বাসবদত্তা

মির্জা গিলগামেশ

মাত্র সকাল দশটা, এখনই বাইরে যেন রোদের রূদ্রতাণ্ডব চলছে। জ্যৈষ্ঠের সকাল এতো দ্রুত পার হয়ে যায় যে রাস্তার কুকুরও পারলে অদৃশ্য হয়ে পড়ে, সূর্যদেবের হাত থেকে কারোরই যেন আর নিস্তার নেই। স্কুল কলেজে সব গ্রীষ্মের ছুটি, তাই আর দশটা মফঃস্বলের রাস্তার মতো সকাল সকাল ইউনিফর্মের দেখা নেই তবে অফিস আর বাজারগামী লোকের কমতি নেই। গরমের তীব্রতা সবাইকেই স্পর্শ করেছে, বিলের পানি শুকিয়ে আসতে থাকলে মাছের দল যেমন কাদাপানির দিকে ছুটতে থাকে তেমনি করে সবাই যেন চাবি দেওয়া পুতুলের মতো ছুটে চলেছে গন্তব্যের দিকে। দোতালার বারান্দা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে অপলা, রাস্তার ব্যস্ততার বিপরীতে এই নিশ্চলতা যেন এক টুকরো মেঘ। বাইরের কোনোকিছুই যেন আজ তাকে স্পর্শ করছে না। সকালে বরের অফিসের তাড়া ছিলো, রোজ যেমন থাকে। ভোরে উঠে বরের সবকিছু গুছিয়ে অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছে সে, অপলার একমাত্র মেয়ে পিঁউ ও স্কুল ছুটির বদৌলতে মামার বাড়ি বেড়াতে গেছে। অপলার ও ইচ্ছা ছিলো এই সুযোগে একবার যাওয়ার কিন্তু বরের অফিস আছে বলে আর যাওয়া হলো না। বর কিন্তু একবারও বলেনি রয়ে যেতে বরং অপলাই বরের সম্ভাব্য কষ্টের কথা ভেবে আর গেল না। সকালের সব কাজ শেষে অপলা আজ একদম ঝাড়া হাত পা। 

