
ঈশাণ শরদিন্দু
—ভাই শুনছেন, এখান থেকে আলীবর্দীর মাজারে কি করে যেতে হয় জানেন? —খাজা আলীবর্দী?
—হ্যাঁ।
—মুন্সী খাজা আলীবর্দী?
—সম্ভবত।
—বাবা মুন্সী খাজা আলীবর্দী গণ্ডবপুরী?
—হ্যাঁ, জানেন কি করে যেতে হয়?
—না।
চোখে মুখে প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে পথচারী লোকটি চলে গেল। এমন উদ্ভট আচরণে আমি অবাক হই নি। ভুল আমারই। কানের লতিতে টোকা দিয়ে যে ব্যক্তি যেকোনো রোগীকে সুস্থ করে তুলতে পারতেন, এমন ক্ষমতাধর ব্যক্তির পুরো নাম না জেনে এলাকায় প্রবেশ, অপমানস্বরূপ। যাই হোক, এবার পুরো নাম নিয়ে জানতে পারলাম স্টেশন থেকে প্রায় এগারো কিলোমিটার দূর, অঞ্জনা গ্রামে। বাহ্! গ্রামের নামটি অঞ্জনা, নদীর নাম কি খঞ্জনা? ঠাকুর সাহেবের কবিতার ট্রেডমার্ক চুরি , তাও উল্টো নামে! কবি বেঁচে থাকলে ভীষণ ক্ষেপে যেতেন। সংশয় দূর করতে রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, আদৌ খঞ্জনা নামে কোনো নদী আছে কিনা। পরে বুঝলাম বিরাট ভুল করে ফেলেছি। প্রশ্ন করেছিলাম নদীর নাম, সে আমাকে শোনাচ্ছে পীর আলীবর্দীর ইতিহাস। এগারো কিলোমিটার রাস্তা এখন এগারো নটিক্যাল মাইল মনে হবে।
-আপনার কথা বলুন চাচা, এই মেঠোপথে রিকশা চালিয়ে আপনার পোষায়?
পোষায় কি পোষায় না তা জানার আমার আগ্রহ নেই, নিছক প্রসঙ্গ বদলানোর চেষ্টা।
-হ চইল্যা যায়। পোলারা বিয়া কইরা আলগা থাহে। আমরা বুড়া বুড়ির চাইড্ডা চাউল অইলেই অয়।
রিকশাওয়ালার কথা শুনে করুণা করা হবে আমার উচ্চাভিলাষী জীবন নিয়ে আহ্লাদীপনা করা। আমিও আরবের কোনো খলিফা না যে রিকশাওয়ালাদের জীবিকা সম্পর্কে ধারণা নেই। শুধু ভর দুপুরে র সুনসান নীরবতা আর হেমন্তের শীতল আবহাওয়া ভাবাতে বাধ্য করছে যে আমি অল্পতে তুষ্ট হতে পারি না। বিলাসবহুল এপার্টমেন্টের মালিক হয়েও আমার মন ভরেনি। হোম লোনটা পেয়ে গেলে মোহম্মদপুরের দিকে আরেকটা এপার্টমেন্ট কিনে ভাড়া দেবো ভাবছি। ক্লাস সেভেন পড়ুয়া ছেলেকে এখন পর্যন্ত তিনটি স্কুল বদল করেছি। যতো দামী স্কুল ততো ভালো পড়াশোনা।
রিকশাওয়ালা তখনও বকবক করছে। কিছু কথা ধরতে পারছি, কিছু কথা না। চেষ্টাও করছি না।
—বুঝছেন স্যার, মুজি ব যে বছর মারা গেল, সেই বছর আমার জন্ম। তহন আমরার ভালা সময় আছিলো।
কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
—দাঁড়ান! কী বললেন আপনি? আপনার জন্ম কোন সালে?
—শেখ সাবরে যে বছর মারলো। এশ্শাদ যহন ক্ষমতাত এই সমু তো আমি বড়। সাত/আট বছর বয়স, সব বুঝি ।
ধাঁধায় পড়ে গেলাম, রিকশাওয়ালা ঠিক বলছে তো? আমি ঠিক শুনছি তো? উনি কেবল আমার দুই বছরের বড়! এই জীর্ণ-শীর্ণ শরীর, ক্ষয়ে পড়া দাঁত, সাদা চুল দাড়ি, কুচকানো চামড়ার মানুষটির সাথে নিজেকে কিছুতে দাঁড় করাতে পারছি না। ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে। উপলব্ধি করলাম, অল্পতেই তুষ্ট হওয়া মহৎ কিছু না। এই বিশাল পার্থক্যের জন্য দায়ী অর্থ। একটা ভালো জীবনের আশায় অর্থলোভী হওয়া কি খুব অযাচিত? অদ্ভুত তো! আমি কাঁদছি কেন?
—স্যার, আপনে কি সাংবাদিক?
হালকা কাশি দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করে বললাম, না।
—তাইলে মাজারে কি কাম? জিয়ারত করবাইন?
—এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।
অজপাড়াগাঁয়ের মাজারে স্যুট -বুট পরা খাঁটি শহুরে লোকের কোন বন্ধু থাকতে পারে ভেবে রিকশাওয়ালাকেও চিন্তিত মনে হলো।
(২)
বহু কাঠখড় পুড়িয়ে স্বপনের বর্তমান ঠিকানা যোগাড় করেছি। পারভেজ বলছিলো, দেখিস, শেষমেষ যেতে পারবি না। পঁচিশ বছর পর পুরোনো বন্ধুর মুখোমুখি হওয়া সোজা কথা না। পারভেজ ভাবছে আমার অনেক বড় মন। হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে খুঁজে পেতে ব্যাকুল হয়ে আছি। কিন্তু আমি জানি আমি কত কুৎসিত মনের। আমার স্ত্রী-সন্তান যদি জানতো কত নগণ্য মন নিয়ে তাদের সাথে বসবাস করি, কবেই ছেড়ে চলে যেত। মৌপুর আমার জীবনে বিশাল একটা স্থান দখল করে আছে। বাবার চাকুরী জীবনের শেষ দশ বছর আমাদের মৌপুরেই কেটেছে। মৌপুরে স্কুল-কলেজ, ছিল উড়নচণ্ডী একদল বন্ধু। পারভেজ, অমিত, রন্টি, বেলাল, স্বপন আর আমি। পারভেজ আমাদের দলপ্রধান। সবাই একদিন ঠিক করলো গ্রুপের একটা নাম দেয়া প্রয়োজন, পাড়ায় নয়তো আমাদের দাম কমে যাবে।
জিতু, পারভেজ আমার পিঠ চাপড়ে বলে, ঝাড় তো একটা নাম মগজ থেকে। খুব ভেবে চিন্তা করে দুদিন পর গিয়ে বললাম, গ্রুপের নাম হবে জুজু ক্লাব! গুণে গুণে পাঁচটা চাটি খেলাম, স্বপন অনুপস্থিত দেখে রন্টি একটা বেশী দিল। খুব কষ্টে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি এই নামের মাজেজা কি।
—দেখ, পাড়ার সবাই আমাদের ভয় পায়, সমীহ করে চলে। কেচ্ছা কাহিনীর জুজু ভূত এবার বাস্তবে ঘুরে বেড়াবে অলি গলিতে।
অবশেষে জুজুই হল আমাদের অফিশিয়াল নাম।
—শোন, স্বপনকে যদি তোরা গ্রুপে রাখিস, আমি থাকবো না।
প্রতিদিনের মতো অমিতের একই ঘ্যান ঘ্যান।
—স্বপন দেখতে ফর্সা, চেহারা সুন্দর, লাল লাল ঠোঁট দেখে তোর হিংসে হয়? রন্টির ঠাট্টায় সবাই হেসে ফেললাম। শুধু অমিতের চেহারা গম্ভীর।
—মশকরা করবি না। ভগবান যেন পরের জন্মে কুকুর বানায়, তাও যেন মাইজ্ঞাটার মতো না হই।
পারভেজ গম্ভীর গলায় বলল, স্বপ্না কোথাও যাবে না। তোর সমস্যা হলে তুই ওর সাথে কথা বলিস না। কিন্তু গ্রুপ ছেড়ে কেউ যাবে না, ব্যস।
পারভেজ স্বপনকে স্বপ্না বলে ডাকতো। আমরা তো তাও ডাকতাম না। মাইজ্ঞা, হিজড়া, হাফ-লেডিস ডেকে সবাই অভ্যস্ত। স্বপনও এসব গায়ে মাখাতো না। বরং কেউ যদি হঠাৎ তার আসল নাম ধরে ডাকে, স্বপন ভাবতো নিশ্চয় নেশা করে এসেছে। অথচ স্বপনের সুস্থির জড় সংস্করণ পৃথিবীর সেরা সুন্দর পুরুষের পুরষ্কার জিতে নিয়ে আসার মতো। কিন্তু আমাদের স্বপন পুরো উল্টো। কথা বলা শুরু করলে মুখের সাথে তার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও কথা বলে। আমরাও চাইতাম না ও চুপ থাকুক । স্বপনের গালি না শুনলে আমাদের আড্ডাই জমে না।
—পারভেইজ্যা, তুই এখনো হাতে শিঙ্গা নিয়া বইসা আছস?
এদিকে আসতে আসতে স্বপন দূর থেকে বলছে।
—বউ, তুমি আইসা ম্যাচের কাঠিতে চুমা না দিলে আগুন ধরবো কও? পারভেজের সস্তা রসিকতার একটি স্বপনকে মাঝে মাঝে ‘বউ’ বলে ডাকা।
—অমিত্যারে দেইখা মনে হইতেছে আজকেও ফায়ার হয়া আছে। ওর পাছায় একটা ঘষা দে।
আমরা হা হা করে হেসে উঠলাম। অমিত কোনো কথা না বলে গটমট করে চলে গেল। বেলাল বলল, অমিতের আজকাল বড্ড বাড় বেড়েছে। সারাক্ষণ মুখটাকে ওয়েস্টার্ন সিনেমার ভিলেন বানিয়ে রাখে।
—আমরা সারাদিন ওর দাদার স্টুডি ওতে পড়ে থাকি, কোনোদিন এক কাপ চা-ও অফার করে না। শালা কিপ্টা। সাথে রন্টিও যোগ করে।
পারভেজ ঠিক করলো অমিতকে একটা শিক্ষা দিতে হবে।
জিতু! বুদ্ধি।
আমি অনুযোগ করে বললাম, শালারা বুদ্ধির দরকার পড়লেই জিতুর কদর বেড়ে যায়!
