বিরহ বিসর্জন

চিন্ময়ের ইতিকথা

আলোকসজ্জার মাঝে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে একটি বাড়ি, আজ সেই বাড়ির উদর মানুষে পরিপূর্ণ। সবার মাঝে চাপা উল্লাস ও সীমাহীন ব্যস্ততা বিরাজ করছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হচ্ছে। সানাই বাজছে। কিছু কিশোরী নিজেদের সাতরঙে রাঙিয়ে সারা বাড়ি জুড়ে বাজাচ্ছে তাদের ঝুনুর ঝুনুর নুপূরের ছন্দ। কে যেন একজন চিৎকার করে বলে উঠলো, —বর আইছে, বর আইছে —গেইটে লোক কই? বাড়ির ছেলেমেয়েরা কোথায় গেল সব? —সাজন পাতিতে নাকি? —আ মলো যা। —কি জানি বাপু আমাদের সময় অত সুনু ফাউটার ছিল না। এখন কত আইলানা, গেলানা, অস্করা, মস্করা বের হইছে … বয়সের ভারে নুয়ে পড়া সেই ঠাকুমাদের কথা কানে নেয়ার মত কারো সময় ছিল না কারণ তখন সবাই বর দেখতে ব্যস্ত। এ সময় বর সার্কাসের আজিব জীবের থেকে আরো বেশী আজিব হয়ে ওঠে। তাইতো এই পাড়া সেই পাড়ার লোক সব দলবেঁধে বর দেখতে আসে। আর সবার মিষ্টিমুখের সাথে সাথে, দারুণ মুখরোচক সব বিষয়বস্তু পাওয়া যায় গল্প করার জন্য। 

আজকের বিয়ের বর হলো নিতিন। তাকে কেন্দ্র করে যে তার চারপাশে সবাই ঘুরে ঘুরে মজা করছে, সে কি আনন্দে আছে? না কি তারও কোন কষ্ট কিংবা বেদনা বা আরো কিছু আছে? আছে কি? তার ঠিক অপরদিকে গায়েহলুদে মেতে উঠেছে আরো একটা বাড়ি। সবাই ব্যস্ত কনেকে হলুদ মাখাতে। স্নান করিয়ে পার্লার থেকে বউকে সাজিয়ে আনতে আনতে যখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হবে হবে, তখন বাড়ির পাকা দাড়িওয়ালা লোকেরা খুকখুক করে কেশে তাদের বৌমাদের কাছে মৃদু ধমকের সুরে কিছু একটা অনুযোগ জানায়, বৌমারা হেসে সযত্নে এড়িয়ে যায়। কিছু বলে না। সাজুক না আজকে একটু মেয়েটা, এই একটা দিনই তো তার জীবনের সর্বোচ্চ সাজ সাজবে। ঐ দিকে পাকা দাড়িওয়ালা লোকগুলোর কপালে কিছুখাঁজ পড়ে। সেগুলো বিরক্তির না কি দুশ্চিন্তার, তা তারাই জানে। কনের নাম আলেয়া। কালকে তাকে যেতে হবে অন্য একজন পুরুষের ঘরে, যাকে সে ভালোভাবে চেনেও না। হয়তো একটা সম্পূর্ণ অচেনা পুরুষ সতীত্বের অবহেলা করে কেড়ে নেবে তার ২১ বছরের সঞ্চিত সেই অমূল্য সম্পদ। ভাবতেই তার মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেলো। বিয়ের অনুসাঙ্গিক কাজকর্ম সারারাত ধরে চলার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার আগে বর কনেকে নামতে হয় আরেক পুতুল খেলায়। জীবনের নাট্যমঞ্চে এই খেলাটি গুরুত্বপূর্ণ। অরুণরাঙা প্রভাতের মতো আগুনে ঘি ঢেলে পুরোহিত বলেন, এবার তাহলে বাবা নিতিন, তুমি মহামায়ার কপালে সিঁদুর টা পরিয়ে দাও। নিতিন সিঁদুর পরিয়ে দিলো। তার হাত কাঁপেনি, কিন্তু মনটাতে কেমন যেন বিষন্নতা ভর করে উঠেছে। অন্যদিকে আলেয়ার বর সিয়াম অবলীলায় তিনবার কবুল বলে সই করল কাবিননামায়। ঘ্যাঁচ করে উঠল। সিয়ামের বুকটা নিতিনের জন্য। