বাসন্তী মৃত্যু

নিরালোকে দিব্যরথ

বাম হাত খাওয়ার প্লেটে ধুলে যেই নালে উৎপন্ন সেই নালে শেষ, কখনও ধনী হবে না, আর চোখ হবে অন্ধ। রুটির বুক কামড়ে খেলে মায়ের অসুখ করবে। 

শনি-মঙ্গলবার নখ কাটা যায় না। শরীরের কোষ পুড়িয়ে দেবে। বুধ বারে নিষিদ্ধ,  চামড়ায় সর্বত্রে শ্বেত দাগে ছেঁয়ে ফেলবে। রাতেও নিষিদ্ধ। ব্যত্যয়ে অর্থকষ্ট হবে। চন্দ্রগ্রহণ সূর্য গ্রহণের সময় গন্নি ব্যারাম পাবে। গন্নির অর্থ বিরক্তিদায়ক ঘন ঘন মলমূত্রের বেগ পাওয়া।  মা বলেন শালাম জন্মের পর থেকে চুপচাপ ছিল। কথা বলা শেখাতে ওকে মুরগির পাছার মাংস খাওয়ানো হয়। শালাম তাই বাচাল হয়েছে। 

—মেহেদি ফোন কলের রিসিভার টিপতেই কারও মুখে র কথায় তুবড়ি ছুটছে।

—‘অভিশপ্ত নগরী’ কে লিখেছেন? ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম, মাথা ফাঁকা লাগছে।  মনে পড়ে না আমার। 

উত্তরের অপেক্ষা না করে বাচাল লোকটি হুলুস্থুল প্রশ্ন করে গেল। 

—অভিশপ্ত নগরীর পরের খণ্ড আছে না? দুটিই প্যালেস্টাইন নিয়ে? 

—আছে। পাপের সন্তান আছে। প্যালেস্টাইন নিয়েই। 

—ইয়েস, আস্ত এনসাইক্লোপিডিয়া – জানতাম – পাপের সন্তান – জেরুজালেমের  ঘটনা, মিকা এবং সদরা। কিন্তু কে লিখেছেন মনে পড়ছে না, মেহেদি।

—সত্যেন সেন লিখেছেন। 

—ইয়েস। সত্যেন সেন। দাম কত হবে, মেহেদি, দাম কত হবে? একশো? দেড়শো? —দুঃখিত, আমি ঠিক কার সাথে কথা বলছি? 

—আরে মিয়া ভাই, আমি শালাম বলছি।  

—ওও। 

—সত্যেন সেনের বই ছাড়াও খুব কম দামে পাওয়া যাবে, সম্ভার আকারের নয়,  এরকম তোমার পছন্দ থাকলে সাজেশান দাও আমাকে। 

—কার জন্য বই সেটি জানা দরকার, ভাই। আমি বলেছিলাম আপনাকে অলীক  মানুষের কথা। 

—‘অলীক মানুষ’ খুব খুব ভাল হবে? 

—একটু ভারী। কিন্তু আপনাকে ঐ বইটি আমি দেবো। 

—আমার জন্যে নয়। 

আন্দরকিল্লা থেকে হলুদ টেম্পোতে উঠে সে অভিশপ্ত নগরী এবং পাপের সন্তানের  ইতিবৃত্ত লিখতে বসবে। টেম্পোতেই। আজ তাকে বইপোকা বললে কোনো ক্ষতি হবে না। জান্নাতুন নুর দিশা, নতুন কবি মেয়েটি গদগদভাবেই বলেছিল চট্টগ্রামে এমন একুশের বইমেলা নাকি কেউ আগে দেখেনি। শালাম যায়নি! কারণ জীবনানন্দ দাশের  অগ্রন্থিত কবিতা নিয়ে মাত্র কয়েক পাতার ছাপানো বইটির দাম পড়বে একশো টাকা।  সে শুনেছে বাজারের মাছের দামের মত বইয়ের দাম ওখানে। হাত দিলে পুড়ে যাচ্ছে। 