(৩)
অমিতদের দোকানে আমি, রন্টি, বেলাল বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। অমিতকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছি, পারভেজকে খেয়াল করেছিস রন্টি? যখন থেকে ওর বেয়াইনের প্রেমে পড়েছে কেমন স্বার্থপরের মত হয়ে গেছে। সেদিন নাকি লুকিয়ে লুকিয়ে দুজন চিত্রাতে ‘সুজন সখী’ দেখে এসেছে।
—তবে অরণী মেয়েটাও কিন্তু হেব্বি দেখতে, ভালো মেয়ে।
রন্টি বললো
—আরে রাখ তো।
অমিত আংশিক বিরক্তির সুরে বলে, মেয়েগুলো প্রথম প্রথম এরকমই হয়। দু’টা দিন যাক, পারভেজও বুঝবে এদের মনে কত প্যাঁচ। এসব প্রেম-পিরিতি আমার একদম সহ্য হয় না।
অমিতের কথা শেষ হতে না হতেই দোকানের উল্টো পাশে পারভেজ বাইক নিয়ে এসে দাঁড়ায়। সাথে সালোয়ার-কামিজ পরা সুন্দরী এক মেয়ে। মেয়েটাকে বাইকের পাশে দাঁড় করিয়ে পারভেজ দৌড়ে এসে দোকানে ঢুকলো ।
অমিত দোস্ত, তাড়াতাড়ি আমাকে দু’শো টাকা দে। অরণীকে চাইনিজ খাওয়াবো বলে নিয়ে আসলাম। পকেটে চার আনাও নেই।
অরণী উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে। বারবার চুল ঠিক করছে। অমিত তড়িঘড়ি করে ক্যাশ থেকে দুইশো টাকা বের করে দিয়ে বলে, কী যে করিস না, টাকা নেই সেটা আগে খেয়াল করবি না? নে আরো দশ টাকা। ফুচকা খাওয়াস। পারভেজ চলে গেলে অমিত আমাদের উদ্দেশ্যে বলে, ঠিকই বলেছিস। পারভেজটা আসলেই স্বার্থপর হয়ে গেছে। মেয়েটাকে একবার আমাদের সাথে পরিচয়ও করালো না! এদিকে পারভেজের বাসায় একসাথে হয়ে হাসতে হাসতে প্রত্যেকের প্রাণ বের হওয়ার উপক্রম। স্বপন কাপড় বদলাতে যাওয়ার সময় বলে, রন্টি, তোর আপার সালোয়ার-কামিজটা পরে যা আরাম পাচ্ছিলাম। উফফ! খাঁটি সিল্ক। —ফলস চুলগুলো সাবধানে খুলে রাখ। আপার নাচের কস্টিউমে লাগে। নষ্ট হলে মেরেই ফেলবে।
(৪)
দু’শো দশ টাকার তখন ভালই মূল্য। বাসমতি চাল দিয়ে কাচ্চি রান্না করে পিকনিক করেছিলাম সবাই। অমিতকেও নিয়েছিলাম। টাকার রহস্যটা বোধ হয় আজও জানে না। তবে কাচ্চিটা দারুণ হয়েছিল। হবে না কেন? বাবুর্চি তো স্বপন। শুধু রান্নাই না, পিঠা বানানো, মসলা বাটা, কাঁথা সেলাই, মেহেন্দী পরানো, মেয়েদের সব কাজে পটু। তাছাড়া আমাদের ফুট -ফরমাশে স্বপন ছাড়া গতি নেই। যে কারো প্রয়োজনে স্বপনকে চাই, কোনোদিন কোনো কাজের জন্য ফিরিয়ে দেয় নি। কারো আপদ বিপদে খুঁজতে হয় না, স্বপন নিজেই হাজির হয়। যেখানে যায়, আসর জমিয়ে দেয়। মরা বাড়ির মানুষদেরও হাসানোর রেকর্ড রয়েছে তার। বাবা-মা ওকে ভীষণ স্নেহ করেন। অন্যদের মত কটু কথা বলেন না, বরং আমি মাঝে মধ্যে বললে ধমকে দেন। একদিন কলেজের বড় ভাইদের সাথে জীবনের প্রথম গাঁজা টেনে বাসায় ফিরেছি। ছাদের ঘরটি ছিল আমার শোবার ঘর। মাঝরাতে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। —কীরে মাইজ্ঞা তুই?