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। বিদায়কালের সেই পরিচিত দৃশ্যে অবধারিত কান্নার পালা শেষ করে নিতিনের সাথে মহামায়া ও সিয়ামের সাথে আলেয়া রওনা দিল। নিতিন ও সিয়াম জানতো না যে তখন তারা দুজনের থেকে সাতাশ কিলোমিটার দূরে। 

(২)

সিয়ামের বাসর রাত। চারদিকে ফুলেল ও তার বিছানার মাঝে বসা আলেয়া নামের সেই মেয়েটি। তাকে দেখে সিয়ামের নিতিনের কথা মনে পড়ে গেলো। কলেজে পড়ার সময় নিতিন কিংবা সিয়ামের মাঝে তেমন কোনো বিশেষত্ব ছিল না। তবে হ্যাঁ, দুজনেই ছিলো চটপটির পাগল। আর পার্কের সেই সর্বজনীন মামার দোকানে তাদের পরিচয়, সেই চটপটির সূত্রেই। দুজনেই খুব তাড়াতাড়ি চটপটি খেতো। একবার সেই চটপটিওয়ালা মামার চেষ্টায় তাদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা হলো, কে কত দ্রুত চটপটি খেতে পারে তার প্রতিযোগিতা। অনেক ছাত্র চারদিক থেকে তাদেরকে ঘিরে ধরেছিল। পুরো একটা ব্যাটেলগ্রাউন্ড। ৩৫ সেকেন্ডে সিয়াম ও ৩৭ সেকেন্ডে নিতিন শেষ করল পুরো এক বাটি চটপটি। সেই ঘটনাই তাদেরকে পরিচয়ের সুরে এনে দিয়েছিলো। পরিচয়ের পর তারা সময়ের সাথে সাথে জেনে নিল দুজনকে। কথা হতো প্রতিদিন দুজনাতে। কত কী কথা! রঙ বেরঙের কথা, অন্তহীন কথা, অর্থহীন কথা। তবু সেগুলোই যেন ছিলো সব আনন্দের উৎস। আস্তে আস্তে সম্পর্কটা যখন বন্ধুত্বকে ছাড়িয়ে গেলো, তারা তা বুঝতে পারলেও মানা করেনি। সাধারণ মানুষের মতো সাধারণ একটা ভালোবাসার প্রস্তাব। তারপর চললো গতানুগতিক প্রেম। তবে তারা কখনো অনুযোগ করেনি এ বিষয়ে। অভিসারের পর আরো কাছাকাছি এসে গেল দুজনে। কত মধুর ছিল সেই স্মৃতিমাখা দিনগুলো। তবে এখন আজকের চিন্তা করতে হবে। অতীত সে তো অতীতেই। তার কোন তুলনা নেই এবং বিশ্লেষণে নতুন কিছু বের হলেও তার দূরত্ব স্মৃতি রোমন্থন করা পর্যন্তই। আলেয়ার দিকে তাকালো সিয়াম, তাকে চাইলে অবহেলা করতে পারত সে। অঙ্গীকারবদ্ধ সে এগিয়ে গেলো আলেয়ার দিকে, কিন্তু আবেগ যে কতটুকু মাপা হতে পারে তা আলেয়া সেই রাতে বুঝতে পেরেছিলো। আরো বুঝতে পেরেছিলো যে প্রতিটা স্পর্শে আছে অবহেলা আর বিতৃষ্ণার এক প্রবল ছাপ। আলেয়া ভাবছে প্রথম রাতের ভালোবাসায় আবেগ কি সীমিত? না কি সিয়াম আমার প্রতি বিরূপ? ভালোবাসাহীন কেমন মিলন সেটা? যেন কাঁধে ভর করে থাকা একটা কাজ কোনরকম শেষ করে মু ক্ত হলো! এদিকে সিয়াম কোনোরকম রাতটা কাটিয়ে দিয়ে সকালে উঠে থাকতে না পেরে নিতিনকে ফোন করলো। —নিতিন? হাই তুলতে তুলতে নিতিন তখন