
তন্ময় সরকার
( ১ ) তালুকঈসাদ নামের এক গ্রামে আমার জন্ম। গ্রামটি তার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট ঘাঘট নদীটির মতই ছোট। দাদা, দাদীর কাছে শুনেছিলাম এই ছোট নদীটিই নাকি আগে রংপুর মহাসড়কের একদম পাশ ঘেঁসে সেই পশ্চিমের বালুরহাট গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো! বড় বড় পালতোলা নৌকাও চলত সেসময়টায়। গ্রামের মানুষ গুলো সেসময় মাস তারিখ বোঝার মত এতোটা শিক্ষিত না হলেও, নদীর হাবভাব থেকে তারা ঠিকই বুঝে নিত এখন কোন ঋতুর প্রতাপ চলছে। বর্ষায় যখন ঘাঘট ফুলে-ফেঁপে ওঠে, তখন দুই কূলের সব গ্রাম তাতে পানিতে তলিয়ে যেত। আবার নদীর পানি যখন কমে যেত তখন ছোটো ছোটো খাল, দোলা-জমি এগুলেতে নাকি প্রচুর দেশি মাছও পাওয়া যেত। পুঁটি, মলা, ঢেলা, খৈলসা, বাইন এসব মাছ এতো বেশি পরিমাণে পাওয়া যেত যে, খাওয়ার পর অতিরিক্ত মাছগুলো দিয়ে সেময় ঘরে ঘরে শুঁটকি করার রেওয়াজ ছিলো। সেই সব দেশি মাছের শুটঁকির সাথে কালো কচু, কিছুমশলা আর সরষের তেল এক সাথে মিলিয়ে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে তৈরি করা হত সিঁদল। এই খাবারটা এখনো, বর্ষাকালে আমাদের বাসায় তৈরি হয়। আমার মায়ের হাতের সিঁদল ভুনা অমৃত সমান! এক হাতা সিঁদল দিয়ে অনায়াসে দু-তিন থালা ভাত খেতে কারোর কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়! আবার নদী পাড়ের দুতীরে যখন থরে থরে কাশফুলগুলো ফুটত তখন ফুটে থাকা এক একটি কাশফুল জানান দিত যে শরত এসে গেছে। হেমন্তের নবান্ন উৎসব, হলুদ শস্যক্ষেত। আবার শীতের রাতে নদীর তীর ধরে শেয়াল দলের বুকফাটা হাহাকার এই সবই ষড়ঋতুর আবর্তে একটার পর একটা আসতো যেতো। ঘাঘটই এই তালুকঈসাদ গ্রামের অসহায় মানুষগুলোর একমাত্র সহায় হিসেবে পাশে থাকে সবসময়!
আমাদের বাড়ি থেকে বেশ দূরে, নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত, তালুকঈসাদ মাদ্রাসার মাঠে সেসময় নাকি অনেক বড় একটা হাট বসত। শনি ও বুধবার বসতো সেই হাট। শসার বীচির মত সরু সরু নৌকা বোঝাই করে আসত নানান জাতের শাকসবজি। কেউ বা দু-একটি হাঁস মুরগী আনত বেচার উদ্দেশ্যে। আবার কেউ হাটের এক কোনায় কুড় নারিকেল নিয়ে বসে থাকত, এক বেলা খাবারের জন্য যদি কিছু টাকা পাওয়া সেই উদ্দেশ্যে! যে দিন তার নারকেল গুলো বিক্রি হয় না সেই দিন শেষের রাত্রিটিতে যেন তার সমস্ত মহাকাল থেমে যায়। এমন দীর্ঘ রাত্রি এই তালুকঈসাদ গ্রামের মানুষের নিত্যসঙ্গী! তবুও তারা বেঁচে থাকে। এক অজানা আশা, এক একটি রাত্রি শেষের ভোরবেলাকার রবি এই সব আদিম মানুষদের বাঁচিয়ে রেখেছে।
