একটি পাজামার আত্মকাহিনী 

লৌহ কপাট

উফফ, কি যে গরম! এজন্যই বোধ হয় লোকে বলে যে শীতকালে বিয়েশাদির অনুষ্ঠান রাখতে হয়। প্রত্যেকটা লোক দরদর করে ঘামছে। ছেলেদের গায়ে লেপটে গেছে সাদা পাঞ্জাবিগুলো। কেউ কেউ অবিরত উত্তরীয় দিয়ে ঘাম মুছে যাচ্ছে। বিচ্ছিরি গন্ধে ভরে উঠেছে হলুদের স্টেজের আশপাশটা। মেয়েরা এই গরমে অমন সাজ দিয়েছে কিভাবে কে জানে? এ সবের মাঝেই সবুজ বসে আছে লাজুক ভঙ্গিতে। আহা! আজ ওর গায়ে হলুদ! হলুদের মঞ্চের আশেপাশে অনেকে ভীড় করছে। একটুপরেই হলুদ দেয়া শুরু হবে। মু খ থেকে রুমাল সরিয়ে সবুজ হাত ঢুকালো পাঞ্জাবির পকেটে। কি খুঁজছে ও? নাকি চুলকাচ্ছে? এই গরম, ঘাম! কিছু একটা ঝামেলা যে হয়েছে তা সবুজের কপালের ভাঁজ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সবুজের এই বিশেষ দৃশ্য ধারণ করছে পাশে দাঁড়ানো লম্বা ছেলেটা? দেখতে বেশ কিউট। চুলগুলো এলোমেলো। নাম কি ছেলেটার? জানতে ইচ্ছে করছে। ছেলেটিও ঘেমেনেয়ে একাকার। এই শাওন, একটু শুনবে? একটা লম্বা ডাক ভেসে এলো। ছেলেটা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। ছেলেটার নাম তাহলে শাওন। সুন্দর নাম। শাওন এগিয়ে গেলো। চোখে কাজল ধ্যাবড়ানো একটা মেয়ের সাথে কথা বলছে শাওন। কাজলটা আসলে শাওনের চোখে বেশি মানাতো। কি সুন্দর টানা টানা মায়াভরা চোখ। একটা মেঘ মেঘ ভাব আসতো। এবার ভাদ্রতেও যা বৃষ্টি হচ্ছে। মানিয়ে যেত খু ব। আরে, এর মানে কী? এই! উফফ! কী এটা? কিছু একটা রাখা হয়েছে আমার ওপর। ঠিক আমার ওপর না। আমাকে ধারণ করে আছে যে প্লাস্টিকের ব্যাগটা, তার ওপর। কি ওজন রে বাবা! এক, দুই, তিন গুনতে গুনতে খেই হারিয়ে ফেলার আগেই সরিয়ে নেয়া হয় জিনিসটাকে। কেউ একজন হাতে করে নিয়ে এগিয়ে যায় স্টেজের দিকে। দেখে বুঝলাম ফুলের বাক্স, কিন্তু অত ওজন কেন, কে জানে? যাই হোক। ভীড় বাড়ছে। হলুদ দেয়া শুরু হয়ে গেছে। ঝকমারি টাইপের একটা হিন্দি গান বাজানো হচ্ছে। যাচ্ছেতাই অবস্থা। শাওনকে খুঁজি আমি, পাই না। আসলে স্টেজের সামনে এত ভীড় যে কাউকে ঠিক মত বোঝা যাচ্ছে না। এত শব্দ, এত মানুষ। এহহে! ফুলের বাক্স থেকে পানি গড়িয়ে পড়েছে প্লাস্টিকের ব্যাগটাতে। আমার গায়ে এসে লাগবে নাতো আবার? কিসের পানি? গাঁদা ফুল ছিল মনে হয়।