আপাতত যাত্রাবদল

প্রদীপ রায়

বললাম তাকে, “ঋণাত্মক রেখায় হাঁটছ কেন?”

সে পিছন ফিরে দেখল আমাকে। চোখ টলটল করছে জলে, ধুয়ে ফেলছে সব পরিচিত বেদনা। আর নাকি ফিরবে না সে কোনো মানবীয় দৃশ্যে। তার চোখে এই কথাটা সহজেই পড়তে পারলাম। টিউবওয়েলের পানি যাওয়ার মাইট্টা নালার পাশে, উচ্ছিষ্ট ভাত ও মাছের কাঁটার উপর দিয়ে হেঁটে চলে গেল সে। সামনের গাছটিই তার পথ যেটার একটি ডাল নুয়ে আছে সেই নালার উপর, বাকি অংশ উধাও কোনো অবীচিলোকে। একটি সাধারণ গৃহপালিত গাছ, সেটির অগাধ শাখায় ঢুকে পড়লো সে, পাতারা তাকে ডুবিয়ে দিলো চোরাবালির মতো। তবু সে মাঝে মাঝে উঁকি দিবে আমাদের উঠানে। টিনের চালে সূর্যালোকের প্রতিফলন দেখবে, রাত ও দিনের পরিবর্তনশীল দৃশ্যগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকবে অজৈব নৈর্ব্যক্তিকতায়।

গাছের গুঁড়ির আঁশটে স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে আমি, ফেলে দেয়া ভাত আর মাছের কাঁটার ফাঁকে তার ফেলে যাওয়া চোখের জলগুলি খুজঁতে লাগলাম। খুঁজেও পেলাম; গাবরা ঘাসের উপর, পচা পাতার নীচে, একটুকরো রান্না করা ডাঁটার পাশে শিলার মতো তিনটি জমাট জল। কাউকে দেখানো যাবে না এগুলো, চিরতরে লুকিয়ে ফেলতে হবে বাড়ীর পরিত্যক্ত ড্রেসিংটেবিলের ভাঙ্গা ড্রয়ারে। গাছটার দিকে ফিরে তাকালাম, সেটা নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছে অন্যসব গাছের সাম্যে, বিড়াল যেভাবে মুখ মুছে ফেলে চুরি করে খাওয়ার পর কোনোকিছু। ভেবে দেখলাম, তার জন্য আর কিছু করার নেই আমার। এঁটো খাবার আর আবর্জনার মশান থেকে, কলতলা পার হয়ে মূল উঠানে উঠলাম। দেখি সমস্ত বাড়িটা সন্ধ্যার ঘোরে আচ্ছন্ন হতেছে। আকাশ গিলে ফেলেছে তার নীল। কোনো তারা উঠেনি, মেঘ চলে গেছে দিগন্ত পেড়িয়ে দূরে, এক অপক্ব কালো হৃদয়ের ভিতর যেন ঢুকে গেছে বাড়িটা। সেই কূট আবছায়া ভেদ করে আমি প্রথমে বাবা-মার ঘরে গেলাম। তারা টিভি দেখছিল, যেমন প্রতি সন্ধ্যায় দেখে। জানি আকাশের নির্বস্ত্রতা তারা খেয়াল করেনি, বা সন্ধ্যার পরিধিকে ব্যবহার করে যে এক এলিয়েন অন্ধকার বিস্তার পেয়েছে তার ঘনত্বের হেরফের তাদের বিচলিত করেনি। তারা অসময়ে আসতে দেখে আমার দিকে প্রশ্নবহুল দৃষ্টিতে তাকাল।

 “তোমরা টিভিই দেখবে?”, তাদের জিজ্ঞেস করলাম। প্রশ্নের মাঝে একটা পূর্বাপরহীন অভিযোগ ছিল যা তাদের ঔতসুক্যকে বিরক্ত করলো।

“তো? তোরে কোলে নিয়া বসে থাকতাম?”, মা উত্তর দিলো।

বাবা বললো, “কিছু কইবি?”

“না। কিছু না।”, বলে ফিরলাম। আসলেই তো, কিছু জানানোর নেই তো! কোনো ঘটনা কী ঘটছে আদৌ?

বাড়ির আলোকিত কক্ষে কক্ষে আমার অন্তর্দৃষ্টি দৌঁড়ে বেড়ালো। বৌদি ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছে, রঞ্জা মোবাইলে গেম খেলছে, কাকিমা রাতের স্বল্প রান্না প্রায় শেষ করে ফেলেছে, ঠিক প্রতিদিনের মতো।

