
নন্দিনী
বিনোদিনীর মা হরিমতি মহেন্দ্রের মা রাজলক্ষ্মীর কাছে এসে ধন্না দিয়ে পড়লো। দুজন একই গ্রামের মেয়ে, ছেলেবেলার সুখ-দুঃখের সঙ্গী। হরিমতির আর্জি – তার একমাত্র কন্যাকে রাজলক্ষ্মীর পুত্রের সাথে বিয়ে দিতে হবে।
রাজলক্ষ্মী আবার মহেন্দ্রকে গিয়ে ধরলেন, বাবা মহীন, গরীবের মেয়েটিকে তো উদ্ধার করতে হয়। শুনেছি মেয়ে বড় সুন্দরী, আবার মিশনারি মেমের কাছে পড়াশুনাও শিখেছে – তোদের আজকালকার পছন্দের সাথে মিলবে।
মহেন্দ্র বললো, মা, আমি ছাড়াও আরো কত আজকালকার ছেলে আছে।
– মহীন, ঐ তোর দোষ, তোর কাছে বিয়ের কথা পাড়াই যায় না!
– মা, বিয়ের কথা বাদ দিয়েও আরো একশো একটা কথা বলা যায়, ওতে কারো ক্ষতি হয় না।
মহেন্দ্র শৈশবেই পিতৃহীন। মাকে নিয়েই তার পৃথিবী। বয়স প্রায় বাইশ হতে চললো, এম.এ.পাশ শেষ করে ডাক্তারি পড়তে শুরু করেছে, তবু মাকে নিয়ে তার প্রতিদিন মান-অভিমান। মায়ের কাছে তার নিত্যনতুন আদর-আবদারের অন্ত ছিলো না। মাকে ছাড়া মহীনের নাওয়া-খাওয়া কিছুই হতো না।
মায়ের কথায় সে মেয়েকে দেখতে যেতে রাজি হল। কনের বাড়ি খবর গেলো, দেখতে যাবার দিন ঠিক হলো।
যেদিন দেখতে যাবার কথা, সেদিন মহেন্দ্র বললো, দেখে আর কাজ নেই। তুমি যখন চাও এ বিয়ে হোক, এ বিয়ে হবে।
মহেন্দ্রের গলায় একটু রাগের উত্তাপ টের পেলেও রাজলক্ষ্মী ভাবলেন, এ মেয়েকে দেখলে পাষাণেরও মন গলে, আমার ছেলেরও মন গলবে। রাজলক্ষ্মী নিশ্চিত মনে বিয়ের দিন ঠিক করলেন।
এবার যত দিন ঘনিয়ে আসে, মহেন্দ্রের তত ঘাম ঝরতে থাকে। অবশেষে একদিন ঘুম ভেঙে তার টনক নড়লো, সে এখন বিয়ে করতে চায় না।
ছোটবেলা থেকে মহেন্দ্র যা চেয়েছে, তা-ই পেয়েছে। তাই তার ইচ্ছার বেগ স্বভাবতই উচ্ছৃঙ্খল। পরের ইচ্ছার চাপ সে সইতে পারে না, সওয়ার প্রয়োজনও বোধ করে না। একান্ত মায়ের অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে গিয়েই সে এই প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ফেলেছে। আর এই কারণেই আসল কাজের সময় তার ঘোর অনীহা দেখা দিলো।
বিহারী মহেন্দ্রের বাল্যবন্ধু। সে মহীনকে দাদা এবং তার মাকে মা বলে ডাকতো৷ রাজলক্ষ্মীও বিহারীকে নিজের ছেলের মতোই দেখতো। মহীনের বেগতিক হাল দেখে নিরুপায় রাজলক্ষ্মী বিহারীকে ডেকে বললেন, দেখ তো বাবা, গরীবের মেয়ে, এ কাজ তো তোকেই করতে হয়…
বিহারী বললো, যে মিঠাই মহীন খাবে না বলে ফেলে গেছে, তোমার কথায় আমি অনেকবার সে মিঠাই তুলে খেয়েছি। কিন্তু কন্যার বেলায় তো তা পারবো না, মা।
রাজলক্ষ্মী ভাবলো, ঠিকই তো, বিহারী সারাক্ষণ মহীনকে নিয়েই পড়ে থাকে৷ বুঝি আরেকটি প্রাণীকে নিয়ে তার ভাবারও সময় নেই। থাক, ওকে ঘাঁটিয়ে কাজ নেই। এই ভেবে বিহারীর প্রতি কৃ পা মেশানো মালিহাতা বুঝি আরো কয় ছটাক বেড়ে গেলো।
বিনোদিনীর বাবা বিশেষ ধনী না হলেও মেয়েকে পড়াশোনা করিয়েছেন। মেয়ের বিয়ের বয়স পার হলেও তার বিশেষ দুঃশ্চিন্তা ছিলো না। তবে গোল বাঁধলো তার মৃত্যু র পর। বিধবা মা দারিদ্র্যের সংসারে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ঘোর বিপদে পড়লেন।
এমন অবস্থায় রাজলক্ষ্মী তার জন্মভূমি বারাসাতের গ্রাম সম্পর্কীয় একভাইয়ের ছেলের সাথে বিনোদিনীর বিয়ে ঠিক করলেন। অবিলম্বে বিয়েটা হয়ে গেল। সবাই ভাবলো, যাক, আপদ বিদেয় করা গেছে। তবে বেশিদিন হাঁপ ছেড়ে বাঁচা গেলো না, বিনোদিনী বিধবা হলো।
এরপর তিনটা বছর পার হয়ে গেলো।
রাজলক্ষ্মী আবারো মহেন্দ্রর কাছে বিয়ের কথা পাড়লেন।
– মহীন, লোকে যে এবার আমাকে নিন্দে করবে।
– কেনো মা?
– লোকে বলবে, বউ আসলে মা পর হয়ে যায় এই ভয়ে তোর সুখের পথে
বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছি।
– হুম, ভয় তো হওয়াই উচিৎ। আমি মা হলে প্রাণে ধরে কোনোদিন ছেলের বিয়ে দিতাম না। ওতে লোকের নিন্দা নিতে আমার কোনো বিকার নেই।
রাজলক্ষ্মী মনে মনে খুশি হয়ে জাকে ডেকে বললেন, দেখলে মেজোবৌ? এমন সৃষ্টিছাড়া কথা কোনোদিন শুনেছো?
কাকি বললেন, বড় হলি, তবু মার আঁচল ছাড়তে পারলি না। এখন তো আর শিশুর মত মায়ের পিছুপিছু ঘুরলে চলবে না। বয়স অনুযায়ী আচরণ করাই ভালো। কী বলো খুঁড়ি?
রাজলক্ষ্মী এ কথায় সায় দিলেও ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি আশা করেছিলেন ছেলের আহ্লাদে সাড়া পাবেন, হাসি তামাশা হবে। কিন্তু তা হলো না। ভাবলেন, ঠিকই, মেজোবৌয়ের তো নিজের সন্তান নেই। তাই হয়তো অন্নপূর্ণা রাজলক্ষ্মীকে ঈর্ষা করে। ভাবনাটা আসার সাথে সাথেই তার খোস মেজাজ পালটে গেলো।
বললো, আমার ছেলেবউ না আনলে তাতে তোমার কী? বেশ তো, এতোদিন যখন ছেলেকে দেখে আসছি, এখনো দেখে রাখতে পারবো। আমাদের কারুকে দরকার নাই।
মেজোবৌ বললো, তুমি শুধালে বলেই যা ভালো মনে হয় বললাম। নইলে আমার কী!
এ কথা বলে অন্নপূর্ণা ভেজা চোখে ঘরে ফেরত গেলেন।
মহেন্দ্র এ দৃশ্য দেখে মনে আঘাত পেলো। কলেজ থেকে সকাল সকাল বাড়ি ফিরেই প্রথমে সে কাকির ঘরে গেলো।
কাকি যে স্নেহের দাবিতে কথাগুলি বলেছিলেন, মহীন তা জানতো। কাকির এক বাপমা হারা বোনঝি আছে, তার একটা হিল্লে হলেই অন্নপূর্ণার এ জীবনে আর কিছু চাইবার নেই।
যদিও বিয়েতে মহীনের মন নেই। তবু কাকির এই দুরবস্থায় তাকে কোনো এক ভাবে সাহায্য করার জন্য মন উতলা হয়ে পড়লো।
মহেন্দ্র যখন কাকির ঘরে ঢুকলো ততক্ষণে বেলা পড়ে গেছে। অন্নপূর্ণা তখনো মুখে কুটো কাটেনি, পাশের ঘরে তার জন্য রাখা ভাত তরকারি ঢাকা পড়ে আছে। তিনি শুকনো মুখে জানালার গরাদের উপর মাথা রেখে বসেছিলেন।
অল্প কারণেই মহীনের চোখে জল আসে। কাকিকে এ অবস্থায় দেখে তার চোখ ছলছল করে উঠলো। কাছে এসে সে ডাকলো, কাকিমা?
অন্নপূর্ণা মুখটা জোর করে হাসি হাসি করার চেষ্টা করে বললেন, আয় মহীন, বোস।
মহেন্দ্র বললো, ভারী ক্ষিদে পেয়েছে, প্রসাদ খাবো।
অন্নপূর্ণা মহেন্দ্রের কৌশল বুঝতে পেরে অতি কষ্টে অশ্রু নিবারন করলেন৷ আগে নিজে খেলেন, এরপর মহীনকে খাইয়ে দিলেন।
মহেন্দ্রের মন তখন কাকির জন্য দরদে পূর্ণ। এমন সময় সে ঝোঁকের মাথায় বলে ফেললো, তোমার কোন এক বোনঝির কথা বলেছিলে, কই তাকে তো একবারো দেখালে না।
অন্নপূর্ণা স্মিত হেসে বললো, তোমার আবার বিয়ের শখ হল নাকি মহীন?
মহীন বলে, না না, আমার জন্য না। বিহারীকে রাজি করিয়েছি, তার জন্যই জিজ্ঞেস করা।
– আহা, বিহারী। তার মত ছেলে কি আর এ অভাগীর ভাগ্যে আছে? তুই যখন বললি তখন আমিও নিশ্চিত হলাম।
এরপর কিছুদিন পার হলো।
মেয়ে দেখার কথা মহীন ভুলে গেলেও কাকিমা ভোলেননি। তিনি শ্যামবাজারে মেয়ের অভিভাবক জ্যাঠার বাড়িতে চিঠি মারফত দেখতে যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করলেন।
দিন ঠিক হয়েছে শুনে মহীনের হুঁশ ফিরলো। সে কাকিকে এবার
সত্যিটা জানাতে বাধ্য হলো, বিহারীকে এখনো কিছুই বলা হয়নি।
অন্নপূর্ণা বললেন, এখন না দেখতে গেলে তারাই বা কী মনে করবে?
মহেন্দ্র বিহারীর কাছে গিয়ে সব খুলে বললো। চোখ টিপে বললো, তোমার পছন্দ না হলে কিন্তু বিয়ে হবে না। বিহারীর তা পছন্দ হলো না। কাকিকে সে দেবীর মত ভক্তি করতো।
– কাকির বোনঝিকে দেখতে গিয়ে ‘পছন্দ হয়নি’ কথাটা বলতেও
আমার মুখে বাঁধবে।
– তবে তো মন্দ হয়না।
– কিন্তু এ তোমার ঘোর অন্যায় মহীনদা। এখন কাকির মনে কষ্ট দেওয়া আমার জন্য কঠিন হবে। এর সবটাই তোমার খামখেয়ালির জন্য!
মহীন কিঞ্চিৎ লজ্জিত হয়ে বললো, তবে কী করতে চাও?
– কথা যখন হয়েই গেছে, আর দেখার ভড়ং করে কাজ কী। কাকিকে জানিয়ে দাও আমি বিয়েতে রাজি।
চিঠিতে উল্লেখিত নির্দিষ্ট দিনে দুই বন্ধু কন্যা দেখতে বের হলো।
কন্যার জ্যাঠা অনুকূ ল বাবু নিজের উপার্জনের টাকায় শ্যামবাজারে বাগানসহ তিনতলা বাড়ির মালিক হয়েছেন। দরিদ্র ভাইয়ের মৃত্যু র পর তার কন্যা আশালতাকে নিজ বাড়িতে থাকতে রেখেছেন। অন্নপূর্ণা নিজেই চেয়েছিলো আশাকে তার কাছে এনে রাখবেন। কিন্তু জ্যাঠার পয়সা নিয়ে ভারী অহংকার। পাছে তার মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়, এই ভয়ে আশাকে কোথাও থাকতে দিতেন না। তাছাড়া আইবুড়ো মেয়ের গায়ে কলঙ্ক লাগার আশঙ্কায় কোথাও যেতেও দিতেন না।
এমনই পরিস্থিতিতে দুই বন্ধু এসে হাজির হল। তাদের বসিয়ে অনুকূ লবাবু ভিতরের ঘরে ডাক পাঠালেন,
– চুনি, পান নিয়ে আয়।
কিছুক্ষণ পর সংকোচের ভারে নত হয়ে আশালতা ঘরে প্রবেশ করলো। গায়ে রাজ্যের লজ্জা নিয়ে সে অনুকূ লবাবুর পাশে এসে দাঁড়ালো।
– বাটা ওদের সামনে রাখো।
আশা পানের বাটা মহীন-বিহারীর সামনে রেখেই চলে যেতে যাচ্ছিলো। অনুকূ লবাবু তাকে আটকে বিহারীর দিকে তাকিয়ে বললেন, এই আমার ছোটো ভাই অপূর্বর একমাত্র মেয়ে। সে যে গেলো, এই মেয়েটিই ওর শেষ স্মৃতি। আমি ছাড়া এর কেউ নাই।
বিহারীর কী ভাব হলো বোঝা শক্ত। তবে মহেন্দ্রের মন আবেগে পূর্ণ হয়ে গেল। সে এবার আশার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলো। বারান্দার পশ্চিম কোন থেকে সূর্যাস্তের আভায় আশাকে এক দুঃখী রাজকন্যার মত মনে হলো। কণে দেখা আলোয় আশার কোমল মুখটা মহীনের মনে যেন সুখের মত ব্যথা বাজিয়ে তুললো।
অনুগ্রহপালিত বলে সুপাত্রে পারা করার জন্য আত্মীয় স্বজনরা আশার বয়স দুই এক বছর কমিয়ে বলে। দেখে ধারণা করা যায়, মেয়েটির বয়স হয় চৌদ্দ, নাহয় পনেরো।
কণে দেখে ফেরার পথে বিহারীকে মহেন্দ্র বললো, তোমার কাঁধে যে বোঝা চাপিয়েছি তা বোধহয় অতটাও ভারী না।
বিহারী অন্যমনস্ক হয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে উত্তর দিলো,
– মেয়েটাকে দেখে মাসিমার কথা মনে পড়ে। বোধহয় তেমনিই লক্ষ্মী হবে।
– বিহারী আমি ভেবে দেখলাম, আমার আসলে একটুভাবা উচিৎ মনে হয় …
– কী বিষয়ে?
– কাকিমা চাচ্ছিলেন যাতে বিয়েটা আমিই করি। এতে করে আশাও তার কাছাকাছি থাকতে পারবে।
– তা করো না, তোমার একটা ফু লস্টপ হওয়া দরকার মহীনদা। নইলে আমাকে নিয়ে একবার এদিক টানো আরেকবার ওদিক টানো।
বিহারী বিশেষ আপত্তি না করে বাড়ি চলে গেলো। মহীন সোজা পথ ছেড়ে দীর্ঘ এক পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি পৌঁছলো। মা-কাকির সাথে কথা বলে বিয়ের দিন তারিখ ঘোষণা হল।
শানাই বাজিয়ে পাড়া মাতিয়ে নির্দিষ্ট দিনে মহীনের সাথে আশার বিয়ে হলো।
বিয়ের পর রাজলক্ষ্মী ছেলেকে বললেন, সামনে তো পরীক্ষা, বউমাকে কিছুদিনের জন্য জ্যাঠার ঘরে পাঠিয়ে দিই, কী বলিস?
