
সিনথিয়া
—ভাইয়া, একটু শুনবেন?
—না, না, এইখানে কোনো টাকা পয়সা হবে না।
—সকাল সকাল কোত্থেকে যে এসে এসব উটকো ঝামেলা হাজির হয় বুঝি না আমি।
একটুও অবাক হলো না সুইটি, এরচেয়েও বাজে ব্যবহার স্বাভাবিকই তার কাছে। তাই একটুও দমে না গিয়ে ফের জিজ্ঞাসা করলো, ভাইয়া এইটা নূতনযাত্রার অফিস না? আপনাদের একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম লিটল ম্যাগ নিয়ে, লেখা আহ্বান করেছেন নতুন সংখ্যার জন্যে সেজন্য আমি— সুইটির কথা শেষ করতে না দিয়েই ডেস্কে বসা লোকটা একবারও সুইটির দিকে না তাকিয়ে ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললো, “আর তার খোঁজ পেয়ে চলে এসেছেন টাকা তোলার জন্য? আপনাদের মতলবই তো এই, কোথায় কিছু একটা হচ্ছে সাথে সাথে টাকা তোলার জন্য হাজির। সরকার তো এতকিছু করতেছে এখন আপনাদের জন্য, তাও টাকা তোলাই লাগে কেন আপনাদের বুঝিনা। এসব অভ্যাস কবে যাবে আপনাদের? এসবের জন্যই হিজড়া দেখলেই আমরা স্বাভাবিক মানুষেরা দশ হাত দূরে পালাই। যান তো এখান থেকে বিরক্ত না করে, এমনেই লিটল ম্যাগ করে বনের মোষ তাড়াচ্ছি তারমধ্যে আবার এসব এসে জুটে, যত্তসব।”
এবার কিছুটা কাতর হয়েই সুইটি বললো, ভাইয়া আমার কথাটা তো একবার শুনবেন! টাকা তুলতে আসিনি আমি এখানে।
—তাহলে?
—আমি একটা লেখা নিয়ে এসেছি আপনাদের কাছে, ছাপানোর জন্য।
“দেখেন, কোনো সাহায্যের আবেদন আমরা ছাপাই না আগেই বলে রাখলাম, স্পন্সর পাইতেই দুনিয়া উদ্ধার হয়ে যায়, সাহায্যের আবেদন ছাপাইতে পারবো না আমরা, বুঝতেছেনই তো অবস্থা।” আগের বারের চেয়ে কিছুটা নরম হলো লোকটার স্বর।
—না ভাইয়া, আমি একটা গল্প নিয়ে এসেছি, ছাপানোর জন্য।
তাই? এবার কিছুটা কৌতূহল লক্ষ্য করা গেল টেবিলের ওপাশ থেকে।
“কই, দেন দেখি কী লিখেছেন? সাথে আছে?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ” বলে দ্রুত ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে স্ট্যাপল করা কয়েকটা কাগজ এগিয়ে দিলো সুইটি ডেস্কের ওপাশে থাকা লোকটার দিকে। আমি কি তাহলে চলে যাবো?
আরে দাঁড়ান, আগে পড়ে তো নিই কী লিখেছেন, বসেন বসেন একটু।
লোকটা পড়তে শুরু করলো — আমার জীবনকাহিনী আমার নাম সুইটি। আড়ং-এর প্রোডাকশন হাউজে আছি। প্রতিটি মানুষের বড় হওয়ার পিছনে কিছু না কিছু কাহিনী থাকে। আমার জীবনেও রয়েছে এমন অনেক সুখ ও দুঃখের কাহিনী। আমি সেখান থেকেই কিছু মুহূর্তের কথা আপনাদের সাথে প্রকাশ করতে চাই। ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম অন্যরকম, আমার পু তুল নিয়ে খেলতে ভালো লাগতো। সারাদিন বাসায় থেকে মায়ের সাথে কাজকর্ম করতে আনন্দ লাগতো। মায়ের সাথে হাড়ি-পাতিল,ঘর মোছা, রান্নার কাজে সাহায্য করতাম। বাইরের আড্ডা, খেলাধুলা পছন্দ করতাম না। যখন স্কুলে ভর্তি হলাম বন্ধু -বান্ধব আমার চলাফেরা দেখে আমাকে অনেক আজেবাজে কথা বলতো। বেঞ্চের প্রথম সারিতে উঠিয়ে পিছনের বেঞ্চে পাঠায়ে দিতো। বাসায় এসে মায়ের সাথে অনেক কান্নাকাটি করতাম। তখন মা আমাকে বোঝাতো তোকে বড় হতে হবে। লেখাপড়া করতে হবে। এই পণ মনের মধ্যে গড়ে কারো কথা মনে না নিয়ে এগোতে শুরু করলাম। আমি যখন ক্লাস ফাইভে এ পড়তাম তখন বাসায় ব্যাচ পড়ানো শুরু করলাম। তখন আমি বেতন পেতাম মাত্র ২০০ টাকা। ঐ টাকা দিয়ে প্রথম আমার মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনছিলাম। আমার মা আমাকে জড়ায়ে ধরে কান্না করে দোয়া করেছিল যাতে আমি অনেক বড় হতে পারি। তারপর আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি বাসায় কিছু মেয়েদেরকে নাচ শিখাতাম । যখন আমি মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করলাম তখন আমি আমার বাবার সাথে গরুর ফার্মে যোগ দিলাম। সেসময় আমাদের গরুর দুধ এলাকার সব বাসায় বাসায় আমি দিয়ে আসতাম। বিভিন্ন