বললো, কে? —আমি, আমি। (কন্ঠ থেকে ঘুমটা পুরোপুরি কেটে গেছে) —সিয়াম! —তোমার সাথে কথা বলবো, সামনাসামনি। —কিন্তু আমার বিয়ের আনুষ্ঠানিকতাই শেষ হয়নি এখনো। এই মুহূর্তে আসতে পারবো না। —খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তোমাকে, বলতে ইচ্ছে করছে এই পর্যন্ত বলে সিয়াম থতমত খেয়ে গেলো। অনুভব করছে কেউ তার পেছনে দাঁড়ানো। আস্তে করে ঘুরে দেখে, আলেয়া! অপরপ্রান্ত হতে নিতিন সেই চিরচেনা কথাটি শোনার জন্য বারবার হ্যালো হ্যালো করছে কিন্তু এর মধ্যে সিয়াম লাইনটা কেটে দিলো। হয়তো ফোনের ওপাশে মন খারাপ করে একটি মানুষ বসে আছে। আলেয়া বলল, আম্মা নাস্তা তৈরি করেছে, আপনাকে ডাকছে। —তুমি যাও আলেয়া, আমি আসছি।

সিয়াম চিন্তা করছে, আলেয়া কি তাকে সন্দেহ করেছে? ওদিকে আলেয়া মনে মনে বলছে, কিছুকি আছে, যা ঠিক বেঠিকের মাপকাঠিতে পড়ে না? দাম্পত্য জীবনটা নিতিন ও সিয়ামের বেশ যন্ত্রনায় কাটছে। প্রায় প্রতিদিন বিকেলে অফিস শেষে একসাথে চটপটির দোকানে বসে কথা বলাটা অভ্যাস হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু এখন কেন যেন সপ্তাহে এক বারও যাওয়া হয় না। দুজনেই বুঝতে পারছে যে পিছুটান তাদের আছে আর দূরত্ব টা দুজনের মাঝে ক্রমশ বাড়ছে। কষ্টও হচ্ছে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। সময় করে একদিন নিতিন ও সিয়াম সেই চটপটির দোকানে দেখা করবে বলে ঠিক করলো। তখন তাদের বিয়ের তিন মাস পেরিয়ে গেছে। যথাসময়ে নিতিন পার্কের কাছে চটপটির দোকানের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করতে লাগল। সিয়াম এখনো আসছে না। কখন যে আসবে? নিতিন ভাবলো, হয়তো জ্যামে পড়েছে। সে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় এসে দেখে যে দুজন মহিলা ফুচকা খাচ্ছে ও একজন অপরজনের ঠোঁটের কোণা মুছে দিচ্ছে। দৃশ্যটা কেন যেন দৃষ্টিকটু লাগলো তার কাছে। তবে পরে কি হয় সেই দৃশ্য দেখার কৌতূহলে সামনের দিকে এগিয়ে গেল সে। আরেকটু ভালোভাবে তাকাতেই দেখতে পেল, আরে, এ তো— মহামায়া! মহামায়াও নিতিনকে দেখলো। তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে বললো, দেখে যাও। নিতিন লম্বা লম্বা পা ফেলে তাদের কাছে আসলো। —মহামায়া এ হচ্ছে নিতিন, আমার বর। আর নিতিন, এ হচ্ছে আলেয়া, আমার স্কুল ফ্রেন্ড। পরিচয়পর্ব শেষ হওয়ার পর নিতিন পরোক্ষ প্রশ্নবাণ ছুঁড়লো মায়ার দিকে, তোমায় এখানে দেখব, ভাবিনি। —আসলে কিছু কেনাকাটা করতে গিয়ে আলেয়ার সাথে দেখা, তারপর আর কি, বসে আড্ডা দিচ্ছি। তা তুমি এখানে? —না, আসলে আমার এক বন্ধু আসবে তো তাই —আচ্ছা, তোমার ফিরতে কি দেরি হবে? আমি আবার এখনি চলে যাবো। —আচ্ছা যাও। আমার একটু