– আমি কি ছেলেমানুষ? নিজের ভালোমন্দ বুঝি না? তাছাড়া ওর তো বাপের বাড়ি নেই। জ্যাঠা লোকটি ভারী কিপটে।ওখানে পাঠাতে আমার মন সায় দেয় না।
রাজলক্ষ্মী: ওরে বাবা, কাল বিয়ে করে আজই এতো দরদ? আমাদের সময় তো এমন বেহায়াপনা ছিলো না!
মহেন্দ্র এক মুহুর্ত চুপ করে থেকে মুখ খুললো,
– তুমি চিন্তা করো না মা, পরীক্ষায় কোনো অসুবিধা হবে না।
রাজলক্ষ্মীর মনে হলো, ছেলে আর তার ছায়ায় হাঁটতে চায়না। তখন সে ঘরের দ্বিতীয় ব্যক্তিটি নিয়ে পড়লেন। আশাকে তুমুল আগ্রহে ঘরকন্না শেখাতে লাগলেন। রাতদিন আশাকে অবিরাম খাটানো হলো। এটাই রুটিন হয়ে গেলো। অন্নপূর্ণা সব দেখেও পাছে হীতে বীপরিত হয়, তাই কিছু বলতে চাইতেন না। কিন্তু মহীনের ভারী গায়ে লাগলো, সে মাকে বললো, বউকে আমি দাসীর মত খাটতে দেখতে পারি না।
মা এ কথা শুনে বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– তাহলে ওর কী হবে?
– ওকে আমি পড়াশুনা শেখাবো।
রাজলক্ষ্মী আর কিছু না বলে আশাকে দিয়ে গেলেন। যাবার আগে বলে গেলেন, এই নাও তোমার বঁধুকে পড়া শিখাও। আমিই দাসীবৃত্তি করবো।
এ কথা বলে ঘরে গিয়ে শশব্দে দরজা বন্ধ করলেন।
মহেন্দ্র ভাবলো, আর নয়, বউয়ের দায়িত্ব এবার নিজের হাতেই তুলে নিতে হবে।
দিন যায়, রাজলক্ষ্মী অপেক্ষা করেন তার ছেলে একদিন মাফ চাইতে আসবে। ঠিক করেন ও এলেই ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরবেন। কিন্তু মহীন ইদানীং ঘর থেকে খুব একটা বের-টের হয় না। মায়ের ঘরটা কোন দিকে সেটিও বুঝি সে ভুলতে বসেছে। একদিন মা নিজেই উপস্থিত হয়ে সব ঠিকঠাক করতে এসে নবদম্পতিকে কিঞ্চিৎ আপত্তিকর অবস্থায় দেখে বিব্রত হন। উনি সেকেলে ঘরানার নারী। বউকে আদর দিয়ে মাথায় তুলে রাখাকে তিনি এক কথায় বেহায়াপনা হিসেবেই জানেন। কিন্তু ছেলেকেও তো কিছু বলা যায় না। তাই ওদিনের পর থেকে রাজলক্ষ্মী আর ছেলের ঘরে যাবার সাহস করেন না। এরপর থেকে আশাকেও কেউ ঘরের কাজ করতে ডাকে না।
দাম্পত্যের নেশায় মগ্ন মহেন্দ্র সে বছর মহীন পরীক্ষায় ফেল করলো। আশাও চারুপাঠের একটি অধ্যায়ও শেষ করতে পারলো না। এই সংবাদ শুনে রাজলক্ষ্মী তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। সেই রাগের ঝাঁঝ এসে লাগলো অন্নপূর্ণার গায়ে।
বিহারী এখনো মাঝেমাঝে ও বাড়ি যেয়ে ‘মহীনদা মহীনদা’ বলে ঘর মাতিয়ে রাখে।
মহীনের পরীক্ষায় ফেল করার সংবাদ শুনে বিহারী তাকে এক চোট ভৎসনা করলো। মহীনকে দিয়ে মায়ের সামনে কথা দেওয়ানো হলো, সে এইবারের ঘাটতি পরেরবার পুষিয়ে নেবে। এই সংসারের হাল তো মহীনকেই ধরতে হবে। বাপের সম্পত্তি চিরকাল থাকবে না। বিহারী আশাকেও ইঙ্গিতে কিছুটা ধীরস্থির হতে বললো।
বিহারী ছেলেটার শাসনে মহীনের খুব আমোদ হয়। যে শাসন বাধ্যতামূলক নয়, যে বাঁধন চাইলেই ভেদ করা যায়, সে বাঁধনে জড়াতে একটা স্বাধীনতার সুখ থাকে। বিহারীর আচরণে তার প্রতি মহীনের মালিহাতা আরো কয় ছটাক বেড়ে গেলো। আশার আবার বিহারীর প্রতি তেমন ভক্তি ছিলো না। আগে এই দুইজনের বিয়ের সম্ভাবনা থাকায় আশা বিহারীকে দেখতেই পারে না। পরিমাণমতো জ্ঞান বিতরণ করে বিহারী আবার রাজলক্ষ্মীর কাছে ফিরে গেলো। বিহারী ছাড়া রাজলক্ষ্মীর সুখদুক্ষের কথা শোনার মত লোক ও বাড়িতে আর কেইবা আছে!
রাজলক্ষ্মীও এই ফাঁকে পরীক্ষা করতে চাইলেন, ছেলে কি তাকে নিয়ে এখনো ভাবে? তিনি ঘোষণা দিলেন, ক’দিন দেশের বাড়ি ঘুরে আসবেন।মহীন এ কথা শুনে সাথে সাথে যাবার ব্যবস্থা করে দিলো। দ্রুত সায় পেয়ে রাজলক্ষ্মীর মন খারাপ হলো। ছেলের অবহেলা সাথে নিয়ে তিনি বিহারীকে বগলদাবা করে বারাসাতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন।
কিন্তু তার পৈতৃক বসতবাড়িটি বসবাসের জন্য ঠিক উপযোগী নয়। দিনে দুপুরেও ওখানে শেয়ালের উপদ্রব। পুকুরের জল ঘোলা – পানের অযোগ্য।বাড়ির চারিদিকে বাঁশবন, ঘন জঙ্গল। এমন অজায়গায় মাকে একা রেখে যাওয়া ঠিক মনে হলো না বিহারীর। সেও মায়ের সাথে কিছুদিন থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। কদিন পর নাহয় আবার মাকে নিয়ে কোলকাতা ফেরা যাবে।
এমন হাভাতে অরণ্যে বনদেবীর মত বিনোদিনী এসে আবির্ভূত হলো।
ভাগ্যের করূণ পরিহাসে বৈধব্যের পর এই নিরানন্দ পল্লীর ভেতরে বিনোদিনীর একাকী নির্বাসন। আজ এতোদিন পর মাতৃস্থানীয়া কাউকে পেয়ে আবেগে তার কণ্ঠ অবশ হবার জোগাড় হলো। দিনরাত সে অন্নপূর্ণার সেবা করতে লাগলো। সেবায় বিমোহিত হয়ে রাজলক্ষ্মী বলতে বাধ্য হলেন, এভাবে চললে যে তোমার শরীর খারাপ করবে!
বিনোদিনী নিজের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে উত্তর দিলো, মাগো, আমাদের দুঃখের শরীরে অসুখ করে না।
বিনোদের সেবায় মুগ্ধ হয়ে রাজলক্ষ্মীর কেবলি মনে হতে থাকে, আহা এই মেয়েই ত আমার ঘরের পুত্রবধূর হতে পারত। কেন হলো না!
বিহারীও এই কয়দিনে পাড়ার কর্তা হয়ে উঠলো। কেউ তার কাছে রোগের ওষুধ শুধায়, কেউ ছেলেকে বড়ো আপিসে কাজ জুটোনোর জন্য তাকে ধরে, কেউবা তাকে দিয়ে দরখাস্ত লিখিয়ে নেয়। সে সব মহলেই সকৌতুক কৌতুহল আর স্বাভাবিক হৃদ্যতা নিয়ে যাতায়াত করে। প্রত্যেকবার বাড়ি ফিরে দেখতো কে যেন তার ঘর সাজিয়ে গেছে, পড়ার টেবিলের উপর কাসার গেলাসে দুই-চারটা ফু ল আর পাতার তোড়া রেখে গেছে, বইপত্তরও গোছানো। একটা বই নিয়ে প্রথম পাতাটি উল্টোলে দেখা গেলো সেখানে একটা নাম লেখা – বিনোদিনী।
যে চিঠির আশায় রাজলক্ষ্মী এতোদিন অপেক্ষা করছিলেন, অবশেষে সে চিঠি এলো। কিন্তু বিহারী তা সম্পূর্ণ পড়লো না, তাই দেখে রাজলক্ষ্মী ভাবলেন, মহেন্দ্র বুঝি মাকে ছেড়ে নিদারুণ কষ্টে আছে। হয়তো রাগের মাথয় বাঁকাত্যাড়া কিছু লিখে ফেলেছে৷ স্নেহে মায়ের মন জলের মত প্রবাহিত হলো। বিহারী সে চিঠি দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দিয়েছিলো। সে গেলে তার অনুপস্থিতিতে চিঠিটি সংগ্রহ করে বিনোদিনীর দারস্থ হল।
বিনোদিনী চিঠি পড়তে আরম্ব করে লজ্জা পেলো, সেখানে মায়ের ব্যাপারে একটি মাত্র লাইনই লেখা আছে। বাদবাকি পৃষ্ঠাজুড়ে সে বিহারীকে তার অসামান্য দাম্পত্যের কথা রসিয়ে রসিয়ে লিখেছে। বিনোদিনী আর তা পড়ে শোনালো না।
রাজলক্ষ্মী এক মুহুর্তের জন্য ছেলেকে মাফ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার অনুভূতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। চিঠিটি ফেরত না নিয়েই তিনি ঘরে ফিরে গেলেন। বিনোদিনী চিঠি নিয়ে বসলো। মহেন্দ্র কেমন, আশা কেমন, মহেন্দ্র আশার প্রেম কেমন, এই কৌতুহল তাকে ঘিরে রাখলো। চিঠিটা বারবার পড়ে বিনোদ হিংসেয় চিড়বিড় করতে লাগলো। ওভাবেই দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে অনেকক্ষণ পা ছড়িয়ে বসে থাকলো।
অন্নপূর্ণা একদিন ঠিক করলেন আর নয়, এবার তিনি তীর্থযাত্রায় যাবেন। সংসারে তার আর মন টেকে না। তিনি কাশি চলে গেলেন। যাবার আগে সে চাইলো, এবার যাতে ঘরের লক্ষ্মী ঘরে ফেরে। তাই রাজলক্ষ্মীর কাছে শেষ দেখা করতে এলো।
কেউ অন্নপূর্ণার পণ টলাতে পারলো না। যাবার আগে বিহারীর ভবিষ্যৎ স্ত্রীর জন্য আশীর্বাদ হিসেবে তিনি এক গাছি বালা রেখে গেলেন। বিহারী কিছুতেই তা নিতে চাইলো না, তবু দিয়ে গেলেন। উনি বুঝেছিলেন বিহারীর সাথে ভারী অন্যায় হয়েছে। বিহারী মুখে না বললেও তিনি বোঝেন। এ নিয়ে তার মনেও বেদনার মেঘ জমে আছে।
আশার মন থেকে থেকে কু ডাকে। ওদের বিয়ের পর থেকে একবার মা বেরিয়ে যায়, আরেকবার মাসিমা চলে যায়। তাদের সুখ যেনো সবাইকেই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এভাবে চললে একসময় সে ছাড়া তাড়ানোর মত কেউ বাকি থাকবে না।
মহেন্দ্রও এসব নাটকে ত্যক্ত হয়ে সংসারের উপর বিদ্রোহ ঘোষণা করলো। সে মহাসমারোহে প্রেমে মনোযোগী হল। আশার উৎকন্ঠা দেখে মহেন্দ্র থেকে থেকে খোঁ চা দিয়ে বলতো, মাসিমা গেছেন তো কী? আমাদের ভালোবাসা কি তোমার জন্য যথেষ্ট নয়?
আশা এমন কথায় ব্যথিত হত, তার নিজের প্রেমের উপর সন্দেহ জাগতো, তার তো মাসিমা, শাশুড়ির জন্য মন কাঁদে। তবে কি আর কারো জন্য মন কাঁদতে নেই?
এই বিশৃঙ্খলার ভেতর দাসদাসীরাও সুযোগ বুঝে ঢিলে দিতে আরম্ভ করলো। বামুনঠাকুর মদ খেয়ে নিরুদ্দেশ হলেন। ঘরকন্না উচ্ছন্নে উঠলো।একদিন প্রতিবেশি কোকিলের ডাকে বাড়িতে পোষা খাঁচার কোকিল সাড়া দিলো না। অনিয়মের যাপনে এতদিন পাখিটির কথা কারু মনে ছিলো না।
খাবার না পেয়ে সে খাঁচাতেই শরীর ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
এ দেখে আশা ধরা গলায় মহেন্দ্রকে মিনতি করে বললো, তবে আর কেনো, মাকে এখুনি ডেকে পাঠাও।
এমনি দুর্দিনে বিহারী এসে হাজির।
বিহারীর আগমনে এ দম্পতি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। বিয়ের পর বিহারীর আগমনে এরা মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলেও এখন এই আড়ালকেই তাদের পরম নিরাপদ আশ্রয় বলে মনে হতে লাগলো।
বিহারী বললো, বাড়ির যে অবস্থা দেখছি মাকে বুঝি না আনলে চলে না।
মহেন্দ্র: আমরাও ভাবছিলাম মাকে এবার ডাকা দরকার। অনেক দিন তো হলো ঘুরলেন।
বিহারী: এই কথাটাই জানিয়ে তাকে একটা চিঠি লিখে দাও৷ বৌদি, তোমার কাছে আবেদন, মহীনকে এই দুটো মিনিট তোমায় ছাড় দিতে হবে।
এসব ঘোরপ্যাঁচানো কথায় আশা কোনো সদুত্তর দিতে পারত না।ভেতর ভেতর বিব্রত হত। বিহারীও ইচ্ছা করেই বুঝি তাকে আরো জ্বালাত।
বিহারীর কথায় আশা রাগ করে চলে গেলো, তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো।
– তোমাদের আর এই জনমে বনিবনা হলো না।
– একেই তুমি মায়ের আহ্লাদে গোল্লায় গ্যাছো, তার উপর স্ত্রীর সোহাগে তোমাকে এখন খুঁজেই পাওয়া যায় না। তাই বন্ধু হিসেবে সময় সময় দুটি কথা মনে করিয়ে দিতেই হয়।
– ওতে কী লাভ হয়?