শালাম প্রথম কবিতার বই ছাপবে যখন, আদতে তা হতচ্ছাড়া কবিতার বইও নয়,  নাম দেবে কী! কবিতা বেরিয়েছে বললে লোকেও পানসে হাসে, কবিতার লোকেরাও পান চিবোনোর মত মুখে রসের আদলে থুথু ফেলে। কী স্বার্থে? শালাম মনস্থির করছে। ‘কবিতা নয় অথবা গল্প নয় অথবা উপন্যাস নয়’ এই নামকরণ পাঠক খাবে?  

অবাক লাগে। হলদে টেম্পোতে দুটি কচুপাতার মতো স্নিগ্ধ মেয়ে বইয়ের গাথা  করছে। এডলফ হিটলারের বড় কষ্টের জীবন, অবশ্য শেষের দিকে ডেভিল হয়ে গেল –  একটা কচুপাতা উচ্ছ্বাস নিয়ে শোনায়। অন্য কচুপাতা হুম হুম, বেশ ভালো পড়া আছে,  একটা দুধে মিষ্ টি ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকায়। শালাম বুঝতে পারে আজ বইয়ে পেল তাকে।  না হয় এই দুধ দাঁত ওঠা মেয়ে দুটো ও বই পড়া শিখলো কবে! মেয়েছেলে দুটোকে বুকে টেনে চুমোয় ভরিয়ে দিতে সাধ জাগে। সে কারণেই কি নামবার সময়ে চিকন মেয়েটির  চুলে তার আঙুলের টোকা যায়? মেয়েটি ‘উহু’ করে উঠেছিল। যদি তারা জানত শালাম ধর্ষণ ঘৃণা করে! 

গোসল করা মেয়েদের সাথে সাথেই ফল খাওয়া নিষিদ্ধ। পানের পিক মাড়িয়ে যাওয়ার মামলা বিপজ্জনক। হেডেক হবে। পানের পিক চোখে দেখলে ছয় মাস দুঃখ হবে,  যে ফেলে গেল তার জীবনভর দুঃখ হবে। তাই পানের পিক পানিতে ফেলে দিতে হয়। 

—রাস্টিক। কুৎসিত। রিলিজিয়ন না ছাই, ওসব কুসংস্কার আর ইররেশনাল কথা  শুনলে মাঝে মাঝে মনে কয় সুইসাইড করব। 

—সহ্য করে নিন। মা-বাপই তো। থাকুক না কিছু কুসংস্কার। ওরা তো আমাদের  মত শিক্ষার মুখ দেখেননি। উনাদের সময়ে উনাদের শিক্ষায় উনাদের মন মানসিকতা  গড়ে উঠেছে। 

—কেন? পৃথিবীতে আর কোনও জ্যেষ্ঠজন নেই? আছেন না? 