দেরি হবে। বিদায় নিয়ে তারা চলে গেলো। বাড়ির পথ ধরে রিক্সা দিয়ে যাওয়ার সময় মায়ার অনেক কিছু মনে পড়তে লাগল। সেই স্কুল জীবন থেকে আলেয়া আর সে বান্ধবী। দুজনের বাসা অনেক দূরে, তবুও তাদের সখ্যতা গড়ে উঠেছিল দৃঢ়ভাবে। তারপর যখন কৈশোরে পা দিল দুজনেই, তখন দেখল যে তাদের আকর্ষণটা একটু ভিন্ন। দুজনেই নিজেদের আবিষ্কার করলো সমপ্রেমী হিসেবে। সেই থেকে তাদের পথচলা শুরু।

বিয়েটা যদিও সামাজিকতার কারণে হয়তো করতে হবে, তবুও তারা প্রণয়ের দৃঢ়তায় অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিল। সে প্রণয় এখনো আছে, অমলিন। সেদিন আর সিয়ামের সাথে দেখা হয়নি নিতিনের। মন ভারাক্রান্ত করে বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিল নিতিন। ফোনে যোগাযোগ হলো তাদের, পরের সপ্তাহে আবার এ সময়ে দেখা করার কথা হলো। প্রতিদিন রাতে সিয়াম ও নিতিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলে। কথা বলার সময় দুজনেই দুজনের সুরে ভাসতে থাকে। তারা ভাবে ভালোলাগা গুলো যে কেন এতো ভালো হয়। অপরদিকে মায়ার মনে কেমন যেন একটা সন্দেহ প্রবেশ করে। সে ভাবে, আমার স্বামী কি অন্য কারো সাথে প্রণয় ডোরে আবদ্ধ? না কি তার হেলাফেলার জন্য নিতিনের সংসারের প্রতি মন নেই? আচ্ছা আমি কি ঠগ? বয়ঃসন্ধিকালে যে পরিচয় টা নিয়ে থেকেছি, তার জন্য আরেকটা মানুষকে কষ্ট দেই কি করে? শত হোক, সে আমার স্বামী। বিয়ের পর একটা মেয়ের পরিচয়। অবলম্বন। আর বিয়েটা করেছি শুধু সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্য তো নয়। নিতিনের ও তো কোনো চাহিদা আছে? বেচারা মুখ ফুটে কখনো কিছু বলে না। সেই প্রথম দিন সে নিতিনকে বাধা দিয়েছিলো। তারপর নিতিন ইচ্ছে করে কিছু করেনি। আমি তো আলেয়ার জন্য নিতিনকে অবহেলা করতে পারি না। মাঝে মাঝে তো সুখগুলোকে বিসর্জন দিতে হয়। আমি কি দিব নিজের সুখকে জলে ভাসিয়ে? তাই হবে হয়তো। আজ মহামায়া অনেক সুন্দর করে সাজগোজ করলো। রাত্রে খাওয়া শেষ করে নিতিন রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল, এত সাজগোজ? মহামায়া কিছু বলেনি। মুচকি হেসেছে। রাত্রে দুজনে একসাথে শোয়ার পর মহামায়া তার হাতটা নিতিনের বুকের উপর উঠিয়ে দিল। নিতিন হাতটা সরিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। এ প্রত্যাখানে মহামায়ার বুকে কেন যেন ঘ্যাঁচ করে কিছু একটা বিঁধলো। কে জানে! কষ্টই হবে হয়তো। সোমেশ্বরী নদীর পাশে একটা বাড়িতে থাকে সিয়ামরা। আলেয়ার শোয়ার ঘরের জানালা দিয়ে সোমেশ্বরী নদী দেখা যায়। এক রাতে সে জানালা ধরে তাকিয়ে আছে সোমেশ্বরীর দিকে। খরস্রোতা নদী। এমন সময় সিয়াম বললো, ঘুমোবে না? —না ঘুম আসছে না। তুমি শুয়ে পড়ো। আলেয়া সারারাত জেগে কাটালো। তার সাথে জাগল নিশাচর জীব ও সোমেশ্বরী নদীর কলকল ঢেউয়ের শব্দ। দিন কাটছে অস্থিরতার সাথে। দিনে দিনে চারটা মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন অভিনয় করতে করতে আজ তারা ক্লান্ত। নিতিন চিন্তা করছে, নাহ আর মহামায়াকে অপমান করতে পারবো না।