এই ফুলটা দেখতে এতো উজ্জ্বল কিন্তু পঁচে গেলে একেবারে গবরের মত হয়। তবে সবচেয়ে পচা গন্ধ মরা রজনীগন্ধার। আমার অবশ্য এসব জানার কথা না। আমি শুনেছি মানুষকে বলতে। মানুষ অবশ্য কত কথাই তো বলে। সব কথা কি ঠিক হয়? ঠিক-বেঠিক বোঝার আগেই আবারো আমার চিন্তার ছন্দপতন ঘটল। আবারও সেই ফুলের বাক্স, আবারও সেই দুঃসহ চাপ! দয়া করে কেউ আমাকে বাঁচান। আমি মিনতি করে বলছি। কেউ শুনছেন? আমি গুনতে শুরু করি, এক, দুই, তিন! বাপরে! ২৯ এ গিয়ে রক্ষা হল। তুলে নেয়া হল ফুলের বাক্স। শাওনই তুলল। ছেলেটাকে কাছ থেকে দেখতে পেয়ে ভালো লাগছে। এখন কেমন যেন কঠিন, দুর্বিনীত একটা ভাব ফুটে উঠেছে চেহারায়। তবুও ভালো লাগছে। হাতের ক্যামেরাটা গলায় ঝুলিয়েছে সে। একটা সিগারেটও ধরিয়েছে। কপালে বেশ কটা ভাঁজ। কি ভাবছে ও? ফুলের বাক্স নিয়ে শাওন হেঁটে চলে যায়। একটু পর ফিরে আসে। সাথে একজন মহিলা, ফিকা ঘিয়া রঙের শাড়ি পরা। আমার দিকে তাকিয়ে চোখ কপালে তুলল মহিলাটি। ঝট করে হাত দিয়ে প্লাস্টিকের ব্যাগে লাগা পানিটুকু মুছে ফেলার চেষ্টা করল। তারপর যত্নে তুলে নিল আমায় হাতের তালুতে। আমি আরো কাছ থেকে শাওনকে দেখি। শাওনের চোখে পানি চিকচিক করছে। কেন? রাত বারোটা বাজে। আমি শুয়ে আছি একটা স্যুটকেসের ভেতরে। ওই ভদ্রমহিলায় এনে রেখেছে। কি ঠাসাঠাসি এখানে। আমার পাশেই মু খ ভচকে শুয়ে আছে একজ় োড়া নাগরা। কমদামি মনে হচ্ছে। আর আমার ওপর রাহুর মত চেপে আছে শেরওয়ানি নামের এইটা উৎকট বস্তু। কেন যে লোকে পরে এইসব! অদ্ভুত একটা গন্ধ বের হচ্ছে বস্তুটার গা দিয়ে। অনেক দিন ধরে বাক্সবন্দি ছিল নাকি? সত্যি কথা বলতে কি আমিও অনেকদিন বন্দি ছিলাম। কাপড়ের গাইটে। সাতদিন আগে বন্দিত্ব ঘুঁচলো আমার। সবুজ আর ওর বোন বিথি নিউমার্কেটের একটা দোকান থেকে কিনে আনলো আমাকে। ঠিক আমাকে না। ৬৫-৩৫ মাপের একটা পাজামার পিস, পাজামা বানানোর জন্য।

কি ধরণের পাজামা হবে তা নিয়ে ভাইবোনে কি তর্ক! বিথি বলে চুড়িদার আর সবুজ চায় সালোয়ার। সবুজ ছেলেটা এমনিতে নাদুসনুদুস হলেও মাথায় বুদ্ধি একটু কমই আছে। শেরওয়ানির সাথে ঢোলা সালোয়ার? দোকানের লোকজন ও হাসে ওর কথা শুনে। বিথির কথামতই বানাতে দেয়া হল চুড়িদার। তিনগজ কাপড় ব্যাগ এ ঝুলতে ঝুলতে চলে এলো দর্জির দোকানে। কেটেকুটে আমায় একটা রূপ দেয়া হল। আমি হয়ে উঠলাম কুঁচিওয়ালা চোস্ত পাজামা। আমার এই হয়ে ওঠার স্মৃতি কিন্তু খু ব একটা মধুর নয়। সে যাই হোক। পরে এক সময় না হয় বলা যাবে। আজ রাতে ঘুমিয়ে পড়ি। কে জানে কাল আবার কি কি দেখতে, শুনতে বা সহ্য করতে হবে! ঘু ম ভাঙল আমার সিগারেটের ধোঁয়াতে। পুরো রুমটা গন্ধে ভরে গেছে। এসিওয়ালা রূমের ভেতর কে সিগারেট খাচ্ছে? আমি হঠাৎ বুঝতে পারলাম আমার ওপরে কেউ নেই, শেরওয়ানিটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। স্যুটকেসটা খোলা। একই সাথে লক্ষ্য করলাম বেলকনির দরজাটাও খোলা, ফাঁকা দিয়ে ঝিরি ঝিরি বাতাস আসছে। ফিনফিনে পর্দাটি বাতাসে দোলা খাচ্ছে একেবারে নিরাসক্তভাবে। কারা ওখানে? আমি অপেক্ষা করতে থাকি। পর্দা সরিয়ে