রয়েল ক্রুজ প্যালেস

রজনী রোয়াজা

দোতলার সিঁড়ি বেয়ে লঞ্চের পাটাতনে যখন নেমে আসে গগন, তখন রাত্রি দ্বিপ্রহর।  চারিদিক সুনসান, হুহু করে বইছে ঝড়ো বাতাস। বাইরে উত্তাল পদ্মা। ঢেউয়ের ঝাপটায়  ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে রয়েল ক্রুজ প্যালেসের এই কাঠের পাটাতন। মেঝেতে পা রাখতেই পিছলে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো তার। কোনোরকম সামলে নিয়ে সামনের  দিকে এগোতে লাগল সে।  

চারপাশে শূন্য পড়ে আছে এলোমেলো ডিনার টেবিল, এদিক ওদিক ছড়ানো এঁটো বাসনকোসন। স্রোতের ঝাপটায় অল্প অল্প কাঁপছে লঞ্চটা, সেই সঙ্গে ফাগুন রাত্রির  শীতল কুয়াশা। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা অনুভব করলো গগন। সেই সঙ্গে ক্ষুধা। একাকী এই রয়েল ক্রুজ প্যালেসের পিচ্ছিল পাটাতন পার হতে বুঁক কাঁপছিলো তার কিন্তু ক্ষুধার কাছে হার  মানলো সব দ্বিধা।  

রান্নাঘরের কাছে এসে যখন দাঁড়াল গগন, বিস্ময়ে দু’পা স্থির হয়ে গেল তার। ভিতরে উঁকি দিতেই তার চোখে পড়লো সঙ্গমরত দুই পুরুষ। রন্ধনশালার শেষপ্রান্তে, যেখানে খাবারের সব উপকরণ রাখা, তার মাঝখানে একটা লোহার থামে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে তীব্র বেগে চুম্ব ন করছেন তারা। হাওয়ার দাপট আর ধূসর কুয়াশায় ঝাপসা দেখা যাচ্ছে তাদের নগ্ন শরীর। জলের ঝাপটায় ভিজে যাচ্ছেন তারা, তবু থামছে না চুম্বনের  বেগ। এক গভীরতর আনন্দে পরস্পরকে নিরন্তর পেষণ করে চলছেন তারা। তাদের  শিৎকার তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে মিশে গেল এই বিভীষিকাময় রাত্রির মেঘের গর্জন, বিদ্যুতের ঝলকানি আর হু হু করে বয়ে চলা বাতাসের সাথে।  

(খ) 

৩১১ নম্বর কেবিনে যখন ঘুম ভেঙ্গে গেল সমুদ্রের, বধূ তার শুয়ে ছিল পাশে।  বালিশের কাছেই রাখা ছিল সিগারেট, দেশলাই আর নোট রাখার খাতা। কেবিনের পর্দা সরিয়ে সে যখন বাইরে তাকালো, তখন শুক্লপক্ষের আকাশের বুকে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে পঞ্চমীর চাঁদ।  

এমন সময় গগনকে দেখার হলো তার সাধ।  

জলের দিকে তাকিয়ে সমুদ্রের মনে পড়লো গগনের সঙ্গে তার প্রথম প্রেমের কথা।  তারা দুজনেই ছিলো সহপাঠী। কিন্তু গগন যেন ঠিক পুরুষের মতো ছিল না, আবার নারীর  মতোও নয়। দূর থেকে গগন যখন হেঁটে আসতো সমুদ্রের দিকে, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো সমুদ্র । মাঝে মাঝে গগনের জন্য অশ্বত্থতলায় অপেক্ষা করতো সমুদ্র , তাকে নিয়ে বেড়াতে যেত নির্জন নদীর পাড়ে, দেখা না হলে কেমন যেন অস্থির লাগতো তার।  

সমুদ্রের কাছে গগন ছিল শৈশবে হারিয়ে ফেলা মায়ের স্মৃতির মতো। গগন তাকে প্রশ্রয় দিতো, তার শখ, ছেলেমানুষি আর সব আবদার নির্দ্বিধায় পূরণ করতো। কিন্তু  বন্ধুরা বলতো গগন নাকি মেয়েলি। একটা হাফ লেডিস।  