(২) শরতে আমার জন্ম। যেদিনটায় আমার জন্ম হলো, সেদিন বাবা সপ্তাহের বাজার-সদাই করতে সেই হাটে গিয়েছিলেন। আমার জন্মসংবাদ দিতে, দাদা তড়িঘড়ি করে হাটের পথে রওনাও দিলেন। পথিমধ্যে বাবার সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি বললেন, তোর অ্যাকনা দেবী হইছেরে অহিম। অ্যাললায় তাড়াতাড়ি করি বাড়িত চলেক!—বলে রাখা ভালো, আমার পরিবার ছিলো মুসলিম। তবুও গ্রামীণ সে জীবনে হিন্দুরের নানান দেব-দেবী ছিলো রহস্যের এক একটা মায়াজাল! সন্ধ্যা নামলেও যখন ছেলেমেয়েরা মাঠে খেলা করে, তখন কালীর ভয় দেখিয়েই গ্রামের মায়েরা তাদের সন্তানদের ঘরে আনেন। গ্রামের পুরোনো কোনো ঘর, আদিম কোনো বটগাছ কিংবা তেতুলগাছে এই কালীর নিত্য বিচরণ! সুতরাং এই সমস্ত স্থানকে গ্রামের বুড়ো থেকে খোকা সবাই এক প্রকারে ভয় করেই চলতেন। আমি এই মিয়া বাড়ির প্রথম সন্তান হলেও, আমার জন্ম যেন এই দরিদ্র মিয়া বাড়ির কুঁড়েঘরে এক টুকরো বসন্তের ছোঁয়া এনে দিয়েছিলো! বসন্তের বাসন্তী দেবীকে শরতের শারদীয় দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে যে অকাল বোধন করা হয়। আমার জন্ম উপলক্ষ্যে এই মিয়া বাড়িতেও তেমনি একটি ছোট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। তবে সেটি ছিলো আমার নাম রাখার অনুষ্ঠান। মুসলিম রীতি অনুযায়ী পালিত এই অনুষ্ঠানটিকে আকিকা বলা হয়। বাবা সেদিনটায় খাসি জবেহ করে গোটা দশেক বাড়িতে মাংসও দিয়েছিলেন। আমার আকিকা অনুষ্ঠানে জবেহ করা হবে জন্যই কেবল বাবা দু’বছর ধরে বড় করছিলেন। ও হ্যাঁ, সেদিন আমার নামটি রাখা হয়েছিল সাগর মিয়া।
গ্রামের ছেলে আমি আর নদী পাড়ের তো বটেই! সে হিসেবে আমার বেড়ে ওঠায় কিংবা আচরণে প্রকৃতির চঞ্চলতা থাকবে এটা অস্বাভাবিক কিছুই নয়। কিন্তু দিন যত গড়াচ্ছিল, আমার চারপাশের মানুষগুলি আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিলো যে আমি হয়ত তাদের মত নই। আল্লাহ আমাকে মাটি দিয়ে বানানোর সময় সম্ভবত একটা কিছুদিতে ভুলেই গিয়েছিলেন। কিন্তু স্বয়ং স্রষ্টার ভুল হতে পারে? এই প্রশ্ন আজও এই একুশ শতকের সমাজেও কূল পায় না! তাই সমস্ত অপরাধ কেবল একার আমার। আর নয়ত আমার এই শরীরের। মাটির শরীর আমার হয়তো ভুলেই স্রষ্টার অপার কৃপায় প্রাপ্ত পুরুষত্বটি নিজেই গিলে