আরো কিছু বাতাস এসে ঢোকে ঘরের ভেতরে। বৃষ্টিভেজা বাতাস। কোথাও বৃষ্টি হয়েছে আজ। রাত কটা বাজে কে জানে! আমি আবার উৎসুক হয়ে উঠি। গুনতে শুরু করি! এক, দুই, তিন। পনেরতে গিয়ে শেষ হয় অপেক্ষার পালা। ঘরে ঢোকে সবুজ, হাতে প্রায় নিবুনিবু করছে সিগারেট, চোখে মুখে হলদে একটা আভার সাথে লেপ্টে আছে রাজ্যের ক্লান্তি। মাথার চুলে, লোমশ হাতের কব্জিতে, পড়নের পাঞ্জাবিতে গুড়ি গুড়ি হলুদ। ওর গা থেকে মিষ্টি একটা কোলনের ঘ্রাণ ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। একটু পরেই ঘরে ঢোকে যে তার নাম শাওন। সেই ক্যামেরাওয়ালা ছেলেটা। এবার আর তার সাথে ক্যামেরা নেই। মাথার চুল একেবারে উশকো-খু শকো। ঠোঁটের কোনে একটা হাসি লেগেছিল তা উধাও। চোখের দৃষ্টি স্থির, চোখের কোনে অবশ্য পানি চিকচিক করছে না। কেন খুলেছিস এটা? সব নাকি গোছানোই ছিল! শুধু শুধু ঝামেলা বাড়াচ্ছিস। সারাদিন খাটতে খাটতে মরলি— এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে সবুজ। শাওনের চোখ তখনো বন্ধ। আলমারির পাশে রকিং চেয়ারে গা এলিয়ে দোল খাচ্ছে সে। পাথর ফেটে যেন ঝরনা নামলো। গড়িয়ে পড়ছে চিকচিকে জল নিঃশব্দে। শাওন কাঁদছে? নাক টানার একটা শব্দ পাই আমি। কেমন যেন শব্দটা। ঘরের এসির একটা যান্ত্রিক গোঙ্গানি, রকিং চেয়ারের মর্মর, কিংবা বিরাজমান একটা নৈঃশব্দের চেয়েও ভিন্ন এই শব্দটা। সবুজের নাক থেকে আসে। ও কি কাঁদছে? আলমারির পাশে পর্দার পেছনে একটা আধখোলা জানালা। সবুজ ওটা বন্ধ করে দেয়। বন্ধ করে দেয় ব্যালকনির দরজাটাও। বৃষ্টিভেজা মিঠে হাওয়াটা আর পায়না জিনিসপত্তরে ঠাসা এই ঘরটা। পায়না শাওনের চোখ বেয়ে নেমে আসা বোবা অশ্রুগুলো। আমাকে জড়িয়ে থাকা প্লাস্টিকের ব্যাগটাও বঞ্চিত হয়। এভাবে কাঁদছিস কেন? আজব তো! শাওনের মাথার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ। আই এম সরি, বলে শাওন চোখ মোছে। হাসিমুখে তাকায় আবার খু ব চেনা বন্ধুটি -এ মুখের দিকে। তারপর আবার ও ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। সবুজের কোমর জড়িয়ে ধরে। পেটের কাছে মু খ ঘষে। আমি অবাক হই। এসব হচ্ছেটা কী? অদ্ভুত তো! আমি মানুষকেই বলতে শুনেছি মানবজন্ম নাকি বিস্ময়ে ভরপু র। পরতে পরতে বিস্ময়। তার কোনটা আনন্দের, কোনটা বেদনা বা বিরক্তের। আমাকে যে বানালো তার নাম ফরিদ। মাঝবয়েসি কাঁচাপাকা দাড়িওলা একটা লোক। ঠিক শিল্পী বলা যাবে না তবে লোকটা আসলেই ভাল কাজ জানে। একেবারে মাপে মাপে কেটেছিলো সে কাপড়। একটুও কমবেশি হয়নি। সেলাই করেছিল এক নম্বর হাতুড়িমার্কা সাদা সুতো দিয়ে। কোন এক অসাবধান মু হূর্তে ববিনে দেয়া তেলের দাগ লেগে গিয়েছিল