কক্ষান্তরে রঞ্জা; পিঠের নীচে বালিশ পেতে আধশোয়া, পালঙ্কের কারুকার্যময় মাথালে ঠেস দিয়ে মোবাইল গেম খেলছে। ঘরে ঢুকে তাকে ডাকলাম না, কথাও বলি না কোনো। ফার্নিচারের দখল থেকে বেঁচে যাওয়া ফ্লোরের ফাঁকায়, ঘরের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত পায়চারী করতে শুরু করি। এর মাধ্যমে পরিপার্শ্বসহ রঞ্জার থেকে নিজের আড়াল বানাই। কয়েকটা আবর্তনের পরে রঞ্জার ঘর থেকে বসার ঘর, এমনকি খাবার ঘরের ফাকা অংশ পর্যন্ত পায়চারীর বুননে ভাবনার ঊর্ণনাভ বিস্তার করে, মাকড়শার মতো বিচরণ করতে থাকি। ইঞ্জিনবিহীন নৌকার মতো গতির, ভিতরে থেকেই নজরে পড়লো রঞ্জার খাটের পাশে, টিটেবিলের উপর ভেঙ্গে যাওয়া শিবলিঙ্গটা সুপার গ্লু দিয়ে জোড়া লাগানো হয়েছে। তা দেখেও ওর সাথে কথা বলতে মন চাইছে না। সে কী এক পলকের জন্য মোবাইল থেকে মাথা উঠিয়ে আমাকে দেখল? যদি দেখেও থাকে, সেটা আমার নজরে পড়েনি। আমি যেই মগ্নতা নিয়ে হাঁটছি তাতে, মনে হবে ঘরে কেউ নেই বা থাকলেও সেই কেউ বা কিছু আমার ভাবনারই সঙ্গত, মানে সেগুলোর আমার কাছে গ্রাহ্য হয়ে উঠতে আমার ভাবনাকে কোনো না কোনো সুবিধা দিতে হচ্ছিল। হঠাৎ রঞ্জা বলে উঠলো, “খাটের উপর স্থির হয়ে বসো তো। এভাবে পাগলের মতো হাইটো না, আমার মাথা ঘুরে, তোমার এইরকম হাঁটা দেখলে।”

তার দিকে কড়া ভাবে চাইলাম, ওর সম্পূর্ণ ভঙ্গিটা যেন মনে না থাকে, কেবল ততোটা সময়। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বললাম, “তুমি গেইম খেল। আমার কাজ আমি করি।”

হয়তো সে বলতে চেয়েছে, “আমার কাজ আমি করি আর তোমার কাজ তুমি, এজন্যই কি আমাকে বিয়ে করছিলা?”

কিন্তু সে কিছুই বললো না, যদিও তার নিরবতার তাপ অনুভব করলাম, হতে পারে সেখানে অনেক অভিযোগের বীজতলা, হোক। বাস্তবে তো সে খাটে হেলান দিয়ে আরামসে গেম খেলছে। একটু আগে শিবলিঙ্গ জোড়া দিয়েছে, তার আগে টয়লেট গেছে, এখন বললে এমনকি এক কাপ চাও বানিয়ে দিবে। হঠাৎ রঞ্জার প্রতি মায়া হলো। ঋণাত্মক রেখায় চলে যাওয়া সত্ত্বাটার সম্পর্কে তো জানে না সে, জানে না ওর একফোটা অশ্রু রঞ্জার জন্যও ঝরেছিল। করুণাঘন, সমব্যথা আর আত্মঘাতী অপরাধবোধের তাপে ঘন হয়ে ক্ষীরের মতো জমেছিল তার চোখে, তারপর মার্বেলের মতো টুপ করে ঝরে পড়েছিল, যেটা টুকিয়ে নিয়ে আমি পকেটে রেখেছি অন্য দুটোর সাথে। ইচ্ছা করলো অশ্রু-শীলাটা থেকে কিছু কথা অনুবাদ করে দেই রঞ্জাকে, তাকে জানাই, কোথাও কেউ, অস্তিত্বের অন্তিম সিঁড়ীতে দাঁড়িয়েও তার কথা ভেবেছিল। 

সকল ভাঙ্গা জিনিসকে জোড়া দিতে পারে যে টিংকার বেল, তার মেরামতকারী মিস্ত্রীসুলভ ক্ষমতাকে কেউ বিশালাক্ষীর অপার শুশ্রূষা বলে ভেবেছিল ভক্তের মতো শ্রদ্ধায়। রঞ্জা;  তুমি পরমা-প্রকৃতি, জগৎ-জননীর বিভা সাক্ষাৎ ধারণ করে আছ, শুষে নিচ্ছ নিরব পীড়ন ও অবহেলা, আর ধৈর্য্যের সাথে জোড়া দিয়ে চলেছ ফাঁটা শিবলিঙ্গ!

তুমি হকদার পূর্ণাঙ্গ সমর্পণের, অথচ তোমাকে বিদ্যুতের মতো অস্পৃশ্য ভেবে তোমার খাটেও বসছি না। তোমার উপস্থিতিকে নিস্ক্রিয় করে দিতে পদচারণ করে চলেছি তোমার অস্তিত্বসীমার বাহির ঘেষে, বিচরণ করছি দাম্পত্যের ফাঁকতালে। চুম্বকের সমমেরুবৎ আমার এই অনীহাকে যেমন তুমি জানো না, তেমনিভাবে তোমাকে নিয়ে ওর মহৎ দুঃখের কিছুও তুমি জানো না।