নিজেকে কেমন যেন ভয় পেতে শুরু করে সমুদ্র । তার ভেতর দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সে নিজেকে প্রশ্ন করে— কেন এমন হয়? প্রত্যুত্তরে সে শুনতে পায়— এ পাপ। মহাপাপ।  গগনকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে সমুদ্র । তার এই বদলে যাওয়া, অকারণ অবহেলা  গগনকে কষ্ট দেয়, মর্মাহত করে, তাকে কাছে পেতে আরো বেশি মরিয়া হয়ে উঠে গগন।  অতঃপর এক ঝড়ের রাতে গগন এসে দাঁড়ায় সমুদ্রের সামনে। তার পরণে বধূর  বেশ, হাতে একগুচ্ছ লাল গোলাপ। হাহাকার ভরা কন্ঠে গগন প্রার্থনা করে— একটি গভীর চুম্বন।  

গগনকে সে রাতে প্রত্যাখ্যান করে সমুদ্র । কিন্তু অন্য এক গগন এই প্রমোদ তরীর বুকে আজ রহস্যজনকভাবে জেগে উঠেছে তার চেতনে-অবচেতনে। তাকে দৃশ্যমান দেখেও আপনার করে না পাওয়ার ব্যর্থতায় এই শুক্লপক্ষের জ্যোৎস্নায় নদীর বুকে ঝাঁপ  দিয়ে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হয় তার।  

(গ) 

সান্ধ্যনদী ছাড়িয়ে প্রমোদতরীটি যখন ত্রিনদীর মোহনায়, তখন পানশালায় ধুন্ধু মার  ভীড়, হৈচৈ। একটি টেবিলে সম্পাদকদের আড্ডা, অন্যান্য টেবিলে মাতাল বণিক আর  নেতাদের হাঁকডাক, স্ক্যান্ডাল বিষয়ক নানাবিধ কানাঘুষা। যুবক-যুবতীর দল ইতোমধ্যেই  মাতাল, ঢলে পড়ছেন একে অন্যের শরীরে, একপাশে চলছে ডিজে বক্স আর তার সঙ্গে উদ্দাম নৃত্য। সুসজ্জিত বেয়ারার দল হাসিমুখে পরিবেশন করছেন একের পর এক রঙিন পেয়ালা।  

এমন সময় পায়ে ঘুঙুর বেঁধে রঙিন আলোর নীচে এসে দাঁড়ালো গগন। তার চোখে ভর  করছে নেশা, পানের রসে ভেজানো তার ঠোঁট, মুখে চড়া মেকাপ, হাত পা রাঙানো গাঢ়  লাল আলতায়। বাহারি ঘাগরা আর রত্নখচিত ওড়না পরে সে যখন দাঁড়ালো পানশালার  মাঝে, কথা থামিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো বণিক আর রাজনীতিবিদের দল। প্রাণ ফিরে এলো পাড় মাতাল যুবকদের ভীড়ে। খিস্তি, হৈচৈ চলতে লাগলো সমান তালে। পানশালার মাঝে কোনো কোনো প্রণয়প্রার্থী আপন করে পেতে চাইলেন গগনকে।  তাকে উদ্দেশ্য করে চলতে লাগলো নানান চটুল কথা। কেউ কেউ বলছে এ তো হিজড়া!  কেউ কেউ আবার ছুঁড়ে দিচ্ছে কাগজের নোট। ভালোবেসে মাতালের দল দু’হাতে বাড়িয়ে দিচ্ছে মদিরা ভরা কাচের পেয়ালা। তাদের কোলাহল যত বাড়ে, দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়  গগনের নাচ। রাত যত বাড়ে ততই আকর্ষনীয় হয়ে উঠতে থাকে সে। রঙিন এই নাচের আসর শেষে, যখন ক্লান্ত শরীর তার, আবেগঘন নয়ন মেলে গগন  এগিয়ে যায় পছন্দের পুরুষটির দিকে। সকরুণ চোখ তুলে তার দিকে দু’হাত বাড়ায় সে।  সভায় আগত মদ্যপ খদ্দেরের দল তখন ক্রুদ্ধ । প্রতিশোধ নিতে তারা পরস্পর  ফিসফিস করে বলতে থাকে— এ নাচ, না খেমটা? মাগী চরিত্রহীন।  

(ঘ) 