– তোমার আদৌ কিছু হয় কীনা জানিনা, তবে আমার হয়। অন্তত নিজেকে বলতে পারলাম, চেষ্টা করেছি। এইটাই লাভ।
বিহারী মহেন্দ্রকে দিয়ে চিঠি লিখিয়ে সে চিঠি নিয়ে পরদিনই রাজলক্ষ্মীকে আনতে গেলেন। রাজলক্ষ্মী সবই বুঝলেন, তবু সংসারের প্রতি টান তাকে আবার গৃহস্থে ফেরত আনলো। রাজলক্ষ্মী বিনোদিনীকেও সঙ্গে করে নিয়ে এলেন।
গৃহীনী ঘরে ফিরে যে দুরবস্থা দেখলেন তাতে আশার প্রতি বিতৃষ্ণা আরো বেড়ে গেলো। কিন্তু আশা এবার থেকে তাকে ছায়ার মত অনুসরণ করতে লাগলো। রাজলক্ষ্মী ভাবলেন, অন্নপূর্ণার অনুপস্থিতিতেই বউয়ের এত উন্নতি হয়েছে।
আশা গোটাদিন রাজলক্ষ্মীর সাথে ঘরকন্না করতে লাগলো। এর মাঝে উপরের ঘর থেকে ডাক এলে সে বেশ অস্বস্তিতে পড়তো। রাজলক্ষ্মী ছেলের সুখের পথে বাঁধা হতে চান না, বিধায় তিনিও আশাকে পাঠিয়ে দিতেন।আশা মহেন্দ্রের আবারও চারুপাঠ নিয়ে ভনিতা শুরু হলো৷ আগের মত বর্ষার দিনকে রাত ও জোছনার রাতকে দিন করা হলো। একসাথে থাকতে থাকতে এমন এসে ঠেকলো যে এক সেকেন্ডও আলাদা থাকা অসহ্য ঠেকতো। বিশেষ কিছুনা করলেও দুজনের একজন আরেকজনকে সবসময় পাশে চাই-ই চাই।
একদিন বিনোদিনী নিজে থেকেই আশার সাথে কথা বলতে এলো। ছোটোবেলা থেকে জ্যাঠার বাড়িতে বড় হওয়ায় আশা স্বভাবতই নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকতো। নিজে থেকে কারো সাথে ভিড়তে চাইতো না৷ কিন্তু বিনোদিনী যখন নিজ গরজে তার সাথে খাতির করতে আসলো, তখন তার আর কোনো সংকোচ রইলো না।
আসার পর থেকেই বিনোদিনীর প্রশংসা শুনে আশা কিঞ্চিৎ দমে গেছিলো। শাশুড়িও যেন তাকে উদ্দেশ্য করে বিনোদিনীর প্রশংসা করতে আনন্দ পেতেন। আশা দেখতো, বিনোদিনী ঘরকন্নায় বিশেষ পারদর্শী। দাসদাসীদের নিয়োগ বিয়োগ – সবেতেই তার সহজাত নেতৃত্ব দেবার প্রবণতা। তবে এসব ছাড়াও প্রথমেই যা সবার আগে চোখে পড়ে, তা হলো –
বিনোদিনী অসামান্য সুন্দরী।
দিনের আলো ফুরোবার আগেই এই দুই নারীর বন্ধুত্ব জমে উঠলো। আশা বললো, এসো ভাই আমরা কিছু একটা পাতাই।
বিনোদিনী হেসে শুধালো, কী পাতাবি?
আশা একে একে নাম ভাবতে আরম্ভ করলো, কিন্তু কোনটাই বিনোদের ভালো লাগলো না।
বিনোদ বললো, আদরের নাম দিস না, আদরের নামে আর আদর নাই।
আশা হাল ছেড়ে বললো, তবে তুমি একটা নাম দাও।
বিনোদিনী এক মুহুর্ত চিন্তা করে বললো, চোখের বালি।
আশা সঙ্গে সঙ্গে নামটা পছন্দ করে ফেললো।
আশারও মূলত একজন সঙ্গীর দরকার ছিল। কেবল দুটি মানুষে দীর্ঘদিন প্রেম চললে একসময় সেটি একঘেয়েমি ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।সুখালাপের মিষ্টি বিতরণের জন্য তখন কিছু বাজে লোকের দরকার হয়৷
বিনোদিনী আসার পর থেকে আশা-বিনোদ দুইজন অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠলো। সন্ধ্যে হলেই কেবল আশাকে মহীনের কাছে পাঠায়। এবাদে বিনোদ সারাদিন আশার মুখে মহীন-আশার অফু রন্ত সুখের আলাপ শোনে। শুনে হিংসায় জ্বলে কয়লা হয়৷ ওদের তুচ্ছতম কথাটিও সে শুনতে চায়, প্রশ্নের উপর প্রশ্ন করে। আশাও সরল মনে সেই সুখালাপের মিষ্টি বিলোয়।বিনোদ সেগুলো গোগ্রাসে গিলে যায়৷ হাসি মুখে সে সব হজম করে। এই হাসিটাই তার মুখোশ, এর আড়ালে বিনোদিনী লুকোয়। তার জেদ হয়, রাগ হয়।মনে মনে ভাবে, সব অবিচার মনে রাখা হবে, মোক্ষম প্রতিশোধ নিতে হবে।
আজ যে বিছানায় শুয়ে আশার মুখে প্রেমলীলা শুনতে হচ্ছ, একটুর জন্য তো এ তার নিজেরই হতে পারতো। এই বাড়িতে আজ সে কেবল একজন অতিথি। আজ এসেছে, কাল আবার চলে যেতে হবে৷
– এতো সুখের ঘরকন্না, এতো সোহাগের স্বামী! এ ঘরকে আমি রাজার রাজত্ব, এ স্বামীকে আমি পায়ের দাস করে রাখতে পারতাম। তখন কি ঘরের এই দশা থাকতো! আর আমার জায়গায় কীনা এই ননীর পুতুল!
বিনোদিনী আশার চুল বেঁধে, সুগন্ধি দিয়ে, পরিপাটি করে সাজিয়ে মহীনের ঘরে পাঠাতে লাগলো। যেনো আশার সাথে তার নিজের একটা অংশও মহীনের ঘরে অকপটে প্রবেশ করতে চায়। এ সাজ তো বিনোদিনীরই নিজস্ব, আশাকে ধার দিয়ে যেনো তা সুদে-আসলে উসুল করতে চায়।
কোনো কোনোদিন সন্ধ্যেয় বিনোদিনী আশাকে ছাড়তে চাইতো না, নানা ছলে তাকে দেরি করানোর চেষ্টা করতো। তখন মহীন একলা ঘরে ছটফট করতো। বিনোদ চায় মহীন একদিন আশার খোঁ জ নিতে আসুক, কিন্তু সে আসে না৷ উল্টো মহীন একদিন রাজলক্ষ্মীকে গিয়ে বিনোদিনীকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে বলে দেয়৷ তার কথা – পরের ঘরের বিধবাকে নিজের ঘাড়ে এনে ফেলার কোনো অর্থ নাই। কিন্তু রাজলক্ষ্মী তাতে বাঁধ সাধে, বলে, বিনোদিনী তো ঘরেরই মেয়ে। এ ঘরে সে মেয়ের মতই থাকবে।
মহীন এরপর আর কথা বাড়াতে পারে না।
আশা ব্যগ্র হয়ে বলে, ওগো, তুমি বালির উপর রাগ কোরো না। আমার তো আর বন্ধুকে আছে? এ বাড়িতে তুমি আর ও ছাড়া আমার প্রাণের কথা কওয়ার কেও নেই।
মহীন: আমি কি যথেষ্ট না? তোমার মোরেও দরকার ওরেও দরকার?
আশা: তোমারও তো বিহারীবাবু আছে। কই, আমার তো ওতে কোনো অসুবিধা হয় না। আমারই বন্ধু হলে দোষ!
মহীন: বন্ধু প্রেমে বাঁধ সাধলে দোষ বৈকি!
এভাবে মধুর দাম্পত্যকলহ চলতো। আশা ঠিক করলো বালির সাথে মহীনের আলাপ করিয়ে দিতে হবে। এরপর থেকে আর মহীন ওদের ভুল বুঝবে না। আশা জানতো, বিনোদিনীকে একবার দেখলেই মহীনের পছন্দ হবে।
এদিকে মহেন্দ্রের মনে বদলের হাওয়া বইছে। আগে তার যেসব উচ্ছৃঙ্খলতা ভালো লাগতো, এখন আর সেসবে কৌতুক বোধ হয় না। আশার সাংসারিক অপটুতায় ক্ষণে ক্ষণে বিরক্ত হয়, তবে প্রকাশ করে না। প্রেমের সুর যেনো কিছুটা তাল কেটেছে, কতক বেসুরো হয়েছে। এবার মহীনের নিজের দিকে খেয়াল হলো। বইপত্তরগুলো বাড়ির সম্ভব অসম্ভব বিভিন্ন জায়গা থেকে কতক উদ্ধার করা গেলো, চাপকান পায়জামা কয়টা ধুলো ঝেড়ে রোদে দেওয়া হলো।
ধীরে ধীরে আশাও বুঝতে পারছিল, কিছু একটা আর আগের মত নেই।সেও সম্ভবমত দূরে দূরে থাকতে লাগলো। এদিকে মহেন্দ্রের অবহেলা যত বাড়তে থাকলো আশা ততই বিনোদিনীর ন্যাওটা হতে থাকলো। বিনোদের চোখে কিছুই এড়াতো না, সে আশাকে দুহাতে বরণ করে নিলো। ভাবলো, ছিদ্র যখন পাওয়া গেছে, এবার তবে লক্ষ্মীন্দরের ঘরে প্রবেশ করা যাক।
মহীনের নিজেকে নিয়ে একটা সুক্ষ গর্ববোধ ছিলো। প্রেমের বিষয়ে যে সে বড় খাঁটি, এটিই মূলত তার গর্বের বিষয়।
আগে সে কেবল মায়ের অধিকার ক্ষুণ্ণ হবার ভয়ে বিয়ের প্রস্তাব কানে নিতো না। বিয়ের পরও সম্পর্কটা সে এমনভাবে রক্ষা করতে চাইতো যাতে অন্য নারীর প্রতি মনে কৌতুহল না জন্মে। এমনকি বিহারীর জায়গাতেও সে অন্য কাউকে প্রবেশ করতে দিতো না। এ নিয়ে বিহারী উসখুস করলে মহীন বলতো, তুমি পারো বিহারী, যেখানে যাও তোমার বন্ধুর অভাব হয়
না। কিন্তু আমি যাকে তাকে বন্ধু বলে টানাটানি করতে পারি না।
কিন্তু লোক দেখানো গুণাগুণ আর নিজের ভেতর থেকে আসা সিদ্ধান্তের ভেতর যে পার্থক্য আছে, একালের পুরুষমানুষ বুঝি সে খবর রাখে না।
এর মাঝে আশা মহীনকে ধরে পড়ে, তার বালির সাথে দেখা করা চাই। মহীন সে অনুরোধ এড়ানোর চেষ্টা করলেও মনে মনে বোঝে, এ কয়দিনে বিনোদকে নিয়ে তার কিছুটা হলেও আগ্রহ জন্মেছে। একবার দেখাই যাক কেমন আচার বিচার। কী দেখে আশাসহ সকলে তার এতো গুণ গায়।
তবে মুখে বলে, থাক চুনি, তোমার চোখের বালির সাথে দেখা করার অবসর কই৷ পড়ার সময় ডাক্তারির বই, প্রেমের সময় কবিতা-নভেল, আর প্রেমের সময় তুমি তো আমার আছোই। এর ভেতর আমার সময় কোথায়?
আশাও বাধা পেয়ে গোঁ ধরলো, এদের সাক্ষাত ঘটাতেই হবে। মহেন্দ্রও ভালোবাসার দৃঢ়তা প্রমান করতে এমন একটা ভাব করতো, যেন তাদের মাঝখানে সে বিনোদিনীকে সূচাগ্রও ছাড় দিতে চায় না। আশা মুখ গোমরা করে বসে পড়লো। তা দেখে মহেন্দ্র অবশেষে বিনোদিনীর সাথে দেখা করতে রাজি হলো।
আশা নাচতে নাচতে বিনোদিনীকে গিয়ে ধরলো, চলো ভাই বালি, উনি তোমার সাথে দেখা করতে চান।
বিনোদিনী বুঝলো এ তলব আশার কারণেই। সেও ঠিক করলো, ডাকমাত্রই ছুটে যাওয়া যাবে না। আগে মহেন্দ্রকে তার কাছে আসতে হবে, বিনোদকে চাইবার মত চাইতে হবে, দিনের পর দিন তপস্যা করে আগে দর্শন ভিক্ষা করতে হবে। তবেই বিনোদ ধরা দেবে। ঠিক আছে, মহেন্দ্রকে সে সময় দেওয়া হবে।
তাই বিনোদিনী কিছুতেই রাজি হলো না। আশার পূনরায় আশাভঙ্গ হলো।
মহেন্দ্র মনে মনে রাগ করলো, সে আর অন্যান্য পুরুষ কি এক হলো? অন্য কেউ হলে এতোদিনে নানা কৌশলে ঠিকই দেখা সাক্ষাত করতো। বিনোদিনী একবার দেখলেই বুঝবে মহীন কী জিনিস। নিজের চরিত্রের ঋজুতা নিয়ে ভাবতে মহেন্দ্রের বেশ ভালোই লাগলো। কিন্তু বিনোদিনীকে নিয়ে এত ভাবনার পেছনে কারণটা যে অমূলক, সে আর তার ঘটে খেললো না।
বিনোদিনীও দিনে দিনে অধৈর্য্য হয়ে উঠলো। সেও ভাবলো, একবার দেখা হলেই মহীন বুঝবে বিনোদিনীই যে তার যোগ্য জীবনসঙ্গী।
মহীনই একটা ফন্দি বের করলো। সে একটা ক্যামেরা জোগাড় করে বাড়ির সবার ছবি তুলতে উঠেপড়ে লাগলো। সেদিন আশাও বিনোদিনীকে ছবির জন্য টানাটানি করলো। বিনোদিনী অবশেষে ছবির জন্য হ্যাঁ বললো।
সেদিনই মহেন্দ্র আর বিনোদের পরিচয় হলো।
তবে মহীন যেমনটা ভেবেছিলো, এখন থেকে প্রায়ই সাথে বিভিন্ন ছুতায় দেখা হবে, সে আশার গুড়ে বালি। বিনোদিনী তার কাছেও ভেড়ে না, সহসা যাতায়াতের পথে দেখাও হয় না। বিনোদ কেবল আশাকে নিয়েই পড়ে থাকে, আশাও ঘুরেফিরে বিনোদের কাছেই ঠাঁই নেয়।
পাছে আশা ঠিক বোঝে, সে ভয়ে বিনোদকে নিয়ে কিছুজিজ্ঞেসও করা যায় না। বিরাট মুশকিল!
বিনোদিনী মহেন্দ্রের অস্থিরতা টের পেতো। তাই সে ইচ্ছে করেই দূরে থাকতো। তবে সবটা যে ইচ্ছে তা নয়, প্রতিশোধের দীর্ঘসূত্রতায় তার কিছুটা অনাগ্রহও জন্মে গেছিলো। সত্যি বলতে ও বাড়িতে তার ভালোই সময় কাটছিলো। সারাদিন ঘরকন্না, আশার সাথে খুনসুটি, সাথে রাজলক্ষ্মীর আদরে তার মূলত স্নেহের অভাববোধ মিটে গেছিলো। যদিও সে জানত এসবই ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু জীবনও তো ক্ষণস্থায়ী, তাই বলে কি বাঁচতে নেই?