তাকে আর কত প্রত্যাখান করবো! সত্যটা তাকে জানাবোই। সেদিকে মহামায়া ভাবছে, কেন আর পুরনো সম্পর্কের জালে জড়িয়ে একটা মানুষকে কষ্ট দিবো! এবার বাস্তবতার পথে হাঁটবো। সিয়াম চিন্তা করছে, আম্মা আব্বা জোর করে বিয়ে দিয়েছে। আমি না করেছিলাম। কিন্তু কেন দিল? পালিয়ে যাবো আমি, নিতিনের সাথে। নিজের ভালোলাগার জন্য কুরবানি দিবো অনেক কিছু। আলেয়া ভাবছে আর এভাবে পারব না। সমাজের দায়বদ্ধতার মাঝে চাপা পড়ে নিজের সুখ গুলো জলাঞ্জলি দিচ্ছি। নিজেকেও হয়তো একসময় জলাঞ্জলি দিবো। সত্তা বলে নিজের মাঝে কিছুই থাকবে না। হয়তো অনেক কষ্ট হবে, কিন্তু আমিও দেখিয়ে দিব, নারীরাও পারে, তাদের সুখের জন্য শৃঙ্খল ভাঙতে। আলেয়া ফোন দিল মহামায়াকে। —মায়া? —বলো আলেয়া। —তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। —আর আমিও তোমার সাথে কিছু বলতে চাই। —কবে দেখা করবে? —আজ তো পুজোর ষষ্ঠী। তিনদিন আছে নবমীর। সেদিন পার্কেদেখা করবো। —আচ্ছা। ভালো থেকো। —বিদায়। আর সেদিকে সিয়াম নিতিনকে ফোন দিলো, নিতিন? কেমন আছো? —ভালো। তোমার সাথে আমি কথা বলতে চাই। মুখোমুখি। —আমিও তোমাকে সেজন্যই ফোন করেছি। —কবে দেখা করবে? —কাল? —না, কাল সপ্তমী। নবমী তে দেখা করবো। মামার দোকানে। —আচ্ছা। —শুভরাত্রি। দুটো দিন কাটলো। সময় যেন অতি দীর্ঘ, ফুরোতেই চায় না। অবশেষে চারজন মানুষের অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। ঢাকের বাড়ির সাথে সাথে শুরু হলো নবমী পূজার আয়োজন। বিকেলে চারজন মানুষ দেখা করতে গেলো। সেই পার্কে। মহামায়া একটু আগে চলে এসেছে। সে ঘু রতে লাগল। হঠাৎ করে সে যা দেখলো তাতে তার চোখ বেরিয়ে পড়ার উপক্রম হল। দেখল যে নিতিন অন্য একটা পুরুষকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে আছে। ধরার ভঙ্গিটা কেমন যেন! —নিতিন! হঠাৎ করে ডাক পড়ায় নিতিন কিছুটা থতমত খেয়ে নিজেকে সামলে নিতে নিতে মায়াকে বলল, ও মায়া, তুমি এখানে? —হ্যাঁ বান্ধবীর সাথে দেখা করতে এলাম। অন্য পুরুষটার দিককে তাকাতেই নিতিন বলে উঠল, সে আমার কলেজ ফ্রেন্ড। বেস্ট ফ্রেন্ড বলতে পারো। আর সিয়াম, এ হচ্ছে মায়া। যার কথা তুমি আগেও অনেক শুনেছো। শুষ্ক একটা হাসি মায়া ফুটিয়ে তুললো। নিতিনের হাতের দিকে নজর যেতেই নিতিন বলল, তোমার জন্য ডার্কচকলেট। 