—জিতু, ভোরে উঠে চলে যাব।
চোখ লাল, গালে চড়ের দাগ। আজও মার খেয়ে এসেছে। এমন পাষণ্ড বাবা দুনিয়াতে মনে হয় না দুটো আছে।
—যা শুয়ে পড়।
সেই স্কুল জীবন থেকে ওকে মার খেতে দেখে এসেছি। বড় চাচা যেন বাপের চেয়ে এক ডিগ্রি বেশী। নিজে মারে, সমানতালে ছোট ভাইকেও উস্কে দেয়। এত বড় হয়েছে ছেলে, তাও গায়ে হাত তোলা থামে নি। ঈদ-পুজো য় স্বপনদের বাড়ি যাওয়া হয়। তখন বুঝি , বাইরের স্বপন আর ঘরের স্বপনের মধ্যে বিস্তর তফাৎ। সদা লাস্যময় ছেলেটা ঘরে থাকে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে।
স্বপন গেঞ্জিটা খুলে চুপচাপ বিছানার এক কোনে গিয়ে শুয়ে পড়লো। ডিম লাইটের আলোতেও পিঠেও স্পষ্ট দেখলাম আঘাতের চিহ্ন। ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সাথে সাথে। ঘুমন্ত চেহারায় রাজ্যের মায়া। যেন সদ্য ভূমিষ্ট নিষ্পাপ শিশুর মত লাগছে। গা থেকে যেন স্তিমিত বেলী ফুলে র সুগন্ধ পাচ্ছি। অসহ্যকর কিন্তু মোহময়। এরকম তো আগে কখনো লাগে নি, কী আশ্চর্য! বুকের মাঝের তিলটায় হাত রাখতেই স্বপন চোখ মেলল। টেনে বুকে জড়িয়ে ধরি। সেদিন রাতে কি হয়েছিল জানি না, আমার শরীরের শক্তি যেন স্বাভাবিকের চেয়ে তিন গুণ বেড়ে গেছিলো। এখনো মনে পড়ে স্বপনের বালিশ চেপে ধরে গোঙানোর শব্দ। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সংবরণের বৃথা চেষ্টা। তবু একটিবারও বলে নি, জিতু থাম।
রাতের ঝড়ে বিপর্যস্ত হয়েছিল দুটি জীবন। স্বপন যেন ঝড় পরবর্তী ফুটফুটে দিন। আর এদিকে, লজ্জায়, রাগে, ঘৃণায় দাবানলের মত পুড়ছি লাম আমি। অথচ এতসব গুণবাচকে কোথাও ছিল না অনুশোচ না। অপরাধবোধ জাগেনি নিজের প্রতি। যার ছাপ পড়েছিল পরবর্তী দিনগুলোতে।
(৫)
চঞ্চল স্বপন হঠাৎ ঠাণ্ডা স্বভাবের হয়ে গেছে। আমার সামনে কেমন নম্র হওয়ার চেষ্টা। কেউ ‘মাইজ্ঞা’ বললে ক্ষেপে যায়। পারভেজের দুষ্টুমিতে লজ্জা পায়। আমি যতটা পারি এড়িয়ে চলি। একটু সুযোগ পেলেই আড়ালে কথা বলার চেষ্টা করে।
—জিতু, চাচার প্রেশারটা এখন কেমন? শংকর বাবুকে দেখিয়েছিলে? স্বপনের মুখে ‘তুই’ থেকে ‘তুমি’ শুনে আমার আপাদমস্তক জ্বলে যাচ্ছিলো। অন্যদিকে ফিরে শুধু ‘হু’ বলে কথা শেষ করতে চাচ্ছিলাম।
—কাল একবার চাচাকে দেখতে আসবো তোমাদের বাসায়।
স্বপনের কথা শেষ না হতেই তেড়ে গেলাম ওর মুখের উপর। আঙুল উঁচিয়ে গলার স্বর যথাসম্ভব আস্তে করে বললাম, এক রাতের ভুলের জন্য তুই আমাকে জামাই ভাবতে শুরু করেছিস মাইজ্ঞা? বাসায় আসতে চাওয়ার উদ্দেশ্য কি আমি বুঝি না? ফের যদি তুই আমার কাছে ঘেঁষেছিস, তোর মুখ আমি থেঁতলে দেব। হিজড়ামি করে সবাইকে মজা দিস, তা-ই কর না। এত ভদ্র সাজার নাটক করছিস কেন?
নর্দমায় থুথু ফেলে মানুষ যেভাবে চলে যায়, আমিও ঠিক সেভাবে চলে গেছি, ফিরেও তাকাইনি একবার। না স্বপন আমার কোনো কথার প্রতিবাদ করেছে। খড়কুটো র আবার কথা কিসের?
(৬)
স্বপন সত্যিই আর কোনোদিন কথা বলে নি। আড্ডায় আসা কমে গেছে। এলেও চুপচাপ বসে থাকতো। কেউ বুঝতে পারেনি স্বপনের অদ্ভুত পরিবর্তনের আসল কারণ কী।
আপাকে নিয়ে একদিন জুয়ে লারি দোকানে গেলাম। তার দুই বছরের মেয়ের জন্য এখন থেকেই গয়না বানানো শুরু। চোখ আটকে গেল অমিতকে দেখে। সাথে সুন্দরী একটা মেয়ে। দুজনে মিলে আংটি বাছাই করছে।
—অমিত, তুই এখানে?
আমাকে দেখে অমিত ভূত দেখার মত চমকে গেল। থতমত খেয়ে বলে, ছোট মাসির মেয়ে আংটি কিনবে। দোকানপাট চেনে না তো, তাই আমাকে সাথে নিয়ে এসেছে। বিশাখা আমার ছোট মাসির মেয়ে।
পরপর দুইবার ‘ছোট মাসির মেয়ে’ বলা আর মেয়েটির হালকা লজ্জা পাওয়া মুখ বলে দিচ্ছে, এ অমিতের বিশেষ কেউ। আমি হেসে ফেললাম। বললাম, থাক তোরা আপা দাঁড়িয়ে আছে। পরে কথা হবে।
অমিত কি মনে করে হঠাৎ আমার হাত চেপে ধরে বলে, দোস্ত কাউকে বলিস না প্লিজ?