ক্লাস ফাইভের প্রথম প্রেম নিভৃতে গজিয়ে নিভৃতে অন্তর্বাসিত হয়েছে। মুখ ফুটে বলার  মুখ ছিল না, নার্গিস। আমাদের বংশেরই আউলিয়ার মেয়ে। হৃদয়ের ঢেউ এলোমেলো করে দেওয়া নীল একটা ফ্রক পরতো নার্গিস। লম্বা গড়নের ওকে দেখলে রজনীগন্ধার  ফুলে র মত মনে হতো। নার্গিস দূরের কথা, কাকপক্ষীও টের পায় না এই প্রেম।  আর এমন প্রেম, যাতে শিশ্ন উত্থিত হবে না। রাবীন্দ্রিক প্রেম না বলে সুফি প্রেম মনে করো। তাকে শুক্রবারের বাংলা সিনেমার হেরোইন ভেবে আমি সেজেছিলাম লায়ক। সব  হয়েছিল কল্পনাতে। কল্পনায় নার্গিসকে সঙ্গমও যে করা সম্ভব ঐ মস্তিষ্ক পরিস্ফুট হয়নি আমার তখনও লয় এবং কখনও লয়। আর এখনও লয়। তবুও নার্গিসের আগে বিয়ে না হতো যদি, আর মায়ের দরবারে যেচে যেতাম এই বলে যে— নার্গিসকে আমিই ঘরে তুলতে চাই, এক পায়ে খাড়া হত ওরা। সময় প্রতিকূল এখন নার্গিসের শুনেছিলাম।  রহস্য করে বলেছিলাম, তালাক নামলে ওকেই বউ করে আনবো আমি, আর কোনও  মেয়েকে কক্ষনও নয়। বুলন্দ গলায় বলেছিলেন আম্মা— যত বড় মরদের মেয়ে হোক,  একবার পুরুষধরা মর্দী ঘরে আসবে, সে আসা অসম্ভব। তালাক হয়েছিল আমার খালাত  দুই বোনের। ওদের নতুন হিল্লা করতে আম্মার তো পেশাকারিতে বাধেনি। এসব ঐ  সময়ের শিক্ষে? এই অশ্লীল দ্বৈত নীতি হালে পানি পাবে? 

—আমি ভেবেছি বেশি ধর্ম ভীরু 

—ধর্মের বালাই, আবার ধর্মের লামই লয় বেশি। 

—এই জিনিসগুলো তো আর ধর্মের নয়। ধর্মের নামে বরং এইগুলো গোঁড়ামি,  কুসংস্কার। আমার মা কিন্তু এদিক দিয়ে মডার্ন। তিনি আমায় ক্লাস ফাইভেই বুঝিয়েছেন,  প্রেম করা খারাপ নয়। অন্যায় বা পাপ নয়, বরং পিউর। আমার ভাইয়ের ন’বছরের  সম্পর্কটেকাতে তিনবার শুধু একটা মেয়ের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ছুটে গেলেন।  মেয়ের পারিবারিক অবস্থা যা, তা আমাদের চেয়ে সুবিধের নয়, কোনও দিকেই নয়।  তবুও শেষমেশ যখন ঐ মেয়ের বিয়ে ঠিক হয় বাবা বলেছিলেন, “মেয়ের আঠারো বছর  হয়ে থাকলে নিয়ে আসো এরপর কী করা লাগে দেখব আমি।” 

—টর্চার্ড হয়েছি। সীমাহীন টর্চার্ড হয়েছি আমি। আমরা যেন ওদের প্রোপার্টি। ইজ্জতে লাগে তেমন কথা শোনায়। তবু মা-বাপ। আমাদের ছাড়া খায় না যে ওরা নমস্যি।  কিন্তু কেন এসবের বাইরে মানুষ হিসেবে ন্যূনতম সহমর্মিতা দরকার সেই বিবেক বুদ্ধি  কোনোটাই ওদের থাকবে না? আর পারছিনে। ছোট বয়েসে হস্তমৈথুনে র অপরাধে বিশ্রী  শাস্তি দিত, জানো? যেন অনেক পাপ করে অশুচি হয়েছি। গা কাঁটা দিয়ে ওঠে আমার 

নিপীড়িত দিনগুলোর কথা ভাবলে। 

—ইয়াল্লা! আমার বাবা তো ওসব দেখেও কিছু কয়নি। ফুল ন্যুড হয়ে গেছিলাম রাতের  বেলা। শুধু গলা খাকরি দিয়ে বলেছিলেন, অনেক রাত হয়েছে বাবা, ঘুমাও।