আমার পায়ের কাছে। বিরাট একটা ভাঁজ পড়তে দেখেছি আমি ফরিদের কপালে। যেন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল! আবার বানানোর শেষে তার তৃপ্তির হাসি আমার সারাজীবন মনে থাকবে। ফরিদ মিয়ার হাত থেকে আমি পড়লাম রঞ্জু নামের এক কারিগরের হাতে। কিছু টুকটাক সেলাই দিয়ে, বোতাম আর নাড়া লাগিয়ে, ইস্ত্রি করে আমাকে চালানের জন্য তৈরি করাই ছিল রঞ্জুর দায়িত্ব। সেই রাতে, কাজের শেষে আর দশটা মালের সাথে রঞ্জু যখন আমাকে ব্যাগে ভরল, আমি চিন্তিত, কোথায় নেয়া হচ্ছে আমাকে? রঞ্জুর নখের ফাঁকে ফাঁকে ময়লা। রঞ্জুর গায়ে গন্ধ। হাতের চামড়া খসখসে, নিস্প্রাণ। এহেন রঞ্জু আমাকে কি বিস্ময় উপহার দেবে কে জানে ভেবে আমি শঙ্কিত হয়ে উঠলাম। তাই বলে এই পরিণতি হবে কে জানতো? রাত তিনটা বাজে। ঘড়িটা কথা বলেই যাচ্ছে। একটানা। কেউ শুনুক আর না শুনুক।আমার ধবধবে সাদা গায়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের মায়াবী ফুৎকার এসে লাগছে। আমার বারো ঘণ্টার দেহরক্ষী প্লাস্টিক-এর ব্যাগটা পড়ে আছে খাটের পায়ার কাছে। আর আমি পরে আছি সেই রকিং চেয়ারের হাতায়। সিদ্ধান্ত বদল হয়েছে। সবুজ আমাকে আর পরিধান করবে না আগামীকাল। নতুন একটা স্যুটে র মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে একটু আগে। এ সারপ্রাইজ গিফট ফর সবুজ ফ্রম হিজ বেস্ট ম্যান শাওন। ট্রায়াল দেয়ার পর ঝকমকে কালো রঙের সেই পোশাকটাকে আবার আলমিরাতে ঢুকিয়ে ফেলা হয়েছে। রকিং চেয়ারের হাতলে গা এলিয়ে পরে থাকা আমি এক ধরনের নির্মোহ মুক্তির আনন্দ বোধ করি। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি বিছানায় দুটি দেহ, দুটি অন্তরঙ্গ প্রাণ। বেগুনি ডিম লাইটের আলোতে ওদের মু খ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে দুজনের চোখে অপার আনন্দ। নিভে যাবার আগে দীপ যেন দপ করে জ্বলে উঠছে। সবুজের নির্লোম দেহে যত্রতত্র হেঁটে বেড়ায় শাওনের লোমশ হাত। আমি বুঝতে পারি অনেক অনেক আদর বিনিময় হচ্ছে। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে চাপা হাসির শব্দ। আবার নীরবতা। আবার একটু উহ-আহ! একেবারে অচেনা এই দৃশ্য কিন্তু নয়নসুখ! রাত চারটা। নিথর দুই প্রেমিক দেহ। পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে একে অন্যকে। আমি দেখছি আর দেখছি। যেখানে আমাকে রাখা হয়েছে সেখানে এক সময় ছিল শাওনের কান্নাভেজা আঙ্গুলগুলো। খুঁজলে হয়ত তার ছাপ পাওয়া যাবে এখনো।