আমি মৃদু হেসে আশ্বস্ত করে চলে এলাম। বাড়ি ফেরার সময় ভাবছি, মানুষ কত অদ্ভুত হয়। যে অমিত মেয়েদের দুই চোখে সহ্য করতে পারে না, দুই টাকা খরচ করতে গেলে তিনবার ভাবে। সে আজ প্রেমিকাকে সোনার আংটি কিনে দিচ্ছে! দুদিন পরের ঘটনা।
সকালে রন্টি এসে খবর দিলো অমিতের দাদা ডেকেছে, এক্ষুনি যেতে হবে। গিয়ে দেখি হুলস্থুল কাণ্ড। সুমিতদা প্রচণ্ড চেঁচামেচি করছে। দোকানের ক্যাশ থেকে নাকি তিন হাজার টাকা চুরি গেছে। আমরা যেহেতু সারাদিন ওখানে বসে আড্ডা দেই, ওনার ধারণা আমাদের মধ্যেই কেউ একজন নিয়েছে। আমি ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি অমিতের দিকে। অমিত চোখ সরিয়ে নিলো। যেন সব পূর্ব পরিকল্পিত। স্বপন পৌছালো সবার শেষে। তাকে দেখেই অমিত তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো।
“ক্যাশের পাশে তুই সবসময় বসিস। এত মানা করার পরও তোর ঐ জায়গাটাই পছন্দ। বল টাকা গুলো কি করেছিস।”
অমিতের কথা শুনে স্বপনের চাইতে বেশী অবাক হয়েছি আমি। অমিত কি করে পারছে স্বপনকে দোষারোপ করতে। নিজের চুরি ঢাকতে বন্ধুর ঘাড়ে চাপানো! —এসব কি বলছিস অমিত? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
পারভেজ সাথে সাথে প্রতিবাদ করে বলল।
“তুই কিছুই জানিস না” অমিত বলে, ওকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। দেখিস না, কয়েকদিন ধরে কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে। করছে কিনা বল?
—তা করছে বটে, তাই বলে..
বেলালও দ্বিধাগ্রস্ত।
—তাই বলে কি? টাকাটা ও-ই নিয়েছে। আমার সাথে সেয়ানাগিরি? —অমিত তুই আমাকে পছন্দ করিস না জানি, তাই বলে চুরির অপবাদ দিস না ভাই। এই প্রথম স্বপনের মুখ থেকে কথা বের হল। চোখে পানি টলমল করছে। সুমিতদা তেড়ে গিয়ে চড়-থাপ্পর মারতে থাকে। পারভেজ আর রন্টি কোনোরকম থামায়। আমি মূর্তির মত দাঁড়িয়ে শুধু অমিতের কর্মকান্ড দেখছি। চাইলেই মুহূর্তের মধ্যে পরিবেশ বদলে দিতে পারতাম। পারিনি। এক আশ্চর্য শক্তি আমার কণ্ঠনালী চেপে ধরেছিল। ভয় পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিলো এখন যদি অমিতের গোমর ফাঁস করে দেই, স্বপন না আবার দুর্বল হয়ে পড়ে আমার উপর। স্বপনের চোখের পানির প্রতিটি ফোঁটায় ছিলো ধিক্কার আর অব্যক্ত শত অভিশাপ। অমিতের সাথে এ অভিশাপের সমান ভাগীদার ছিলাম আমি, হয়ত অনেকাংশে বেশী।
(৭)
সেদিনের ঘটনা বদলে দিয়েছিল সবাইকে।
ছন্নছাড়া হয়ে যায় জুজু ক্লাব। শেষ হয়ে যায় অমিতের সাথে সবার সম্পর্ক। তার কিছুদিন পর পরীক্ষা শুরু। ইন্টারমিডিয়েটে লেটার মার্কনিয়ে ভর্তি পরীক্ষায়ও ভালো করি। বাবা-মাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসি একেবারে। ছেড়ে আসি আমার প্রিয় মৌপুর, জুজু ক্লাব, প্রিয় অপ্রিয় স্মৃতিগুলো। এখন আমি প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকার। বউ আমার বিশ্ববিদ্যালয় প্রেমিকা। ক্লাস সেভেন পড়ুয়া ছেলের বাবা। জুজু ক্লাবের শুধু পারভেজের সাথে যোগাযোগ হয় আচার অনুষ্ঠানে । সে ব্যস্ত তার এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসা নিয়ে। রন্টি নাকি জার্মান প্রবাসী। বেলাল মৌপুরে ই হাইস্কুল টিচার। অমিত এখনো দাদার হয়ে কাজ করে। স্ত্রী- সন্তান ছেড়ে চলে গেছে অনেক আগে। খবর নেই শুধু স্বপনের। পরীক্ষার আগের রাতে বাবার মারধোরে জ্বর উঠে যায়। দুটো পরীক্ষা মিস হয়। সেখানেই পড়াশোনার ইতি। হঠাৎ একদিন কাউকে না বলে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। মাজারে মাজারে ঘুরে । শেষবার মৌপুরে দেখা গেছিলো দুইবছর আগে, ওর মায়ের কুলখানিতে। পারভেজের কাছে আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। ব্যস্ততার মাঝেও দৌড়ঝাঁপ করে ঠিকানাটা যোগাড় করে দিয়েছে। জানতে পারলাম স্বপনের দেখা মিলবে এই অঞ্জনা গাঁয়ের মাজারে। শতভাগ অনিশ্চয়তার মাঝে বের হতে যাব তখন মনে হল দরজার সামনে স্বপন দাঁড়িয়ে। মুখে বিদ্রুপের হাসি নিয়ে বলছে, “কীরে জিতু, প্রায়শ্চিত্ত কি এতই সোজা? রাস্তার কুকুরে র মত ব্যবহার করেছিস যার সাথে, যার জীবনটাই ছিল উপহাস, আজ এত বছর পর ক্ষমা চাইলেই ক্ষমা পেয়ে যাবি? তোরা অট্টালিকায় ঘুমাস, পথে স্থান পাওয়া আমি কি একটু ভালো জীবন আশা করতে পারি নি? আমার জীবন কি জীবন না?