—হুমায়ূন আহমেদ নাকি একটা শালার পুত আর নাস্তিক, তাই নাকি মরেছে। ভালো। মেহেদির সৌভাগ্যের কথা শুনে নিজের কপালের উদ্দেশ্যে আক্ষেপে হয়তো শালাম  রেগে কলাগাছ হয়ে ওঠে। পরিবারকে ভালবাসে এই সত্যি কথা শালামের মনে পড়ে না।  তুবড়ি ছুটিয়েছে । থামে না। বাচালের সর্বশেষ ভার্সন সে। 

—পাঁচ বেলা একসঙ্গে ডেকে খেতে বসানো আর খোঁটা দেয়া ছাড়া আমাদের কিছুই  শেখান নাই। পুতুল সেজে প্রোগ্রামে যাও, মিলাদ, মোনাজাত শেখো, ওয়াজ শেখো। শিখি না, ইচ্ছে করে শিখি না আমি। ঘাড়তেড়া বেদ্দপ। 

—মানে, পীর থাকে না? সেরকম আপনাদের পরিবার? পীর পরিবার? মাজার, ওরস  এসব তো পীর পরিবারেই হয় সাধারণত। 

—আমার বাপ, বাপের বাপ, দাদা, চাচা, চাচাতো ভাই থেকে নিয়ে চৌদ্দ পুরুষই পীর।  পিচ্চি পিচ্চি পীর আছে বহুত। 

 —সেটাই ধারণা করেছিলাম। ‘অলীক মানুষ’ পড়েছেন আপনি? 

জাহাজের আকারের বইয়ের দোকান। ঢোকার সময় ব্যাগ আর ঝোলা-টোলা কুপন  নিয়ে জমা দিয়ে যেও। কথাসাহিত্য, কবিতা, নাটক, রাজনীতি, আইন, পুরাণ, ধর্ম,  সাময়িকী শতরকম ক্যাটাগরিতে তাকে তাকে আলাদা নেমপ্লেট দিয়ে রাখা হয়েছে। বই  বিক্রি হয় দেদারসে। না থাকলে অর্ডার দাও। সপ্তাখানেকের মধ্যে এনে দেবেন ওরা।  কফিশপ আছে, খাও। ইচ্ছে হলে সুন্দ র কাঠের মোড়ায় বসে ফ্রিতে পড়। অচলায়তন  পড়েছিলো কোনও এক দুপুরে শালাম। একাকী। 

আজ বাতিঘরে দু’শো টাকার বইটা কেনা দরকার। সুন্দরবন কুরিয়ারে নবীনগর  পাঠাতে দরকার আরও আশি টাকা। শালামের পকেট গড়ের মাঠ হবে না যদিও তবু সব  মিলিয়ে দু’শোতেই খেপ মারা যেতো! মেহেদি কি তার কিপ্টেমি দেখে হেসেছিল? যা খুশি করুক। মেহেদি উপদেশ দিয়েছে, “তারাশঙ্করের ‘নাগিনী কন্যার ড্যান্স’ উপন্যাসটা খুঁজে দেখবেন, সমগ্র হবে না, সিঙ্গেলেই পাওয়া যাবে। গায়ের দামে আড়াইশো পড়তে পারে।  আমার চমৎকার মনে ধরেছে।” 

শালাম নিজে পড়েনি এমন কেতাবই পাঠাবে ভাবতে ভাবতে মাত্র পচাত্তর টাকায় ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ চোখে পড়ে, মানে গায়ের দামে একশো লেখা ছিল। ক্লাসিক।  উপন্যাসটি শালাম আগে চেখেছিল যদিও, কিন্তু এই সস্তায় বই গছিয়ে দিতে পারলে নিজের গরিব ভাবমূর্তির সাথে একদম মানানসই হবে। নাগিন কন্যার ড্যান্সও চোখে পড়েছিলো। এখানে গায়ের জোরে দু’শো বিশ দেখেছিল, আরেকটু হলে কিনেই ফেলতো।  নাগিনী — ওহ ওটা তো কাহিনী, নৃত্য নয়। ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী’ মেহেদিও এমনটাই  বলেছিল। শালাম এবার তবে মেহেদির জন্যে অভিশপ্ত নগরী, পাপের সন্তানের খোঁজ  করতে যাবে? এত উপন্যাস পড়ে ঢোল হয়েছে সেই শালা, কিন্তু এখনও সত্যেন সেন পড়ে নাই। গল্পটা অবশ্য শোনা থেকেই আধেক জানত। ব্রিলিয়ান্টের আখড়া। ধুর, তার  বয়েই গেছে উপহার দেবার। আগে হোক, পয়সা হোক। 