—থ্যাংক ইউ। এমন সময় মায়ার ফোন বাজতে থাকল। —আমি আসি নিতিন। বাসায় দেখা হবে। —আচ্ছা। মায়া এগিয়ে গেলো। সোমেশ্বরী নদীর ধারে। দেখল যে আলেয়া দাঁড়িয়ে আছে। কাছে আসতেই আলেয়া বললো, আমার জন্য ডার্কচকলেট এনেছো! —আসলে এটা আমার হাসবেন্ড গিফট করেছে তবে তোমায় গিফট করি? —এটা কি ঠিক হবে? —কত কিছুই তো বেঠিক করছি। আমার সম্পর্কটা বেঠিক। বিয়েটা বেঠিক। বিয়ের পর যে এই একটা সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছি এটা বেঠিক। কিচ্ছু ঠিক নেই। —কিছু হয়েছে তোমার? চিৎকার করে মায়া বলে উঠলো, আমি আর নিতে পারছি না। বুকে পাহাড় সমান কষ্ট জমা হয়েছে। প্রতিটি রাতে আমাকে ধরতে গেলে অপমানের সাথে প্রত্যাখ্যান করে। কারন আমি তার ভালোলাগাটাকে বিন্দুমাত্র না দেখে তোমার উপর খুঁজেছি পরম নির্ভরতা। কিন্তু তাতে একটি পুরুষের মন অবহেলায় বিষিয়ে উঠেছে। না পারছে বলতে, না পারছে সইতে। কথাগুলো বলার পর মায়া হাঁপাতে লাগলো। —কিন্তু আমরা ভালো আছি মায়া! —আমরা নয়, তুমি ভালো আছো। —মানে! -আমি আর নিষিদ্ধ একটা জিনিসের ভার বইতে পারব না। —তুমি কি সম্পর্কটার ইতি টানতে চাও? —একটা সম্পর্ক গড়ার জন্য আরেকটা ভাঙতে হবে। এছাড়া আর কিছু না। —মন থেকে বলছো তো? —হ্যাঁ। বুকটা মুচড়ে উঠল আলেয়ার। চোখ ফেটে পানি বেরুচ্ছে তবু হাসিমুখে বলছে, তোমার ইচ্ছাকে সম্মান করলাম। ভালো থেকো। আমি অপেক্ষায় থাকব। এই সোমেশ্বরীর তীরে। মায়া চোখের জল মুছতে মুছতে চলে গেলো। কিন্তু চোখ আজ বলছে তার ভাষা। গলিত নোনা ব্যথা বেরুচ্ছে প্রতিটা কথা হয়ে। এদিকে নিতিনের কথা শুনে সিয়ামের অবিমিশ্র অনুভূতি হলো। —সিয়াম, এ ছাড়া আর কোন পথ জানা নেই। তুমি কিছু বলছো না যে? —তুমি খুশি থাকলে আমিও খুশি। জীবনের কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। এই সমাজের হয়ে তাদের এটাই করা উচিত ছি্লো। পরদিন সকালে চারদিকে ঢাকের ও উলুধ্বনি শুনে ছেলে বুড়ো তড়াক করে উঠে গেলো। আজ যে দশমী। মা-এর প্রস্থানের দিন।

শাঁখ, কাসি, ঘণ্টা এসব বেজে উঠছে থেকে থেকে। চারদিক শিউলি ফুলের সুবাসে মেতে উঠেছে। কলরব কোলাহলে মাতোয়ারা সবাই। সকাল থেকে নিতিন নেই। অবশ্য বলেছিলো যে আজকে সারাদিন সে বাসার বাইরে থাকবে। আজ মহামায়া সাজলো খুব সুন্দর করে। কপাল ভর্তি সিঁদুর দিয়ে পায়ে আলতা লাগিয়ে লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে বের হলো। তখন প্রায় বিকেল গড়িয়ে গেছে। গানের তালে তালে পাড়ার ছেলেরা নাচছে। “ঢাকের তালে কোমর দোলে খুশিতে নাচে মন” সবাই সিঁদুর খেলছে। সেও গিয়ে সবার সাথে সিঁদুর খেলায় যোগ দিল। লালরঙে রাঙিয়ে দিচ্ছে সবাইকে। এমন সময় ফোন, হ্যালো