সকালে স্নান শেষে কপালে সিঁদুর পরতে পরতে কার কথা মনে পড়ে হাতটা যেন একটু কেঁপে উঠলো অপলার; নাহ, কারো কথা না, হয়তো চোখের উপর চুলের গোছা এসে পড়েছিলো বলেই। স্বামী ও সন্তান নিয়ে যে সুখের সংসার অপলার সেখানে হাত কেঁপে ওঠার জন্য তৃতীয় কেউ থাকতে পারে বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। মফঃস্বলের আরো অনেক মেয়ের মতো কলেজের গণ্ডী পার হতেই বাবা মায়ের পছন্দের পাত্রের সাথে মালা বদল করে নিয়েছিলো সে। এ নিয়ে অভিযোগও নেই অপলার। সবসময়ই সংসার করতে চেয়েছিলো অপলা, মফঃস্বলের এই ছোট্ট সংসার তার সব সাধ পূর্ণ করে দিয়েছে। সবাই আজ অপলা কে এক সুখি মানুষ হিসেবেই জানে, এমনকি অপলাও। তবু যখন আজ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা অপলার চোখের দিকে আমরা আরেকবার চোখ ফেরাই, সেই চোখে যেই কামনা দেখি তা কি শুধুই কাজলের কালো? তবে প্রেম একবার এসেছিলো একবার অপলার জীবনে। সমুদ্রের জোয়ারের মতো নয়, একেবারে আচমকা পাহাড়ি ঢলের মতো যা সমস্ত বাঁধ ভেঙে দশ দিক ভাসিয়ে দিয়ে যায়। সেই ঢল এসে আছড়ে পড়েছিলো কলেজে পড়ার সময়, যখন অপলা কিশোরী শরীরের খোলস ছেড়ে ক্রমশ ঢুকে পড়ছে যুবতীর শরীরে। এক কলেজেই পড়তো তারা, অপলা ছিলো আর্টসে আর সে সাইন্সের। অপলা ছিলো পুরো কলেজের সবচেয়ে ভালো গায়িকা আর সে ছিলো জেলার শ্রেষ্ঠ বিতার্কিকদের একজন। অপলা যেমন গলার সুর দিয়ে সকলকে মোহিত করে তুলতো তেমনি বিতর্কের মঞ্চে তার সুতীক্ষ্ণ যুক্তিবাণে বিপরীত দলেরা কোণঠাসা হয়ে পড়তো। দুজনের হয়তো কখনো দেখা হওয়ারই ছিলো না, তবু কলেজের ফাংশনে একদিন চোখে চোখ পড়লো দুজনের। এখনো সেই দিনের কথা মনে পড়লে অপলার পেটে যেন অযুত লক্ষ নিযুত প্রজাপতি উড়তে থাকে। জীবনের কত সুখের দুঃখের স্মৃতি ঝাপসা হয়ে এলো তবু অপলা এখনো যেন চোখ বুজলেই সেই চোখদুটো দেখতে পায়। সেই থেকে শুরু, দুজনে যেন একদম হরিহর আত্মা। কলেজ থেকে একসাথে ফেরার পথে ফুচকা, ছুটির দিনে শহরের বইয়ের পুরনো দোকানটায় একবার ঢুঁ বা অপলার তানপু রা ঠিক করার ছুতোয় দুজনের দেখা হওয়া। যেই অপলা কোনোদিন বিতর্কের ধারে কাছে যায়নি তাকেই আজকাল দেখা যেতে লাগলো বিতর্কের সব আয়োজনে দর্শক সারিতে। কলেজের সবাই তো বটেই, টিচারদেরও কেউ কেউ হাসতে হাসতে বলেছিলো, তোরা বরং বিয়ে করেই ফেল। তবুও প্রেম হলো না। ধর্মের ব্যবধান তো ছিলোই, তা ছাপিয়ে আরো কিছুর একটা বাধা যেন ছিলো দুজনের মধ্যে। আজ অপলা বোঝে ধর্ম আসলে কোনো কারণই ছিলো না, আসল বাধা ছিলো ভয়; প্রত্যাখানের ভয়। সেই ভয়ের কাঁটাই পড়লো প্রেমের দুয়ারে, এতো প্রেম কাছে এসে এলো না। তারপর কলেজের পরীক্ষা শেষে সে চলে গেল দূরের শহরে ডাক্তারি পড়তে আর সেই সময়ে অপলা পড়লো বিয়ের মন্ত্র। ঘোর সংসারী অপলার চার দেয়ালের বাইরে যে বৃহৎ জগৎ সংসার তার সাথে আর যোগাযোগই রইলো না। ফিরে যাওয়া যাক আজকের সকাল দশটায় অপলার বারান্দায়। জরি পাড়ের কলাপাতা রঙা শাড়ি পরে আনমনে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। গরমে ঘেমে সাদা ব্লাউজ স্বচ্ছ হয়ে উঠছে, গলার কাছে পাউডারের ছোপ গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। 

আজকাল এই সময়টায় লোডশেডিং এর বড় প্রাদুর্ভাব হয়েছে , একবার চলে গেলে আবার কখন আসবে তার কোনো হদিশ থাকে না। এমন সময় হঠাৎ সদর দরজায় ঠক্ ঠক্ ঠক্। এখন তো কারো আসার কথা নয়! কিছুটা বিরক্ত এবং অনেকটা সতর্ক হয়ে অপলা দরজার দিকে এগোলো। দরজা খু লতেই এ যে যুথি! কিন্তু এতো বছর পর কিভাবে? 

অপলার বিষ্ময় ও প্রশ্নপীড়িত মুখের দিকে তাকিয়ে যুথি বললো— আরে এই গরমে বাইরে আর এক সেকেন্ড দাঁড়ালে মাথাটা একদম ফুটিফাটা হয়ে যাবে আমার। ঢুকতে দিবি না ঘরে? 

বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করেই ভেতরে ঢুকে পড়লো যুথি। প্রায় দশ বছর পরে দেখা তবুও যেন এতোটুকু বদলায়নি যুথি, আকারে ও প্রকারে এখনো যেই সেই কলেজের মেয়েটি। শান্ত অপলার পাশে দুরন্ত যুথি কে দেখলে মনে হবে যেন চকিত হরিণীর চোখ সদাই খুঁজে চলেছে কিছু।

—আয় আয়! বোস! তুই এই বাসার খোঁজ পেলি কিভাবে? অবশেষে জিজ্ঞেস করার ফুরসত পেলো অপলা।

—তুই তো জগৎ সংসার থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পাকা গিন্নি হয়ে গেছিস দেখছি! একটু ঠাণ্ডা পানি খাওয়া না, বরফ দিস না আবার! আর বাসার ঠিকানা? তোর মেয়ের স্কুলে সেঁজুতি আছে না পড়ায়? ও তো আমার খালাতো বোন, ওর থেকেই তোর ঠিকানা পেলাম অনেক কষ্টে। 

—তারপর তুই এই শহরে কিভাবে? এরই মধ্যে ফ্রিজ থেকে পানি বের করে যুথিকে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো অপলা। 

—আরে আমি তো এসেছিই এক সপ্তাহের জন্য, একটা মেডিক্যাল ক্যাম্পের সাথে। আগামীকাল চলে যাবো আর আজই তোর ঠিকানা পেলাম। কেমন আছিস বল? 