খেয়েছে! সুতরাং আমি দেহে কেবল পুরুষ কিন্তু আমার অন্তরে, আমার দেহের প্রতিটি কৈশিক নালীর শাখায় উপশাখায় এক আদিম নারীসত্তার বসবাস। তাই আমায় মেনে নিতে সমাজের বিপত্তি বাঁধল এইখানে। খুব স্পষ্ট করে বলতে পারব না। তবে আমার কৈশোরের দিনগুলো খুব বেখেয়ালিভাবেই যাচ্ছিলো। কিন্তু আমার বেড়ে ওঠাকে, চালচলনগুলোকে এই সমাজের সবাই খুব সুক্ষ্ম দৃষ্টিতেই খেয়াল করছিলেন বলে আমার বিশ্বাস। প্রচলিত সমাজের সরল নিয়মের বাইরে গিয়ে এমন বঙ্কিমসত্ত্বাকে কে মেনে নেবে? তাই আমার উপস্থিতি সবার চোখে আরও বেশি করে জ্বালা ধরাত। তবুও এক অজানা শক্তির বলে আমি বেড়ে উঠছিলাম।
(৪) বর্ষাকালে বাড়ির আশেপাশের খালগুলোতে যখন থরে থরে শাপলা ফুল ফুটতো, তখন গ্রামের মহিলারা শাপলা তুলত সবজি হিসেবে খাওয়ার জন্য কিংবা হাটে বিক্রি করার জন্য। ছোটো বেলায় আমিও শাপলা তুলতাম, কিন্তু খাওয়ার জন্য নয় বরং নিজেকে একটু সাজানোর জন্য। শাপলা ফুলের যে লম্বা ডাঁটাটা থাকত, সেটি দিয়ে গ্রামের মেয়েরা মালা বানিয়ে নিজেকে অলঙ্কৃত করত। আমিও তাই করতাম। নদীর পাড়ে বসে মালা বানিয়ে গলায় পরতাম, কোমরের বিছা বানাতাম। গ্রামের মানুষগুলো যখন আমায় এই অবস্থায় দেখতেন তখন তারা হাসতেন আর বলতেন, অহিম্মার এটা চ্যাংড়াও হয় নাই চেংড়ীও হয় নাই। মোদ্দতে একটা হইছে! তখন তাদের এসব কথার যথার্থ মর্ম আমি উপলব্ধি করতে না পারলেও। এটা ঠিকই বুঝতাম যে, আমি হয়ত ঠিক তাদের মত না! কিন্তু আমার অস্বাভাবিকতাটি আসলে কোথায় সেটি আমি অনেক চিন্তাভবনা করেও সেদিন উদ্ধার করতে পারিনি। মাঝে মাঝে মনে হতো, আমি তো কোনো অন্ধ না কিংবা বধির। আমার হাত পা সবই আর দশজনের মতই। তবে আমার জন্মগত ত্রুটিটি আসলে কোথায়? জন্মের পরের বছরেই আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন। তাই পিতৃ ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও আমি এই জনমে পেলাম না। সুতরাং এই দরিদ্র মিয়া বাড়ির কর্তা আমার দাদাই।
দাদা অন্যের ক্ষেতখামারে কাজ করতেন আর আমার মা কাজ করতেন অন্যের বাড়িতে। এই দুইয়ে মিলে যা পেতেন তা দিয়েই কোনো মতে আমাদের দিন চলে যেত। আমি তখনও ছোট। তাই পরিবারের কোনো দায়-দায়িত্ব আমার উপর ছিলো না। আর হ্যাঁ— আমার মেয়েলি স্বভাব দেখে দাদি সদাই বলতেন, হামার সাগর যদি মাগী হইলো হয়, তয় উয়ার চোদ্দটা ভাতার থাকিল হয়!— দাদির কথা শুনে লজ্জায় আমার মুখ লাল হয়ে যেত কিন্তু এখন আমার নিজেরও তেমনটাই মনে হয়!