আমি তাই ভাবি আর অবাক হই। স্পর্শকি আজব একটা জিনিস! ৬৫-৩৫ মাপের একটা কাপড় হাতের স্পর্শে হয়ে উঠতে পারে একটা চোস্ত পাজামা। কিংবা এই হাতে স্পর্শেই হয়ত এমন কিছু হয় যা ভাবতেও গা রি রি করে ওঠে। সম্পূর্ণ ঘটনাটা নাহয় নাই বললাম। যে রাতে রঞ্জু আমায় নিয়ে গেল তার বাড়িতে, তার প্রমোদ রসে আমার এই শুভ্র দেহ কলঙ্কিত হয়েছিল সেই রাতে। ছোপ ছোপ এলার্জির মত দাগ বসে গিয়েছিল আমার গায়ে। এখানে, সেখানে। কি জঘন্য সেই অনুভূতি। আমি তো রঞ্জুর জন্য তৈরি হইনি। তবুও তার শীর্ণ পা দুটি সে গলিয়ে দিয়েছিল আমার ভেতরে। পৃ থুলা রমণীদের নাচ দেখতে দেখতে তার বিকৃত সুখের অবশিষ্ট সে উগড়ে দিয়েছিল আমার শরীরে। কাস্টমারদের আনকোরা পোশাক গায়ে চাপিয়ে স্ব-মেহন করা রঞ্জুর পু রনো শখ। সে যাইহোক— পরদিন ভোরে আমাকে ডলে ডলে ধোয়া হলো, তালপাকা গরমে শুকানো হল, মরচে পড়া ইস্ত্রির বৈদ্যুতি ক উষ্ণতায় টানটান করা হলো। কিন্তু এত কিছুর পর ও সেই গ্লানি গ্লানি ভাবটা যাচ্ছিল না আমার। আজ এই মু হুর্তে গোপন কি এক দুখে দুখী দুজন মানুষকে সাময়িক ভাবে সুখী হতে দেখে আমার বড় ভালো লাগল। সুখের আবেশে সকালের প্রত্যাশায় আমি ঘুমিয়ে পড়তে থাকি। সকাল থেকেই তুমু ল বৃষ্টি। কনে কি মেঘ রাশির মেয়ে নাকি রে বাবা! ঝম ঝম শব্দে ঘু ম ভাঙ্গে আমার। কটা বাজে? সাতটা? আটটা? বিছানায় কেউ নেই। হঠাৎ নাকে সিগারেটের গন্ধ আসে, আসে মচমচে একটা ঘ্রাণ। বাতাসে পর্দাটা সরে যায়, দেখতে পাই, ব্যালকনিতে বসে আছে শাওন। খালি গায়ে বসে আছে ছেলেটা। টি…টি…টি… টি…বিরক্তিকর শব্দে ডেকে ওঠে নচ্ছাড় ঘড়িটা। ভোরের অবসাদগস্ত বাতাসে পরিতৃপ্ত হওয়া ঘরটাতে দিনের ব্যস্তসমস্ত ভাব চলে আসে মু হূর্তেই। সাড়ে ছয়টা বাজে। বাথরুম থেকে টাওয়েল পেছিয়ে বের হয়ে আসে সবুজ। ঘড়িটা বন্ধ করে কোমর থেকে টাওয়েল এর বাঁধনটা আলগা করে মাথা মু ছতে থাকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে। আমিও দেখি সবুজকে। কি সুন্দর একটা গড়ন। কখন যে পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে শাওন টের পায়নি ও। মু খ গুঁজে দেয় সবুজের ঘাড়ে। কিসের ঘ্রাণ নিচ্ছে ও? শ্যাম্পুর নাকি কোন পুরোনো স্মৃতির? প্লিজ, ছাড় তো। সকাল হয়ে গেছে! আমি অবাক হই। স্মৃতি কি শিশিরের মত যে সকাল হয়ে গেলেই শুকিয়ে যাবে, মিলিয়ে যাবে? শাওন ছাড়ে না। “আহ…কি পাগলামি করছিস…কেউ দেখে ফেলবে তো…” সবুজ হালকাভাবে বাঁধন আলগা করতে চেষ্টা করে। আমি তাকাই দরজার দিকে। কে দেখবে? দরজাটা লক করা। বোবা, কালা, লম্বা এক জানোয়ার। অথচ কি তাৎপর্যময়। তার উপস্থিতি আলাদা দুটো জগত তৈরি হয়। দরজার এপারের সবুজ আর ওপারের সবুজ কি এক? কোনজন সত্য? আমার চিন্তার ছেদ পড়ে ধড়মড়িয়ে পড়ার একটা শব্দে। শাওন পড়ে যায় খাটের পায়ার কাছে। সবুজ তাড়াহুড়ো করে ওয়ারড্রোবের ড্রয়ারে