চোখের পানি মুছতে মুছতে রিকশাওয়ালাকে বললাম, ভাই আর কত দূর? চাচা থেকে ভাই শুনে রিকশাওয়ালা একবার আমার দিকে তাকালো।
—আয়া পড়সি স্যার, হেই দু বিরিজডার কোনাত।
ব্রীজের বাঁকে বিশাল তালগাছ দেখা যাচ্ছে। তাল গাছ এত বড়ও হয়? গিয়ে যদি দেখতাম তাল গাছটাকেই সবাই মাজার বলে ডাকে, স্বপন গাছের ছায়াতে বসে আছে! ওসব গোলাপজল-আগরবাতির গন্ধে আমার দম বন্ধ লাগে। মনে হয় যেন কেউ মারা গেছে। মিছে সংশয় কাটলো ব্রীজের উপর উঠে। ঢালুতে বিশাল অংশ জুড়ে মাজারটি অবস্থিত। চারিদিকে দেয়াল। ভেতরে প্রচুর গাছপালা, তারমধ্যে প্রধান গম্বুজটি দেখা যাচ্ছে। রিকশাওয়ালাকে প্রাপ্য ভাড়ার চাইতে কিছু বেশী দিলাম। জানি এ টাকায় তাঁর জীবন চলবে না। এ শুধু আমার নিজের মনকে সান্ত্বনা দেওয়া।
(৮)
মাজার মানে ভক্তদের সমাগম, বাদ্যযন্ত্রের শব্দ, মাথার উপর রঙ-বেরঙের শামিয়ানা, একদিকে শিরনি বিতরণ, আরেকদিকে ভক্তদের সম্মানী গ্রহণ। আলীবর্দীর মাজার ব্যতিক্রম না। শুধুলোকজনের ভীড় কম। আজ মনে হয় তাদের সাপ্তাহিক জিয়ারতের দিন না।
—ভাই শুনছেন?
বাবরি চুল, হাতে পায়ে স্টিলের চুড়ি , গলায় লাল রঙের সুতা দেখে বোঝা গেল উনি মাজারের সাথে সংশ্লিষ্ট।
—আপনে কি সাংবাদিক? ক্যামারাডা বাইরে থুইয়ান, যান। এইতা আর ভাল্লাগে না। যন্ত্রণা!
চলে যেতে উদ্যত হলে বললাম, না ভাই, আমি সাংবাদিক না। আমার কাছে কোনো ক্যামেরা নেই। আমি একজনকে খুঁজছি। এখানে স্বপন বলে কেউ থাকে? কি মনে করে লোকটি আমার কথা বিশ্বাস করলো। জিজ্ঞেস করলো, কোন স্বপন? স্বপইন্যা? গার্মেনস থান পলায়া আইছে যে স্বপইন্যা? আপনেরও ট্যাকা মারছে? আমার আগেই সন্দেহ হইছিল।
—দুঃখিত। আমার মনে হয় উনি না। আর কেউ আছে স্বপন নামে, চল্লিশোর্ধ্ব বয়স?
—স্বপন মৌপুরী নাকি? না, হের সাথে আপনার কোনো কাম থাকতে পারে না। আর কে আছে…
মৌপুর থেকে মৌপুরী? বেদুইন হয়েও স্বপন পরিচয় মুছে নি অথচ এই মৌপুর তাকে কত ঘৃণা দিয়েছে।
লোকটি স্বপনের ঘর দেখিয়ে দিতে নিয়ে যাচ্ছে। চেহারায় বিস্ময়।
—স্বপন এই মাজারে আছে পাঁচ বছর ধইরা। মুরিদদে র জন্য রান্নাবান্না করতো। এর আগে কেউ আসে নাই হের খোঁজে। না স্বপন কোনোদিন কারো কথা কইছে। আর কইবো কি, সারাদিন চুপচাপ থাকে। হা হু ছাড়া মুখ থাইক্যা রাও বাইর হয় না। ভালা হইছে আপনে আইছেন, কয়দিন আর বাঁচবো! বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো লোকটির কথা শুনে।
—কী হয়েছে ওর?