বাতিঘরের আশেপাশে এসএ পরিবহন বা সুন্দ রবন কুরিয়ারের শাখা আছে? ওর বন্ধু মৈত্রীর ফ্ল্যাট পাশে। কিন্তু আজ সোমবার, জবের অন-টাইম থাকবে মৈত্রীর। ফোন  ধরবে না আর ফোনের রিপ্লাই দেবে না। বাতিঘর পার হয়ে অপটিক্সের এয়ার কন্ডিশনড  দোকানগুলো, ওসবের ভেতর ঢুকে কুরিয়ারের শাখার কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে না। কুয়ার পাড় নামের টঙের চাওয়ালাদের মোড়টাতে এক বিড়িখোরকে জিজ্ঞেস করলে আমতা আমতা করে জানিয়েছিল আন্দরকিল্লায় গেলে সুন্দ রবন পাবেন।  আন্দরকিল্লা এই তো সামনেই। কিন্তু কাঁধের ব্যাগে ল্যাপটপ আর বইয়ের বোঝা, ঘাড় ভেঙে পড়ছে। তবু হাঁটতে হবে। রিকশা ভাড়া অপব্যয় যেন না হয়। বলা বাহুল্য, এই  ল্যাপটপটা যক্ষের ধন। এটা বাগাতে মুখ বেচতে বড় যন্ত্রণা গেছে।  বাতিঘরের নান্দনিক খামটার উপরে আরও একটা খাম কিনতে বলেছিল, বলেছিল ওটা  তো শপিং ব্যাগ। মোটা ফ্রেমের চশমায় মেজাজ তিরিক্ষি করা লোকটা বলেছিল এসব।  বড় খাম বিশ টাকা নেবে না তো! না পাঁচ টাকাই তো চাইলো, বেশ! আগেরবার এসএ  পরিবহনে ‘গোরা’ পাঠাতে একশো টাকা সার্ভিস চার্জ কেটেছে। আবার দেওয়ানহাটের  সুন্দরবনে শালামের প্রিয় সোয়েটারটা পাঠাতে চার্জ কেটেছিল আশি টাকা।  শালাম একশত টাকার আধ ময়লা নোট বের করে বললে- কতো? অদ্ভুত! মাত্র পঁচিশ  টাকা! ভাংতি দিতে হবে যদিও। মোটা-ফ্রেম-চশমা লোকটিকে দরাজ বুকে টেনে সোহাগে ভরিয়ে দিতে পারত! ফ্রেমটাও বোধ করি আর মোটা নয়।  

হলো কী আজ! পচাত্তর টাকার বই আর পঁচিশ টাকার কুরিয়ার পেমেন্ট মিলিয়ে একশো টাকায় একটা ভ্যালেন্টাইনের কার্গো! খামের পাঁচটি টাকা ভিখিরিকে উৎসর্গ করেছে ভাবলেই হলো। সাভারে পল্লি বিদ্যুতের ঠিকানায় গছিয়ে দিয়ে ল্যাপটপ আর বই  বোঝাই ভারি ব্যাগে কাঁধ ব্যথা নিয়ে শালাম হলুদ টেম্পোতে উঠেছিলো। আন্দরকিল্লা না  এসে সকালবেলা গাঁয়ের বাড়ি যাবার জন্যে অক্সিজেন পৌঁছুলে তার কাঁধ ব্যথা করত না।  

