
ইরফান নিশো
অপূর্ব জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। বন্ধ জানালার কাচে বৃষ্টি ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়ছে। তোফায়েল সাহেব অপূর্বের কাঁধে হাত রাখতেই অপূর্ব চমকে উঠলো। তোফায়েল সাহেব মুচকি হেসে বললেন, চমকানোর কিছু নেই। আমি। আবহাওয়াটা বেশ ভালো তাই না অপূর্ব? এবার চলো যাই।
অপূর্ব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তোফায়েল সাহেবের পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করলো। অপূর্ব কিছু সময় পর তোফায়েল সাহেবের সাথে একটা কক্ষে প্রবেশ করতেই তোফায়েল সাহেব দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
অনেক সময় পর অপূর্ব কক্ষ থেকে বের হলো। বৃষ্টি এখনো কমে নাই। এখানের কাজ শেষ, সুতরাং এখানে আর এক মুহূর্তও বসা যাবে না। অপূর্ব রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির ফোঁটা গুলো বিন্দু বিন্দু করে অপূর্বকে ভেজাতে লাগলো।
কিছু সময় পর তোফায়েল সাহেব বের হলেন। রাস্তার পাশেই তার কালো রঙের গাড়িটা রাখা। তোফায়েল সাহেব অপূর্বকে দেখেও দেখলেন না, যেন অপূর্বকে তিনি চেনেনই না। অপূর্ব বারবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কিছু সময় পর তোফায়েল সাহেবের নির্দেশে একটা রিকশা পাঠানো হলো অপূর্বর জন্য।
রিকশাচালক অপূর্বকে দেখে বললো, ভাই ওঠেন। অপূর্ব খেয়াল করলো দূরে তোফায়েল সাহেবের গাড়ি থেমে আছে এবং গাড়ির ড্রাইভার ছাতা হাতে অপূর্বর দিকে তাকিয়ে আছে।
অপূর্ব রিকশাচালককে বলল, আপনি চলে যান। আমার রিকশা লাগবে না।
—ভাইজান ওঠেন, ভাড়া দেওয়া লাগবোনা, আপনার ভাড়া এক ভদ্রলোক দিয়া দিছে।
—ভাড়াটা আপনি রেখে দিন। অপূর্ব একবার তোফায়েল সাহেবের গাড়ির দিকে তাকিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে হাঁটতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর পর আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। অপূর্ব একটা মদের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো। অপূর্বর সমস্ত শরীর ভেজা, চুল বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ছে। একটা বৃদ্ধ লোক অপূর্বের দিকে এগিয়ে এসে বললো, কিরে এই বৃষ্টির মধ্যে কোথা থেকে এলি? সন্ধ্যাও তো নেমে এলো। অপূর্ব প্যান্টের পকেট থেকে দুটো ভেজা এক হাজার নোট বের করে বললো, আলম চাচা মাল দাও, পিনিক ধরা মাল।
—এই বয়সে তুই আর কত মাল খাবি?
