঠেকিয়ে রেখেছে। লিমা বলল, আপনি নিজেকে খুব চালাক ভাবেন? হিরণের বাসা যে চিটাগাং থেকে মাত্র এক ঘণ্টার পথ তা আমি জানবো না? মিথ্যা কথা বলে এইখানে টেনে নিয়ে এসেছেন? আমাকে খুন করার জন্য?

তোমার কাহিনী শোনার পর ঘৃণায় তোমার মুখে থুথুফেলতে ইচ্ছা করছিলো। তুমি এত নীচ? নিজের সুখের জন্য একটা ছেলের মনের বিরুদ্ধে তাকে ব্যবহার করেছো দিনের পর দিন। আমার জন্য নয়। তোমার জন্য সে সুইসাইড করেছে। আজ সেটা বুঝতে পেরেছি।

—পিস্তল পেলে কোথায়?

—আনিয়েছি। আমার নিজের পিস্তল। গাড়িটা আমার। রেন্ট-এ-কার নয়। গাড়িতেই ছিল পিস্তল। আজ তোমার নিস্তার নাই। তোমার আজকে মরতেই হবে।

—ওকে আমাকে গুলি কর। আসলেই আমার বেঁচে থাকার আর ইচ্ছা নেই।

—পিনপতন নীরবতা।

হঠাৎ আমি পিছন ঘুরে ওর হাত মুচড়ে ধরে পিস্তলটা নিজের হাতে নিয়ে নিলাম।

—হা হা। নিজে পিস্তল রাখো কিন্তু পিস্তল কিভাবে ধরতে হয় তাও জানো না।

তারপর আমি আর দেরি করলাম না। পর পর দুটো গুলি করলাম লিমার বুকে।

যেদিন হিরণ আত্মহত্যা করেছে সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এই মেয়েকে আমি ছাড়বো না। আজকে এতো দিন পর ট্রেনে এই প্রতিজ্ঞার কথা মনে পড়ে গেলো। সুযোগও পেলাম। যাক আমার একটা কাজ সমাপ্ত হল। আরেকটা কাজ বাকি। লিমা সত্যি কথা বলেছে হিরণের মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী। সেটার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।পাহাড়ি নদীর ধারে দাড়িয়ে আছি। নদীতে ঝাঁপ দিবো। নিশ্চিত মৃত্যু। ঠিক যেমন হিরণ ছাদ থেকে লাফ দিয়েছিল। এই হবে আমার প্রায়শ্চিত্ত।

প্রথম প্রকাশ: সমারূঢ়
(মন্দ্র প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রথম কুইয়ার ছোটগল্প সংকলন)

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.