—এই যেমন দেখছিস, ছোট্ট একটা সংসার, ভালোই আছি, কী বল?

অপলা হাসলো। এতো বছর বাদে যুথিকে দেখতে পেয়ে নাকি সংসারের সুখের আনন্দে অপলার চোখ ঝলমল করে উঠেছে তা ঠিক ঠাহর করে ওঠা গেল না। তবে সেই শান্ত, ধীর অপলার চোখে যেন সেই কলেজ জীবনের পুরনো চঞ্চলতা ভর করতে শুরু করেছে। —তোর কথা বল যুথি, কী করছিস আজকাল?

—আমাকে তো এই দেখতেই পাচ্ছিস মেডিক্যাল টিম নিয়ে আজ এখানে তো কাল সেখানে। তোর কথা বল বরং। 

—আমার কথা আর কী বলবো, এই স্বামী সন্তান নিয়ে দৌড়ের উপর আছি। ছুটি বলে মেয়ে গেছে মামার বাড়ি আর কর্তা গেছে অফিস। তোর সংসারের কী খবর?

—আমার আবার সংসার!

—ওমা, সে কী? 

—যার সাথে সাগরে সাতরানোর কথা ছিলো সে যে জলে নামতেই ভয় পেলো অপলা! তুই কলেজে থাকতে গাইতিস না, “মন দিলো না বঁধূ, মন নিলো যে শুধু…” আমার হয়েছে সেই। 

—যাহ! এসব আবার কবে হলো তোর? বিতার্কিকের মুখে গান? 

—সে তো তোর থেকে ভালো কেউ জানে না অপলা, বিতার্কিকের মুখে গান কে বসালো বল? 

এই কথার কোনো উত্তর দিলো না অপলা। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্যই কি না কে জানে, বললো, ঘরের ভেতর টা খুব গুমোট হয়ে উঠেছে, আয় বারান্দায় তোকে আমার বাগান দেখাই। 

—বাহ, ভালোই তো বাগান করেছিস দেখছি। 

—এই দেখ তোর পছন্দের শিউলি, যদিও এখনো ফুলের দেখা পাইনি। 

—এই যে আমি এলাম, এবার ঠিক ফুল ফুটবে দেখিস। জানিস তো, শিউলিকে ল্যাটিনে বলে ‘দুঃখের গাছ’, হয়তো সেজন্যই আমার এতো প্রিয়। 

অপলার গাল ধীরে ধীরে আরক্ত হয়ে উঠলো, কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর যুথিই ফের জিজ্ঞেস করলো 

—বইয়ের দোকানে এখনো যাওয়া হয় তোর? 

—হয়, তবে কোহিনূরে না। এখন তো বই মানে মেয়ের সিলেবাসের বই। একটু কাষ্ঠহাসি হেসে বললো অপালা। দুই পুরাতন সখির প্রাণের বিদ্যুৎ স্পন্দনের মতো শহরেও আজ দ্রুত বিদ্যুৎ ফিরে এলো। 

—আয় ঘরে আয় যুথি ফ্যানের বাতাসে, বাইরে অনেক গরম। 

—হ্যাঁ মেয়ে বাড়ি নেই, বর অফিসে, এই সুযোগে ঘরে অভিসারিকা কে ডাকছিস? নীল ওড়নায় ঘাম মুছতে মুছতে হাসতে থাকলো যুথি। 

অপলার শরীর ও মন কেমন যেন তরল হয়ে উঠতে থাকলো, প্রজাপতির ওড়াউড়ি সে আবার টের পেতে থাকলো পেটের ভেতর। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো এই চারপাশে যা রয়েছে সব মিথ্যা, সব মায়ার পর্দা ঘিরে ধরছে অপলাকে দশ দিক হতে। ইচ্ছা হলো যুথিকে সব সত্যিটা জানিয়ে দিতে, কিন্তু এই সংসার ছেড়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়ার মতো সাহস আছে কি তার? 

