
জ্যোতির্ময় ধ্রুব
হরিণটা দৌড়ুচ্ছে। ছুটছে কেবল। তিরতির করে কাঁপছে তার চোখের পাতা। বুক ওঠানামা করছে ঘনঘন। নাকের ডগায় জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। পিছে পিছে দৌড়ে আসছে সিংহ। দুজনের মাঝে দূরত্ব ক্রমেই কমছে। হরিণ একবার পিছু ফিরল। তার চোখে শংকামিশ্রিত দ্বিধা। সে ধরা দেবে কিনা বুঝতে পারছে না। মাঝে মাঝে এমন হয়। সিংহের হিংস্রতার মাঝেও সুখ খুঁজে পাওয়া যায়। সেই সুখের স্পর্শ পেতে গিয়ে নিজের জীবন নির্দ্বিধায় তুলে দেয়া যায় অন্য কারো হাতে। সুখের স্পর্শের লোভ মৃত্যু শঙ্কার কাছে পরাজিত হলো। ইচ্ছে করেই দৌড়ের গতি কমালো হরিণ। পর মুহূর্তেই সিংহের কেশর আর দেহের মাঝে হারিয়ে গেল ক্ষীণকায় হরিণ। আহ, মরণেও কী সুখ! হঠাৎ অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল রিফাতের। —ধুর, আজকেও! সময়মতো ঘড়িটা না বাজলে কি হতো! সকাল সাতটা বাজে কিন্তু পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে আছে। রিফাত উঠে জানালার পর্দা খানিকটা সরিয়ে দিলো। ঘর জুড়ে বিশাল জানলা তার। প্রায় মেঝে থেকে ছাদ অবধি। গাঢ় নীল পর্দার খানিকটা সরাতেই দেখা গেল আকাশ পুরো অন্ধকার। কালো মেঘ গুড়গুড় শব্দে যুদ্ধ ঘোষণা শুরু করে দিয়েছে। যেকোনো সময় কালবৈশাখী হয়ে ঝরে পড়বে বসুন্ধরার বুকে। রিফাত জানালার পাশে রাখা টকটকে লাল কুশনটায় বসে পড়ে। তার ঠিক পাশে রাখা কালকেউটের হা-করা মাথাটা টেনে নেয়। সিগারেট ধরিয়ে পরম তৃপ্তিতে টান মারে। আবেশে চোখ বুজে আসে তার। অনন্তের কথা মনে পড়ে যায়। সিগারেট খাওয়াটা অনন্তের একদম পছন্দ না। তবুও বেশিক্ষণ এই নেশা ছাড়া থাকতে পারে না রিফাত। দম বন্ধ হয়ে আসে তার। পুড়ে যাওয়া সিগারেটের অংশ নিয়ে হালকা টোকা মারে মাটির তৈরি কালকেউটের মুখে। ছাই হয়ে ঝরে পরে নিকোটিন। এই ছাইদানিটা অনন্তের দেয়া। কবে দিয়েছিল সেটা ঠিক রিফাতের মনেও নেই। কোন এক জন্মদিনে মনে হয়। এটাও এক অদ্ভুত ব্যাপার। সিগারেট খেতে মানা করবে, আবার এইসব উপহার দিয়ে পরোক্ষ উস্কানিও দেবে। সত্যি প্রেমিক মন বোঝা বড় কঠিন! মেঘের গর্জনে চিন্তা ভেঙে জানলা দিয়ে বাইরে উঁকি দেয় রিফাত। দমকা হাওয়ার সাথে সাথে দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি ঝরে পড়া শুরু করেছে। আজকে ভীষণ অলস লাগে তার। অফিস বাদ দিয়ে লেপের তলে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। হরিণ-সিংহের স্বপ্নের বাকি অংশটুকু দেখতে বাসনা জাগে মনে। মনের ভিতর ঘনীভূত হয়ে ওঠা ইচ্ছেটাকে অনেক কষ্টে মাটিচাপা দিয়ে উঠে পড়ে রিফাত। বাথরুমের দিকে এগোয়। শোবার ঘরের সাথে লাগোয়া ছোট্ট এক চিলতে বারান্দার রেলিং এ সবুজ চায়ের সুবাসে ভরা ধূমায়িত চায়ের মগ নিয়ে দাঁড়ায় রিফাত। ঝড়ের দাপট শেষ। এখন অঝোর ধারায় ঝরছে বৃষ্টি। আকাশ যেন মন খুলে কেঁদে নিচ্ছে একটু পর মন হালকা হলে খুশিতে ঝলমল করে উঠবে বলে। রিফাত দুচোখ ভরে বৃষ্টি দেখে আর চায়ের কাপে আলতো আলতো করে চুমুক দেয়। পাশের বাড়ির কার্নিশে এক জোড়া শালিক ভিজে জবুথবু হয়ে যায় গা লাগিয়ে বসে আছে। শালিক দুটোকে দেখে রিফাতের গত বর্ষার কথা মনে পড়ে যায়। মধ্য শ্রাবণের শেষ বিকেলে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। অফিস শেষ করে অনন্তকে নিয়ে সবে ক্যাম্পাসে এসেছে রিফাত। অমনি আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি। দৌড়ে দুজন এক বিল্ডিংয়ের নিচে দাঁড়িয়ে কোনমতে বাঁচার চেষ্টা করছিল। অতটুকুতেই ভিজে একশা! শেষ বিকেল হওয়াতে লোকজন খুব