বাসার লোকেরা আমাকে বিভিন্ন কথা বলতো। কেউ কেউ আমাকে ঘৃণা করে হিজলা ডাকতো। আমার অনেক খারাপ লাগতো। গরুর গোবর পরিষ্কার করা, গরুর যত্ন সব কিছু আমি করতাম। তারপর আমার জীবনে একজন ভালো বন্ধু আসলো। সে আমাকে সময় দিতো। আমিও অনেক কিছুতাকে শেয়ার করতাম। কিন্তু এই সম্পর্ক বেশিদিন টিকলো না। সেও অন্য একটি মেয়েকে ভালোবেসে আমার থেকে দূরে চলে গেল। আমি তখন নিজেকে সেইভাবে তৈরি করতে চাইলাম যেই অবস্থায় আমি আমার পরিবারকে ভালো রাখতে পারবো। আমি আড়ং এ কাজে জন্য আবেদন করলাম। সেখানে তিনশো জনের মধ্যে দশজন ফাইনাল হলো তারমধ্যে একজন আমি। আমি আমার মতো করে কাজ শুরু করলাম। অনেকে আমাকে হিজলা বলে ডাকতো কিন্তু আমি আমার ভালো কাজের জন্য আপাদের কাছে অনেক সুবিধা পেতাম। তারা আমার কাজ পছন্দ করতো। I got benefit from my good work. তখন সেই আয়ের টাকা দিয়ে আমি সংসারের জিনিসপত্র কেনা শুরু করলাম। ঘরের জিনিসপত্র, বোনদের জন্য লিপস্টিক, মায়ের জন্য শাড়ি আরো কিছু ছোট জিনিস দিয়েও ওদের মুখে অনেক হাসি দেখতে পারতাম। আর আমি আগেও বলেছিলাম যে, আমার এখানে আসার পেছনে আমার ফ্যামিলি থেকে অনেক সাপোর্টছিল। তারা যদি আমাকে মেনে না নিতো, কখনোই আমি এইখানে এসে দাঁড়াতে পারতাম না। সেই ছোট জায়গা থেকে আজকে আমার এত বড় একটা প্রতিষ্ঠান। যেখানে প্রায় দুইশজন কর্মী আমার। আমি জীবনে অনেক বাধা অনেক কষ্ট পেয়েছি কিন্তু আমি থেমে যাইনি। ধীরে ধীরে যেভাবে পারি আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি আমার গ্রামের বাড়িতে একটি দালান করেছি। আমার মা-বাবার মাজার ঠিকভাবে যত্ন করতে পারছি। আমার এখন একটাই ইচ্ছা যারা আমার মতো আছে, যারা এইভাবে সমাজের কাছে লাঞ্ছিত, অনেকের পরিবারও মেনে নিচ্ছে না তাদের নিয়ে একটি এনজিও খোলা। সেইখানে যাতে তারা একটু ভালো থাকতে পারে । আসলে সত্যি বলতে কি, আমি খুব ভাগ্যবান এবং ব্যক্তিজীবনেও আমি সুখী। আমি আমার পরিবার নিয়ে অনেক ভালো আছি। আমার সততা, মায়ের ভালোবাসা, সবার দোয়া আমাকে জয়ের পথে এনে দিয়েছে।
—ব্যস, এইই?
—কেন ভাইয়া খু ব খারাপ কী?
—না, মানে আর কিছু নাই? এই ধরেন আপনাদের তো অনেক স্ট্রাগল থাকে, স্যাড স্টোরি থাকে সেসব একটু লিখতে পারলেন না? —কেন ভাইয়া স্ট্রাগলের স্টোরি তো লিখেছি আমি আমার, আজ এইখানে আসতে তো কম স্ট্রাগল করতে হয়নি আমার, সবই তো লিখেছি ।
—আসলে বুঝলেন পাঠক তো একটু মাসালা চায় এইসব লেখায়, অনেক স্যাড স্টোরি থাকবে, তাইলে না পাবলিক এসব খাবে? এইসব হ্যাপি এন্ডিং গল্প পাবলিক আসলে খাবেনা আপা, হিজড়ার গল্পে তো এইসব একটু থাকা লাগে বুঝছেন? তো আমি একটা সাজেশন দেই আপনারে, আপনি গল্পে একটু স্যাড জিনিসপাতি এড করেন, যেসব পাবলিকে খায় আর কী। একটা অন্যরকম গল্প ছাপাইলে তো আমাদেরও লাভ বুঝেনই তো, তাই বলতেছিলাম আর কী।
—তাহলে তো গল্পটা আর আমার থাকলো না, আমি তো এখানে আমার গল্প বলতে এসেছি, মিথ্যা কিছুকেন লিখবো আমি বলেন?
—না না তা কেন, কিন্তু দেখেন, আপনাদের জীবনটাই তো মিথ্যা দিয়ে বানানো।, নতুন কিছু এড করলে যদি পাবলিক গল্পটা খায় তাইলে তো সমস্যা নাই না? এবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো সুইটি। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, থ্যাংক ইউ ভাইয়া, আমার জীবন আমার কাছে কতটা সত্যি সেটা আমাকে আরেকবার বোঝানোর জন্য। আমার জীবনের গল্প পাবলিককে খাওয়ানোর জন্য আর কোনো মশলা দিতে হবে না।
দিন— লেখাটা ফেরত দিন। আমার লেখা একদিন আমি নিজেই ছাপা অক্ষরে বের করবো — পুরো সত্যি গল্প। লেখাটা হাতে নিয়ে লোকটাকে কিছু আর বলতে না দিয়েই বেরিয়ে এলো সুইটি। চোখেমুখে তখন তার এক আশ্চর্যদৃঢ় দীপ্তি।
প্রথম প্রকাশ: সমারূঢ়
(মন্দ্র প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রথম কুইয়ার ছোটগল্প সংকলন)