যত দিন যায়, ততই তার আশাকে নিয়ে আগ্রহ বাড়ে। আশাকে কোন শাড়িতে বেশি মানায়, কোন রঙে বেশি সুন্দর দেখায়, এসব বিশ্লেষণে বিনোদ আনন্দ পেতে থাকলো। যেনো এ দারুণ এক পুতুলখেলা। আশাও নিত্য নতুন প্রসাধন লেবাশে নতুন হয়ে উঠতো, নিজেকে দেখে বালির ফ্যাশনসেন সকে বাহবা দিতো।
মহেন্দ্র প্রথম প্রথম আশার সাজগোজ নিয়ে আহ্লাদ করতে চাইতো, পরে গিয়ে বুঝলো তার এসবে আর মন লাগে না। আশাকে ভালো করে দেখাও হয়ে ওঠে না। যাকে দেখতে ইচ্ছে করে সে যখন আসে না তখন আর কাউকে দেখে কী লাভ। আশাকে তো আজীবন দেখবেই৷ আশা আজীবন থাকবে – এই চিন্তাটা মহেন্দ্রকে এমন নিশ্চিন্ত করে তুলেছিলো যে আশা ঘরের আসবাব নয়, একটা রক্তমাংসের মানুষ – সে কথা তার খেয়াল ছিলো না।
বিনোদ যখন জিজ্ঞেস করতো, কী লো বালি, মহীন কী বললো? তখন আশা মুখ কালো করে রাখতো। বিনোদ বুঝলো সর্বনাশের ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছে। সে আর লুকিয়ে রাখবে না বলে স্থির করলো।
আশা-মহীনের ছাইচাপা প্রেম তৃতীয় ব্যক্তির অবতারনায় জ্বলে উঠলো। আশা হাস্যালাপে বিশেষ পটুছিলো না, বড়দের মত কথার পিঠে কথা বলার অভ্যাসও তার ছিলো না। বিয়ের পরেই আশাকে নিয়ে মহীনের বাড়াবাড়ি পরষ্পরের কাছে নিজেকে নিঃশেষ করার উপক্রম করেছিলো। এমনি সময়ে বিনোদিনী যেন পানপাত্র ভরে সুধার রিফিল নিয়ে ওদের জীবনে এলো।
আশাও স্বামীর খোশমেজাজ দেখে আরাম পেতে লাগলো। সে এরপর থেকে সরল হৃদয়ে ওদের হাসিতে প্রাণ খুলে হাসতো। তাসখেলায় মহেন্দ্র আশাকে অন্যায় ফাঁকি দিলে আশা বিনোদিনীকে বিচারকের দায়িত্ব দিত।মহেন্দ্র আশাকে ঠাট্টা করলে আশা চাইতো বিনোদিনী যেনো তার হয়ে তাকে উপযুক্ত জবাব দেয়।
এভাবে তিনজনের সভা জমে উঠলো।
বিনোদিনীর কল্যাণে মহীনের অনিয়ম বন্ধ হল। সে নিজে গাড়ি
ডাকিয়ে মহীনকে কলেজে পাঠাতো। জলখাবার, জামাকাপড়, বইখাতা সব গুছিয়ে দিত। আমোদের লোভে কাজে ফাঁকি দেওয়া বিনোদিনী একবিন্দুও সহ্য করতো না। বিনোদের কড়া শাসনে মহেন্দ্রের অসময়ের আলস্য বাতিল হলো। মহেন্দ্র এরপর থেকে অপেক্ষা করতো কখন সন্ধ্যা নামবে, বিনোদিনীর সাথে দেখা হবে। এই অপেক্ষা বড় মধুর হয়ে ঠেকলো।
প্রথম প্রথম বিনোদিনী মহেন্দ্রের বিশৃঙ্খলা নিয়ে তার সামনে আশাকে উদ্দেশ্য করে হাসি তামাশা করতো৷ দেখতে দেখতে সে আশার হাত থেকে কর্তৃত্ব নিয়ে নিলো৷ ফলে ঘরের শ্রীও উত্তরোত্তর বেড়ে গেলো৷ আহারে, পোশাকে, আরামে, কাজে ও বিশ্রামে – মহেন্দ্র সবখানেই বিনোদিনীর ছোঁয়া অনুভব করতে থাকলো৷
বিনোদিনী আসায় বিহারীর আদর কমতে লাগলো৷ ও বাড়ি থেকে আর তার ডাক পড়ে না। সে নিজেই এক রোববার বাড়িতে আসবে জানিয়ে চিঠি দিলো৷ সেই চিঠির প্রতুত্তরে মহীন বললো, রোববার তার বিশেষ কাজ আছে৷ বিহারী তবুও কী যেন ভেবে বিকেলের দিকে বাড়িতে গেলো।মহীনকে বাড়িতেই পাওয়া গেলো।
মহীন অবস্থা বেগতিক দেখে বললো, বিহারী এমন সময় এলি! আমার যে বড় মাথা ধরেছে, তাই কোথাও গেলাম না। মহেন্দ্রের একথা শুনে আশা ব্যস্ত হয়ে বিনোদিনীকে খবর দিল৷ বিনোদিনী তখন বরফজল দেওয়া ওডিকলোন আর রুমাল এনে আশার হাতে ধরিয়ে দিল। মহীন বারবার না বলা সত্ত্বেও তার মানা কেউ শুনলো না। বিহারীর সামনে আশা কাঁপা হাতে রুমাল বাঁধতে বেগ পাচ্ছিলো, তখন বিনোদিনী তার হাত থেকে সে দায়ভারও তুলে নিলো। বিহারী এ সমস্ত নাটক দেখে ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো৷
মহীন ভাবলো, দেখুক শালা, আমার সুখ দেখুক। তোর ভাগ্যে তো একটাও জোটে না!
বিনোদিনী বিহারীর চোখে মুখে কৌতুক দেখে বুঝতে পারলো, একে ভোলানো সহজ নয়। কিছুই তার চোখ এড়ায় না।
বিহারী সমস্ত বুঝলো। সে উঠে পড়লো, বললো বন্ধুর সেবা তো বন্ধুকেই করতে হয়। যে মাথাব্যথা নিয়ে এসেছিলাম তাই নিয়ে বিদেয় হইগে। ওডিকলোনের বাজে খরচ করবেন না।
আশার দিকে তাকিয়ে বললো, বৌদি, জানেন তো, রোগ হবার আগে প্রতিষেধক নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
আশা কিছুই বুঝলো না৷
এ কয়দিন বিহারী পড়াশুনোয় ব্যস্ত ছিলো, এরই মধ্যে তিনজন মিলে এই রঙ্গ পাকিয়ে ফেলবে তার কিছুমাত্র ধারণা ছিল না। আজ সে বিনোদিনীকে ভালো করে একচোট দেখে নিলো, বিনোদিনীও তাকে দেখলো৷
বিহারী প্রথমেই বুঝেছিলো এ নারী জঙ্গলে ফেলে রাখার নয়। কিন্তু আগুন যেমন প্রদীপে বসে আলো দেয় তেমনি ঘরদোর পুড়িয়ে ছাই-ও করে দেয়৷
বিহারী গোটা রাস্তা ভাবলো, কী করা যায়। তার কি বন্ধুহিসেবে কোনো দায়িত্ব আছে? মহীন সংসারে লালবাত্তি জ্বালানোর যে সুব্যবস্থা করে রেখেছে – তার ভেতর কি নিজেকে এনে ফেলা ঠিক হবে? এ নোংরামিতে কি তার জড়ানো মানায়? উত্তর একটাই – না।
কিন্তু আশার জন্য বিহারীর মন কেমন করতে থাকে। বালিকার কোমল হৃদয়, ওতে কোনো প্যাঁচ খেলে না, সে দুজনকেই সরল মনে বিশ্বাস করে।তারই সাথে এত অবিচার কি ধম্মে সইবে? বিহারী ঘোর দ্বন্দে পড়ে যায়৷ পায়ে পায়ে পথ ফুরায়, তবু ভাবনা বাড়তে থাকে।
চিন্তার সুতো জড়িয়ে এমন জট পাকে যে সবটাই মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।
বিহারী একবার ভাবে, যা হবার হোক, আমি এসবে নেই। আবার আশার কথা ভেবে তার চোখ ভিজে যায়৷
বিহারীও যে সেদিন আশাকে কণ্যাসুন্দর আলোয় দেখেছিলো, তখন তো ধরেই নিয়েছিল, ইনিই আমার স্ত্রী। দেখার পর থেকেই মেয়েটাকে সে আপন ভাবতে শুরু করেছিলো।
বিয়েটা তো নিশ্চিতই ছিলো, মহীনদা যদি না …
বিহারী ঠিক করে এখন থেকে প্রায়ই ও বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে হবে।সে বেঁচে থাকতে চোখের সামনে আশাকে কষ্ট পেতে দেখতে পারবে না।
যেমনি ভাবা তেমনি কাজ৷ বিহারী এরপর থেকে কারু তোয়াক্কা না করেই ও বাড়িতে যাওয়া শুরু করে দিলো। তাকে দেখলেই মহীনের মুখ মলিন হত, কাষ্ঠহাসি দিয়ে যে কোনো রকমে ভদ্রতা রক্ষা করতো।
মহীন-বিনোদিনী ধীরে ধীরে বুঝলো, বিহারী সব পণ্ড করতেই তাদের জীবনে জুড়ে বসেছে। বাধা পেয়ে লুকোনো প্রেমে বুঝি আরো একটি মাত্রা যোগ হলো।
বিহারীর ভনিতা পছন্দ নয়। একদিন সে রাখঢাক ফেলে মহেন্দ্রকে বললো, মহীনদা নিজের সর্বনাশ করতে চাও করো, কিন্তু তোমার সাথে সাথে আরেক যে জন আছে, তাকে ঠকিও না৷ এখনো সময় আছে, বিনোদিনী যে তোমাকে আকৃ ষ্ট করেছে, তা দিনের আলোর মত স্পষ্ট।তোমার উপর আশার নেহাত অগাধ শ্রদ্ধা বিশ্বাস, সে কিছু দেখেও দেখে না। হয়তো সে ঠিক বোঝেও না, তাই বলে ওর এমন অসদ্ব্যবহার করো না।
বিহারীর কথায় মহীন ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলো। কেউ যেন তার সর্বাঙ্গে বিষ ঢেলে দিলো। এতোদিন বিনোদ আর মহেন্দ্রের ভেতর যা চলছিলো তাতে লুকোছুপির একটা আনন্দ ছিলো। টুকিটাকি চিঠির আদানপ্রদান, জামার বোতাম আটকানোর ছলে কাছে আসা, এসব খুচরো রোমান্টিসিজম তৃতীয় ব্যক্তির আড়ালে রহস্যাবৃত ছিলো। যখন সেই রহস্যকে দিনের আলোতে চোখে আঙুল দিয়ে সনাক্ত করা হল, তখন সে রোমান্সের আলাপ বড় বেখাপ্পা শোনালো।
মহীন নিজেকে সামলে বললো, বিনোদ নেহাত ভদ্রঘরের মেয়ে, তাকে নিয়ে এমন কটু মন্তব্য করা তোমার মোটেও উচিৎ হয়নি। আশা করি তুমি তোমার কথা ফিরিয়ে নেবে এবং মাফ চাইবে।
বিহারী সে কথায় কোনো ভ্রুক্ষেপ করলো না৷ মহেন্দ্র এ নিয়ে কলহ করতে গিয়েও থেমে গেলো। চোরের মায়ের বড়গলা বাগধারাটি কেবলি তার কানে বাজতে লাগলো।
রাতে আশা মহীনের কাছে বিহারীকে নিয়ে নানারকম নালিশ জানালো৷ অন্যান্যদিনের মতো মহীন সেসব হালকায় নিয়ে তামাশা করলো না, নিজেও বিহারীকে যোগ দিলো।
নিষিদ্ধ প্রেমের পথে বাল্যবন্ধুকে বিশাল এক কাঁটাগাছ মনে হতে লাগলো।
হাওয়া বদলের জন্য মহীন ঠিক করলো, সে আশা আর বিনোদ – তিনজন মিলে দমদমের বাগানবাড়িতে চড়ুইভাতি করতে যাবে। একথা জানামাত্র বিহারী নিজেকে ওদের সাথে সামিল করে ফেললো৷। কাটানোর উপায় নেই বুঝে মহীনও তাকে আসতে বলতে বাধ্য হলো। মহেন্দ্রের পিকনিকে যাওয়ার উৎসাহ ওখানেই মরে গেলো। তবু কথা যখন ঠিক হয়ে গেছে, এখন তো উপায় নেই।
নির্দিষ্ট দিনে সকলে দমদমের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
কোলকাতার ইটপাথর থেকে অবারিত সবুজের ভেতর ছাড়া পেয়ে আশা হরিণের মত চঞ্চল হয়ে উঠলো। বাগানে কতরকমের গাছ! শ’য়ে শ’য়ে শিউলী, রাঁধাচূড়া, হিজল, হাসনাহেনা, গাঁদা , গোলাপ, সূর্যমুখী, মাধবীলতা, কু ঞ্জলতা, কসমস – আরো কত নাম না জানা ফু লগাছ। আরো আছে আম, আতা, বরই, আমড়া, পেয়ারা, আঙুর, জাম, তাল -নারকেল, ঝাউগাছ, মেহগনি গাছ। গাছে গাছে বসন্তের পাখিদের আনন্দঘন কিচিরমিচির। দিনের বেলাতেও সেখানে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যায়। ওরা একটা বটগাছের নিচে মাদুর পেতে বসলো। ।
আশার চঞ্চলতা বিনোদিনীকেও স্পর্শ করলো।
সে বালিকে নিয়ে আঁচল ভরে ফু ল কু ড়ালো, ঢিল দিয়ে আম পাড়লো, গাছ থেকে আতা ছিঁড়ে জড়ো করলো। দুই সখীতে সদ্য বোঁটা ছেঁড়া ফল খেতে খেতে দিঘীতে নেমে স্নান সেরে নিলো। ওবেলা ওরা প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে রইলো।
স্নানের পর দুজন আবার গাছের নিচে এসে বসলো। মহেন্দ্র তখন শুকনো মুখে বিলাতি দোকানের বিজ্ঞাপন পড়তে ব্যস্ত৷ বিনোদিনী শুধালো, বিহারীবাবু কোথায়?
– সে হারায় নাই, কেউ তারে চুরি করে নাই, তারে না খুঁজলেও পাওয়া যাবে।
এমন প্রতুত্তরে বিনোদিনীর আমোদ হলো। বিহারী না থাকলে মহেন্দ্র কী করতো সে কথা ভেবে নিজে নিজে একচোট হেসে নিলো৷ কিন্ত এই ভাবনায় কেবল জয়ের আনন্দটুকু ই ছিল, নইলে মনের আশ তো দীঘির জলেই মিটেছে। আজকের দিনটাকে সফল ঘোষনা করে বিনোদ শুকনো তোয়ালে দিয়ে চুল শুকোতে লাগলো।
এদিকে বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়, ভৃত্যরা কেউ এসে পৌঁছোয় না। ভাগ্যিস মহেন্দ্র শহর থেকে চাল, ডাল, সব্জি প্রভৃতি নিয়ে এসেছিলো৷ তাই দিয়ে দুপুরের খাবার রান্না হলো।আশা-বিনোদ যতক্ষণ ফু র্তি করতে ব্যস্ত ছিলো, ততক্ষণে বিহারী রান্নাবান্না শেষ করেছে। মহেন্দ্র অবশ্য বিহারীর কোনো কাজেই হাত দিলো না৷ গাছের নিচে মুখ কালো করে বসে থাকলো৷
আশা রাশিকৃত ফুল দিয়ে মালা গাঁথলো, তা দিয়ে হার বানালো, সে মালা বালিকে পরালো। আরেকটি মালা বানিয়ে সে নিজে পরলো। বিনোদ হেসে বললো, কীগো ঠাকু রপো, তোমার বঁধু যে আমার সাথে মালাবদল করলো। এতে তোমার কী ভাব?