—যান, ভেতরে গিয়া নিজেই দেখেন।
লোকটি ঘর দেখিয়ে বলে, আপনে কে হন কইলেন না তো? উত্তরে বললাম, এক হেরে যাওয়া বন্ধু।
লোকটি কি বুঝলো জানি না, আমি ভেতরে ঢুক লাম। বিশাল দোচালা ঘরের ছোট্ট একটা কামরা স্বপনের ঘর। টেবিলের উপর রাখা হ্যারিকেনের আলো টিমটিম করে জ্বলছে। সেলফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে দেখলাম বিছানায় কেউ একজন কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। চেয়ারটা টেনে বিছানার পাশে বসলাম। দেখলাম স্বপনের ঘুমন্ত মুখ। ঘাড়পর্যন্ত লম্বা চুল, বলি চিহ্নিত মুখ, চোখ ঢুকে গেছে কোটরে, থুতনি বেয়ে লেগে আছে পানের পিকের দাগ। আমি কি ভুল ঠিকানায় এসেছি? এটাই কি আমার বন্ধু স্বপন? রিকশাওয়ালার কথা মনে পড়ে গেল। ঠিক করেছিলাম কাঁদবো না, তাও গড়িয়ে গড়িয়ে জল পড়ছে। রুমাল দিয়ে অনবরত মোছার চেষ্টা।
—জিতু, তোর মোবাইলের আলো বন্ধ করে হ্যারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে দে। পঁচিশ বছর পর স্বপনের ভাঙা ভাঙা কন্ঠে নিজের নাম শুনে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। আধশোয়া হয়ে স্বপনের হাত গালে চেপে ধরে কাঁদছি। যেন সহস্র বছরের কান্নার বাঁধ আজ ভেঙেছে। কতক্ষণ কেঁদেছি জানি না। আমার পুরুষালি অহংকার বাঁধা দেয়নি একবারও।
বেশ খানিকক্ষণ পর নীরবতা ভাঙলো স্বপনের কথায়, “আমার মন বলতো তুই একদিন আসবি”।
নিজেকে সামলে বললাম, তোর এ অবস্থা কেন স্বপন?
—ঘুণ ধরেছে শরীরে। প্রতিদিন কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে। মরতে হলে নাকি দু’তিনবার ব্রেইন স্ট্রোক করতে হয়। কেমন বিচ্ছিরি নিয়ম। একবার এসে অর্ধেক শরীর নিস্তেজ করে গেল, বললো পরেরবার এসে একেবারে নিয়ে যাবে।
—তোর চিকিৎসার প্রয়োজন। আমার সাথে ঢাকায় যাবি?
স্বপন হাসলো। হাসিতে সেই মিষ্টতার অবশিষ্টও নেই।
—তোর কথা বল জিতু। সুখে আছিস তো?
স্বপনের গলায় হঠাৎ উদ্বিগ্নতা, “তুই কি ভাবিস আমি তোকে অভিশাপ দেই? বুকে ঘৃণা চেপে আছি? না রে পাগল।”
স্বপনের কণ্ঠস্বর আবার স্বাভাবিক হল।
“কিছুই নেই।দুঃখ ছিল, আস্তে আস্তে তা-ও চলে গেছে। জীবনটাকে মানুষের জীবন হিসেবে ধরি নি। আমার জীবনটা ফড়িংয়ের। উদ্দেশ্য হল মানব দেহটিকে কিছুদিন বয়ে বেড়ানো। মৌপুর, বাবা মা, তোরা, এ সবই মরীচিকা। মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার কঠিন কঠিন স্তর। আমি ভালো আছি। সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি। বিশ্বাস কর।”
স্বপন জোরে জোরে নি:শ্বাস ফেলছে। বিছানায় শুয়ে শুয়েই পুরো এক গ্লাস পানি খেলো।
“তোর কি হয়েছে জিতু? চোখে পড়ে কেন মনে হচ্ছে তুই ভালো নেই?” আমি আবার হাউমাউ করে কাঁদছি। এবার যেন তীব্রতা কয়েকগুণ বেশি। গলা থেকে শুধু একটি কথা বের হচ্ছে, “আমার ছেলে…স্বপন…আমার ছেলে…”
(৯)
তেরো বছর বয়স। এই বয়সেই তিন বার আত্মহত্যা করতে গেছিলো। কোথাও গিয়ে শান্তি পায়না রে বন্ধু। স্কুলে , খেলার মাঠে, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, সবাই হাসাহাসি করে। বাচ্চাটাকে গে, হিজড়া কত কি না বলে ডাকে। আমার একমাত্র সন্তান স্বপন, আমার কলিজার টুকরা।
আমি তখনও ডুকরে ডুকরে কাঁদছি।
—আলীবর্দীর মাজারে এসেছিস ছেলের জন্য পানি পড়া নিতে? যেন বাপের মত সুপুরুষ হয়?