কিছু একটা খোঁজে। হাতে কাছে কিছু না পেয়ে সে আসে আমার কাছে। খামচে ধরে আমার শুভ্র শরীরের একটা অংশ। গলিয়ে দেয় তার দুটো বলিষ্ঠ পা আমার ভেতরে। হ্যাঁচকা টানে পায়ের কাছে এক জায়গায় সেলাইয়ে ঢিল পড়ে। ঘসঘস করে টান পড়ে নাড়ার গলিতে। এসব কিছুই আমার কাছে অবান্তর মনে হয়। আমি তাকিয়ে রই শাওনের দিকে। সে তখনো বসে আছে খাটের পায়ার কাছে। হাঁটু ভেঙ্গে বুকের কাছে নেয়া। যেন ধ্যান করছে। একটু আগের দৃশ্য আর এখনকার দৃশ্যের মাঝে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। একটু আগে যেখানে আঘাত ছিল, আকুতি ছিল, এখন সেখানে প্রশ্রয় আছে, প্রশান্তি আছে। শাওনের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে সবুজ। কেউ কোন কথা বলছে না। বাইরে বৃষ্টির শব্দ কমে গেছে। ব্যালকনিতে গোলাপের টবের কাছে পড়ে আছে শাওনের আধখাওয়া সিগারেট। বৃষ্টির পানিতে একেবারে তুবড়ে গেছে ওটার দেহ। ঠিক যেন শাওন আর সবুজের প্রেমকাহিনি? “কিছু বল! এমন করছিস কেন? আই থিঙ্ক উই ডিসাইেডড টু এন্ড ইট, না?” কোন উত্তর দেয়না শাওন। চোখ খোলে ধীরে। তাকায় সবুজের দিকে। তারপর ঠাস করে একটা থাপ্পড় লাগায়। এবার আমি কাছ থেকে দেখি শাওনের মু খটা। কেমন একটা জান্তব ছায়া পড়েছে তাতে। প্রেম বিদায় নিলে মনে কি পশু বাধা বাঁধে? নাকি অপার তৃষ্ণা জাগে? চেনা পৃথিবী ধূসর মরুময় মনে হয়? সবুজ উঠে দাঁড়ায়। খুজে পেতে একটা সিগারেট ধরায়। বর্তুলাকার ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, লাইক ইট ম্যান। দ্যাট ওয়াজ সো লাইক মাই টপ! তারপর কাছে আসে। পাশে বসে। সবুজের হাতটা শাওনের বিশেষ জায়গায় কিছু খোঁজে। নির্বিকার শাওন যেন পাথরের মূর্তি। সবুজের হাত ততক্ষণে গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। ব্যাপারটা আরো একবার হলো আমার সামনে। খুব দ্রুত। একেবারে সাদামাটা ভাবে। রুক্ষভাবে। আমি দেখলাম। আমার স্বজাতি স্ট্রাইপের পাজামাটাও দেখল। কারণ এই যুদ্ধে আমরাও শামিল ছিলাম। ওটা তো যুদ্ধই ছিল, না কি? মুক্তি লাভের জন্য যুদ্ধ। যেন শেষবারের মত দিয়ে আর নিয়ে দায়মুক্তির মহড়া। ভাঁজ পড়েছে আমার দেহের জায়গায় জায়গায়। সঙ্গহীন সঙ্গমের মত স্বার্থপর ভাঁজ, বিষণ্ণ রতি ক্রিয়ার বিরক্তির ভাঁজ! বেলা সাড়ে আটটা। ঘণ্টা নামের একটা আস্ত আগরবাতি গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে পুড়ে শেষ হল আমাদের সামনে। নাকি একটা সিনেমা শেষ হচ্ছে? সিনেমা শেষে পপকর্ন ছড়িয়ে হল থেকে বিদায় নেয় সবাই। সবুজের কক্ষে এবার সংলাপের পপকর্ন ছড়িয়ে পড়ে। “যত্তসব— কি যে একটা ভাব তোদের। জানিস, সেদিন আহসান কি বলছিল? বলে, আমি