(৫) আমাদের গ্রামে প্রতিবছর বৈশাখ মাসের শেষের দিকে নদীর দুই পাড় ধরে, ‘নাপাই চন্ডী’ নামের একদিনের একটা মস্ত বড় মেলা বসতো। এই চন্ডী দাস নাকি ব্রিটিশ আমলে ইংরেজ ও নীলকরদের বিরুদ্ধে এই অঞ্চলে একটা ছোটখাটো বিদ্রোহ করে বসেছিলেন। এই আচরণে স্থানীয় নীলকররা তাঁর বিরুদ্ধে ইংরেজদের কাছে বিচার দিলে, হঠাৎ-ই চন্ডী দাস একেবারে উধাও হয়ে যায়। হয়ত তাঁকে তারা হত্যা করে এই ঘাঘটের স্রোতেই বাসিয়ে দিয়েছিলেন। সেই অবধি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে এই অঞ্চলের মানুষ ‘নাপাই চন্ডী’ নামের এই মেলাটি দীর্ঘদিন ধরে উদযাপন করে আসছেন। চন্ডী দাসের এই কীর্তি গ্রামের মানুষ এখন ঠিক মনে রেখেছেন কিনা সেটি জোর গলায় বলতে না পারলেও এই মেলা উপলক্ষ্যে নদীর দুই পাড়ে যেন এক আনন্দের রোল পড়ে যেত। যাদের আত্মীয়স্বজন দূরে থাকতেন, এ সময়টায় গ্রামের মানুষ তাদের বাসায় আসার আমন্ত্রণ জানাতেন। সেবার দাদার সাথে নাপাই চন্ডীর মেলায় যাওয়ার পথেই দেখলাম কিছু পুরুষালি কণ্ঠের মেয়ে ঢোল আর সানাইয়ের শব্দে নেচে যাচ্ছেন। অনেকেই গোল করে তাদের নাচ দেখছেনও। পুরো মেলার এপাশ থেকে ওপাশ সেই ঢোল আর সানাইয়ের শব্দ যেন এক অন্যরকম আবহ তৈরি করে রেখেছে। আমি দাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এরা কেটাগো দাদা? জবাবে তিনি বললেন, এরা হিজলা। এরা চ্যাংড়াও নোয়ায় চেংড়ীও নোয়ায়। তোর জন্মের কালে যে বকনা বাছুর কোনা হামার হছিলো, ওটার মত। গাইটা বড় হয়া না দেলে কোনো বাছুর, না দেয় দুদ। হাটত তুললেও কেউ নেবার চায়না। এগুলার কাজ নাই দাদু। এমন ধামরি গরু মরলেই বাঁচং! একটা গরুর সাথে মানুষের এহেন তুলনা আমাকে যে সেদিন একদমই ভাবায়নি তা কিন্তু নয়। তবে কোথায় যেন সে চিন্তাটি মিলিয়ে গিয়েছিল সেদিন। তখন মনে মনে একটা প্রশ্নও ঘু রপাক খাচ্ছিলো। গ্রামের মানুষগুলোও তো আমাকেও বলে, আমি না হইছি ছেলে না হইছি মেয়ে। তবে? না, আর তবে ভাবতে চাইনি সেদিন। মেলা ছেড়ে বাড়ির দিকে যখন আসছিলাম তখন পু রুষালি কণ্ঠের ওই সব মহিলার একটি দল দাদাকে হঠাৎ-ই ঘিরে ধরে বলেন, এই যে দাদুদাও কিছু। দাদা কিছু না বলে পাঁচ টাকা দিয়ে বললেন, অ্যালা তোরা ঘাটা ছাড়িদে দেখিনি। বাড়ি যাওয়া নাগবে! তখন ওই দলের একজন আচমকাই আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে বসলেন, ওমা দেখ সবাই।
দাদুর পাশের চ্যাংড়া কোনা তো কতি! এই কতি যাবু হামার সাথে? এটা শুনে দাদু আর দাঁড়ালেন না। তৎক্ষনাৎ আমার হাত জোরে চেপে ধরে হনহন করে বাড়ির পানে হাঁটা দিলেন। ফেরার পথে আর একবারের জন্যও দাদা আমার দিকে ফিরে তাকাননি।