অন্যদিন হলে মহেন্দ্রের রসিক প্রত্যুত্তরে কথাটা মিলিয়ে যেতো। কিন্তু আজ তার দিনটাই মন্দ। সে কতকটা না শুনে, কতকটা হেসে আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। তার দৃষ্টি কেবলি বিনোদের ভেজা থানের ভাজে ন্যস্ত হতে চায়। মহেন্দ্র না শুনলেও আশা ঠিকই এ কথা শুনে লজ্জা পেলো।মহেন্দ্রকেও যে মালা দেওয়া যায়, এ কথা তার মাথাতেই আসেনি। বোধহয় জাগতিক কোমল সবকিছুর মাঝে সে তার বালিকেই রাখতে চায়। যদিও বালি পরিস্থিতি চাইলে কঠোর হয়, কিন্তু আশার বেলায় সে বরাবরই কোমল। আশা আবার বাক্স থেকে সুঁই সুতো বের করে আরেকটা মালা গেঁথে মহেন্দ্রকে দিলো। বিনোদ উঠে গিয়ে বিহারীবাবুর সাথে খাবার পরিবেশনে লেগে পড়লো।
আশার মালাটা নিয়ে মহেন্দ্র কিছুক্ষণ হাতবদল করলো। আশার খেয়াল হলো, তার সারাদিন মহেন্দ্রের সাথে ভালো করে কথা হয়নি৷ আগের সেসব দিন হলে এ দুজনকে আলাদা করাই শক্ত ছিলো। কিন্তু এখন আশা যেন মহেন্দ্রের চোখে অদৃশ্য। সে ঠিক করলো মহেন্দ্র না এলে সে নিজেই গায়ে পড়ে কথা বলবে। শত হোক, স্বামী তো। কতক্ষণই আশাকে উপেক্ষা করবে? সে প্রবল উৎসাহে মহেন্দ্রকে বালির সাথে সেদিনের সকল ঘটনা একে একে বলতে লাগলো। আশার এমন উচ্ছাসেও মহেন্দ্র হ্যাঁ হুঁ ছাড়া বিশেষ একটা জবাব দিতে পারলো না৷
আশার মনে হলো সে একটা দেয়ালের সাথে কথপোকথন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে৷ লক্ষ্য করলো মহেন্দ্র অন্যমনস্ক হয়ে মালা থেকে একটা একটাকরে ফুল ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছে।
আশা বিনোদের সাথে থেকে এতক্ষণ যে উল্লাসে মেতেছিলো, তারপর থেকে তাকে কী যেন একটা নেশায় পেয়ে বসলো। সে ঠিক করলো মহেন্দ্রর জন্য যে তার নিজের দিনটা নষ্ট হতে দেবে না। স্বামীকে গ্রাহ্য না করে সে আবার বিনোদিনীকে নিয়ে পড়লো। আহার শেষে মহীন বাড়ির ভেতর দরজা এঁটে বিশ্রাম নিতে গেলো। আশা ইচ্ছে করেই তাকে এড়িয়ে গেলো।বিহারী কী করবে ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হয়ে গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়লো৷
বাকি রইলো বিনোদিনী আর আশা।
এতোদিন ঘরের ভেতর যেনো কিছু একটার আড়াল ছিলো, একটা আবরণের ভেতর ওরা বন্দি ছিলো। আজ খোলা প্রাঙ্গনে ঘন সবুজের মাঝে এ দুই নারী যেন স্বাধীনতার স্বাদ পেলো৷ বাগান থেকে কিছু দূরেই একটা ঘাসের মাঠ, সে মাঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘাসের ফাঁকে ছোটো ছোটো কাশফুল।সে মাঠের ভেতর তারা দৌঁড়ে বেড়ালো। গলা ছেড়ে চিৎকার করলো। সুখ যেন আর বাঁধ মানে না৷
দৌঁড়ুতে দৌঁড়ুতে একবার ডানে যায়, একবার বামে যায়। আশা হঠাৎ দেখে বিনোদিনী ঘাসের উপর ধুপ করে পড়ে গেলো। পড়লো তো পড়লোই, তার আর কোনো নড়াচড়া নেই। এ দেখে আশা ভয় পেয়ে তার কাছে গেলো৷ বিনোদিনীকে বারবার ডাকলো কিন্তু তার কোনো সাড়াই নেই৷ আশা আতঙ্কে নীল হয়ে কাঁদতে শুরু করলো। তবু সাড়া পেলো না৷ কান্নার রোল আরো বেড়ে গেলো৷ যক্ষুনি সে মহীনদের ডাকতে উঠতে যাবে তখনি বিনোদিনী চোখ খুললো৷ এরপর তার সে কী যে হাসি৷ হাসতে হাসতে বিনোদের চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গেলো৷ আশা হতভম্ব হয়ে বসে রইলো৷ মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হলো না।
বিনোদিনী বুঝলো এই রসিকতা আশার পক্ষে বেশ রুঢ় ঠেকেছে।এই মেয়ে তাকে বোকার মত ভালোবাসে৷ বোকা মেয়ে, গাধা মেয়ে! বিনোদিনী তার জীবনে এতো বেশি ভালোবাসা পায়নি যে কেউ তা দিলে সে তা ফিরিয়ে দেবে। আশার মুখ আর অশ্রুভেজা গাল দেখে তার বুকের ভেতরটা মুচড়ে গেলো। বোকা মেয়ে, গাধা মেয়ে! চারপাশে কী হয় সে কিছু জানেই না৷ ঠিকই আছে, একটা মানুষ এতো বোকা হবেই বা কেনো? সোহাগের জিনিস পাহারায় রাখবে না কেনো? কেনো মানুষকে যেমনি দেখতে তেমনি বিশ্বাস করবে? লোকের কিসের এতো ঠ্যাকা যে সবাই তার প্রতি সুবিচার করবে? বিনোদিনী তো দয়া পায়নি।
সে তো বলেনি আমাকে নিয়ে ছেলেখেলা করো? বিয়েটা যখন হলোই, সে তো ঠিকই সংসারে মন দিতে চেয়েছিলো। সেখান থেকেও তাকে ছিটকে এনে বারাসাতের অরণ্যে নির্বাসন দেওয়া হলো৷ এর আগ অবধি জীবনে কেবল অর্থ সংকট ছিলো। বৈধব্যের পর তার জীবন থেকে শেষ রংটুকু ও মুছে গেলো। তার তো কোনো দোষ ছিলো না। সে তো এ জীবন বেছে নিতে চায়নি। তার সাথে এ জীবনে কেবল একচেটিয়া অবিচার হয়েছে। আশা কেনো বাকি যাবে? সেও কষ্ট পাক, প্রতারিত হোক, দুঃখের সাথে পরিচিত হোক।
কিন্তু অন্যান্য দিনের মত আজ তার আশার প্রতি অবিচার করতে গায়ে বাঁধলো। আশার সারল্যে সে যেন নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলো।আশার ভেতরে একটা সহজাত সাবলিলতা আছে, বিনোদ যে সারল্যকে পেতলের সিন্দুকে ভরে চাবি হারিয়ে বসেছে।
আশা: তুমি আর কখনো আমার সাথে ছলনা করবে না।অন্তত আমার সাথে কখনো না। খবরদার বলে দিচ্ছি।
আশাকে এতোদিন বিনোদিনী মাছের কাঁটার মতই মনে করে এসেছে।মাছ খেতে যেমন কাঁটা সরানো অনিবার্য, তেমনি বালিকেও। বালি হলো এক নিপাট নিরীহ মাছের কাঁটা। সেও যে কোনোদিন এই গলায় কথা বলবে, তার জন্য বিনোদিনী প্রস্তুত ছিলো না। হারানোর ভয়ই বুঝি আজ আশাকে এত সাহস দিয়েছে। আদরের দাবি নিজে থেকেই অধিকার চেয়ে বসেছে।
আর কখনো আমার সাথে ছলনা করবে না। খবরদার!
এই আবদারটা বিনোদের খুব রাখতে ইচ্ছে করলো।
পরিবেশটা হেসে হালকা করতে বললো, আমার কী আর তোর মত ভাগ্য বালি? আমি তো মরলেই বাঁচি।
অন্য সময় হলে আশা কটমট করে তাকিয়ে ভেতর ভেতর জ্বলতো, কারণ এসমস্ত কথায় সে অপ্রস্তুত হয়, তা দেখে বিনোদ একগাল হেসে নেয়৷ আজ আশা গম্ভীর হয়ে থাকলো, ততক্ষণে তার গাল শুকিয়ে গেছে, আসার পরে মুখে যে চকমকি ছিলো সেটি নিভে গেছে৷ আশা ধীরে ধীরে উঠে হাঁটা দিলো।
বিনোদিনী হতবাক, আশার হলো কী! সে ডাকলো, কোনো সাড়া নেই, আশা হাঁটছে তো হাঁটছেই। আজব বিপদ হলো!
– কিরে ভাই দাঁড়া! এই বলে সে আশার পিছুপিছু হাত ধরে ফেললো।
– তুমি আগে আমায় কথা দাও যে আর এমন করবে না। নইলে কিন্তু আমাদের আর কোনো কথা নেই।
ছেলেবেলায় মেয়েটার বাবা মারা গেছে বলেই হয়তো মৃত্যু জিনিসটাকে আশা আর দশজনের মত সহজে নিতে পারে না। বিনোদেরও তো বাপ মরেছে, তবে সে বয়েসে বিনোদের বোঝার ক্ষমতা তৈরি হয়েছিলো। এই মেয়ে তো এখনো খুকি! নাহ, ভুল হয়ে গেছে।
– মাফ করো ভাই বালি, আর এমন কোনোদিন করবো না।
– সত্যি?
– সত্যি।
– তিন সত্যি?
– সত্যি, সত্যি, সত্যি!
আশা বিনোদিনীর গলা জড়িয়ে ধরলো।
– আচ্ছা ভাই বালি, আমি মরলে তুই কী করতি?
বিনোদ আলিঙ্গনেই টের পেলো আশা এই কথা শুনে আবার যেন সতর্ক হয়ে উঠেছে।
– বাজে কথা বলে তোমার কী মজা হয়?
– আমাকে এতো ভালোবাসিস কেন? আমি তো বেশিদিন বাঁচতে চাই না।
বিনোদিনী দুর্বলতা নিয়ে পরিহাস করতে অভ্যস্ত। কারু সামনে অন্তত নিজের দুর্বলতা নিয়ে সে দুঃখ করে না। তবু আজ চোখে জল আসে কেন, কন্ঠ কেন ভারি হয়?
– তোমার আমরা আছি, মা আছেন, উনি আছেন। আর কী চাই বলো? এখন তো বিধবা বিবাহও চালু হয়েছে। যদি তুমি রাজি হও তবে…
– আমার আর বিয়েতে কাজ নেই।
– তুমি তো একালকার মেয়ে৷ সে তুমিই যদি পিছিয়ে থাকতে চাও তবে আমরা কী বলতে পারি?
বিনোদিনী একমুহুর্তের জন্য ভুলে গেলো যে সে আশার সংসার তছনছ করতে এসেছিলো। সে তার মনে যা আসে তাই বলা শুরু করলো।
– আসলে বালি, আমার কোনোকালেই বিয়ে করার ইচ্ছে ছিলো না।কোথাও মাথা গোঁ জা যাবে, মা কন্যাদায় থেকে মুক্তি পাবে, এই কারণেই বিয়ে করা। নইলে পুরুষমানুষের প্রতি বরাবরই আমার অরুচি।
– এ তোমার অভিমানের কথা বালি। কেন, সব পুরুষ তো এক হয় না।এই যে দেখো, আমার উনি কত ভালো।
এই কথায় বিনোদিনী হেসে ফেললো৷ আশা তা দেখে ঠোঁট ফোলালো।
– এতোই যখন ভালো, তবে তুই তার সাথে না গিয়ে আমার সাথে কেন?
আশা কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলে আবার বন্ধ করে ফেলে। তার মনে হল, তবে কি ওনাকে বাদ দিয়ে বালির সাথে ঘোরার জন্য উনি রাগ করবেন? আবার ভাবলো, আজকের দিনটা ভীষণ সুন্দর। কে রাগ করলো কে মান করলো আমার এসব দেখবার ফু রসত নেই। আশার কি কোনো আশা থাকতে নেই! এমন তো না সে চেষ্টা করেনি। নাহ, রাগ করবেন না উনি। রাগ করলে সেটা যৌক্তিক হবে না।
আশা: যাও তো তোমার খালি বাজে বকাবকি।
বিনোদ: বিকেল নেবে গেলো বালি। আরেকবার দীঘির পাড়টা ঘুরে আসি, কী বলিস?
আশা: হ্যাঁ চলো।
বিনোদ আশার হাত ধরে হাঁটতে শুরু করলো। দুজন এমনি চলতে লাগলো যেন কিছুই হয়নি৷ উষ্ণ বিকেলের তেজ কমে এলো, দীঘির পাড়ে জামগাছের ডালে কোকিলের মুহুর্মুহু ডাক শোনা যেতে লাগলো।
এটা সেটা নিয়ে কথা বলতে বলতে সন্ধ্যাও নেমে এলো। বিকেলের সে কান্নাকাটি বসন্তের বাতাসে উড়ে দিঘীর জলে মিশলো, নাকি মাঠে প্রান্তরে হারিয়ে গেলো, কে তার খবর রাখে?
বিহারীর ডাকে ওদের হুঁশ হলো,
বিহারী: রাতটা কি এখানেই কাটাবেন বৌঠান?
বিনোদ: এই যাহ! বালি, বেলা গড়িয়ে কোথায় গেলো বল তো?
দুজন ঘাট থেকে উঠে ঝটপট হাঁটতে আরম্ভ করলো।
আশা: আরেকটুসন্ধ্যা করে ফিরলে কী বিশেষ ক্ষতি হয়?
বিহারী: শেষকালে মাতাল গোরার হাতে পড়তে হবে। কী দরকার?
বিনোদিনী: ঠাকুরপো, বাক্সপ্যাট্রা গোছানো আছে না?
বিহারী: হ্যাঁ তা আছে, তক্ষুনি গুছিয়ে রেখেছি।
ওরা গাছের নিচ অবধি আসতে আসতে মহীনও বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। সে ঘরে যেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভেঙে দেখে অন্ধকার নেমে গেছে। মহীন মনে মনে ভাবলো, শালার দিনটাই মাটি!