নাকি বিয়ে করে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করছি। হোয়াট ডাজ হি মীন বাই ইট? আমি কি ইম্পটেন্ট? জাস্ট বিকজ আই টেক, দ্যাট ডাজেন্ট মেক মি আ ডাই—হার্ডফ্যাগ লাইক ইউ গাইজ-সবুজের মু খ থেকে পাকানো ধোঁয়ার সাথে বের হয়ে আসে কথা গুলো। বায়ুর স্তরে স্তরে বসে পড়ে আর অপেক্ষা করতে থাকে নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বীর। আমিও অপেক্ষা করি শাওনের উত্তরের। কিন্তু সে কিছু বলে না। সবুজ আবার বলতে থাকে, তুইও তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেল। তুই না অস্ট্রেলিয়াতে সেটেল্ড হবার কথা ভাবছিস? ওখানে কি গে-ম্যারিজ লিগালাইজড? উদ্দেশ্যহীনভাবে প্রশ্নের পাহাড় গড়ে তোলে সবুজ। 

শাওন উঠে যায়। বাথরুমে ঢুকে পড়ে। আমি শাওয়ারের শব্দ পাই। ক্লান্তির মত সব ব্যথাগুলো কে ধুয়ে ফেলা গেলে কত ভালই না হতো! আমাকে আবারো ছুঁড়ে ফেলা হল মেহগনি কাঠের সেই রকিং চেয়ারে। কি আশায় লাগছে নিজেকে! একেবারে বিদ্ধস্ত। নিজেকে গুছিয়ে নেবো সেই ক্ষমতা নেই আমার। তবুও আমার কেমন যেন ভালো লাগে। মনে হয় শাওনের জন্য সবুজের ভালোবাসার যে অবস্থা তার চেয়ে আমার এই এলোমেলো দশা অনেক ভালো। এর পরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটে যায়। নয়টার দিকে অনেক লোক ঢোকে। সবুজের মা, কাজিন, খালারা। সবাই আসে আর যায়। সবাই নিজের নিজের কথা নিয়ে ব্যস্ত। অথচ একটু কান পাতলেই হয়ত ওরা শুনতে পেত এই ঘরের ইথারে জমে থাকা কাল রাতের বা আজ সকালের অজানা কাহিনি। কিন্তু ওরা কেউ সেই কাহিনি জানতে চায় না। একজন ছাড়া। সে হল সবুজের ছোট দুলাভাই। ভদ্রলোক সম্ভবত জানতো ওদের ব্যাপারটা। আজ সকালে ওদের ঘর উনিই প্রথম এসেছিলেন। মুখে ছিল কেমন একটা হাসি, ঠিক যেন চোর ধরতে পুলিশ এসেছে। শাওনের বাহুতে চাপ দিয়ে বলেছিল, কি ব্রাদার, তুমি কবে বিয়ে করছো? এইবার কিন্তু শাওন ও হাতছাড়া হয়ে গেল! আমি অবাক হয়ে ভাবি, এর মানে কি? আর কে কে ছিল শাওনের হাতে? শাওন যথারীতি কোন উত্তর দেয় না। শুধু মলিন একটা হাসির রেখা ভেসে ওঠে ওর মুখে। লোকটা এইবার যায় সবুজের কাছে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল সবুজ। আবারও বৃষ্টি নেমেছে। ওরা দুজন ঘরে এসে বসে। হাসতে হাসতেই উনি আবার বলে, কি সবুজ, একাউন্ট ক্লোজ করে ফেলেছো তো? সবুজ হো হো করে হেসে বলে, কি যে বলেন, দুলাভাই। লোকটা বলে, ভায়া, আমি ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলাম। এইসব খু ব ভালো বুঝি। আমার চোখ ফাঁকি দেয় না কিছুই। আমি অবাক হয়ে লোকটাকে দেখি। অনেকক্ষণ পর একটা ভালো পজিশনে গেলাম আমি। সবুজের চাচাতো বোন