ভ্যালেন্টাইন!! সস্তাখেকো চিন্তাভাবনা কোত্থেকে এল তার হঠাৎ উড়ে! কিন্তু সরস্বতী  পূজায় মানুষটির সাথে শালামের ঢাবি ঘুরে দেখা হল না। কথা ছিলো, হলো না তো।  উপলক্ষগুলো শুধু নষ্ট হলে উপলক্ষ না-গুলোও কালশিটে পড়বে। হতদরিদ্রের পক্ষেও  একশো টাকায় একটা দাঁও মারা যায়, গায়ে মাংস খসবে না। ফাগুনে ঐ ছেলেটি পরবে পাঞ্জাবি। ঘুরবে বন্ধু মহলে। শালাম থাকবে না। না, দরকার নেই। একশো টাকার একটা  কিছু গছিয়ে দিয়েছে সে। দিতে হয়। 

—একশো টাকার বই স্পাউসকে পাঠালেন।  

—হেসো না। 

এরপরে মেহেদি অশ্রুর ইমোজি দিয়ে বলেছিল, আপনি কেন আমার প্রেমিক হলেন  না? আফসোস হচ্ছে। 

—আমার মত মিসকিনের তুলনায় তোমার বইয়ের ভাণ্ডার প্রশান্ত মহাসাগর, নিদেন পক্ষে আটলান্টিক তো হবেই। তোমার বইয়ের ঘরটা দেখেই তো নতুন উপহার দেবার  আগ্রহ ফিকে হয়ে এসেছিল। দোকানী একটা। 

—এই বই পাঠানোর মধ্যে যতটুকু ব্যাপার আছে, বাকি কিছুতে নেই। কিচ্ছুতে না।

—এত কালেকশান যার, তাকে কচু পাঠিয়ে হবেটা কী! 

—আমার সত্যিই মন খারাপ হয়ে গেছে। আমার কপালে এমন কেউ জুটলো না কেন  কখনও! না ছেলে, না মেয়ে। 

—কী কও! নিজের সব সাবাড় করে ফেলেছ নাকি? 

—উৎসব নয়, পার্বণ নয় বা উৎসব-পার্বণে সই, শুধুই বই খুঁজে কোনও সুদূর থেকে পাঠিয়ে দেওয়া, আমার জন্যে। পড়বো বলে… ধুর মিয়া, বইয়ের তৃষ্ণা দেখলেন, এভাবে কেউ ভাবে, কেউ ভাবছে, আপনার চোখে পড়লো না? 

—ঠিক। বইয়ের ফাঁকা পৃষ্ঠায় কিছু একটা লিখে দেয়া হয়, কবিতা, চিঠি, কোটেশন।  যেই জিনিসটা সে ভালবাসে। 

—চুপ, আপনি চুপ। আমি একটা অভাগা। 

—এই যে। প্রেমিক না হলাম, তবুকি বই দিতে পারি না তোমায়? কিন্তু তুমি তো হলে একটা দোকান। 

—ধন্যবাদ। বইয়ের অভাব আমার নেই। কম্পিটিশনে প্রাইজ পেয়েছি, তিন বছর ধরে মাসে দুটো করে বই নিতে দেয় ওরা, একদম নিজের পছন্দ মতো। নিজেও কিনি প্রচুর।  ভালোবাসারও অভাব নাই। অনেকেই বাসে। হয়ত আমি বাসি না। তাছাড়া উপন্যাস  পড়বার ধৃষ্টতা ওদের হবে না। নেই, অমন ভালবাসার অভাব নেই। অমন বইয়ের অভাব  নেই। অভাব এই দুটোর কম্বিনেশনের। আজই আমার চোখে আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে দিলেন।