দোতলার সিঁড়ির কাছে একটা নেমপ্লেটে বড় বড় হরফে লেখা ভিআইপি। জাহাজের  এদিকটা প্রায় ফাঁকা, দু’একজন গার্ড ছাড়া তেমন কেউ নেই বললেই চলে। সাধারণত এসব কেবিন সরকারের উচ্চস্থানীয় মন্ত্রী, সচিব বা বড় আমলাদেরই স্থান। এইযাত্রায়  এখানে আছেন সরকারের একটি বিশেষ মহলের দায়িত্বপ্রাপ্ত শহরের একজন নব্য ধনকুবের।  

প্রমোদতরীর পানশালায় যখন ধনকুবেরটি গগনকে না পেয়ে ক্ষিপ্ত, গালির বহর ছুটছে তার আকণ্ঠ পান করা জড়ানো কণ্ঠস্বর থেকে, তখন তার জন্য বরাদ্দকৃত বিলাসবহুল কামরাটির একপাশে কর্মচারীদের জন্য রাখা কেবিনে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছে বরুণ ও জুলফিকার। নদীটি তখন শান্ত, বাতাসে মৃদু উড়ছে বরুণের  ঈষৎ লম্বা চুল। প্রেমিকের লোমশ বুকে মাথা রেখে সে ভাবছে তাদের অনাগত সুখের  দিনগুলোর কথা।  

ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক ছাড়িয়ে বরুণ ও জুলফিকার কবে একে অপরকে আরো গভীরভাবে আপন করে নিয়েছে, তা জানে না দুজনের কেউ। বরুণ জানে জুলফিকারকে একা রেখে সে যখন পা বাড়ায় শহরের দিকে এই ধনকুবেরটির ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ পাওয়ার পর, নিজের ভেতর হু হু করা এক হাহাকার টের পায় সে। শহরের অট্টালিকা, সুরম্য আসবাব, ঘুপচি গলি, থিয়েটার বা দামি গাড়ি কোনো কিছুতেই সে হাহাকার  দূর হয় না তার। অজানা এক ব্যাধির মতন দিন দিন বাড়তে থাকে তা। শেষ অবধি,  মালিকের মন জয় করে প্রেমিকটির জন্য কাজের ব্যবস্থা করে তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে বরুণ। এজন্য গর্বের অন্ত নেই তার! 

সব কাজ শেষে, যখন রাত্রি নেমে আসে বরুণ ও জুলফিকারের ছোট্ট কামড়ায় একে অপরকে ঘামে ভিজিয়ে— এই ব্যস্ত শহরের এককোনে এক নিবিড়তর সুখে পরস্পরকে জড়িয়ে রাখে তারা। 

(ঙ) 

সেদিন রাতে, নৈশভোজ ও পানাহারের পর ধনকুবেরটির শরীরে কামের আগুন  ছড়িয়ে দেয় গগন। নাচের আসর শেষে তাকে কাছে ডেকে সে কানে কানে বলে— কি উপহার চাই— বহুমূল্য রত্নরাজি, বস্ত্র যাহা চাও নাও, বিনিময়ে এ দাসে দাও— শুধু একটি রাত। 

কপট হেসে তার হাতটি ছাড়িয়ে নেয় গগন। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সে।  গগনের মতো এক সামান্য নর্তকীর প্রত্যাখ্যান, নব্য এই ধনকুবেরকে আরো বেশি আগ্রাসী করে তোলে সেই রাতে। কামরায় ফিরেই সে ডেকে পাঠায় বরুণকে। তাকে একটানে বিছানায় ফেলে কেবিনের দরজা বন্ধ করে দেয় সে।  

পাশের রুম থেকে জুলফিকার শুনতে পায় বরুণের চাপা চিৎকার। শেষ রাত পর্যন্ত বরুণের উপর চলতে থাকে নির্যাতন। জুলফিকারের ইচ্ছা করে, মাতাল ধনকুবেরটির রক্তে দুই হাত লাল করবে সে, তারপর বরুণকে নিয়ে এই প্রমোদতরী জনারণ্য ছেড়ে অজানা দেশে পালিয়ে যাবে তারা। 

প্রথম প্রকাশ: সমারূঢ়
(মন্দ্র প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রথম কুইয়ার ছোটগল্প সংকলন)

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.