—জ্ঞান দিও না তো চাচা। তোমার লাগবে টাকা আর আমার লাগবে মাল। আলম মিয়া নোট দুটো রেখে এক বোতল মদ নিয়ে আসলো।
মদ হাতে অপূর্ব আবার হাঁটা শুরু করলো। বৃষ্টি ভেজা শহরটা আজ বড্ড ফাঁকা। দু’চারজন লোক পথে থাকলেও গাড়িঘোড়া তেমন নেই।
অপূর্ব মদের বোতল হাতে একটা ওভারব্রীজের মাঝে গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসলো। অপূর্ব হা হা করে হাসছে আর মদের বোতলে চুমুক দিচ্ছে। বৃষ্টি ঝরে পড়ছে, চারিদিকে জনমানব শূন্য। অপূর্ব নেশাতুর কণ্ঠে গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করলো। মদ শেষ হতেই অপূর্ব উঠে দাঁড়ালো। হঠাৎ একটা লোক ছাতা হাতে টর্চজ্বালিয়ে ওভারব্রিজের উপর উঠলো। লোকটা অপূর্বর চোখের দিকে টর্চের আলো ফেলতেই অপূর্ব চোখ মুখ কুঁচকে এক হাত দিয়ে টর্চের আলোকে বাঁধা দিতে চাইতেই ডান পা ফসকে নিচে পড়ে গেলো এবং সাথে সাথে একটা ট্রাকের ধাক্কায় ছিটকে পড়লো অপূর্বর শরীর। রাস্তায় পড়ে থাকা অপূর্বর শরীর আর দুটো চোখের অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শরীর গড়িয়ে রক্ত বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে পিচঢালা পথে পড়ছে।
১৩ বছর আগে
ছয় বছরের ছোট্ট শিশু সিধু। বাবা আনোয়ার হোসেন। পেশায় শিক্ষক। হাসপাতালে বসে যখনই সিধুর মা লাইজুবেগম প্রথম সিধুকে আনোয়ার হোসেনের কোলে তুলে দিয়েছিলো তখনই মুখ দেখে একমাত্র ছেলের নাম রেখেছিলো সিধু। আনোয়ার হোসেনের বড় মেয়ে তানিয়া মুখ ভার করে হাসপাতালে এক কোনে বসে রইলো। ভাই হওয়াতে সে একদমই খুশি না।
কারণ সবাই বলাবলি করছে, কিরে তানিয়া তোকে তো আর তোর বাবা মা বেশি ভালবাসবে না। এখন তোর ভাইকেই সবাই ভালোবাসবে। এভাবেই কেটে যায় দিনের পর দিন। সবার চোখের সামনেই সিধু আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে।
দুধে আলতা চেহারার জন্য সিধুকে তার ছোট মামা হালিম মিয়া প্রিন্স বাবু বলেই ডাকতো। স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি বলে সারাদিন সিধু ছোটাছুটি করেই কাটাতো বেলা। বাবা আনোয়ার হোসেন ব্যস্ত সারাদিন স্কুল নিয়ে আর মা লাইজুবেগম পেশায় নার্স। বোন তানিয়া সেও লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত। সিধুকে সময় দেওয়ার মতো সময় পড়ে থাকে শুধু রাতে। সুনসান দুপুরবেলা। সিধুদু হাত মুখে চেপে ধরে শতকিয়া গুনছে। এক, দুই, তিন, বিশ, ত্রিশ। সামিম সিধুকে দেখে বলল, কিরে সিধুকি করছিস? সিধুগোনাগুনি বন্ধ করে বলল, লুকোচুরি খেলছি কাকা। সিধু আবার চোখ বুঝে গুনতে শুরু করলো।
সামিম এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, এই সিধু আমায় তোদের সাথে খেলতে নিবি? সিধু উত্তেজিত হইয়ে বলল, কি মজা কি মজা সামিম কাকা আমাদের সাথে খেলবে। কি মজা, কি মজা। সিধুর বন্ধুরা সবাই বেরিয়ে পড়লো আর বলল, কি সিধুতোর কি হইছে?
—সামিম কাকাও আমাদের সাথে খেলবে।
সিধুর একটা বন্ধু বলল, বড় মানুষ নিয়া খেলবো না।
সামিম বলল, ধুর আমি বড় নাকি? দাঁড়া আমি আঙুল ফুটাই। ফোটা আঙ্গুল যে ধরবে সে হবে চোর।
সামিম বুদ্ধি করে আসিফকে চোর বানালো। সবাই যে যার মতো করে লুকিয়ে পড়লো।
সিধুকে নিয়ে সামিম পুরাতন একটা পরিত্যক্ত ঘরে লুকিয়ে পড়লো। কিছু সময় পর সিধু বলল, কাকা এখানে খুব অন্ধকার,আমার ভয় লাগছে।
—আরে পাগল ভয়ের কি আছে? আমি তো আছি। এই দেখ আমি তোকে জাপটে ধরছি।
—উফ কাকা এখানে অনেক গরম, আমি বের হব।
—ধুর বোকা, তুই বের হলেই তো আসিফ তোকে ধরে ফেলবে।
কিছু সময় পর সামিম সিধুর পরনের হাফ প্যান্ট এক টানে খুলে ফেলল।
সিধু বলল, কাকা কি করছেন! আমার প্যান্ট কই? সামিম বলল, এই দেখ সিধু আমিও আমার পরনের লুঙ্গী খুলে ফেলেছি। আর আমাদের গরম লাগবে না।
সামিম সিধুকে কোলে তুলে নিয়ে চুমু খেতে লাগলো। সিধুখিলখিল করে হেসে বলছে, কাকা আমার কাতুকুতু লাগছে।
অনেক সময় হয়ে গেছে…
সিধুর বন্ধুরা সবাই সিধুকে ডাকতে ডাকতে পুরাতন ঘরটির কাছে এসে পড়েছে। সামিম সিধুকে কোল থেকে নামিয়ে বলল, সিধু জলদি প্যান্ট পর। আর শোন আমাদের এই লুকোচুরি র কথা কাউকে বলবি না, খবরদার। এটা হলো বড়দের লুকোচুরি । সিধু বলল, কাকা এই খেলায় আর কাউকে নিবেন না?