আমাকে সুন্দর করে ভাঁজ করে উঠিয়ে রাখলো ওয়ারড্রবের ওপর। কি সুন্দর হাতের আঙুলগুলো মেয়েটার। মেহেদি রাঙ্গা হাতে সে যত্নের সাথে আমার ভাঁজ পড়া অংশগুলোকে টান টান করার চেষ্টা করে। ওর রঙিন হাত আমাকে কনের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই মেয়েটিও নিশ্চয় অনেক সুন্দর করে মেহেদি পরেছে। নিশ্চয় দেখতে শুরু করেছে সুন্দর একটা সংসারের স্বপ্ন। সবুজকে নিয়ে সে কী কী ভেবেছে আমার জানতে ইচ্ছে করে। কোনদিন যদি সে জানতে পারে সবুজের অতীত তাহলে কি করবে সে, সেটাও আমার জানতে ইচ্ছে করে। সে কি ‘প্রতারিত’ বোধ করবে? মেহেদি একবার পরলে তো সাথে সাথে তোলা যায়না। অপেক্ষা করতে হয়। সময়ের সাথে সাথে মেহেদির রঙ হালকা হয়। সময়ের সাথে সাথে প্রতারণা বা বঞ্চনার স্মৃতি বা অনুভবগুলোও কি হালকা হয়ে যায়? আমি আরো ভাবি সবুজের কথা। মানুষ কেন বিয়ে করে? কাল হলুদের অনুষ্ঠানে কারা যেন বিয়েকে সোশ্যাল সিকিউরিটি-এর সাথে তুলনা করলো দেখলাম। এর মানে কি? আমার মত তুচ্ছ ৬৫-৩৫ কাপড়ের পাজামা সেই সব কঠিন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়না। আমাকে যে বাতিল করা হয়ে গেছে সে তো গতকাল রাতেই শুনেছি। 

কিন্তু আজ সেই বিষয়টা নিয়ে খন্ডপ্রলয় হয়ে গেল। সবুজ পরতে চায় স্যুট আর প্যান্ট কিন্তু ওদের বাড়ির রেওয়াজ শেরওয়ানির চুড়িদার। কঠিন জেদি ছেলে মনে হয় সবুজকে। কিছুতেই মানলো না কারো যুক্তি। হার মানলো রেওয়াজ। সবুজের মুখে বিজয়ের হাসি। আমি ভাবি, একই ভাবে যদি সবুজ লড়াই করত বিয়ে করার, তাহলে কি ওরা মেনে নিত? কিংবা সবুজ কি আদৌ লড়াই করত কখনও? অনেক প্রশ্ন দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। বেলা বারোটা। সবুজকে দারুণ দেখাচ্ছে। স্যুটটা একেবারে ফিট। টাই-এর নটটা বাঁধতে বাঁধতে সবুজ গুণগুণ করে গান গাইছে। ওর বন্ধুদে র দিয়ে ঘরটা ভর্তি। অনেকগুলো সিগারেটের ধোঁয়াতে ঘরটা আচ্ছন্ন। এদের মাঝে আমি শাওনকে দেখলাম না কোথাও। “শালা, যা একেকটা শালি পেয়েছিস না, একেবারে চমচম! হাঁপিয়ে উঠলে মাঝে মাঝে আমাদের ও চান্স দিস”— বলে ছেলেটা ঘর কাঁপিয়ে হাসে। ওর সাথে সাথে সবাই হাসে। বিয়ের পর বাসর রাতে বেড়াল মারার বুদ্ধি দেয় কেউ কেউ। বিয়ের পর পর বাসর রাতে বেড়াল মারা মানে কি? এমন একটা কিছুকি প্রেমে পড়ার পর পর করা যায় না? এমন করলে কি প্রেমটাকে দু-পায়ের মাঝে লেজগুটানো বেড়ালের মত অনুগত করে ফেলা সম্ভব? প্রেম যেন বিদ্রোহী, প্রতারক বা পলাতক হয়ে না ওঠে সেজন্য কোন পন্থা কি মানুষ আবিষ্কার করেছে না করতে পারবে? না কি করবে বলে ভাবছে?

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.