কম ছিল ক্যাম্পাসে। তাদের দুজনের আশে পাশে কেউ ছিল না। অন্ধকার হয়ে আসছিল। বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। অনন্তের পরনে ছিল সাদা শার্ট। উপরের দুটো বোতাম খোলা। মাথার ভেজা চুল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল গাল, চিবুক বেয়ে নামছিল বুকের ঘন অরণ্যের মাঝে। সাদা শার্টভিজে লেপ্টে শরীরের মাংসল ভাঁজগুলোকে আরো প্রকট করে তুলছিল। রিফাতের তখন কি হয়ে গেল বলতে পারবেনা সে। স্থান-কাল-পাত্র সব ভুলে নিজেকে সঁপে দিল অনন্তের মাঝে। দু’ঠোঁটের সুধা আকণ্ঠ পান করেছিল তারা কতক্ষণ সে ধারণা ছিল না কারোরই। যখন হুঁশ ফিরে এলো, তখন চারদিক অন্ধকার। বৃষ্টি থেমে গেছে। বজ্রপাতের আওয়াজে বর্তমানে ফিরে এলো রিফাত। বৃষ্টি মনে হয় একটু ধরে এসেছে। আর অলসতা করা চলবে না। অফিসের জন্য তৈরি হতে হবে।
আলমার খুলতেই ঝপ করে একটা কালো শার্ট নিচে পড়ল। তাকে সেটা গুছিয়ে রাখতে গিয়ে মনে হলো আজ এটাই পরা যাক। গত বছর ভালোবাসা দিবসে পাগলটা দিয়েছিল রিফাতকে। তখন রিফাত প্রশ্ন করেছিল, আচ্ছা, আজকের দিনে কেন অনন্ত? আজ তো প্রেমিক প্রেমিকাদের দিন। আমরা কি প্রেম করছি নাকি? তখন কোন উত্তর দেয়নি অনন্ত। কিন্তু দোকান থেকে বের হয়েই হাতে থাকা শার্টের প্যাকেটটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় রাস্তায়। ঘটনার আকস্মিকতায় কয়েক মুহুর্তের জন্য রিফাত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে খেয়াল হতেই গিয়ে রাস্তা থেকে তুলে এনেছিল সেটা। —বাব্বা, এত রাগ সাহেবের? মজা করেও কিছু বলা যাবে না? —যা বলেছ তা সারা জীবন মনে রাখবো। আমরা শুধু বন্ধু। এর বেশি কিছু নয়। ঠিক আছে? অনন্তের অভিমানী উত্তর। —রিফাত অফিসে যাবিনা? এখনও তৈরী হোসনি কেন? মায়ের ডাকে আবার বাস্তবে ফিরে আসে রিফাত। সত্যি, এতদিন ধরে দুজনের আলাপ, ঘনিষ্ঠতা। কিন্তু কখনো রিফাত কথা দেয় নি অনন্তকে কিংবা মুখ ফুটে কখনো বলেনি যে, চলো দুজনে একসাথে ঘর বাধি। অথচ সে জানে এই কথাটা শোনার জন্য অনন্ত প্রতিটা মুহূর্তে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করে থাকে। হঠাৎ করে রিফাতের নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হতে থাকে। স্বার্থপর মনে হতে থাকে। মনে হয় ইচ্ছে করেই এতদিন সে কষ্ট দিয়ে এসেছে তার প্রেমিক পুরুষটিকে। অফিসের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে, চোখে রোদচশমা আর হাতে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে রিফাত রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে। একটু এগোতেই প্রত্যাশামাফিক ভাড়ায় একটা রিকশা পেয়ে যায়। রিকশার হুড ফেলে দিয়ে চশমাটা খুলে আকাশের দিকে তাকায়। হাতের ব্রেসলেটটা ঝনঝনিয়ে ওঠে। এটাও অনন্তেরই দেয়া। নতুন চাকরি পাওয়া উপলক্ষে। ব্রেসলেটে হাত বোলায় রিফাত। অনন্তের ভালবাসার পরশ অনুভব করে সে ব্রেসলেটের প্রতিটা খাঁজে। বৃষ্টিহীন ঝলমলে আকাশে আজ রংধনু উঠেছে। সাতরঙের দীর্ঘ এক আলোক রেখা। চোখ বন্ধ করে বুকভরে নিশ্বাস নেয় রিফাত। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে। প্রতিরাতে হরিণ হয়ে সিংহের কাছে ধরা দিতে না চাওয়া সে আজ নিজেকে স্বেচ্ছায় সমর্পন করবে সিংহের থাবায়। প্রতিরাতে দেখা অসম্পূর্ণ স্বপ্নটার শেষ দেখতে চায় সে। রিকশা টুংটাং শব্দে এগিয়ে চলে। রিফাতের ঠোঁটে প্রশান্তির মৃদু হাসি খেলে যায়।
প্রথম প্রকাশ: সমারূঢ়
(মন্দ্র প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রথম কুইয়ার ছোটগল্প সংকলন)