গাড়িতে করে জোছনা ছড়ানো পথে সারি সারি বৃক্ষের ভেতর দিয়ে তারা বাড়ি ফিরে গেলো।
বাগান থেকে ফেরার পর মহেন্দ্রের যেন কিছুই ভালো লাগে না।
বিনোদিনী কাছেও ডাকে আবার পাশেও বসে না। সে ঠিকই প্রেম দেখায়, কিন্তু তার কাছে প্রেম দাবি করা যায় না। সে অধিকার মহেন্দ্রের নেই।থাকবে কেমন করে, আশা থাকতে মহেন্দ্র কীভাবে নির্দ্বিধায় যা খুশি তাই করে? কিন্তু সে তো সারাজীবন যা চেয়েছে তখন তাই পেয়েছে। তার তর সয় না। মাঝেমাঝে মনে হয় ভুল হয়েছে, অত্যন্ত পাপ হয়েছে বিনোদিনীর সাথে, যার প্রায়শ্চিত্ত তাকেই করতে হবে। সই, তাও সই, তবু বিনোদিনীকে চাই।এক মুহুর্তের জন্য হলেও চাই।
রাজলক্ষ্মী হঠাৎ অসুস্থ হলে বিনোদিনী আবার তার সেবায় মগ্ন হয়ে পড়ে। মহীনের দিকে খেয়াল রাখতে পারে না, কিছুটা আবার চায়ও না।আশাকে দেখতে দেখতে মহীনের আর ভালো লাগে না।
মহেন্দ্রের কাছে এখন কেবলি আশার নিত্য নতুন ভুল ধরা পড়ে। কেনো স্নানের পর জামা-পায়জামা তৈরি নাই – এ নিয়ে কথা শোনায়। কেন ফুলদানি থেকে শুকনো ফু ল ফেলা হয়নি, এ নিয়েও ভৎসনা করে। আশার ধারণা ছিলো না যে, ঘরের এসব কাজ অভ্যাস ও অভিজ্ঞতাসাপেক্ষ।ঘরে তবু দাসদাসী আছে। আশা নিজের অপারগতায় কুঁকড়ে যায়। মহেন্দ্র দিনরাত বিনোদিনীর তুলনা দিয়ে আশাকে ধিক্কার দেয়, সেও বিনা বিদ্বেষে তা গ্রহণ করে।
আশা শুধু কোথাও একটু আশ্রয় চায়। এই সংসারের কোথাও সে একটুকু শ্বাস নিতে চায়। সে বুঝতে পারে, যেন তার চারদিকের পৃথিবী ভেঙেচুরে যাচ্ছে। কেমন করেই এককালে তার কপালে এত সুখ এসে জুটেছিলো, কেমন করেই সেই সুখ হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে, সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না। কী করলে এর প্রতিকার হবে, তাও সে জানে না। তার কেবল থেকে থেকে গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছে হয় কেউ বলুক, সব ঠিক হয়ে যাবে। মিথ্যে হলেও বলুক।
বিনোদিনীক্ ইদানীং বেশি একটা দেখা যায় না। সে সারাদিন মায়ের ঘরে পড়ে থাকে। আশা আসতে চাইলে কোনো ছুতোয় ঘর থেকে বের করে দেয়। সেও যেন আশাকে এড়িয়ে যাচ্ছে।
মনে হয় এ সংসারে সবাই আশাকে ত্যাগ করলো। তার আর যাবার জায়গা নেই।
এদিকে কখন বিনোদের কৃপা হবে, কখন সে দেখা দেবে, কখন দুটো কথা শুধোবে – মহীন তার জন্য চাতকের মত অপেক্ষা করে।
কিন্তু মহীনকে এখন বিনোদের বিরক্ত লাগে। এই লোক বিয়ের সময় আশাকে নিয়ে মাতলো, আবার কদিন যেতে না যেতেই বিনোদকে নিয়ে পড়লো। সে নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসে না, দিনদিন বিনোদের মহেন্দ্রের প্রতি ঘৃণা জন্মাতে থাকে।
বাগান থেকে ফেরার পর বিনোদিনীর মধ্যে একটা অদ্ভুত বদল হয়।সে নীরবে নিজেকে নীরিক্ষণ করতে আরম্ভ করে। এখন তো তার হাতের মুঠোয় সব, তবুও যেন হাতটা ভারী খালি খালি লাগে।
নিজেকে এমন এক ভূমিকায় কখনো দেখতে হবে ভাবেনি। কিন্তু তারও তো হারানোর কিছুই নেই। বরং অনেক কিছু পাওয়ার আছে। আর তা পেতে মহীনকে হাতে রাখা প্রয়োজন।
কিন্তু মহীনকে যে তার এখন সহ্যই হয় না! বিনোদের নিজেকেও সহ্য হয় না, মন কোথায় যেন ঘুরে বেড়ায়। যাকে ঠকিয়ে বিনোদের এত ফন্দি, তার ঘুঙুরের শব্দেই যেন সংকল্প টলে যাচ্ছে। চার পাঁচদিন হলো তার চুলের ঘ্রাণ নাকে আসে না। স্বামীসেবায় এতোই মগ্ন যে সখীকে মনে পড়ে না?
কী এমন স্বামী যে তার পথ পানে চেয়ে থাকতে হবে?
বিনোদ ইচ্ছে করলেই আশার কাছে যেতে পারে, কিন্তু যায় না। সে চায় আশা তার কাছে আসুক। আবার আশার আশেপাশে গেলে তার ভীষণ যন্ত্রণা হয়। মনে হয় আর বেশিক্ষণ থাকলে বুকটা ফেটে চারদিকে রক্তমাংসের দলা ছিটকে পড়বে। আশ্চর্য! এমন কেন হয়?
আশা বাঁচে নাকি মরে তাতে আমার কী! বিনোদ বুঝে ওঠে না। বোঝে না তাই দুরত্ব বজায় রাখতে চায়। কোনো সিদ্ধান্ত নেবার আগে সে নিজেকে বুঝে নিতে চায়। কিন্তু বোঝাটা বোধহয় এতও সহজ নয়। এদিকে একদিন দুদিন করে সময় বয়ে চলে যাচ্ছে।
মহীন বাহিরে-অন্দরে কোথাও শান্তি পায় না। কারণ সে কিছুতেই বিনোদের পাত্তা পাচ্ছে না, বিনোদকে চিঠি লিখলে তার জবাবও দিচ্ছে না। অবশেষে মহেন্দ্র অতিষ্ট হয়ে বাড়ি ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। কিছুদিন চোখের আড়ালে থাকলে হয়তো বিনোদ তার মর্ম বুঝবে।
এছাড়া আশার দিকে তাকালে ভেতর ভেতর একটা অপরাধবোধ তাড়া করে বেড়ায়। ওর চোখের দিকে তাকানো যায় না। এক একবার মহীনের ইচ্ছা হয় আশাকে জড়িয়ে ধরে। সে তাকে মাফ করুক, কারু কিছু জানতে হবে না। মহীন নিজেই সব ঠিক করে ফেলবে। আশাকে আবার রাণীর মত মাথায় করে রাখবে। বিনোদের সাথে প্রেমের শেষ চিহ্নটুকু ও সে মুছে ফেলবে। কিন্তু পরক্ষণেই বিনোদের তীব্র দৃষ্টি আর নিখুঁত মুখটা মনে পড়লে শরীরে কী যেন ভর করে। দুটো চোখ অন্ধ হয়ে যায়। এতো নেশা, এতো মুগ্ধতা, এই নারী কি জাদু জানে?
রাজলক্ষ্মী সবে কিছুটা সুস্থ হয়েছে। এমন সময় মহীন বাক্স গুছিয়ে মায়ের ঘরে গেলো। বললো, বাড়িতে থাকলে পড়াশুনোর অসুবিধা হয় বলে কলেজের কাছে বাসা নিয়েছি।
রাজলক্ষ্মী চাইতো না ছেলে বাইরে বাইরে থাকু ক। ঘর থাকতে বাহিরে কেন, ঘরে কি তার যত্ন হয় না? বউয়ের উপর রাজলক্ষ্মীর বিরক্তি বাড়ে, এই মেয়ে বরকে বশও করতে জানে না! ছেলেটা চলে যাচ্ছে শুনে তার শরীর যেন আবার খারাপ করতে লাগলো।
– কদিন থাকবি?
– যতদিন পরীক্ষা চলে, অন্তত সে কদিন থাকব।
– কবে শেষ পরীক্ষা?
মিথ্যা কথা বলা মহীনের স্বভাবে ছিল না। নিশিদিন বিনোদের চিন্তায় মাকে কী বলবে তা আগে থেকে গুছিয়ে নিতে ভুলে গেছে। আমতা আমতা করে আন্দাজে একটা সংখ্যা বলে কোনোমতে শাক দিয়ে মাছ ঢাকলো।
রাজলক্ষ্মী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আচ্ছা বাবা। ভালো করে পরীক্ষা দিস। বেরো তবে। দুগ্গা দুগ্গা।
মহেন্দ্র বিনোদিনীর দিকে শেষ একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উল্টোদিকে ফিরে বেরিয়ে গেলো।
মহেন্দ্র যাওয়ার পর থেকে বিনোদের ভেতর কেমন একটা চাঞ্চল্য বোধ হতে থাকে। মেরুদণ্ডের নিচে থেকে পিঠ হয়ে একটা স্রোত এসে মস্তিষ্কের সাথে মেশে। কী যেন কীসের জন্য মন টানে, মনের সাথে মনের কী যেন কথা হয়, কিছুই বিনোদের কাছে ধরা পড়ে না।
সে ঠিক করে, এবার আশার সাথে দেখা করা যায়। যে ভাবনা সেই কাজ। নিচ থেকে উপর তলা, একটি তলার ব্যবধান। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে বিনোদের মনে পড়লো, ধ্যেত, রোগীর শয্যাপাশ থেকে উঠে এই অবস্থাতেই বালির কাছে যাবো? এই ভেবে সে নিজের ঘরে ফিরে জামা ছাড়ে। নিজেকে আয়নায় দেখে।
কাপড় ছাড়তে ছাড়তে সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখে। নারীদেহ মাত্রই শিল্প। বিনোদের মনে হয়, দেবতারা খুব যত্ন করে নারীদের বানিয়েছেন। কেবল নারীদের তৈরির সময়েই তারা মুক্তহস্তে সুধা ঢেলেছেন।
বিনোদ আজ সাদা থান ফেলে একটা খয়েরী রঙের শাড়ি পরে। এই শাড়িটা তার বালিকাবেলার স্মৃতি। বাবা জন্মদিনে কিনে দিয়েছিলেন, এর কিছুদিন পরেই উনি চিরতরে বিদায় নেন। এতোগুলি বছর সে শাড়িটা পরেনি, পরতে পারেনি, কিন্তু আজ সে শাড়িটা পরবে। আজ বাড়িতে মহেন্দ্র নাই। আজ বিহারীও আসবে না। বিনোদ আজকে সাজবে। আজ মাসিমা বিছানা ছেড়ে উঠবেন না। আজই বিনোদ নিজস্ব রূপে অবতীর্ণ হবে। এই বেশে সে আশার সামনে যেয়ে দাঁড়াবে। আশা কি অবাক হবে? তা তো হবেই। খুশি হবে? হতেই হবে!
আচ্ছা, আশা আছে কেমন?
এইসব ভাবতে ভাবতে ঘোরের ভেতর বিনোদের সাজসজ্জা শেষ হলো।সে যত্ন করে চোখে কাজল পরলো। সামনের দুপাশ থেকে বেণী করে পেছনের চুলগুলো দিয়ে খোপা বাঁধলো। গলায় হার, হাতে ঝুনঝুনি, পায়ে নুপুর পরে নিজেকে আয়নায় আরেকবার দেখে নিলো। নিজেকে দেখে তার পুরোনো বিনোদের কথা মনে পড়লো। যখন জীবন সহজ, নির্মল ছিলো।
বিনোদ দোতলায় আশার ঘরে গেলো, গিয়ে দেখলো – আশা বিছানায় শুয়ে আছে, তার চারপাশে মহীনের নানা জিনিসপত্র ছড়ানো ছেটানো।মেয়েটা মহীনের একটা ছবি হাতে ধরে ঘুমিয়ে গেছে। আশার হাতে মহেন্দ্রের ছবি দেখে বিনোদের সর্বশরীর রাগে জ্বলে উঠলো৷ কিন্তু কেন? সে তো অন্যকে জ্বালিয়ে অভ্যস্ত, জ্বলার লোক তো সে কোনো কালে ছিলো না।আজ তার এ কেমন দশা! আর জ্বলতে যখন হচ্ছেই তখন, সে একলা কেন? আরেকজন কেন দিব্যি ঘুমোচ্ছে!
রুন-ঝুনঝুন চুড়ির শব্দে আশার তন্দ্রা ভেঙে গেলো। চোখ খুলে দেখলো, সামনে তার মা দুর্গা মুচকি হাসছেন। আরেকবার ভালো করে চেয়ে দেখে বুঝলো, আরে এ তো বালি। চোখের বালি।
এতোদিন দুজনই দুজনকে এড়িয়ে গেছে, আজ যেন সব অভিমান গলার কাছে এসে আটকে গেলো। আশা বিনোদের দিকে তাকিয়ে থাকলো, তার চোখে যত না বেশি মুগ্ধতা, তার চাইতে অনেক অনেক বেশি ব্যথা জমে আছে। অকস্মাৎ আশার মুখে কোনো কথাই সরলো না। বিনোদও বুঝি আশার মনের ভাব বুঝতে পারলো। সে কিছু না বলে তার পাশে শুয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। কেউ কোনো কথা বলছে না, কিন্তু এই নীরবতাই যেন তাদের হয়ে সকল কথোপকথন সেরে নিচ্ছে।
বিনোদের মুখ আশার মুখের উপর প্রবল আবেগে কাঁপতে লাগলো৷ হৃদপিণ্ডে এতো জোরে জোরে বাড়ি পড়তে থাকলো যে ভয় হলো, আশাও সে আওয়াজ শুনে ফেলে কিনা। নিচতলা থেকে মাসিমাও উপরে উঠে আসে নাকি!
মধ্যরাতের বাতাস জানলা গলে বিনোদের কপালের চুল উড়িয়ে আশার গালে এনে ঠেকালো৷ আশা এতোক্ষণ আরামে চোখ বন্ধ করে রেখেছিলো, সে এবার চোখ খুলে বিনোদের মুখের পানে চাইলো। বললো, কী ভারী সুন্দর লাগে তোকে, বালি। প্রথমে দুগ্গা ভেবেছিলুম।
বিনোদ আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। আশার কপালে চুমু খেলো, গালে চুমু খেলো। মুখে বললো, তোর কোথায় কষ্ট বালি? আমায় বল। তোর সব কষ্ট আমায় দে, আমি সব ঠিক করে দেবো। তোর ব্যথা আমায় দেখা, আমি সব ব্যথাও সারিয়ে নেবো। তোর এ দুঃখ আমি আর নিতে পারি না। মনটা থেকে থেকে বিষিয়ে যায়। চল কোথাও চলে যাই, এখানে আমার দম আটকে আসে।
বালির এ আচরণ তার চরিত্রের সাথে বড্ড বেমানান। আশা একটু অবাকই হলো। কিন্তু আজ রাতটা তো আর দশটা রাতের মতো না, ভিন্ন।নয়তো এ কয় মাসে আশার ভেতর ধীরে ধীরে কিছু একটার বদল হয়েছে, যার ফলে বিনোদের এমন আচরণও বিশেষ অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না। যেন সময়ের শুরু থেকেই এমন হয়ে এসেছে, যেন শেষ অবধি এমনটাই হওয়া চাই।
এই আদরের জন্যই হয়তো আশা এতদিন মানসিক দুর্ভিক্ষে ভুগছিলো।মহীনের স্তুপ করে রাখা কাপড় জামা, বইপত্র হাঁতড়ে মরিয়া হয়ে সে এই আশ্রয়টাই খুঁজে বেড়াচ্ছিলো।
বিনোদের ইচ্ছা হয় সে বালির কাছে সব অকপটে স্বীকার করে। এমন কথাও বলতে ইচ্ছে হয়, যা সে নিজেকেও বলেনি।
বিনোদিনী একটা ঢোঁক গিলে আবারো নিজেকে সামলায়।
– মহীন কোথায় গেলো?
মহীনের নাম শোনামাত্র আশা বর্ষার মেঘের মত ঝরঝর করে ঝরে পড়লো। বিনোদ তাকে নির্দ্বিধায় ঝরতে দিলো। সে জানে, একদিন আশার এই কান্নাও ফুরোবে। ব্যথার ষোলোকলা পূর্ণ হলেই আর পুরাতন বেদনা তাকে কাবু করতে পারবে না। সবকিছুরই একটা শেষ থাকে, এ ব্যথারাও একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মত যন্ত্রণা সয়েই
যন্ত্রণা তাড়াতে হয়।
আশার এই দশার জন্য বিনোদের যেটুকু ভূমিকা, তা সে কখনোই অস্বীকার করবে না। কিন্তু এও সত্যি, যদি কেউ আশার যোগ্য হয়ে থাকে, সে অন্তত মহীন নয়।
অন্তত মহীন কোনোদিনই আশার ভালোবাসার যোগ্য নয়। বিনোদের দোষ আছে ঠিকই কিন্তু তা মহীনের তুলনায় অন্তত কম। চোর তো চুরি করতে চাইবেই। অভাব আছে বলেই সে চোর। কিন্তু মহেন্দ্রের কীসের অভাব? সে যেভাবে বইয়ের পাতা ওল্টানোর মতো প্রেমিকা পালটালো, তা থেকে একটা কথা বেশ স্পষ্ট, আগে পরে হলেও বিনোদের সাথে সে একই কাজ করতো। বিনোদ না থাকলেও অন্য কারো সাথে জড়িয়ে পড়তো।আশার কপাল নেহাত মন্দ, যে তার স্বামী মহেন্দ্র। তার কপাল আরো মন্দ, কারণ তার একমাত্র সখীই কিনা তার সবচেয়ে বড় শত্রু। কিন্তু এই মেয়ের যে ভীষণ মালিহাতা, পরম শত্রুও তার সামনে আত্মসমর্পণ করতে চায়।আশাকে বুকে চেপে বিনোদেরও চোখে জল আসে।
বিনোদের কান্না টের পেয়ে আশা আবার মুখ তোলে, শুধায়, কাঁদিস কেন বালি?