—কিছু বলছিস না যে? কী ভাবছিস এতো? যুথির কথায় সংবিৎ ফিরে এলো অপলার। 

—নাহ আমি কী বলবো, তুই কিছু বল। 

—আমি? আমি কী বলবো? 

—এতোদিন বাদে দেখা, আর তোর কবে কথার অভাব পড়লো রে? 

—তাহলে রবিবাবুর কথাই বলি, “আজি রজনী তে হয়েছে সময় এসেছি বাসবদত্তা।” 

—মিললো না যে যুথি, এ যে জ্যৈষ্ঠের দুপুর, নিশীথ রাতের শ্রাবণ গগন কোথায় পেলি? 

—উঁহু, তুই সব ভুলে গেছিস দেখছি, শ্রাবণ নয়, তখন ছিলো চৈত্র সন্ধ্যা। 

—সে যা ই হোক, এখন বড় ভুল সময় যুথি। চারদিকে জ্যৈষ্ঠের খরতাপ, বসন্ত বা বৃষ্টি বাদলা কিছুই নেই দেওয়ার মতো। অভিসারের জন্য এ বড় অসময়। 

—কে বললো বাদল নেই? ওই দেখ আকাশ কালো হয়ে উঠেছে, একটু পরেই বৃষ্টি নামবে। জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালো অপলা। তার বুকের ভেতরের মতো বাইরের আকাশেও কালো মেঘ জমাট বাধতে শুরু করেছে, ঝড় অত্যাসন্ন। 

—শোন আমি বরং উঠি, ক্যাম্পে ফেরত যেতে হবে, ঝড় শুরু হলে তখন তো রাস্তাঘাট সব সমুদ্র হয়ে উঠবে, সাথে ঝাঁপ দেওয়ারও কেউ নেই। হাসতে হাসতেই বললো যুথি। অপলা কিছু বললো না। ভেতরে ভেতরে সে ভেঙে পড়ছিলো। আর কিছুক্ষণ এভাবে চললে আবার যে পাহাড়ে ঢল নামবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ধীর পায়ে চুল বাঁধতে বাঁধতে দরজার দিকে এগোতে থাকলো সে। 

—শোন, তোকে কতবার বলেছি খোলা চুলে তোকে কত সুন্দর দেখায়, তাও তুই বেঁধে রাখিস কেন? 

—এ সংসারে টিকতে গেলে যে চুল আর হৃদয় দুটোকেই শক্ত করে বেঁধে রাখতে হয় যুথি, না হলে জীবন বড় মুশকিল। ম্লান হাসি হেসে বললো অপলা। নিজেকে আটকানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে সে ভেতরে ভেতরে, সারাক্ষণ যেন ধরা পড়ার ভয়। বাইরে বের হয়ে রিকশা পেতে একটু সময় লাগলো, এর মাঝের প্রতিটি মুহূর্ত যেন মনে হচ্ছিলো নিস্তব্ধতার সহস্র বছর। 

রিকশা পেতেই যুথি এবার নরম গলায় বললো, আসি রে, অপলা। ভালো থাকিস। তারপর একবারও পেছনে না ফিরে হুড তোলা রিকশায় উঠে পড়লো সে। ঝড়ের হাওয়া শুরু হয়ে গেছে ততোক্ষণে, সাথে বৃষ্টিও। হঠাৎ অপলার মনে হলো যেন জগৎ আজই ভেঙে পড়বে, সব সত্যি জানানোর এই শেষ সময়। যুথির রিকশা এতক্ষণে চলতে শুরু করেছে, যুথি! যুথি! বলে রিকশার পেছনে দৌড়াতে থাকলো অপলা, হাওয়ার তোড়ে ততক্ষণে তার চুল সহস্র নাগিনীর মত বাতাসের সাথে লড়ছে। যুথির রিকশা থামতেই অপলা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, যুথি তোকে একটা দরকারি কথা বলার ছিলো আমার। হুডের ভেতর থেকে সিক্ত মুখ বের করলো যুথি, বৃষ্টির ফোঁটারা তখন অবিরলভাবে অপলা ও যুথির মুখের উপর পড়েই চলেছে। যুথির গালের উপর আলতো করে হাত রেখে অপলা ফিসফিসিয়ে বললো, “সময় যেদিন আসিবে সেদিন যাইবো তোমার কুঞ্জ।” 

প্রথম প্রকাশ: সমারূঢ়
(মন্দ্র প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রথম কুইয়ার ছোটগল্প সংকলন)

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.