সামিম বলল, না। এই খেলা শুধু দুজনে মিলে খেলতে হয়। সন্ধ্যা নেমে এলো।
সন্ধ্যা থেকে সিধু গভীর চিন্তায় চিন্তিত। লাইজু বেগম আনোয়ার হোসেনকে বলছে, শোন, এই আসছে মার্চের ২৭ তারিখ সিধুর ছয় বছর হবে। নতুন বছর আসতে আসতে প্রায় ওর সাত বছর হয়ে যাবে। তাই বলছিলাম আগামী বছর থেকে ওকে স্কুলে ভর্তি করাবো।
আনোয়ার হোসেন বলল, তানিয়াকে যখন স্কুলে ভর্তি করেছি, তখন ওর বয়স আট বছর। এত জলদি কি আছে, আর ছেলে তো আমার এখন ছোট।
লাইজুবেগম বলল, তবুও এইটুকু ছেলে, সারা দিন বাসায় একা থাকে। তানিয়াও তো স্কুলে থাকে। কাজের বুয়ার কাছে আর কত দিন সিধুকে রেখে যাব? আনোয়ার হোসেন বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। নতুন বছর আসুক তারপর দেখা যাবে। রাতে সিধু তার বোন তানিয়ার পাশে শুয়ে আছে।
কিন্তু চিন্তাটা তার মাথা থেকে কিছুতেই নামছে না। বারবার সিধুর মনে একই প্রশ্ন জাগছে, সামিম কাকার পাখিটার চুল আছে কিন্তু আমার পাখির নিচে চুল নেই কেন? সিধু বার বার নিজের পাখিতে হাত দিচ্ছে আর দেখছে চুল আছে কিনা। আর এই কথাটা ভাবতে ভাবতে সিধু শুয়ে পড়লো। এভাবেই আসতে থাকে প্রতিদিন এক নতুন সকাল আর রাত নিয়ে হাজির হয় নতুন কোন প্রশ্ন।
গোপন রাখা প্রশ্ন নিয়েই শুরু হয় সিধুর নতুন জীবন। সিধু আস্তে আস্তে বুঝতে শিখে গেছে সে আর পাঁচটা লোকের মত নয়। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া সিধু পুকুর পাড়ে বসে পুরুষদের গোসল করা দেখতেই বেশি উপভোগ করে। সে ক্ষেত্রে সিধুর বয়সী বাচ্চারা ব্যতিক্রম।
আর এ ক্ষেত্রে সিধুকে বাধা দেওয়ার মতো কেউ নেই। কারণ ছেলে হয়ে ছেলেদের গোসল দেখা সাধারণ ব্যাপার।
আজ দুপুরে স্কুল মাঠে ক্রিকেট ম্যাচ। সিধুর বন্ধু আজিম দুপুরে র আগেই সিধুর বাসায় হাজির। সিধু আজিমকে দেখে বলল, কিরে আজিম তুই? আজ তো স্কুল আর প্রাইভেট সবই বন্ধ।
আজিম বলল, কেন তোর মনে নেই আজ স্কুল মাঠে ক্রিকেট ম্যাচ আছে।
—হু আছে তবে যাব কিনা তাই ভাবছি। আচ্ছা আজিম, আমাদের স্কুল থেকে খেলবে কে কে?
—রনি ভাই, শাওন ভাই, উজ্জ্বল ভাই আর তরিক ভাই আর কে কে আছে আমি জানি না।
—তরিক ভাই খেলবে? তাহলে যাব।
—তরিক ভাই খেললে যাবি কেন?