ওর ভাবে আমি এমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম যে ইচ্ছা করছিল, ওর হয়ে রঞ্জার দিকে এগিয়ে যাই, পাশে বসি, হাত দিয়ে রঞ্জার মুখটা কাছে টেনে চুমো খাই সাবধানে, যেন ভেঙ্গে না যায় এই নাজুক মুহুর্ত। তার চোখে যে হাসিটা নিভে ধূসর হয়ে আছে সেটাকে জ্বালিয়ে দেই অকস্মাত। খোলা চুলের ঝরনায় হাত পেতে দিয়ে দেখতে থাকি, তার শরীরে অনিবার খুশির পুষ্প গুচ্ছে গুচ্ছে ফুটছে, বাতাসে  ভেসে আসা পুরুষ ঘ্রাণে শিহরিত হয়ে ত্যাগ করছে মৃদু রেণু। স্পর্শ করলেই লজ্জাবতীর মতো মুদে যাবে ধ্যানে। অপেক্ষা করবে নির্বিঘ্ন আগ্রাসনের। কিন্তু দ্বিতীয় চুম্বনের জন্য এগিয়ে গিয়ে আমি থেমে যাই, ওর প্রতিনিধি হয়ে এক্ট করার ভূমিকা ঝরে যাওয়াতে আমার বুক রঞ্জার স্তনের ঘর্ষণে কেঁদে ফেলে। খানিক আগে যে দূরত্ব থেকে রঞ্জাকে সুখি দেখতে চেয়েছিলাম, সেই দূরত্বটা ফিরে না পেয়ে শ্বাস নিতে পারছি না। আমার বুকের উষ্ণ বেদী থেকে তাকে নামিয়ে দিয়ে শ্বাস নেই, সহজ হই। ওমা, তারপর দেখলাম রঞ্জা আগের জায়গাতেই আধশোয়া, গেম খেলছে। আমি ঘোরমুক্ত ত্বরণে দাঁড়িয়ে আছি তার মাথার কাছে। সেখান থেকে স্টীলের আলমারির আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেলাম। কী করূণ! চুল-দাড়ির কৃষ্ণযৌবন চলে গেছে, বুকের এক মুঠো পশম দারিদ্রের লজ্জায় মাথা তুলতে পারছে না, মুখমন্ডলে অপরাধের রেখা। যাকে দেখে প্রেম জাগে না, সম্মান করতে ইচ্ছা করে না। এভাবে নিজেকে তাকিয়ে দেখতে অধৈর্য্য লাগছে; আয়না থেকে চোখ সরালে জোড়া লাগানো শিবলিঙ্গের উপর চোখ পড়ে, বিষে মনটা ভরে ওঠে। অতি তিক্ত অনুভবটাকে সরানোর চেষ্টায় হাতের বৈঠা দিয়ে বাতাস কাটি, শক্ত করে মুখ আটানো ঔষধের শিশির মতো মাথাটা দুইদিকে ঝাঁকাই, অস্তিত্ত্বের ধারাবাহিক পরিণতিকে পাশ কাটিয়ে আনকোড়া শুরুর অশুদ্ধ লিপ্সায়।

রঞ্জার ঘর থেকে ছিটকে বের হওয়ার পথে কনুইর বাড়ি লেগে, ওয়ারড্রবের ওপর থেকে গোপালের মূর্তিটা পড়ে যায়, ফ্লোরে। মেঝের সাথে সংঘর্ষে সেটা ভাঙলো কিনা, দেখার জন্য থামি না। যদি ভেঙ্গেও থাকে, রঞ্জা তো আছেই মেরামত করার জন্য, খাটের উপর আধশোয়া।

চলে যাওয়া সত্ত্বাটার ভাবনায় ফিরে যেতে চাইলাম, ঘর থেকে বের হয়ে আসতে আসতে। দাঁতাল আলোর পরিধির বাইরে, প্রকৃষ্ট অন্ধকারে তার অনুপস্থিতি স্পর্শগ্রাহ্য। উঠানের মধ্যভাগ পাড় হয়ে প্রান্তের একটু আগে গিয়ে থামলাম। এখান থেকে অপর প্রান্তের গাছটাকে দেখা যাচ্ছে না। বাড়িটাকে লাগছে আলোকিত জাহাজের মতো আর, আমি যেন চলে এসেছি অজানা তরঙ্গে। ছলছল করতে করতে আমার গায়ে ছিটকে পড়লো তরল অন্ধকার, পিঠেও হাত বুলালো অন্ধকারের ঢেউ। ওর প্রস্থান, উদযাপন করতে সমস্ত শূন্যস্থাণ বিভঙ্গে নড়ে উঠলো ইন্দ্রিয়গোচর সত্ত্বাদের মতো। এই অন্ধকার এতোই অনুময় যেন তা আমাকে ভাসিয়ে রাখবে, তবু আমি একটা বিরুদ্ধবল প্রয়োগ করে তাদের স্পষ্টভাবে গোচরে আনতে চাইলাম, যাতে চোখের মণির নড়া-চড়ার মতো অর্থময় হয়ে উঠে তারা, যেন গালে হাত দেয়ার শান্তি, ঠোঁটের বঙ্কিমতায় আঙুল বুলানোর স্বাধীনতার  মতো ধরতে পারি ওদের। ওরা অসংখ্য স্পর্শের স্থিতি দিয়ে আমাকে ঢেকে দিল। এই বুঝি কবরের ভিতরের না থাকা! পর মুহুর্তে স্থান বদল করে, ওরাই আবার ভেঙ্গে দিল সেই অখন্ডতা। আমার আনখকেশ একযোগে শিউরে উঠলো। যেন কেউ রমণসুখের তূরীয় তোলপাড়কে হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে ঠুকে অচঞ্চল করে রেখেছে সময়রহিত মাত্রায়, তারই এক ঝলক বুঝি তড়িতের মতো আমার শরীর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলে গেছে, অচিন্ত্য লক্ষ্যে! আমাকে আইসক্রিমের মতো চোষণ দিয়ে, দুই আঙুলে চিপ দিয়ে ধরে রেখেছে কোনো অদৃশ্য কাঠিতে। সেই বিগলনময় স্মৃতির ধারক যে আমি, তার ক্ষয়িষ্ণু ইচ্ছা এমন বহুরুপী অন্ধকারের, অনির্দিষ্ট ঠোঁটের প্রতি তৃষ্ণার্ত হলো, মুমূর্ষু নবজাত ইচ্ছাটাকে বাড়তে না দিয়েই ওরা নিয়ে গেল বন্টন করে এবং ফিরিয়ে দিলো সময়ের একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে, একসাথে। কেবল সেই মুহুর্তেই আমি নিজেকে ফিরে পেলাম ইচ্ছুক সত্ত্বা হিসাবে তৎপর, কিন্তু পূর্বের থেকে পৃথক, মোহমুক্ত যথাবৎ স্পষ্টতায়। অন্ধকারে একা, আমি নিজের দুটি কাঁধের মিষ্টতা অনুভব করতে পারলাম। তখনই ঝুমুর আমাকে ডাক দিলো, “দাদা। তুমি এহনো এইখানে পড়ে আছ?” তার কণ্ঠে চমকে উঠি, তাকে দেখে চমকটা অন্তরে প্রসারিত হয়; কাঁথায় মোড়ানো একটি শিশুকে পাঁজা কোলে করে সে সামনেই দাঁড়িয়ে আছে, পূজা শেষে পুরোহিতকে দেওয়া দক্ষিণার মতো অন্তিম ও আবশ্যক। আমি তাকে মেনে নিয়ে উঁকি দিলাম শিশুটির মুখ দেখতে, কবজি খাড়া করে সে শিশুর মুখ আড়াল করে, বলে, “ওরে দেখতে নেই।”

