
অনু ইসলাম
[এই গল্পের কাহিনী এবং সবগুলো চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক । জীবিত বা মৃত কারো সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।]
আয়নায় নিজেকে দেখছেন রাবেয়া সুলতানা। আজ শিপলুর দেওয়া একটা শাড়ি পরেছেন তিনি। এক বৈশাখে এই শাড়িটা উপহার দিয়েছিলেন শিপলু। সাদা তাতের শাড়িতে লাল কালো ছাপ। যখনই এই শাড়িটা পরা হতো শিপলু তার কপালে একটা লাল টিপ পরিয়ে দিত। উনি চাইতেন না পরতে, শিপলু জোর করে পরিয়ে দিত। মাকে সাজাতে বড় ভালোবাসত শিপলু। হ্যা, ভালোবাসতো। অতীতকাল। শিপলু— ফারিহান ইসলাম শিপলু, রাবেয়া সুলতানার একমাত্র পু ত্র সন্তান এখন অতীত হয়ে গেছে। বর্তমান হয়ে আছে শুধু তার স্মৃতিগুলো। রাবেয়া সুলতানা শাড়ির আঁচলে ধীরে ধীরে হাত বুলান। যেন তার শিপলুর স্পর্শ অনুভব করতে চান। আয়নায় তাকান তিনি।
খুব ইচ্ছে হয় একটা লাল টিপ পরার কিন্তু মেয়ে আর জামাতার কথা ভেবে থেমে যান। তার মেয়ে জামাই এখন লম্বা দাড়ি রেখেছে, টুপি পরে থাকে সবসময়। যদিও স্ত্রী সন্তানের ভরণপোষণ করার জন্য আয় রোজগার করার দিকে কোন মনোযোগ নাই। ঘরে বসে থেকে শ্বশুরশাশুড়ির টাকায় খাচ্ছে আর প্রতিটা বিষয়ে ধর্মের বিধিনিষেধ জাহির করছে। তার মেয়ে এখন হিজাব পরে আর সারাক্ষণ অন্যরা ধর্মপালন করছে কি করছে না সেই হিসাব নিকাশ করে। এদিকে তাকে একাই সংসারের সব ঝামেলা সামলাতে হয়। তাদের ধর্ম এখন দাড়ি-টুপি আর হিজাবের মধ্যে ঢুকে যাবে। মেয়ে স্বামী সন্তান নিয়ে ননদের বাড়ি বেড়াতে গেছে। রাতে খেয়ে ফিরবে। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছেন রাবেয়া সুলতানা। ছেলে-মেয়ে বিকেল চারটায় আসতে বললেন।
(২)
মাসখানেক আগে ছেলেমেয়ে দুটো তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। তিনি তখন ক্লাস নিচ্ছিলেন। অচেনা নম্বর দেখে তিনি ফোন ধরে বলেন যে তিনি ব্যস্ত আছেন, পরে কথা বলবেন। ক্লাস শেষে তিনি ঐ নম্বরে ফোন করে কথা বলেন। ওরা শিপলুর এক বন্ধুর কাছ থেকে রাবেয়া সুলতানার মুঠোফোন নম্বর জোগাড় করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছে এরা। শিপলুর ওপরে ওরা একটা প্রতিবেদন তৈরি করছে। শিপলুর বিষয়েই ওর সঙ্গে কথা বলতে চায় । শিপলুর বিষয়ে কি জানতে চায় ওরা? এতদিনে অনেক কিছুতেই প্রকাশ হয়ে গেছে। ছোটবেলা থেকেই শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি গভীর টান ছিল শিপলুর। নাচ-গান, আবৃত্তি, অভিনয়ের সঙ্গে সে জড়িয়ে ছিল। ওরা নিশ্চয়ই এসব কিছু ওনার কাছ থেকে জানতে চাইবে নাহ। এসব বিষয়ে ওনার থেকে ভালো বলতে পারবে ওর সহকর্মীরা। রাবেয়া সুলতানা সেই কথা বলেই তাদেরকে এড়িয়ে যেতে চান। ছেলেমেয়ে দুটো নাছোড়বান্দা আর এত মায়া নিয়ে কথা বললো ওরা যে তিনি সরাসরি নাও করতে পারলেন না। তবে