(৬) এদিকে বাড়ির আয় রোজগার একদমই নাই। দাদাও আর তেমন অন্যের ক্ষেতে কাজ করতে পারেন না। বয়সের ভার টানতেই এখন তিনি নাস্তানাবুদ। তাই মা আমাকে বললেন, কিছু একটা কাজ করে যেন ঘরে দু এক টাকা দেই। সুতরাং হন্যে হয়ে একটা কাজ খুঁজতেও লাগলাম। ব্যাপারি হান্নান মন্ডলের চাল কলে একটা কাজ জুটেও গেলো। দিনের বেলা প্রখর রোদ উঠলে চাতালে ধানগুলো শুকোতে দিতাম আবার আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখলেই সেগুলো তুলে ফেলতে হতো। কিছুদিন থাকার পর এই সব বিষয়গুলো এখন আর কাউকে বলে দিতে হয়না। একবার এক শুক্রবার, চাল কলে সেদিন ধান ভাঙ্গা হবে। সুতরাং আমাদের কয়েকজনকে বলা হলো আজ রাতটা যেন আমরা এই চাল কলেই থাকি। সদ্য কিশোর থেকে যৌবনে পা দিয়েছি আমি। সুতরাং আমার আশপাশের মানুষজন আমার দিকে কিভাবে, কোন উদ্দেশ্যে তাকেচ্ছেন সেটা এখন একটু হলেও বুঝতে পারি। চাল ভাঙ্গা শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এখন আমি বস্তাগুলোর মু খ সুঁচ দিয়ে সেলাই করছিলাম। এমন সময় চাল কলের মিস্ত্রি রফিক ভাই আমাকে একটু আড়ালে ডেকে বললেন, এতো অাইতোত থাকপুকোটে? আজ মোর ঘরত থাকিস। মুই একলায় থাকোং। আমি তার কথায় কোনো প্রকার বাধা না দিয়ে শুধু মাথা নাড়লাম। কাজ শেষে রফিক ভাইয়ের ঘরে যেতেই তিনি আমাকে বলেন, আলুর ভত্তা দিয়া দুইডা ভাত খায়া নে চ্যাংড়া। মুই বাহিরত থাকি বিড়ি খায়য়া আসতোছং। খাওয়া শেষে আমি চাতালের শান বাঁধানো মেঝেতে বসে আছি। সেদিন চাঁদ আকাশে থাকলেও, পূর্ণিমাগত এই চাঁদের আলো তেমন ছিলো না। এ যেন আলো অন্ধকারের এক অসম যুদ্ধক্ষেত্র! কিছুক্ষণ পর রফিক ভাইও এসে পাশে বসলেন। “ঠিক মত খাওয়াদাওয়া হইছেতো ছোট ভাই? গরিব মানুষ হামরা, ভাত পাই অ্যাকনাই মেলা!” আমি সে কথায় আর যুক্ত না হয়ে বললাম, “অফিক ভাই, বিড়ি খাইলে কি ঠোঁট কালা হয়?” প্রশ্ন শুনে রফিক ভাই হাসলেন। চাল কলে ধান, চালের বস্তা ওঠা নামা করতে করতে রফিক ভাইয়ের পুরো শরীরের প্রতিটি মাংসপেশি যেন লোহার মত শক্ত হয়ে গিয়েছিল। রোদে পোড়া কালো সেই শরীরটি যখন ঘামে একেবারে জুবুথুবু খেয়ে যেত তখন তার গায়ে থাকা স্যান্ডো গেঞ্জিটি যেন তার শরীরের প্রতিটি অংশে জোঁকের মত রক্ত শুষে নিতে চাইত! সেই সময়টায় এক অপার পুরুষত্ব যেন তার পুরো শরীর থেকে ঠিকরিয়ে পড়তে থাকে। এমন দৃশ্য উপেক্ষা করার মত এতোটা আহাম্মক আমি মোটেই ছিলাম না! তবে পাছে যেন কেউ সন্দেহ না করে, তাই আড়চোখেই কেবল রফিক ভাইকে দেখতাম। বিছানা একটি তাই আমাদের ঘু্মাতেও হলো একসাথে। এদিকে রাত্রি বাড়ছেই কিন্তু আমার চোখে কোনো ঘুম আসছিলো না। এক প্রবল অস্বস্তি আমাকে ঘিরে রেখেছিল। ইতোমধ্যে রফিক ভাইয়ের একবেলার ঘুম হয়েও গিয়েছিল বোধহয়! আচমকাই রফিক ভাই পাশ ঘুরিয়ে আমার গায়ে পা তুলে দিলেন আর এক হাত দিলেন বুকের এপাশে থেকে ওপাশে। আমার এই অচেনা উত্তেজনা, অস্বস্তি যেন মুহূর্তেই আরও দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। আমি