“কেন?” বিরক্ত হয়ে জিগাইলাম তাকে।

“সেটা তুমি বুঝবা না। কিন্তু তোমার না চলে যাওয়ার কথা?”

“কই যামু?”

“যাওয়ার জায়গার অভাব!” অলস, প্রলম্বিত শ্লেষের স্বরে বললো সে।

“হ্যাঁ, অভাব। তুই বল, কই যামু আমি? এই গ্রামের বাইরে? কোনো শহরে? রাজধানীতে? নাকি দেশের বাইরে? যেখানেই যাই, এই অত্যাচারী মনটারে পারমু থুইয়া যাইতে?”

“যেখানে তোমার মন বাসা বাঁধতে পারে, এমন জায়গায় যাও না কেনে?” যেন আমাকে বলার চেয়েও তার নিজের কথা নিয়ে খেলতে, সে মজা পাচ্ছে বেশি।

“আছে এমন জায়গা, এই দুনিয়ায়?” তার কৌতূকময় ভাব দেখে আমি ভিতরে ভিতরে চটছিলাম। তবু মনের এক কোণ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রশ্নটা বেড়িয়ে এলো, গোটা মনের সচেতন সম্মতির আগেই।

“না না, কাঁদে না, আমার বাবা, আমার সোনা, মানিক আমার, কাঁদে না।” বলতে বলতে সে কোলের শিশুকে দোল দেয়, হঠাৎ অস্ফুটে কেঁদে ওঠেছিল বলে।

শিশুটিকে দেখার প্রচণ্ড কৌতূহল দমন করে তাতানো কণ্ঠে বললাম, “ক। কস না কেরে? আছে নি এমন জায়গা এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে?”

“হ। তুমি তো এলিয়েন আইছ।”, কড়া ভাবে বললো সে, তারপর নিমিষেই হিংস্র ভঙ্গিটা সংবরণ করে মোনালিসার মতো গূঢ় রহস্যময় নারীতে রুপান্তরিত হলো। নৈর্ব্যক্তিক ক্যানভাস থেকে ঈষৎ সক্রিয় স্মিতি নিয়ে বললো, 

“বিভ্রান্তির বিলাসিতা নিয়া থাকতে চাও, থাকো; দুনিয়ারে দুষাইয়ো না। এইটা কইয়ো না যে তোমার যাওনের কোনো জায়গা নাই, এটাও কইয়ো না যে তুমি জানো না। নিজেরে জিগাও তুমি যাইতে চাও কিনা। কিন্তু তুমি তো যাইতে চাও, চাও না? তবু যে যাইতাছ না, তার কারণ তুমি ভাবতাছো তোমার জীবনের অনস্বীকার্য সংগ্রামরে এড়াইয়া পার পাইবা। ভাবছো, জীবনের নির্ধারিত সময় কোনোক্রমে কাইটাই তো যাইবো। ঠিক নি?”

এই অথৈ অন্ধকারের মাঝেও একটা জারজ টিকটিকি আওয়াজ করলো, টিক টিক টিক, আর ঝুমুর তার সম্ভ্রান্ত প্রতিমাকে খিলখিল হাসির উচ্ছাসে ভেঙে ফেলে বললো,

“দেখছো দাদা, আমি সত্য কইছি। টিকটিকিও সায় দিছে আমার কথায়।”

আমি স্তব্ধ থাকলাম। ঝুমুর জীবিত থাকতে যেমন, মরণের পরেও বদমাশ টিকটিকিগুলি তার পক্ষ নিতে ভুলে না। কিন্তু তার কথার প্রখর আলোকসম্পাত থেকে আমার মনটাকে সরিয়ে রেখে বললাম, “খুব তো বুঝদার কথা কইলি, দুনিয়ারে দুষতাম না! তুই নিজে এই দুনিয়া ছেড়ে ভাগলি কোন আক্কেলে?”