আজ নয় কাল নয় করে কয়েক মাস পার করে দিলেন। এর মাঝেই তিনি একদিন তার মেয়ে ও জামাতার কাছে বললেন ছেলেমেয়ে দুটোর কথা। ওদের কথা শুনেই রেগে গেলেন দুজনেই। মেয়ে বেশ কড়া স্বরেই বললো— তুমি মানা করে দিয়েছ তো ওদের? “না, মানা করিনি। দেখি কি জানতে চায়।” “কী জানতে চায় মানে? তুমি বোঝো না কি জানতে চায়? ও তো মরেনি, আমাদের সবাইকে মেরে রেখে গেছে। কারো কাছে মু খ দেখাতে পারি না।” মেয়ের কথায় আহত হন রাবেয়া সুলতানা। শ্লেষ মিশিয়ে বলেন— মুখ দেখাতে পারছো না, তেমন কিছুতো দেখছি না। প্রতিদিনই তো বাইরে যাচ্ছে। হ্যাঁ, মুখ ঢেকে যাচ্ছো তা ঠিক। কিন্তু যাদের কাছে যাচ্ছো তাদের সামনে তো মু খ দেখাচ্ছোই। মায়ের কথায় মেয়ে আরো রেগে যায়। “তুমি তো এমনই বলবে। তোমার লাই পেয়ে পেয়েই তো শিপলুর এই অবস্থা হলো। তুমি কোনভাবেই ওদের সাথে কথা বলবে না।” সেদিন আর কথা বাড়াননি রাবেয়া সুলতানা। উঠে চলে গেছেন তার ঘরে।
(৩)
মেয়ের সাথে আর কথা না বাড়ালেও বিষয়টা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল ঠিকই। শিপলু মারা যাওয়ার পর তাদের ওপর দিয়ে বিরাট ঝড় বয়ে গেছে। একে তো তরুণ বয়সী তরতাজা পু ত্রকে হারানোর শোক তার ওপর পুলিশ আর মিডিয়ার আনাগোনা। তবে সবচেয়ে বেশি পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছিল চেনা-অচেনা মানুষের অশ্লীল কৌতূহল। এখন পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক। এখন কি ওদের সাথে বলে আবার বিষয়টা কে তাজা করে তোলা উচিৎ হবে? কিন্তু তার ছেলেতো কোনো অপরাধ করেনি। সে একটা মানবিক বিষয় নিয়ে কাজ করছিল, মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করছিলো। এখন তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন সেই সব সংখ্যালঘু মানুষদের ভালোবাসার অধিকার পাওয়াটা কতটা প্রয়োজনীয়। তাঁর ছেলে তো বীরের মতন জীবন উৎসর্গ করেছে মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। তাহলে তার কথা সবাইকে জানানো যাবে না কেন? দোদুল্যমান দুলতে দুলতে রাবেয়া সুলতানা সারাদিন দুজনের সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেন।
(৪)
চুলটা আঁচড়ে নিয়ে বসার ঘরে ঢোকেন রাবেয়া সুলতানা। মেয়ে তার জামাতার কথার চাবুকে শিপলুর সব ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আজ তিনি শিপলুর একটা বাধানো ছবি দেরাজ থেকে বের করে বসার ঘরের বইয়ের কাচঘেরা খাট আলমারিটার ওপরে রেখেছেন। তিনি ছবিটার সামনে দাঁড়ালেন। শিপলুর মু খ ঝলমল করছে হাসিতে। এমন সুন্দর করে হাসতো ছেলেটা। এমন নরম স্বভাবের ছিল ও যে অচেনা লোকজনকেও খুব অল্প সময়েই আপন করে নিতে পারতো। এমন হাসিখুশি ছেলেটাকে কিভাবে হত্যা করতে পারলো ওরা? কিছু মানুষের যৌক্তিক অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করছিল ও। এটাই ছিল ওর অপরাধ? এ কেমন পৃথিবীতে বাস করছি আমরা ? সারা পৃথিবীতেই ধর্মের নামেই সবচেয়ে বেশি অধর্ম করা হচ্ছে। দরজা-ঘণ্টার আওয়াজে চিন্তাভঙ্গ হয় রাবেয়া সুলতানার। সাংবাদিক দুজন মনে হয় এসে গেছে।