হঠাৎই রফিক ভাইয়ের সেই শক্ত পেশিবহুল হাতে একটা চুমু দিয়ে বসলাম। ঘুমের ঘোরে রফিক ভাইয়ের আদৌ কোনো অনুভূতি হচ্ছিল কিনা সেটা বোঝা গেল না কিন্তু আমি যেন সেই অচেনা উত্তেজনার সাগরেই ডুবে মরছিলাম। সেটি আমি ছাড়া বুঝার মত আর কেউ তখন ছিলো না। আরও কয়েকটি চুমু আমি বসিয়ে দিলাম রফিক ভাইয়ের হাতে আর কপালে। কি যেন কি হলো, রফিক ভাই এতে একটু নড়েচড়ে আমাকে ছেড়ে দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন। এবার আমি আস্তে আস্তে আমার হাতটা রফিক ভাইয়ের নাভীর উপরে রাখলাম। আমার ভয় হচ্ছিল ঠিকই কিন্তু সেই অদ্ভুত , অচেনা উত্তেজনার কাছে সে ভয় আর ধোপে টিকলো না। আস্তে আস্তে আমার হাতটি একটু একটু করে নিচে নামিয়ে যাচ্ছিলাম। একেবারে লুঙ্গীর গিঁটে এসে সেই হাতটি আমার বাধা পেল। এবার আরও একটু জোর দিয়ে আমার হাতটি লুঙ্গীর ভিতরে ঢুকিয়ে দিলাম। এই সব অভিজ্ঞতাই আমার কাছে অচেনা। তবু্ও এক অপার আনন্দের রোল, ভালো লাগা আমাকে বুঁদ করে রেখেছিল সেই রাত্রিটিতে। হঠাৎই আবিষ্কার করলাম রফিক ভাইয়ের শিশ্নের কাছে আমার হাতটি পৌঁছে গেছে। খুব মনে আছে ততোক্ষণে রফিক ভাইয়ের হুশ ফিরেছে। আমার যে হাতটি তার শিশ্নটিকে পরম কামনায় চেপে ধরেছিল, সেই হাতটির উপরে আলতো ভাবে তিনিও তার একটি হাত রাখলেন! কিন্তু তার পক্ষ থেকে এ যেন কোনো বাধা ছিলো না। পরম কামোত্তেজনায় সে মুহূর্তে সেই হাত দুটিই ছিলো সম্মতির স্মারক স্বরূপ! সুতরাং সেদিনের সেই পূর্ণিমাগত রাত্রিটিতেই আমার যৌনকামনার আদিমতম ক্ষুধাটি পূর্ণতা পেয়েছিলো।
(৭) রফিক ভাইকে এখন আর আমি ভাই বলে ডাকিনা। নাম ধরে ডাকতেই এখন আমার বড্ড ভালো লাগে। লোকটার দিকে তাকিয়েই যেন পুরো একটা দিন আমি কাটিয়ে দিতে পারব। দিন যতই গড়াচ্ছিল রফিকের সাথে আমার ঘনিষ্টতা ততোটাই বাড়ছিলো। কিন্তু এরকম অদ্ভুত সম ঘনিষ্টতা, চাল কলের অন্যান্য মানুষজন খুব একটা ভালো দৃষ্টিতে নিতে পারেননি। তার উপর আমার মেয়েলি স্বভাব যেন সেই আগুনে আরও নতুন করে ঘি ঢেলে দিচ্ছিলো! নিত্যই সেই সব কথা আমার কানে আসতে লাগলো। তখন সেসব উপেক্ষা করার মত এতো শক্তি আর সাহস আমার কোনোটাই ছিলো না। সে খবর একদিন আমার বাড়ি অবধিও চলে এলো। দাদা বললেন, দিন দিন হিজলা হইতেছিস নাকি? মাইনষে এগুলা কি কয়া বেরাইতোছে যে, তোর নাকি কোন অফিক মিস্তিরির সাথে মাগী ভাতারের সম্পক্ক চলতোছে? তুই কি হামার মানসম্মান কিচ্ছু থুবু না নাকি? দাদার এসব কথা শুনে আমার সেদিন খুব ভয় করতে লাগল। কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ছেড়ে চাল কলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। চাল কলে গিয়ে দেখি ব্যাপারি আমার নাম কেটে দিয়েছেন আর বললেন, তোর মত হিজলা চ্যাংড়াকে মোর চাউলের কলত আর থুবার নাং। তুই কি