সে তার কোলের শিশুটির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে যেন ঘুম পাড়ানি গল্প শুনাচ্ছে, এমনভাবে বলতে থাকলো, “আমি মেয়েমানুষ। তবু সাহস করে সব ত্যাগ করতে রাজি ছিলাম তো তার জন্য। তোমরার পরিবার, তোমরার সমাজ, তোমরার ধর্ম। তার জন্য সমস্ত দুনিয়ার সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত আছিলাম, অথচ সে পিছায়ে গেল। আমার ত্যাগ সহ্য করার ক্ষমতা ওর ছিল না। সে আছিল তোমার মতোই ভীতু। আমার সমর্পণ নিয়া কী করতে পারতাম আর? আমি তো তোমাদের মতো যাত্রাবদল করতে পারি না, নিছক পুতুলের মতো বাইচা থাকার জন্য।”

“ধর্মান্তরিত হয়ে সুখি হতে পারতি তুই? আশৈশব সংস্কারের শিকড় ছিঁড়ে কারো পক্ষে সুখি হওয়া দূরের কথা মানসিক স্বস্তিতে থাকা সম্ভব?”

“ভবিষ্যৎ কে জানে, দাদা? আমারে তো ভবিষ্যৎ গড়নের সুযোগটাই সে দিলো না। এক নাবালিকা কিশোরীর সহজ আত্মদানের ভার নিতে, সে ডারাইছে। পরিবার, সমাজ, ধর্ম, আইন এইসব তছনছ করা প্রেমের শক্তিটাকে সে প্রত্যাখ্যান করছে। ঘোড়ার ডিমের পুরুষ সে!”

“পুলিশের ঝঞ্জাট, আইনের প্যারা, পরিবারের চাপ, তোর দায়িত্ব, এতো সবকিছুর ভার নিতে কেউ যদি ডরায়, পিছায়ে আসে সেজন্য তারে দোষ দেওন যায়?”

“দোষ দিতাছি না গো, ভীতুরে ভীতু কইতাছি। এখন কি সে আরামে আছে? দেবদাসের মতো টাল হইয়া ঘুরতে এখন খুব ভালো লাগে তার! আফসোস আর অপরাধবোধের পাথরের নীচ তিকা বের হইতে পারবো কোনোদিন? যে যুদ্ধটা একবার করলেই হইতো সেটা এখন জীবনভর নিজের সাথে নিজে করবো। এটা খুব ভালো হইছে, না? এখন সে বুঝে আমারে তার কী ভীষণ প্রয়োজন আছিল।” স্বর নীচু করে বলল,  “আমারো তারে।”

“ভবিষ্যৎ কে জানে ক? তুইও তো তারে, তার নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ দেস নাই। ভালোবাসার বিধ্বংসী রুপটারেই আপন করে নিলি।”

আমার কথা শুনে রাগে, রক্তজবার মতো রক্তবর্ণ হয়ে উঠলো তার মুখমন্ডল। শ্বাপদের হিংস্র ভঙ্গিকে ভাবে ও ভাষায় অনুবাদ করতে শুরু করলো, “তোমরার দাসী হয়ে বেঁচে থাকতাম যদি তাইলেই তোমরা খুশি থাকতা! তোমাদের সোনায় তেল মাখাইতে ঝুমুররে চাই। তোমরার সমাজ-সংসার ধর্ম-আইন, সম্মান সব ঠিক থাকতো! মানুষের মনের মূল্য, ইচ্ছার মূল্য আছে তোমরার কাছে? আমি নিজেরে খুন করে ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছি আর তোমরা যে আমার ভবিষ্যৎ টারে অর্থহীনভাবে সুনির্দিষ্ট করে রাখছ তাতে কোনো দোষ নাই? তোমরার এইসব অশ্লীল নীতিকথার উপর আমি মেয়ে হইয়া খাড়ইয়া মুতি। আর দাদা, তুমিও তারার দলে।”, শেষের বাক্যটা সৃষ্টি হয়েছে জমাটবদ্ধ অভিমান দিয়ে, কিঞ্চিৎ কান্নায় ভেজা।

আমার ভিতরে উথালপাথাল শুরু হলো। তার ক্রোধের ঘূর্ণিতে তৃণের মতো উড়তে উড়তে আমি কয়েকটি বাক্যের অবলম্বন বানাতে চাইলাম,

“আর কোনো বিকল্প তোর নজরে পড়লো না? কলতলার পাশ দিয়া, গন্ধে ঝিম ধরা মুকুলিত আমগাছের নীচে আইসা বুক কাঁপল না তোর? নিজের উড়নাটার প্রতিও মায়া জাগলো না? মনে হইলো না, এই জীবন সুন্দর? তারে ছাড়াও জীবন স্বয়ং প্রাচুর্য্যময় আর অর্থবহুল? শুধুমাত্র একজন মানুষ, তারে বাদে সমস্ত দুনিয়ার একটা কণাও তোরে টানলো না?”