– তুই তো স্বামীর সোহাগ পাসনি। সোহাগ হারানোর দুঃখ কী জানিস না।
এই কথা বলে আশা চুপ করে গেলো। ঝোঁকে র মাথায় সে কি তবে স্বামীর অমঙ্গল কামনা করে ফেললো? এই আশংকায় তার কান্নার রোল আরো বেড়ে গেলো।
বিনোদ কিচ্ছু বললো না। সে পরম মালিহাতায় বালির চুল নিয়ে খেলতে লাগলো।
বিনোদিনী ঠিক করলো, তার সাথে ঘটে যাওয়া অবিচারের ক্ষোভ সে একজন নিরাপরাধের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে না। এই বিষাক্ত চক্রের এখানেই সমাপ্তি হবে, বিনোদিনীর নিজের হাতেই তা শেষ হবে।
কিন্তু মহেন্দ্রের আয়ত্তে সে কিছুতেই বালিকে ছেড়ে যেতে পারবে না।মহেন্দ্র আজ বিনোদের প্রেমে পড়েছে, সে না থাকলে কাল আরেক কু হেলী জালে আটকা পড়বে৷ বিনোদ ছাড়া আশাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।বিনোদেরও প্রাণের মানুষ বলতে কেইবা আছে?
সে ঠিক করলো আশাকে সে রক্ষা করবে। কিন্তু আশাকে আগে তার সত্যিটা জানতে হবে। এরপর সে যে সিদ্ধান্ত নেবে তাই বিনোদ মাথা পেতে নেবে। বিনোদের নতুন করে আবার ভয় হতে লাগলো, আশাকে হারানোর ভয়। আশা যদি সবটা জেনে বিনোদের সাথে সম্পর্ক একেবারে ছিন্ন করে, যদি দূরে যেতেই হয়?
আশাহীন অরণ্যে বিনোদ একাকী কীভাবে বেঁচে থাকবে? নির্বাসনের সাথে বিনোদের সখ্য চিরদিনের। কিন্তু এ নির্বাসনে যদি আশার কাঁচা হাতে লেখা একটি মনের কথাও এসে না পৌঁছোয়? যদি আশা তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে?
সত্যি মিথ্যা যাই হোক সে আর ক’টাদিন পরেই বলা যাবে।তাড়া কিসের? মহেন্দ্র আসার আগে আগেই এ কাজটা সেরে নিতে হবে।
হাতে কদিন সময় আছে বিধায় বিনোদ কিছুটা স্বস্তির পেলো। মুহুর্তেই সে আবার নিজস্ব চর্ চায় ফেরত গেলো। সে বালিকে ওঠালো, চোখ মোছালো। ঐ লোকের জন্য একটি ফোঁটাও চোখের জল বাজে খরচ করা বোকামি। আশাকে অনেক বোকা বানানো হয়েছে, আর নয়। আশা আর অবলা থাকবে না। সেও নিজ তেজে দীপ্তিমান হবে৷
বিনোদ আশাকে রাতের আহার করিয়ে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে চুল বেঁধে দিলো। এরপর দুজন তাস খেলতে খেলতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলো টের পেলো না। তখন প্রায় ভোর হয়ে এসেছে।
সকালে বিহারী রাজলক্ষ্মীর খবর নিতে বাড়ি এলো। মূলত তার আসার অন্য আরেকটি উদ্দেশ্যও ছিলো। সে আজ আশাকে মহীনের ব্যাপারে সব বলতে এসেছিলো, বিনোদিনী সম্পর্কেও সাবধান করতে এসেছিলো।
রাজলক্ষ্মীর ঘর থেকে বেরিয়ে তাই প্রথমেই সে মহীনের ঘরের দিকে রওনা দিলো। গিয়ে দেখে দুই বৌঠান জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে আছে।বিনোদিনীর গায়ে গত রাতের সাজপোশাক এখনো রয়েছে।
বিহারী বিহ্বল হয়ে গেলো। কী করবে ভেবে পেলো না। আশাকে পরম শত্রুর বক্ষে এমন নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোতে দেখে মুখ থেকে একটা মাইলখানেক লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। এ দৃশ্যের সামনে বিহারীর নিজেকে বড্ড অপ্রাসঙ্গিক মনে হলো।
বিহারী ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। অপেক্ষা করতে লাগলো কখন এদের ঘুম ভাঙে, কখন আশা একলা হয়, কখন সে তাকে কথাগুলি বলার সুযোগ পায়। কথা শেষ না করে সে আজ এক চুলও নড়বে না।
বেলা দশটার দিকে এদের ঘুম ভাঙলো৷ আজ বিনোদের দিনটাই অনিয়মে শুরু হলো।
কিন্তু আশা বিয়ের পর থেকে অনিয়মকেই আদর জেনে অভ্যস্ত। তাই বিনোদও প্রবল আগ্রহে অনিয়ম করতে প্রলুব্ধ হয়েছিল। তবে রাতের আবেগ দিনের বেলায় কিছু্টা বুঝি ফিকে হয়৷ বিনোদ চট জলদি ঘরে ফিরেই স্নান সেরে আবারও গায়ে সাদা থান জড়িয়ে নিলো।
এই সুযোগে বিহারী আশাকে সব খুলে বললো। আশা কিছুতেই বিহারীর কথা বিশ্বাস করতে পারলো না। সে ভাবলো স্বামীর অনুপস্থিতিতে বিহারী বুঝি তাকে বিপথে টানতে বাড়ি বয়ে এসেছে। রাগে আশার গা রিরি করলো। বিহারী কথা শেষে হালকা মনে সেদিনকার মত বাড়ি ফিরে গেলো।
একটা ঝড়ের মত আশার উপর দিয়ে সব বয়ে গেলো। কারু সত্যি, কারু মিথ্যা, কারু করূণা, কারু ভালোবাসা।
আশা স্নান করলো, জলখাবার খেলো। কিন্তু মহেন্দ্রের কথা তাকে আর তেমন ভাবিয়ে তুললো না। বিহারীর উপর রাগ করতেও ভারী ক্লান্তি পেলো। আশার বারবার গত রাতের কথা মনে পড়তে থাকলো। বালির চোখে গতরাত সে যে দৃষ্টি দেখেছিলো, তা কেবলি স্নেহ কিংবা করূণার দৃষ্টি নয়। তবে কী দাঁড়ালো? অত রাতে সেজেগুজে বালি কেনই বা আশার কাছে এসেছিলো?
গতরাত অবধি আশা নিজের দুঃখে এমনই বুঁদ ছিলো যে কথাটা এতোক্ষণ ভাবা হয়নি। তবে এখন তার মনে হাজারটা প্রশ্ন জাগে। উত্তর একমাত্র বিনোদিনী দিতে পারে।
তবে উত্তরের জন্য আশা বিশেষ তাড়াও বোধ করলো না। আজ বাতাসটা কিছু শীতল, গত রাতটা নিয়ে আরেকটু রয়ে সয়ে ভাবা যাক। একে একে বিনোদিনীর সাথে তার সব স্মৃতি মনে পড়তে থাকলো। দমদমের সেই দীঘির পাড়, জলকেলি, এই ঘরেই কত দিনরাত বালির সাথে হাসিখেলায় কেটে গেছে। মহেন্দ্র তাকে ভোলার আগে এসব সুখের দিন আশা আর মহেন্দ্রর একান্ত নিজস্ব ছিল। ধীরে ধীরে মহেন্দ্রের জায়গায় বিনোদ কবে এসে জুড়ে বসেছে, বসে কী আমূল পরিবর্তন এনেছে – আশা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে এইসব ভাবতে লাগলো। মনে মনে সে বিনোদিনীর অপেক্ষা করছিলো। বাইরে থেকে আসা প্রতিটা শব্দে সে চমকে ওঠে, এই বুঝি এলো!
মহেন্দ্রের প্রেম সর্বগ্রাসী পদ্মার মত- ভেঙেচুরে নিঃশেষ করে দেয়।আবার বিনোদিনীর আদর যেন সৃষ্টিশীল, যেখানে তার ছোঁয়া লাগে সেখানেই তরুগুল্ম জন্মে।
বিনোদ আছে কথাটা জেনেই আশার এই সংসারটাকে একটু সহজ লাগে।
বিহারী যা বলে গেলো তার কতটুকু সত্যি? আশা নিজে যা বুঝেছে তার কতটুকু ই সত্যি? দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, বালি এখনো আসে না কেন? সে এলেই তো সব দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়।
বিনোদিনী বিহারীকে আশার ঘর থেকে বেরোতে দেখেই বুঝেছিলো কিছু একটা অঘটন ঘটেছে। সে আর বিলম্ব না করে ব্যাগ গুছিয়ে নির্বাসনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। যাবার আগে সে তিনটা চিঠি লেখে।
প্রথম চিঠিটা বিহারীর জন্য, দ্বিতীয়টা রাজলক্ষ্মী ও তৃতীয়টা আশার জন্য।
রাজলক্ষ্মীর চিঠিটা বেশ সংক্ষিপ্ত, না বলে চলে যাওয়ার জন্য বিনোদ মাফ চেয়েছে। এরপর মায়ের আশীর্বাদ চেয়েছে। শেষে মাকে প্রণাম ও বালিকে স্নেহ জানিয়ে চিঠি শেষ করেছে।
আশার চিঠিতে বিনোদ নিজের সব দোষ স্বীকার করে। লিখতে গিয়েই এই প্রথম সে উপলব্ধি করে, আশাকে সে ভালোবাসে। এই ভালোবাসা কেবল বোনে বোনে, কিংবা সখীতে সখীতে যে সখ্য – তেমনি না। সত্যি যখন লিখতে বসেছেই, তখন এটাই কেন গোপন থাকবে?
বিনোদিনী বিহারীর চিঠিতেও সে অকপটে সব স্বীকার করে। বিনোদ চলে যাচ্ছে, মহেন্দ্র আর কখনো তাকে দেখবে না। কী যেন মনে করে সে আশাকে ভালোবাসার কথাও চিঠিতে লেখে। লেখার পর তার নিজেকে খুব শক্তিশালী মনে হয়। হ্যাঁ এটাই বিনোদিনী, সে ভালোবাসে। ভালোবাসে, ভালোবাসে, ভালোবাসে। শব্দটা লিখতে লিখতে মুখে ক’বার উচ্চারণ করে নেয়। ভালোবাসি, ভালোবাসি। নিজেকে এখন সে বোঝে, সে তো কেবল ভালোবাসে।
মহেন্দ্র রগচটা লোক, বিহারী বিনোদের চিঠি পেয়েছে এ কথা শুনলে তিলকে তাল ভাবতে পারে। এই আশংকায় তাকে চিঠির কথা গোপন রাখতে অনুরোধ করে। বিনোদ জানে বিহারী আশার শুভাকাঙ্ক্ষী, সে হাতে ধরে আশার ক্ষতি হয় এমন কিছু করবে না। বিহারী বুদ্ধিমান ব্যক্তি, তার বিবেকের উপর ভরসা রাখা যায়। যদিও নারী হয়ে নারীর প্রেমের বিষয়টা জানাজানি হলে সে বিশাল কেলেঙ্কারির ব্যাপার। এত বড় ঘটনা বাঙালি পুরুষ গোপন রাখতে পারে কি না, সে নিয়ে কিছুটা দ্বন্দ্ব তো রয়েই যায়।কিন্তু এ প্রেম তো বিনোদের একলার, আশার তো সেথায় উপস্থিতি নেই।
বিহারী চিঠিটা পড়ে ভীষণ চমকায়। তার চোখে সেদিন ভোরে আশা আর বিনোদের ঘুমন্ত মুখ দুটি ভেসে ওঠে। বিহারী অস্বীকার করতে পারে না, দুজনকে মানায় ভালো। কিন্তু আশাও কি বিনোদকে ওই চোখে দেখে?
বিহারী ভেবেচিন্তে মহেন্দ্রকে একটা চিঠি লিখে জানায়, বিনোদ নিরুদ্দেশ হয়েছে।
আশা বিনোদের চিঠি পেয়ে প্রথমত অবিশ্বাস করে। কিন্তু যত সময় যায় ততই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলতে শুরু হয়। গোটা ঘটনাটা যখন কেবল ভাবনায় ছিলো, তখন সেটি ফ্যান্টাসি মনে করে ভোলা সহজ ছিলো। কিন্তু হাতে লেখা অক্ষরে পড়ার সময় সব কেমন অদ্ভুত স্বপ্নের মতো লাগতে থাকলো। ভালো লাগতে থাকলো, মহেন্দ্রের প্রতারণা ছাপিয়ে বিনোদের প্রেমে যে সুখ, আশা সে সুখে গা ভাসিয়ে বেড়াতে লাগলো। সে বারবার চিঠিটা হাতে নেয়, পড়ে আবার রেখে দেয়, আবার পড়ে। মাঝেমধ্যে বাংলা কথা বুঝতেও বুঝি বেগ পেতে হয়। বিনোদ যা লিখেছে তাতে এক মুহুর্তে মহেন্দ্রের প্রতি যত রাগ ঘৃণা সব মলিন হয়েছে। ক্ষতটা তাজা, কিন্তু মলমটাও যে খাসা। বালি নিজ থেকে এসে ধরা দিয়েছে, সে কোথায় আছে তাও আশাকে জানিয়ে গেছে।
এত অগাধ বিশ্বাস, এই ভরসা আশা চাইলেই ভাঙতে পারে। চোখের বদলে চোখ তুলে নেওয়া যায়, কিন্তু না। এই চিঠি কারু হাতে পড়তে দেয়া যাবে না। এই চিঠি একান্তই আশা আর বিনোদের। কোনো তৃতীয় ব্যক্তি এ চিঠি কোনোদিন দেখবেনা। এ তাদের একান্ত ব্যক্তিগত। এতে শুধু আশার দাবি, আর কারু জায়গা নেই।
মহেন্দ্র খবর পেয়ে ফিরে আসে। সে এতোদিন পরীক্ষার পড়ায় মন দেবার অনেক চেষ্টা করেছে। বিনোদের খবর শুনে সে পাগলপ্রায় হয়ে বাড়ি ফিরে এলো। সবাইকে শুধালো বিনোদ কোথায় গেছে। আশাকেও জিজ্ঞেস করলো। আশা উত্তর দিলো, সে জানে না।
মহীন ভাবলো বুঝি বিহারীর কথায় কষ্ট পেয়ে সে চলে গেছে। সে বিহারীকে গিয়ে ধরলো,
– বিনোদিনী কোথায়?
– বোসো মহীনদা।
– আগে যা জিজ্ঞেস করেছি তার জবাব দাও।
– আমি জানি না।
– তুমি না জানলে আর কে জানে? আমার অনুপস্থিতিতে ও বাড়িতে গিয়ে তুমি কলকাঠি নাড়ো, ভাবো আমি কিছুই টের পাইনা?
– কী জেনেছো শুনি।
– তুমি বিনোদকে বশ করেছো! বলো সে কোথায়!
– যার মনে যা সে তো তাই ভাববে।
– মানে!
– আমি তোমাদের কথা জানি। বিনোদ যাবার আগে সব বলে গেছে।
– আর কে জানে?