মনে করছিস অফিকের সাথে তোর কি চলে হামরা বুঝি না? ছিঃ ছিঃ কত্ত বড় পাপী তুই আর তুই কিনা কাজ করিস মোর চাউলের কলত! তুই এলায় চলি যা। এতো সব কথা শুনে আমার মুখে আর কোনো রা নাই। রফিকের কাছে গিয়েছিলাম এসব বলব বলে। আমাকে দেখেই সে বলল, মোর সাথে তোর এতো কি হে? তুই আর মোর সাথে কথা কইস না। ব্যাপারি নোয়াইলে মোক বাদ দেবে। তুই চলি যা সাগর। সবটা শুনে অপরাধীর মত মাথা নিচু করে একেবারে সোজা বাসার পথে রওনা দিলাম। একদিনের এতো সব অভিজ্ঞতা যেন আমাকে একেবারে বুড়ো করে দিয়েছিল সেদিন। যার প্রতি আমার এতোসব অজানা অনুভূতির জন্ম হয়েছিল, সে আজ আমাকে চলে যেতে বলেছে! আমি জানিনা আল্লাহ আমাকে সৃষ্টি করেছেন কোন উদ্দেশ্যে! কেন এতো সব অচেনা, অজানা অনুভূতি দিয়ে আমার চেতনাকে জাগিয়ে দিলেন অন্য ভাবে? প্রচলিত সরল সমাজে তাই আমার এই বঙ্কিমসত্ত্বার কোনো মূল্যই ছিলো না! বাসায় এসে সবাইকে বললাম, চাল কলের কাজটি আমার খোয়া গেছে। সবটা শুনে দাদা চিল্লায় উঠে বলেন, এই সব হইছে তোর হিজলাগীরির জন্য। হামার মানসম্মান তো কিছুই থুইস নাই। তুই মোর বাড়ি থাকি এলায় বাইর হয়া যা। সবটা শুনে মা ও কিছু বললেন না। শুধু মুখ ফিরিয়ে রইলেন। আমার মত এক চির অপরাধীকে পেটে ধরেছিলেন তিনি! সেদিনের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার মাধ্যমেই তার প্রায়শ্চিত্ত হল সেই দিনটায়! সুতরাং এ বিষয়ে তার বলার কিছু থাকতেই পারেনা। সেই রাতে আমি মোটেই দুচোখের পাতা এক করতে পারলাম না। শুধু একটা কথাই গানের ধুয়ার মত বাজতে লাগত, তুই বাইর হয়া যা! আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আজই এই রাত্রেই এই বাড়ি থেকে আমি বের হয়ে যাব। সেদিনটায় আমার উদ্দেশ্য ছিলো অজানা। একরাশ হতাশা আর অনিশ্চয়তার ভারে আমার চোখ দুটো সেদিন সামনে ঘোর অমাবস্যা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না! তবুও এটাই স্থির করেছিলাম এই ঘর ছেড়ে, প্রচলিত সমাজ থেকে আমি পালিয়ে যাব বহুদূরে। পালিয়েও গেলাম! হয়তো সেদিন পালিয়ে গিয়েছিলাম বলেই, আজ বেঁচে থাকার মত এতো গুলো মানুষ পেয়েছি। এখানকার মানুষগুলো তোমাদের সমাজের মত মানুষকে কেবল নারী-পু রুষ বলে কোনো দলাদলিও করে না আবার কাদা ছোড়াছুঁড়ি করে না! তাই ঘাঘট ছাড়া আমার দিনগুলো এখানে ভালোই কাটছে। শুনেছি ঘাঘটকেও তারা মেরে ফেলেছে! জীবনদাত্রী সেই ঘাঘট ছাড়া তালুকঈসাদ গ্রামের রাত্রিগুলো কি আরও দীর্ঘ হয়েছে?
ও হ্যাঁ— দাদার দেয়া আকিকা করা সেই নামটিতে এখন আর কেউ আমাকে ডাকেই না। এখানে সবাই আমাকে সাগরিকা বলেই চিনে। আমি এখন সাগরিকা হিজড়া! থাকি মগবাজার রেলগেটের হিজড়া কলোনিতে।
প্রথম প্রকাশ: সমারূঢ়
(মন্দ্র প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রথম কুইয়ার ছোটগল্প সংকলন)