“না।”

তার উত্তরটা স্বপ্ন থেকে জেগে উঠার আগের দৃশ্যের মতো, ফুটতে ফুটতে মিলিয়ে গেল। বুকের ভিতর চওড়া একটা রেশ রেখে অন্ধকারের নিরাপোষ হৃদয়ের অংশ হয়ে গেল সে, শিশুটি সমেত। আমার আর সেই শিশুর মুখ দেখা হলো না।

এখন রাত্রিটা প্রাত্যহিক হয়েছে। পরিচিত বাড়ি, উঠান, গাছ, তারাভরা আকাশ আমাকে আশ্বস্ত করলো। ঝুমুরের অস্তিত্বের আচ্ছন্নতা এখনো কাটেনি। তার কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ঝুমুর ফাঁস লাগানোর পর, সারা গ্রাম এমনকি সারা উপজেলায় লাড়া পড়ছিল। মানুষের মনে ও আলাপে জীবন্ত ঘটনা হিসাবে স্বীকৃত পেয়েছিল তা। কিন্তু একই পথে, প্রতিবেশী গাছটিকে বাহন করে যে আরেকটা সত্ত্বা চলে গেল আজ, সেটার আমিই অদ্বৈত সাক্ষি। আমি ছাড়া অন্য কারো মনে বা আলাপে বা কল্পনায় তার কোনো অস্তিত্ব নেই। ওর চোখের জলের দ্বিতীয় শিলাটি কি নিজের প্রতি করুণায় ঝরেছিল, নাকি আমার জন্য— যে আমি, অবিরাম পলায়ণ করছি! গন্তব্য জানা সত্ত্বেও যাত্রা বদল করে ঢুকে পড়েছি ভুল জীবনে? 

যথেষ্ট ক্লান্ত হওয়া স্বত্বেও দুটি ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমিয়েছিলাম। ঘুমের ভিতর নিজেকে সঁপে দিয়েছিলাম যাত্রীর মতো। ট্রেন যেরকম নিরপেক্ষভাবে দূরত্ব অতিবাহিত করে, তেমনি করে স্বপ্নহীন ঘুম আমাকে পৌছে দিল পরদিন সকালে। সকালের শব্দগুলো মধুর, কাপ প্লেটের টুংটাং আওয়াজ, পানির ছিটার শব্দ, পাখিদের কিচকিচ, শিশু আর শিশুর পেছনে ধাবমান বড়দের মিষ্টি খুনসুটি, বাবার বাজারের ব্যাগ খোঁজার খুটখাট, বারান্দায় চলে আসা নির্ভিক পায়রাদের বাকবাকুম, আর জানালা দিয়ে চলে আসা গৌরাঙ্গ রোদ, সকলে মিলে একটু একটু করে খুচিয়ে ঘুমের প্যাকেট ছিঁড়ে আমাকে জাগিয়ে তুললো। রঞ্জার শাখা-বালার আওয়াজ, শাড়ির খসখসানি অনেকক্ষণ ধরে আমার ঘুমের চারপাশে ঘুরঘুর করছিল। চোখ মেলতেই দেখলাম সে, চুল আঁচড়াচ্ছে। আমি জাগছি বুঝতে পেরে মিষ্টি করে বললো, “ঘুম ভাঙ্গলো আপনার?” আমার দিকে না ফিরেই সময় নিয়ে নিরবে ক্রীম মাখলো মুখে, সীঁথিতে সিঁদুর পরলো যত্ন করে, এরপর দুই ভ্রূর মাঝখানে নবোদিত সূর্যের মতো টিপ পরতে পরতে বললো, “মা চা বসাইছে। তাড়াতাড়ি মুখ ধুইয়া আসো।”

আমি মাথা উঁচিয়ে ওর রূপচর্চা দেখতে ছিলাম। স্নানের পর তাকে স্নিগ্ধ লাগছে খুব। এদিকে বলিষ্ঠ রোদ প্রাণোচ্ছল বন্ধুর মতো ডেকে যাচ্ছে ক্লান্তিহীন, আমাকে একটু তাপ দিয়ে ছুঁয়ে বলছে, “উঠ উঠ।” আর আকাশ অপেক্ষা করে আছে নীল মদ নিয়ে। এই সকালে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য আমাকে উঠতেই হবে। জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম কলতলার দিকে। গত সন্ধ্যার আলামত বিস্মৃত গাছটির পাতাও ঝিলমিল করছে রোদে। পুষ্টির লোভে প্রতিটি দৃশ্য নিজেদের মেলে দিয়েছে ভাঁজহীন কাগজের মত। এই আয়োজন কোনো চলে যাওয়াকেই গুরুত্ব দিতে রাজি না। যা আছে, যারা আছে তাদের নিয়েই ঘটনাময় থাকতে চাইছে সুন্দর সকালটা।

প্রতিদিনের মতো মাও পরিচিত অভিযোগ নিয়ে এলো, “সকালে একটু তাড়াতাড়ি উইঠা বাজারটাও করতে পারস না? তোর দাদা পইত্তাকালা উইঠা যায় গা বন্দে, তুই থাকস ঘুমাইয়া। এই শরীর লইয়া তোর বাবা বাজারে যায়। কবে সুখ দিবি তোর বাবারে! আমরা মরলে পরে শিখিস বাজার করন।” এসব বলে সকালের বিবিধ কাজের ব্যস্ততায় ফিরে গেল মা।