(৫)
সাংবাদিক ছেলেমেয়ে দুটোর সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে দুটো ঘণ্টা চলে গেছে টেরই পাননি রাবেয়া সুলতানা। এই দুই ঘণ্টা হাসি-কান্নার ভিতর দিয়ে তার ছেলের পচিশ বছরের জীবনের অনেক কিছুযেন আরেকবার দেখা হয়ে গেল। কিছুক্ষণের নীরবতা ভেঙ্গে ছেলেটা বললো— চাচী, এবার শেষ একটা প্রশ্ন। আমরা এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছি। কিন্তু আমরা চাই আপনার কাছ থেকে জানতে। —হ্যাঁ, বলো। আমার জানা থাকলে নিশ্চয়ই জানাবো। একটু ইতস্তত করে মেয়েটা বললো, শিপলু সমপ্রেমীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছিলেন, তিনি নিজে কি সমপ্রেমী ছিলেন? মেয়েটার প্রশ্নে থমকে যান রাবেয়া সুলতানা। এই প্রশ্নটা যে করা হবে তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। এর উত্তর অবশ্যই তার জানা। তাঁর শিপলু যে কিছুই তার কাছ থেকে লুকাত না। কিন্তু এর সত্যি উত্তরটা দিলে সেটা যখন প্রকাশিত হবে তখন কি হবে? তাঁর কাছ থেকে পাওয়া উত্তর অবশ্যই সর্বগ্রাহ্য হবে। তিনি যে বিদ্যালয়ে পড়ান সেখানে এর কি প্রতিক্রিয়া হবে? তাঁর স্বামীর প্রতিক্রিয়াই বা কি হবে? তার মেয়ে আর জামাতার প্রতিক্রিয়া কতটা ভয়ংকর হবে? কয়েক সেকেন্ডেই অনেক অনেক প্রশ্ন তার মাথায় খেলে যায়। গত কয়েকটা দিন তিনি প্রায় সারাক্ষণই এই বিষয়ে ভেবেছেন কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। তিনি সোফা থেকে উঠে ছেলের ছবির সামনে দাঁড়ান। গভীর ভালোবাসায় চেয়ে দেখেন ছেলের হাসিমুখ। এই সেই মুখ যার দিকে তাকিয়ে তিনি নিজের জীবনের সব অপ্রাপ্তিকে ভুলে থেকেছেন। এই সেই হাসি যে হাসিকে থামিয়ে দিয়েছে ধর্ম-সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্র। তিনি বাঁ হাতে ছবিটা ধরে ডান হাতটা ধীরে ধীরে বুলাতে থাকেন ছবির মু খটাতে। সে অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করতে গিয়ে নিজের জীবন হারালো তাঁর নাড়ি ছেঁড়া ধন, সেই সত্যকে তিনি অস্বীকার করবেন? তা কি করে হয় ? তাহলে তার সন্তানের আদর্শের কী মূল্য থাকলো? তিনি মা হয়ে সন্তানকে এত বড় অপমান করতে পারেন না। তিনি ছবিটা বুকে চেপে ঘুরে দাঁড়ালেন সাংবাদিক দুজনের দিকে। বাধানো ছবিটাতে সন্তানের হাসি মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে রাবেয়া সুলতানা ধীরে ধীরে দৃঢ়কন্ঠে বললেন, হ্যাঁ, আমার ছেলে সমপ্রেমী ছিলো।
প্রথম প্রকাশ: সমারূঢ়
(মন্দ্র প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রথম কুইয়ার ছোটগল্প সংকলন)