—এত আবেগি হলে চলবে! মন খারাপ করো না আমার ভাইটি। 

—হিংসে হচ্ছে ঐ ডাক্তারকে। মায়া হচ্ছে নিজের উপর। রাগ হচ্ছে আপনার উপর।

—ডাক্তার আমার উপর খুশি নয়। 

—তবে ছাইড়া দেন তারে। আমার সাথে প্রেম করেন। 

—এহেম, হেসে নিই। বুঝেছি তোমার সব ফোকর। 

—কচুটা বুঝেছে ন আপনি। 

দৈনিক বার্তার জারুলতলা ইদ সংখ্যায় ছাপিয়েছিল। একই সংখ্যায় দুটো লেখা।  মেহেদি হাসানের ‘অলীক মানুষ’। আর অন্য যুবকের একটা সুইসাইডাল। না কোনও  সম্পর্কনেই দুটি গল্পের। একই সংখ্যাতে ছাপিয়েছিল, শুধু এইটুকুই। তাছাড়া মেহেদি হাসান গল্প লিখেনি, লিখেছে এনালাইসিস।  

উপন্যাসের শুরুর বাক্যটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের  ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’- এর কর্নেল অরিলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার কথা। যেইভাবে কর্নেল  বুয়েন্দিয়া ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে স্মরণ করেছিলো অনেক দূর শৈশবে নিজের পিতার সাথে বরফ আবিষ্কারের কথা ঠিক সেই একইভাবে এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র শফিউজ্জামান স্মরণ করেন দুজন মানুষ অথবা মানুষ নয় অন্য কিছুর কথা। “দায়রা জজ ফাঁসির হুকুম দিলে আসামি শফিউজ্জামানের একজন কালো আর একজন শাদা মানুষকে মনে পড়ে গিয়েছিল।” আর তারপরে, ঠিক মার্কেজের মতই,  এই বাক্যের সাথে সাথে এক মহাকাব্যের সূচনা করেন কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। ধীরে ধীরে উন্মোচন করেন উনিশ-বিশ শতকের এক মুসলিম পরিবারের প্রায়  শত বছরের উপাখ্যান। আমরা প্রত্যক্ষ করি এক বর্ধিষ্ণু পরিবারের কথা। উত্থান দেখি পীর-মাজার প্রভৃতি বে-শরিয়তি কাজের বিরোধী এক ফরায়েজি আন্দোলনের নেতার,  যিনি কিনা কালে কালে নিজেই পরিণত হন পীরে। আমরা শফিউজ্জামানকে চিনতে থাকি,  যে কিনা ধীরে ধীরে আমাদের কাছে অচেনা হতে থাকেন এবং অত্যন্ত ব্যথিত চিত্তে লক্ষ্য করি সেই পরিবারের ক্ষয়। 

সুইসাইডাল নোটটিও জারুলতলা ছাপালো কেন তার সূক্ষ্ম কূটনীতি বোঝা দুষ্কর।  এইটির আলোচনা সোশ্যাল কমিউনিকেশন মাধ্যমে ভাইরাল হতে সময় নেবে না। কিন্তু  সব ঘটনা নিভৃত পরিসরে চাপা দেয়া হয়েছিল। এমনকী এটি যে আত্মহত্যা কোথাও  লেখা নেই। একটা নোট পাবলিশ করে যুবকের গুম হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে সুইসাইড  বলে রটিয়ে দিলে কেমন হয়! অথবা ঘটনা সত্য? কে গুম হয়েছে, শালাম? জারুলতলায়  লেখকের নামের পাশে হোসেন, মহসিন এমন আর কিছু লেখা নেই, কেন? শুধু এই  একটি শব্দ। শালাম। ভুল করেও কেউ ‘সালাম’ বলেনি। 