—উমমমমম সে ভালো খেলে বলে তাই। চল যাই।
ক্রিকেট ম্যাচ শেষে সিধুর বাসায় আসতে প্রায় সন্ধ্যা। সিধুর মনে একটাই ভয়।
তা হলো আনোয়ার হোসেনের ভয়। লোকটার বয়স বাড়ার সাথে সাথে রাগটাও দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে। রাস্তা দিয়ে আসার সময় সিধু বারবার দুয়া ইউনুস পড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই সিধুর দুয়াটা মনে পড়ছে না। সিধুতার মায়ের মুখে শুনেছে এই দুয়া পড়লে বিপদ কেটে যায়। কিন্তু সিধুর এই এক সমস্যা বিপদ আসলেই সে মাঝে মাঝে এই দুয়াটা ভুলে যায় কিন্তু মাঝে মাঝে অকারণেই সিধুর এই দুয়া মনে পড়ে। সন্ধ্যা ৭.৩০ বাজে। আনোয়ার হোসেন এখন বাসায় আসেনি। লাইজুবেগম চোখে চশমা দিয়ে উল দিয়ে সোয়েটার বুনছে। তানিয়ার জ্বর এসেছে সে তার ঘরে আলো নিভিয়ে শুয়ে আছে। সিধুকে দেখেই সিধুর মা বলল,খাবার টেবিলে এক গ্লাস দুধ রাখা আছে। তোর বাবা আসার আগে খেয়ে পড়তে বস। সিধু পড়ার টেবিলে বই খুলে পড়তে বসলো। সিধুর পড়ার টেবিলে বসে মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন আসলো। বিয়ে শুধুছেলেমেয়েদের সাথে হয় কেন?
ছেলে-ছেলের বিয়ে হতে পারে না? আসলে সিধু নিজেও জানে এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। তবে সিধু নিজেই বুঝতে পারছে সে অন্য সবার থেকে একটু ব্যতিক্রম। তবে সে রক্তে মাংসে মানুষ এটুকু সে নিশ্চিত। এভাবেই বিভিন্ন প্রশ্ন জন্মাতে থাকে সিধুর মনে যার কোনো সঠিক উত্তর নেই।
ক্লাসে খুব একটা ভালো ছাত্র নয় সিধু। বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয়েছে আজ। ছোট্ট সিধু আজ আদরের গন্ডি পেরিয়ে শাসনের কারাগারে বন্দী। তানিয়া দশম শ্রেণীর ছাত্রী। সামনে তানিয়ার এসএসসি পরীক্ষা। লেখা পড়ায় তানিয়া খুবই ভালো। আনোয়ার হোসেন সিধুর রেজাল্টের খবর আগেই পেয়েছে।
আনোয়ার হোসেন লাঠি হাতে সিধুকে বলল, সিধুতোর রেজাল্ট কার্ড দেখা। সিধু থরথরে হাতে মার্কশিট আনোয়ার হোসেনের দিকে এগিয়ে দিলো। সিধু আনোয়ার হোসেনের রাগী চোখ দেখেই কাঁদতে কাঁদতে বলল, বাবা সামনের পরীক্ষায় ভালো হবে। আনোয়ার হোসেন সিধুকে লাঠি দিয়ে পেটাতে লাগলো আর বলল, বল তুই আমার ছেলে হয়ে এত খারাপ রেজাল্ট করলি কি করে? আমার মান-সম্মান কিছুই তো তুই রাখলি না। স্যারদের গিয়ে এখন আমি কি বলবো? সিধু চিৎকার করে বলছে, মা বাঁচাও! আপু বাঁচা! বাবা আর করবো না বাবা মাফ করো! লাইজু বেগম রান্নাঘর থেকে ছুটে আসলো। তানিয়াও মায়ের পাশে এসে দাঁড়ালো। লাইজু বেগম আনোয়ার হোসেনের হাত থেকে লাঠিটা কেড়ে নিয়ে বলল, কি শুরু করেছো? ছেলেটাকে কি মেরে ফেলবে? রেজাল্ট খারাপ হয়েছে হোক। সামনে ভালো করবে। আনোয়ার হোসেন বলল, এই তুমিই ছেলেটাকে লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলছো। সিধু পড়ার টেবিলের এক পাশে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তানিয়া পড়া থামিয়ে বলল, কাঁদিস