আমিও যথারীতি মার কথাগুলো পাত্তা না দিয়ে, বিছানায় উঠে বসলাম। বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা তুলে নিয়ে ফেসবুক ওপেন করলাম। সকালটা কি ঢুকে পড়েছে এখানেও! টাইমলাইন স্ক্রল করতে করতে দেখলাম আরেকটা সমান্তরাল ঘটনাজগৎ, যার বিশৃঙ্খলা থেকে আমি চয়ণ করতে পারছিলাম পুষ্টিকর কিরণ, যা এই সকালের উদারতায় স্বচ্ছ দেহ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি কয়েকটি দীর্ঘ পোস্ট ও আর্টিকেল এর লিংক পরে পড়বো বলে সেইভ করে রাখছিলাম, রঞ্জা এসে খাটের কিনারে বসলো নিরবে। তখনই মেসেঞ্জারে একটা নতুন বার্তার ঘন্টি বাজলো, ওপেন করে দেখি রঞ্জা পাঠাইছে—একটা প্রেগনেন্সি কিট এর ছবি , যেটাতে দুটো লাল দাগ; নীচে লেখাঃ “অভিনন্দন। তুমি বাবা হতে চলেছ।” আমি রঞ্জার দিকে ফিরলাম, সত্যি! ওর চোখের উজ্জ্বলতা বেড়ে গেল। ঠোঁটের হাসিটা চেপে রাখতে গিয়ে সেটা চোখ দিয়ে উপচে পড়তে লাগলো। টের পাচ্ছি তার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেছে। আশা করছিল আমি তাকে জড়িয়ে ধরবো। কয়েক সেকেণ্ড অপেক্ষা করে নিজেই মুখ এগিয়ে দিল, “পাপ্পি দেও।” আমি বললাম, “মুখ ধুইনি তো।”

“লাগবে না। আগে চুমা দেও।” বলেই আমার ঠোঁটের সামনে গাল পেতে রইলো। চুমা দিলাম; সে আরেক গাল এগিয়ে দিলো। আমি সেটাতেও চুমো খেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। ব্রাশে পেস্ট লাগাতে লাগাতে জিগাইলাম, “কী নাস্তা বানাইছ?”

“মাংস আর রুটি।” বাব বাহ! সাতসকালে মাংস? কোনোদিন তো হয়নি আগে? বললাম, “মারে জানাইছো?”

“এখনো না। সবার আগে তোমারে জানাইলাম। তুমি ঘুম থেকে উঠতাছ না, আমার অস্থির লাগতেছিল। মন চাইছিল পানি ঢাইলা দেই।”

“দিতা।”

“আইচ্ছা! ঠিক আছে, মনে থাকলো। এহন যাও, তাড়াতাড়ি মুখ ধুইয়া আসো। চায়ের পানি আজকে আবার শুকাইবো। এখন স্নান করবা, নাকি পরে?”

“স্নান করমু।” বলে ব্রাশ, লুঙ্গি ও গামছা নিয়ে কলে গেলাম। টিউবওয়েল চাপতেও সুখ পাচ্ছি, চাপে চাপে স্নানের বড় বালতিটা ভরে উঠছে পানিতে নাকি আমার সুখে? বালতি ভরার পরে দুই হাতের আজলায় পানি নিয়ে মুখের কাছে নিয়ে গেলাম, নাক-মুখে পানির ছোঁয়া লাগছে। এই অভিনব রীতি বুঝি নতুন জীবনকে অভিবাদন জানাতে! তারপর আজলার পানি ছিটিয়ে দিলাম আকাশের দিকে। এতো সুখ! এই বিশ্বে যেন আঁটে না। জীবন যদি হতো আমার জমজ, তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে দেহের রোমাঞ্চকর ঝনঝনানি প্রবাহিত করে দিতে পারতাম। তার মস্তকে ঝাঁকুনি দিয়ে ওর প্রতি আমার অধিকার গেঁথে রাখতাম। কিন্তু জীবন তো একক মানব শরীরে আত্মপ্রকাশ করে না। বহুতে বিভক্ত এক বিমূর্ত ধারণা সে, তাই এই সুখে কিছুটা ক্লান্ত বোধ করলাম।

“কিরে। এতোক্ষণে স্নান করছ? অফিসে যাবি কোনসময়?”, বাবা বাজার থেকে ফিরে এসেছে সেটা জানান দিলো এইভাবে।

“আজকে শনিবার বাবা। অফিস বন্ধ।”

“অহ। তাইলে তোর দাদার লগে গেলি না কেন, বন্দে?”, কিছু কই না আমি প্রত্যুত্তরে। আমার স্নান শেষ হয়ে গেছিল, স্নানঘর থেকে বের হলাম, বাবা ঢুকলো হাত-মুখ ধুতে। ঘরে গিয়ে চুল আঁচড়ানোর সময় স্টীলের আলমারির আয়নাতে নিজেকে দেখলাম, রীতিমতো সুপুরুষ মনে হলো। চোখ ও কপাল কুঁচকে কয়েকটা এঙ্গেল থেকে দেখলাম, বেখাপ্পা লাগলো না, সবদিক দিয়েই সুষম বোধ হলো। মা বসার ঘর থেকে জিজ্ঞেস করলো, “নাস্তা নিয়া আনমু তোর লিগা?”

 “বাবা আসুক।”, বলতে বাবাও এসে পড়লেন। গামছা দিয়ে হাত-পা মুছতে মুছতে মারে জিগাইলেন, “তারা বইছে খাইতে?”

“হ। অপুর মা তারারে খাওন দিতাছে। এহন তোমরা বাপ-পুতের লিগা আনমু নি? তোমরা তো ভাত খাইতা না, রুটি করছি। নিয়া আই?”