আগামী বসন্তে শালাম ঘুঙুর পরবে। ডাক্তার আর সে জাহাঙ্গীরনগর মেঠো রাস্তায় হেঁটে আলুপুরি খাবে। এবার সে নাচতে পারত না, সেবার সংশপ্তকের পায়ের পাতা  ঘেষে দাঁড়াবে, শিঙা ফুঁকে নেচে, হুল্লোড় করে জানাবে সেই ঘটনা, বিশ্বচরাচরে। বোটানি ডিপার্টমেন্টের কাশফুলের আড়ালে ওরা খুব গোপন কথাটি কইবে। শাপলাদিঘিতে অতিথিদের সাথে একবার উড়ে চক্কর দিয়ে আসবে শালাম। উড়ে যাবে না কারণ তার  ডাক্তার চশমার আড়ালে মিটিমিটি হেসে অপেক্ষায় থাকবে। বাসন্তী রঙেই থাকতে হবে শালামকে? গোলাপি কিংবা লাল, চলবে না? পারফিউমটা কোনও ফুলে র হওয়া চাই।  ডেইজি? আলুপুরি খাওয়ার পর দুটো ন্যাংটো অনাথ এসে ডিউ’র বোতলটা কেড়ে খেতে চাইবে — অনাথ! মানে বাপ-মা নেই! ওরা খাবার পায় না! পাঁচবেলা খাবার পায় শালাম।  জোর করে খাওয়ায় ওর কুসংস্কারাচ্ছন্ন মা আর বাপ। ওদের ভাই বোনদের এক টেবিলে জড়ো করা ছাড়া মা বাপ খায় না। ফকফকা আলোতে শুভ্র সকালের মতো সব সম্ভাবনা  সব ভবিষ্যত শালামের সামনে পরিষ্কার, সাথে সব বিপ্লব শালামের সামনে নিরর্থক হয়ে গেল। সে অলীক মানুষ। সে পাপের সন্তান, পাপীর নয়। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে সে কুলাঙ্গার, পাপী। জনক আর জননীর খেতে আর শুতে দেয়ার ঋণ স্বীকার না  করে শুধু সে ডাক্তার চেয়েছিল। যাও না, না জানার দেশে, শালাম। পাখিদের সাথে।  না পাখিরা সাইবেরিয়া যাবে। শালাম যাবে আরও গভীর অচেনা গন্তব্যে। ঋণে জর্জরিত  লোকটির জন্যে কিপ্টে হওয়াই ছিল বৈজ্ঞানিক সত্য। এ কারণে সে অতিথিদের সঙ্গে সাইবেরিয়ার মত ব্যয়বহুল দূরদেশে যেতে পারলো না। আরেকটি বসন্তও ঘুরে আসবে কিনা ঠিক নেই তার জীবনে। একদা নার্গিস ফুলে র প্রতি যৌনাকাঙ্ক্ষা তাড়িত না হয়েও  সে ভালবেসেছিলো। এখন তা হবে না, তা অসম্ভব। কেন অসম্ভব! এর কোনও জবাব  নেই। কিন্তু সে জানে সে আর নার্গিস ফুলদের ভালবাসতে জানে না। সে নিষিদ্ধ রকমের  ভালবাসতে পারে ঐ পুরুষ ডাক্তারকে। সম্ভব হলে অপেক্ষায় না রেখে পাখি হয়ে দুজনেই  উড়ে যেত সেখানে, যেখানে একশো দেড়শো অঙ্কের কোনও হিসেব থাকত না। কিন্তু  সে ঋণে জর্জরিত। অর্থের ঋণ শোধ করে দেয়া যায়। কিন্তু ভালবাসার ঋণ তিলে তিলে পাপে ছ্যাবড়া করে দেয়। ডাক্তারের কাছে সে তত ঋণী নয়। 

মেহেদি একশো পাঁচ ডিগ্রি জ্বরে কাঁদলো, শালাম ভাই! ফিরে আসো।  

প্রথম প্রকাশ: সমারূঢ়
(মন্দ্র প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রথম কুইয়ার ছোটগল্প সংকলন)

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.