স্বপনের কথার মাঝে ঈষৎ ঠাট্টা।
“নিজের সন্তানকে দেখে সেকেন্ডে সেকেন্ডে অনুভব করি কত অন্যায় করেছি তোর সাথে। পাহাড় সমান অনুশোচনা কুরে কুরে খাচ্ছে। ঘরের প্রতিটি দেয়াল যেন আমায় ভর্ৎসনা করে বলে, স্বার্থের জন্য সত্যিকারে বন্ধুকে বলি দিলি? একবারও পেছন ফিরে দেখলি না অবহেলার আঘাতে কত জর্জরিত মানুষটা? একটিবার পাশে দাঁড়িয়ে হাত ধরে বলতে পারি নি, ভয় নেই, আমি আছি তোর সাথে। সামান্য ভরসাটুকু দিতে পারিনি তোকে। সৃষ্টিকর্তা এ অন্যায়ের শাস্তি আমাকে দিয়েছেন। তাই কোনো প্রায়শ্চিত্ত করতে আসিনি এখানে। এসেছি আমার প্রাণের বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরতে। পুরোনো দিনের মত একসাথে বসে গল্প করতে, হাসাহাসি করতে। কিন্তু তোকে এ অবস্থায় দেখব আশা করিনি। এটা তোর প্রাপ্য নয়। আমি জানি অনেক দেরি হয়ে গেছে, তবুও, চল না বন্ধু একসাথে বুড়ো হই?
এই প্রথম স্বপনের চোখে পানি দেখতে পেলাম। নিঃশব্দে চোখের পানি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
—বন্ধু মহলে সবথেকে বেশী স্নেহ করতাম তোকে। ভালোও বাসতাম অনেক। পারভেজ আর তোর মত আমার উপর সদয় কেউ ছিলো না, এমনকি আমার পরিবারের কেউও না। কিন্তু তুই একদম আলাদা। তোর প্রতি টান অনুভব করতাম সবসময়। কিন্তু কোনোদিন প্রকাশ করি নি, পাছে আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়। সেই রাতের পর আমি আরো দুর্ব ল হয়ে পড়ি। কোথাও না কোথাও মনে হতো, এ মানুষটা আমাকে বুঝবে। আমার সকল দুঃখে পাশে থাকবে। বাবা যখন মারবে, আমি আবার এসে লুকাবো তার বুকে। সে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে রাখবে, যেমন করে রেখেছিলো সেই রাতে। কিন্তু বিশ্বাস কর জিতু, তোর শাসানো কথাগুলো মনে প্রাণে মেনে চলার চেষ্টা করেছিলাম। কষ্ট হচ্ছিলো, তাও হাল ছাড়ি নি। তারপরও যেন তোদের মাঝেই থাকতে পারি। তোরা আমার বন্ধু, আমার প্রাচীর। যে প্রাচীর বাইরের কুৎসিত দুনি য়া ভেদ করতে পারবে না। হলো না। পারিস নি তোরা। স্বপন আবার হাঁপাচ্ছে। আমি এখনো তার হাত ধরে আছি।
—সবার নিয়তি এক না জিতু। কপালের লিখন খণ্ডানো যায়। প্রমাণ করে দে। বাড়ি ফিরে যা। মুহূর্তের জন্য ছেলেকে হাতছাড়া করিস না। ছেলে তোর, জীবন তার, সমাজের মানুষ আঘাত করে কোন সাহসে? প্রতিবাদ কর তোর পিতৃত্বের জোরে। বুঝিয়ে দে কেউ না থাকলেও তার বাবা আছে দেয়াল হয়ে। সন্তানকে এত অনুপ্রেরণা আর উৎসাহ দিবি, যেন আত্মমর্যাদাশীল মানুষ হয়ে উঠে। বুকে সাহস নিয়ে চলতে পারে। আর শোন, কোনোদিন যদি কোনো জিতুর প্রেমে পড়ে, পাশে থাকিস তখনও। কে জানে, দিনে দিনে হয়ত জিতুদের মনও আরো উদার হবে।
(১০)
আধখানা সূর্য মুখ উঁচিয়ে আছে। সোনালী আভায় চকচক করছে তালগাছের পাতাগুলো। আমি ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে আরেকবার দেখে নিলাম লাল-নীল শামিয়ানা টানানো মাজারটিকে। যার মাঝে রয়েছে একটি ধূসর রঙের। আগলে রাখতো আমাদের সকল উত্তাপ থেকে। স্বপনেরা এভাবেই ধূসর হয়ে যায়। অস্ত যাওয়া সূর্যের পানে চেয়ে প্রতিজ্ঞা করে বলছি, চোখের সামনে কোনো স্বপনকে হারাতে দেবো না, ডুবতে দেবো না অবজ্ঞা-অবহেলার সমুদ্রে । ছোট্ট এ জীবন, জীবন তো একটাই। কেউ কেন হারাবে একটু ভালভাবে বেঁচে থাকার অধিকার? হাঁটছি আমি ঢাকার পথে, একা। চোখের কোণে পানি, মুখে চওড়া হাসি। প্রশান্তির হাসি। আমি যেন এক অন্য আমি। অঞ্জনা গ্রামের সোনালী আলোয় পুড়ে খাঁটি হয়েছি।
প্রথম প্রকাশ: সমারূঢ়
(মন্দ্র প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রথম কুইয়ার ছোটগল্প সংকলন)