“লইয়া আনো।” বলে বাবা বসার ঘরের চকিতে বসলেন। একটা সেন্ডু গেঞ্জি পরে আমিও বাবার পাশে বসলাম। রঞ্জা আসনঘরে পূজায় বসেছে, বসার ঘর থেকে তার পেছনদিকটা দেখতে পাচ্ছি, আঁচলটা চৌকাঠের উপর পড়ে আছে, যেন সাপের মত বুক বেয়ে চলে যাবে বাড়ির কোণায়; কলতলার পাশ দিয়ে, মাইট্টা নালা ঘেষে, বাড়ির এঁটোকাঁটা আর আবর্জনা ফেলার অবতল ঢাল বরাবর।

মা দুইভহাতে নাস্তার থালা নিয়ে আসলো। দক্ষিণ হাতেরটা বাবাকে দিয়ে বাম হাতের থালাটা আমাকে এগিয়ে দিলো। বাবা খেতে শুরু করেছে; থালায় সাজানো খাবার দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। চারকোনা করে কাটা এক বাটি কাঁচা মাংস, সাথে দুটি রুটি। বাবা নিঃসংকোচে খাচ্ছে। রুটির টুকরা দিয়ে মাংসের টুকরোকে মুড়ে, ঢুকিয়ে দিচ্ছে মুখে। চাবানোর চোটে মুখের কষ বেয়ে সুতোর মতো সরু রক্তের ধারা পড়তে লেগেছে। আমার উটকি আসলো, মার দেয়া থালাটা না নিয়ে খাবার ঘরের দিকে যেতে লাগলাম পানির খোঁজে। মা বলছেন, “কই যাস আবার? আমি বুঝি থাল লইয়া দাঁড়াইয়া থাকতাম!” মার কথাগুলো কানে পৌঁছানোর আগেই খাবার ঘরে চলে আসলাম। গিয়ে দেখি, দাদা মুনি-মানুষদের নিয়া খাওনে বইছে। ভোর থেকে একবেলা কাজ শেষ করে এসে, এখন এক পত্তন খেয়ে আবার তারা বন্দে যাবে। সকলের পাতেই ছোট ছোট টিলার মত সাজানো ভাত, পাশে শুকনো রক্ত লেগে থাকা কাঁচা মাংসের তরকারি। এই খাদ্য নিয়ে কারো কোনো অরুচি নেই।

আমার অদম্য ইচ্ছা হলো রঞ্জার আঁচল দিয়ে বানানো কল্পিত সাপটার মত, ঋণাত্মক রেখায় চলে যাওয়া ভূতটার মত, ঝুমুরের মত। আমিও ধাবিত হই কলতলার পাশ দিয়ে, মাইট্টানালা অতিক্রম করে এঁটোকাঁটা আর আবর্জনার মশানে, দাঁড়িয়ে থাকা জনমদুখি গাছগুলোর দিকে। কোনো একটাতে চেপে বসি অবীচিলোকের উদ্দেশ্যে।

কিন্তু ইচ্ছাটা স্বল্পায়ু হওয়াতে আমি বমি বমি ভাব স্বত্ত্বেও ফিরে আসলাম বসার ঘরে। মা আমার দিকে নাস্তার থালা ধরিয়ে দিয়ে বললো, “তাড়াতাড়ি খা। চায়ের জল একবার শুকাইছে, আবার বসাইছি। এমন নবাবি করলে চা পাইতি না আজকে”। চায়ের প্রসঙ্গ আসাতেই কিনা, মনটা এখানে থাকতে রাজি হলো। মাকে বললাম কাঁটাচামচ এনে দিতে। মা এনে দিলো। আমি চামচে গেঁথে এক টুকরা মাংস দাঁতের ফাঁকে আটকালাম, একটু একটু চাপ দিয়ে দ্বিখন্ডিত করতে চাইলাম বমি ভাবের সাথে মনোদৈহিক যুদ্ধে রত থেকে। অবশেষে একটা খণ্ড মুখের ভিতরে গেল, জিহবা রস পেয়েও ব্যর্থ হলো স্বাদ বুঝতে, তবু চাবানো যায়, একটু কষ্ট হলেও গিলে ফেলা সম্ভব। হোক কাঁচা মাংস, সেটা থুৎকার করে ফেলে দিতেই হবে এমন কোনো অবিচ্ছেদ্য আবশ্যকতা আছে কি? রুচি? রুচি তো বদলায়, কখনো স্বাভাবিক চাহিদায়, কখনো জবরদস্তির বাবদে। নাহয় একটু জোর প্রয়োগই করলাম! দ্বিতীয় টুকরাটা হয়তো একইরকম খারাপ লাগবে না। কাঁটাচামচে গেঁথে দ্বিতীয় টুকরাটা মুখে নিলাম। বাম চোখ দিয়ে একফোটা জল গড়িয়ে গালের কাছে থেমে গেল, বেদনার সাথে সম্পর্কহীন অপরিচিত কান্না। এটা কি আমারই অশ্রু, নাকি ওর চোখের জলের তৃতীয় শিলাটা আমার শরীর যন্ত্রে পুনরুতপাদিত হচ্ছে? হয়তো আজকেই তৃতীয় টুকরাটা খেতে পারবো না, কিন্তু তাড়া কিসের? মাংসের বাটিটা নামিয়ে রাখতেই মা বললো, “কিরে। মাংস খাইলি না?” কিছু না বলে মার হাতে বাটিটা তুলে দিলাম, মা আমার চোখ দেখে ব্যথা পেল। তবু বললো, “পরে খাইস। নাইলে রঞ্জা খাইবো নে বাকিটা। চা আনতাছি।”

বাবা আর আমি চায়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। নিখিলের বিবিধ ভূতেরা আমাদের অপেক্ষার বৈসাদৃশ্য তুলনা করে কৌতূকে ডিগবাজি খেতে লাগলো।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.