মহেন্দ্রের চোখে গলায় একটা উগ্রতা ছিলো, যেন যেকোনো সময় বাঘের মত থাবা বসিয়ে দেবে। বিহারীর তাকে আর নিজের বন্ধু বলে ভাবতেও ইচ্ছে করলো না। নিরুত্তাপ দৃষ্টি মেলে জবাব দিলো, জানি না।
মহেন্দ্র দমে গেলো। বিহারী জানে, আশা কি জানে? মা কি জানে? বিহারীর ঘর থেকে বেরিয়ে সে বাড়ির পথে রওনা দিলো। বাড়িতে পৌঁছেই মায়ের ঘরে গিয়ে বসলো।
ছেলে আসায় রাজলক্ষ্মীর খুব ভালো লাগলো। কতদিন পর ছেলেটা বাড়ি ফিরেছে, শুধু তাই নয় – এসেই আগে তার কাছে গিয়েছে। মায়ের মন তো কতকিছুই চায়। তবু রাজলক্ষ্মী তো আর বলেননি আগের মত মাকে নিয়েই পড়ে থাকু ক। মহেন্দ্র দুই দিনে একবেলা খোঁ জ নিলে সেও তার জন্য ঢের। মাকে বুঝি ভুলেই গেছিলো মহেন্দ্র। আজ তবে তার মাকে মনে পড়লো, দুগ্গা বুঝি সহায় হয়েছেন। মা কতদিন ধরে অপেক্ষা করে আছেন ছেলে তার ভালোমন্দ দুটো কথা বলবে। ছেলেকে তিনি কবেই মাফ করে দিয়েছেন।
এর মাঝে খবর পেয়ে আশা নিচে নেমে এলো। মায়ের ঘরে গিয়ে মহীনকে বললো উপরে আসতে। বউ আগে কখনো এভাবে কর্তৃত্ব দেখায়নি।কিন্তু রাজলক্ষ্মীর মনে ব্যাপক খুশি। তিনি খুশিমনে ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন।
মহীন ঘরে ঢুকতে সাহস পাচ্ছিল না। তারই ঘর, তারই শয্যা, কিন্তু তবু মনে হয় যেন অনধিকার চর্ চা হচ্ছে। ভেতরে আশালতা, সে কি কিছু জানে? কতটুকু জানে? ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালো।
– কেমন ছিলে?
– আমার আবার থাকা। খাবারের যে ছিরি বাবারে।
– হুম্মমম্মম, বেশ দুঃখজনক।
– ঠিক
– বাড়িতে থাকলেই পারো। গিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে এসো না হয়। বা কাউকে দিয়ে আনিয়ে নাও।
– দেখি যা ভালো মনে হয় করবো।
– তা তো বটেই।
– আমি কিছুদিন জ্যাঠার কাছে গিয়ে থাকবো৷ বালি নেই, এখানে মন টেকে না।
– আচ্ছা যাও।
– বেশ।
জ্যাঠার বাড়ির নাম করে আশা আগে বিহারীর বাড়ি গেলো। বিহারীকে বললো, সে আর মহীনের সাথে থাকবে না। একটা সম্পর্ক টেকার জন্য দুটি মানুষের কমবেশি ইচ্ছে থাকতে হয়। মহেন্দ্র তো আগেই পর হয়েছে।আশাও এই নাটক দেখতে ইচ্ছুক না। সে মুক্তি চায়। কিন্তু তার যাবারও কোনো জায়গা নেই। জ্যাঠার বাড়িতে কদিনই বা থাকা চলে? একাকী থাকতে চাইলেও সেটাইবা কেমন করে হবে?
হিন্দুসমাজে তালাক দেয়ার রীতি নেই। তবে ইংরেজি শিক্ষার যুগে বাংলাতেও একটা বিপ্লব শুরু হতে চলেছে। কয়েক বছর হলো সমাজ সংস্কারের জের ধরে সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে, এটিও এখন সময়ের দাবী।
বিহারী বোঝে, আশা ঝোঁকে র মাথায় এ সিদ্ধান্ত নেয়নি। এ সমাজে মেয়েরা তালাকের কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারে না। তালাকপ্রাপ্ত নারীদের প্রতি পদে কটু কথা শুনতে হয়। সেখানে কিনা আশার মত একটা মেয়ে বাড়ি বয়ে এসে এই কথা বলছে। তার বলাতেও কোনো দ্বিধা বা জড়তা নেই। নিজের অনাগত ভবিষ্যতের ভাবনা আর অসুখী বাস্তবতা থেকে পরিত্রাণের ক্ষুধাই তাকে আজকের এ দিনে টেনে এনেছে।
বিহারীর ধারণা, আশার এই সিদ্ধান্ত হয়তো কেবল তার একার জন্য নয়। এই মেয়ে কেবল একার জন্য এতোবড় কাজ করবে মনে হয় না। সে রাখঢাক ফেলে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি এরপর বিনোদ বৈঠানের কাছে থাকতে চাও?
– জানি না। তবে থাকা যায়। ও তো আমায় রাখতেই চায়, রাখুকই না। কজনই বা রাখতে পারে?
বিহারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
– আমি বালির সঙ্গেই থাকবো ঠাকু রপো। তুমি হয়তো ভাবছো এ ঘোর অন্যায়, পাপাচার। কিন্তু একটাবার ভেবে দেখো, এই পাঁকে বিনোদের সত্যিটাই কেবল একরত্তি পদ্মফু ল। নইলে আর সব তো কবেই মাটি।
আশার মুখের দিকে চেয়ে বিহারী মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো।
– বৌঠান, যখন সব ঠিক করেই ফেলেছো, তবে আর দেরি করা ঠিক হবে না। তোমার ভয় নেই, যুদ্ধে তোমার পাশে এই অধমকে নিশ্চয়ই পাবে।
– উনি যাতে কোনো গোল না পাঁকাতে পারেন, তার একটা স্থায়ী বন্দবস্ত করতে হবে। তুমি দ্রুত তালাকের ব্যবস্থা করো।
– আমি দেখছি কী করা যায়। আগে তোমায় ও বাড়ি দিয়ে আসি চলো।
যাওয়ার পথে দুজন মিলে পরিকল্পনা করে পরের পদক্ষেপগুলোর নীলনকশা এঁকে নিলো।
বিহারী আশার জ্যাঠার কাছে মহেন্দ্রের সকল কু কর্মের কথা খুলে বললো৷ জ্যাঠাকে এও বললো, আশা মহীনের বিচ্ছেদ হলেই বিহারী আশাকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত।
আশার জ্যাঠা বৈষয়িক লোক, তার কাছে অর্থের চেয়ে দামী আর কিছু নেই। বিয়ের আগ অবধি আশাকে তিনিই এতদিন আশ্রয় ও ভরণপোষণ দিয়েছেন। ব্যবসার মত মেয়েটার প্রতিও তার মায়া জন্মে গেছে। প্রথমে এ প্রস্তাবে সম্মতি না দিলেও পরে ভাবলেন, পাত্র তো তৈরিই, এর সাথে বিয়ে হলে আশাকে ফেরতও নিতে হয় না, তার বিয়ের জন্য পণও গুনতে হয় না। হয়তো মন্দিরের ভেতর গোপনে গোপনে বিয়ে হয়ে যাবে। এতে বিশেষ পয়সাপাতিও খরচ হবে না।
মেয়েটার বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো এই সিদ্ধান্তেই মত দিতেন। অপূর্ব মেয়েটাকে বড্ড ভালোবাসতো। ভাইয়ের কথা ভেবে মনে বিষাদের সুর বেজে উঠলো। আশার করূণ মুখমন্ডল দেখে অনুকূলবাবুর ভীষণ মায়া হলো।
আশা বিহারী নিজেরা নিজেরা ভালোমন্দ কিছু করে ফেললে হয়তো একটা ঘোর গণ্ডগোল বাঁধতে পারতো। কিন্তু এই ঘোর দুর্দিনে সবার আগে তারা অনুকূ লবাবুকেই পুছতে এসেছে। আশা তার কূলের মান রেখেছে।তারও এই সম্মানের মর্যাদা রাখা উচিৎ। অনুকূ লবাবুর একটা হ্যাঁ-র ফলে যদি মেয়েটা সুখে থাকে, তবে তিনি কেনোইবা বাধা হয়ে দাঁড়াবেন?
অনুকূলবাবু সম্মতি দিলেন।
অবিলম্বে মহেন্দ্রের বাড়ি তালাকের কাগজ গেলো, মহেন্দ্র দেখলো কাগজে আশা আগেই সাক্ষর করে রেখেছে।
বিহারী আর আশার সম্বন্ধের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। মহেন্দ্র রাগে অপমানে কাঁপতে কাঁপতে অনুকূ লবাবুর বাড়ি গিয়ে পৌঁছুলো। তবে মহেন্দ্রের শত গর্জনেও কোনো কাজ হলো না। জ্যাঠামশাই কোনোমতেই আশার সাথে মহেন্দ্রের দেখা করালেন না। অবশেষে এই কেস কোর্টে উঠলো। দিকে দিকে খবর ছড়িয়ে পড়লো। আশা স্থানীয় পত্রপত্রিকার শিরোনাম হয়ে গেলো, স্বামীর ব্যভিচারের বিরুদ্ধে স্ত্রীকুলের বিদ্রোহ নিয়ে কলামের পর কলাম লেখা হলো, তার্কিকরা বৈঠক করে গলা শুকিয়ে ফেললেন। বাড়িতে টঙেতে চায়ের কাপে ঝড় উঠলো। এরূপে মহাসমারোহে আশা-মহেন্দ্রের বিবাহবিচ্ছেদ সম্পন্ন হলো। অনুকূ লবাবু ক্ষতিপূরণের অর্থ বুঝে নিয়ে আশাসমেত তা বিহারীবাবুর হাতে ন্যস্ত করলেন।
ক্লান্ত ক্ষান্ত মহেন্দ্র একূ ল ওকূ ল দুকূ ল হারিয়ে পরাজিত বেশে ঘরে ফিরলো। এদিকে শেষ বয়েসে অসম্মান ও লোকলজ্জার ভারে নত হয়ে রাজলক্ষ্মীর শরীর আরো খারাপ করতে লাগলো। একদিন তার কাছে বিহারীর একটা চিঠি এসে পৌঁছুলো। বিহারীও তো তারই আরেক ছেলে।বরং বলা চলে মহীনের তুলনায় বিহারীই মায়ের যোগ্য ছেলে। রাজলক্ষ্মী তা আজও অস্বীকার করতে পারলেন না। এদিকে তার যে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছে তাও তিনি টের পাচ্ছেন। এখন আর রাগ রেখে কী লাভ, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। বিহারীর সাথেও অন্যায় কম হয়নি, ধম্মের কল তো বাতাসে নড়বেই।
রাজলক্ষ্মী বিহারীকে ক্ষমা করে দিলেন। এর আগে তিনি বিভিন্ন সময় বিহারীর মুখে গরীব দুঃখীদের জন্য স্বল্পমূল্যে চিকিৎসালয় দেবার ইচ্ছার কথা শুনেছিলেন।
রাজলক্ষ্মী জমিদার পরিবারের মেয়ে, যাবার আগে রাজলক্ষ্মী
বিহারীর হাসপাতালের জন্য একটি গ্রাম দলিল করে দিয়ে গেলেন।বিহারীকে আশীর্বাদ করলেন, আশাকে কেবল মাফ করতে পারলেন না।রাজলক্ষ্মীর মতে মেয়ে হয়ে জন্মে যদি ত্যাগই না স্বীকার করতে পারে তবে তো তার নারীজন্মই বৃথা।
বিহারী মায়ের আশীর্বাদ গ্রহণ করলো। সেই গ্রামে আশাকে নিয়ে সেখানে একটা চিকিৎসালয় খুলে বিহারী রোগী দেখা শুরু করে দিলো।আশা চিঠি লিখে বিনোদিনীকেও সেখানে নিয়ে এলো৷ বিনোদ-আশা আবার এক হল। রোগীর সেবা শুশ্রূষার মাঝে বিনোদ-আশা যেন নিজেদের প্রকৃত স্বরুপ খুঁজে পেলো।
সকলে জানলো আশার সাথে বিহারীর বিয়ে হয়েছে।
আশা-বিনোদের সংসার লোকচক্ষুর অন্তরালে ফুলে ফলে ভরে উঠতে থাকলো। এ নিয়ে কোথাও দাঙ্গা হাঙ্গাম হলো না, পত্রিকায় সমপ্রেম বিষয়ক কোনো কলামও লেখা হলো না৷ হয়তো আরো একশত বছর পর এ বাংলায় সমপ্রেমের স্বীকৃতি মিলবে। না মিললেও তাতে আশা বিনোদের কিছু যায় আসে না। তারা একে অপরকে পেয়েছে, বিশ্ব মাঝে নিজেদের ঠাই খুঁজে পেয়েছে, সেবার মহান ব্রতে ব্রতী হয়েছে। তাদের ঠেকায় কার সাধ্যি!
বিঃ দ্রঃ হাসপাতাল থেকে কিছুটা দূরেই একটা বাড়ি তুলে বিনোদ-আশা আর বিহারী – তিনজন থাকতে শুরু করে। বাড়ির পেছনে ফাঁকা জায়গায় আশা বালির জন্য একটা বাগান করেছে। সে বাগান দমদমের মত ব্যাপক না হলেও সাধ্যের মধ্যে যতটুকু করা গেছে তা-ই দুজনের জন্য যথেষ্ট। দুটিতে মিলে নানারকম গাছপালা এনে বাগানটা প্রায় জঙ্গল বাঁধিয়ে ফেলেছে।
বিনোদ এই বাগানের নাম দেয় নন্দনকানন। কাজের অবসরে তারা এখানে এসে বসে। বিহারী ছাড়া আর কাউকে এখানে সহসা আসতে দেওয়া হয় না। আশাই চায় না বাইরের কেউ এখানে বেড়াতে আসুক। এটা ওদের নিজস্ব নিরাপদ জায়গা। এখানে ইচ্ছে হলেই বিনোদকে চুমু খাওয়া যায়।ইচ্ছে হলেই পরস্পরের গলা জড়িয়ে রাত গড়িয়ে ভোর বানিয়ে দেওয়া যায়।
আশার মনে হয়, নিজস্ব কিছু বিষয়ে ছাড় না দেওয়াই মঙ্গল।
ইদানীং বিহারীর এক বিলাতি মেডিকেল ছাত্রীর সাথে চিঠি চালাচালি চলছে। সে প্রায়ই খাতাকলম নিয়ে বাগানে চুরুট টানতে আসে। পাতার পর পাতা ভুল লিখে ছিঁড়ে ছিঁড়ে কাগজের স্তুপ জড়ো আবর্জনা বানিয়ে ফেলে।আশা স্নেহভরা অভিমানে তাকে ভৎসনা করে। বিনোদ তা দেখে কেবলি হাসে।
[সে বছর রবীবাবুর চোখের বালি নামক ধারাবাহিক উপন্যাসটি একটা গোটা বই হিসেবে প্রকাশিত হলো। আশার ররবীন্দ্রনাথের সব লেখাই পড়তে ভারী ভালো লাগে। বিনোদের আবার স্বভাব এমন – নানা পর্যালোচনা করে লেখার বিভিন্ন দোষ গুণ তার খুঁটিয়ে বের করা চাইই-চাই। বিনোদের কঠোর সমালোচনায় আশা কিছুটা দমে, তবে ওতে তার চাঞ্চল্য কমে না। উপন্যাসটা পড়ে আশা যেভাবে কান্নাকাটি শুরু করেছিলো, বিনোদিনী ভেবেছিলো কী না কী! সে নিজে বইটা পড়ার সময় নানা অসঙ্গতি চোখে পড়ে। সে ঠিক করে আশার জন্য এ উপন্যাসটা আবার নতুন করে লিখবে।
সেইটেই এত বছর পর ধুলো ঝেড়ে এখানে এনে ফেলা হলো। ]
প্রথম প্রকাশিত
আসর
বাংলাদেশের প্রথম ও ভিন্ন ঘরানার বহুমাত্রিক ক্যুইয়ার নারী সংকলন