নিতিন? —শোন মায়া, আমি তোমাকে কিছু কথা বলব। তারপর তুমি আমায় যা বলতে পারো বলো। শোন, এই বিয়ে করার কোন ইচ্ছে আমার ছিল না। শুধুমাত্র চাপে পড়ে পরিস্থিতির সামাল দিয়েছি। কারণ আমি সমকামী। আর তোমাকে প্রতিদিন আর প্রত্যাখান করতে পারবো না। তাই একেবারে প্রত্যাখান করে সবাইকে ছেড়ে চলে গেলাম আমার বন্ধু সিয়ামের সাথে। আর আমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করে ড্রয়ারে রেখে এসেছি। তুমি বাকি কাজটা সম্পন্ন করে দিও। পারলে ক্ষমা করে দিও। ভালো থেকো। প্রতিমা ট্রাকে তোলা হল। সকল নারী চোখের জলে ভাসান দিচ্ছে প্রতিমা। সবার কান্না ছাপিয়ে উঠল মহাময়ার আর্তনাদে। সবাই ভাবছে “আহারে, মেয়েটার নরম মন।” কিন্তু সে যে কি ব্যথা নিয়ে আছে তা কেউ জানে না। বুকটা ভেঙে গেছে তার। সব সাজানো স্বপ্ন ও কল্পনা আজ ধুলোতে মিশে গেছে। আবেগগুলো তার গলা টিপে ধরেছে। সন্ধ্যা নামছে গড়িয়ে গড়িয়ে। সবাই সোমেশ্বরীর তীরে। মহামায়াও। খরস্রোতা নদীর মাঝে নৌকা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিমা। —মাঝি, আমিও যাবো। —দিদি, আপনি গিয়ে কি করবেন। —আমার মানত ছিলো, প্রতিমা বিসর্জন দিবো। —দিদি, উঠেন তবে। নৌকা এগুচ্ছে। মহামায়ার কাছে সবকিছু অর্থহীন লাগছে। এখন সে কাঁদে না। যে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ভালোবাসার বিসর্জন দিয়েছিল, সে ভালোবাসারই বিসর্জন হয়ে গেলো। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। এই বিরহ আর নিতে পারছে না সে। সকল বিরহ সে বিসর্জন দিবে মায়ের বিসর্জনের সাথে। সব শান্ত হয়ে যাবে। প্রতিমা তুলছে সবাই। চিৎকার করে সবাই বলছে, “বলো দুর্গা মা কি—জয়” ঝপাৎ করে শব্দ হলো পানিতে। দুর্গা ও মহামায়া দুজনের বিসর্জন হলো আজ। সবাই চিৎকার করছে “গেলো গেলো মেয়েটা”! সকল বিরহের বিসর্জন হলো আজ। সেদিকে নিতিনের কাঁধে সিয়াম মাথা রেখে বাস দিয়ে চলছে। নিতিন দেখছে সোমেশ্বরীর বুক চিরে অনেক প্রতিমা ভেসে আসছে। তারা চলল অজানায় সুখসন্ধানে। অপরদিকে খোলা এলোচুলে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে আলেয়া। বিসর্জনে ভেসে আসা প্রতিমা দেখছে সে। দেখলো যে সাদা কাপড়ের মতো কি একটা ভেসে যাচ্ছে, প্রতিমাই হবে হয়তো। খোলা হাওয়ায় উড়ছে আলেয়ার চুল। সে অপেক্ষায় আছে। কোনদিন হয়তো মহামায়া নীল শাড়ি পরে সোমেশ্বরীর তীর দিয়ে হেঁটে আসবে কাশফুল হাতে। সে থেমে আছে। থামেনি সোমেশ্বরী। সোমেশ্বরী বইছে নিরন্তর।

প্রথম প্রকাশ: সমারূঢ়
(মন্দ্র প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রথম কুইয়ার ছোটগল্প সংকলন)

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.