না। লেখাপড়া না করলে তো মার খাবিই। রাতে আনোয়ার হোসেন আলো নিভিয়ে তার ঘরে শুয়ে আছে। আনোয়ার হোসেনের ঘরের দেয়ালে একটা খয়েরি রঙের ঘড়ি ঝুলানো আছে। যদিও রাতের অন্ধকারে ঘড়িটা বোঝা যাচ্ছে না শুধু টিকটিক শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই মুহূর্তে এই শব্দটাও বিরক্ত লাগছে আনোয়ার হোসেনের। এক মাত্র ছেলের গায়ে হাত তুলে সে নিজেই অনুতপ্ত । কিন্তু কি আর করবে? শিক্ষকের ছেলে হয়ে এমন ফলাফল কাম্য নয়। সময় আর মানুষ দুটোই পরিবর্তনশীল।
আগে আনোয়ার হোসেন খুব শান্ত প্রকৃতির মানুষ ছিলো। কিন্তু এখন বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেও খিটখিটে স্বভাবের হয়ে গেছে। পরের দিন দুপুরবেলা আনোয়ার হোসেন বারান্দায় বসে আছে।
আনোয়ার হোসেন খেয়াল করলো সিধু বাসার সামনে বসে খালি গায়ে কিছু একটা করছে। গতদিনের আঘাতের দাগ গুলো এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
আনোয়ার হোসেন আস্তে আস্তে গিয়ে সিধুর পাশে দাঁড়ালো। সিধু বাবাকে দেখেই চমকে উঠলো। আনোয়ার হোসেন সিধুকে বলল, কি করছিস এখানে?
—ঐ স্কুল থেকে ফেরার সময় একটা কামিনী গাছ কিনলাম।
—কিন্তু বাবা কামিনী গাছে তো বাড়ির পরিবেশ নষ্ট হয়। গাছটা খুব বড় হয় তো তাই।
কথাটা শুনে সিধুর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সিধু তবুও গাছটা লাগালো।
সিধু আনোয়ার হোসেনকে বলল, বাবা!
—কি সিধু কিছু বলবি?
সিধু না সূচক মাথা নাড়লো। আনোয়ার হোসেন বলল, আরে বলেই ফেল। কি বলবি?
—বাবা তুমি এই গাছটা কাটবে নাতো?
—না কাটবো না। সিধু মুচকি হাসি দিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। আনোয়ার হোসেন সিধুর দিকে তাকিয়ে রইলো। কি নিষ্পাপ এই হাসি। এভাবেই দিনের পর দিন কাটতে কাটতে কয়েক বছর কেটে গেলো। আনোয়ার হোসেন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে লক্ষ্য করলো তার মাথার প্রায় অর্ধেক চুল পেকে গেছে। এমনকি চামড়ায়ও পড়েছে ভাঁজ।
লাইজু বেগম আনোয়ার হোসেনের দিকে চশমা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, কি গো স্কুলে যাবে না? দেরী হয়ে যাবে তো।
আনোয়ার হোসেন চশমা পড়তে পড়তে বলল, হ্যাঁ যাবো। আনোয়ার হোসেন বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। আনোয়ার হোসেন লক্ষ্য করলো কামিনী গাছটা অনেক বড় হয়ে গেছে। চারিদিকে ডালপালা গজিয়েছে তাই গাছের চারপাশটা অন্ধকার। প্রতিদিন আনোয়ার হোসেনের এই গাছটার পাশ দিয়েই যাওয়া হয় কিন্তু গাছটা যে এত বড় হলো সেটা আজই চোখে পড়লো আনোয়ার হোসেনের। কালক্রমে সবকিছুই পরিবর্তন হয়েছে।
লাইজু বেগম তার পেশা জীবন ত্যাগ করেছে তিন বছর হলো। এখন সে একজন গৃহিণী।
তানিয়া এখন অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী।
প্রথম প্রকাশ: সমারূঢ়
(মন্দ্র প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রথম কুইয়ার ছোটগল্প সংকলন)