
অরণ্য রাত্রি
মুখবন্ধ
১৯৪৭ ভারতীয় উপমহাদেশের একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য সাল। এই বছরেই ব্রিটিশরা তাদের ২০০ বছরের দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটিয়ে তড়িঘড়ি করে ভারত ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪৭ সালের ২ জুন লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভাগ পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগ হয় ধর্মের ভিত্তিতে। হিন্দুদের জন্য ভারত আর মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান নামে রাষ্ট্র গঠন করা হয়। স্যার রেডক্লিফ রাষ্ট্রীয় মানচিত্র গঠন করেন। পাকিস্তানের ২ টা অংশ। এক পশ্চিম পাকিস্তান আর অন্যটা পূর্ব পাকিস্তান যা এখন আমাদের বাংলাদেশ। ২ পাকিস্তানের মাঝে ভারতের বিশাল ভূখণ্ড ছিল। আর ২ পাকিস্তানের মাঝে ধর্ম ছাড়া আর কোন কিছুতেই মিল ছিল না। আমাদের গল্পের শুরু এমনই একটি সময়। সময়কালটা শুরু হয়েছে ১৯৬৭ সাল থেকে। এই সময় বিশ্ব রাজনীতির অবস্থা কিন্তু টালমাটাল ছিল। আরব ইসরাইল যুদ্ধ হয়েছিল এই বছর। ইসরাইলের সাথে মিশর, জর্ডান এবং সিরিয়া যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
এই গল্প লিখতে আমি অনেক বই এর আশ্রয় নিয়েছি, মানুষের অভিজ্ঞতা শুনেছি। তারপরও তথ্যগত ভুল থাকতে পারে। থাকলে ধরিয়ে দেবার জন্য আকুল আবেদন করছি।
পূর্ব পাকিস্তানের পালইকান্তা গ্রামের ২ জন কিশোর সুব্রত আর সুমন। প্রচণ্ড দুরন্ত। পড়ে ক্লাস এইটে। তাদের বন্ধুত্বকে সারা জীবনের বন্ধুত্বের সাথে তুলনা করে সারা গ্রামের মানুষ। তারপরও তারা মারামারি, ঝগড়া করে নিজেদের মাঝে। থাকে অভিমান, রাগ, ক্ষোভ আর জিদ। কিন্তু তারপর আবার সব ঠিক হয়ে যায়। একসাথে থাকতে গেলে এরকম একটু আধটু হয়েই থাকে। বয়স বলেও তো কথা আছে। এই বয়সে একটু চঞ্চল থাকে সবাই। তাই এই সব ব্যাপার গ্রামের মানুষের চোখ এড়িয়ে যায়। শুধু ২ জনকেই যখন তারা একসাথে দেখে তখন তাদের চোখ জুড়িয়ে যায়। এক কথায় সবাই তাদেরকে মানিকজোড় বলে।
প্রথম পর্ব
পালইকান্তা গ্রামটি খুব সুন্দর। শান্ত নীরব সুখী পরিবেশ। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পাগলি নদী। নদীর পানি কাকচক্ষুর মত স্বচ্ছ। অসংখ্য গাছপালা সবুজে ঢাকা গ্রাম পালইকান্তা। গ্রামে সবাই মোটামুটি সচ্ছল। মানুষের আয় এর এর উপায় মূলত কৃষি কাজ। শীতকালে যখন মাঠের পর মাঠ হলুদ সরিষা ফুল ফুটে থাকে তখন মনে হয় কোন এক সুন্দরী নারী তার হলুদ রঙের শাড়ির আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে। আবার যখন রাত্রিতে মেঘমুক্ত আকশে দিকে তাকিয়ে থাকা হয় তখন মনে হয় আকাশটা চুমকি বসানো কালো একটি শাড়ির আঁচল। হরেক রকম পাখির মেলা এই গ্রামে। দোয়েল, ফিঙে, বউ কথা কউ, মাছরাঙা পাখির কলরবে টিকা দায়। গ্রামের এক কোনে শত বছরের পুরাতন মন্দির। এখনো পোড়া মাটির নকশা করা মন্দিরে। আর তার পাশেই শাপলা পুকুর। গোলাপি শাপলাতে সারা বছর ঢেকে থাকে পুকুরটা। গ্রামের আসল সৌন্দর্য কিন্তু বর্ষা তে। বৃষ্টির অঝোর ধারা আর তাতে গোসল করার আনন্দ সুব্রত আর সুমনের থেকে আর ভাল কে জানবে। এক ধারে জঙ্গল। সেখানে নানা বুনো ফুল ফুটে থাকে। নাম না জানা কত ফুল। ফুলের সুবাসে চারিদিক মৌ মৌ করে। এই জঙ্গলেও প্রায়ই দেখা যায় এই মানিকজোড়কে। কখনো পাখির বাসার ডিম চুরি করতে আবার কখনো ফল পাড়তে তাদের দেখা যায় এই গভীর জঙ্গলে। শেষ বিকেলের পরন্ত সূর্য দেখতে তারা চলে যায় রেল লাইনের কাছে। ২ হাত ধরে রেললাইনের ২ পাশ দিয়ে হেঁটে যায় তারা। মনে হয় এই হাত যেন তারা যুগ যুগ ধরে ধরে রেখেছে।
এখানে সুব্রতের এবং সুমনের বাবাই গ্রামের মাথা। ২ জনের মধ্যে অনেক মিল মহব্বত। তারাই নিজেরা মিলেমিশে গ্রামে ছোটোখাটো অপরাধ গুলোর বিচার করে দেন। সালিসি করে দেন। গ্রামের মানুষও পুলিশ এর কাছে তেমন যায় না। আর বড় ধরনের অপরাধ খুব একটা হয় না এই গ্রামে।
জামান সাহেব আর অমলেশ বাবু ২ জনই অবস্থা সম্পন্ন। নিজেদের পুকুর আছে। আছে ধানি জমি। গোয়ালে গরু। অসংখ্য হাস মুরগি। সবজি আর ফলের বাগান। জামানের বাজারে বেশ কয়েকটা দোকান আছে। আর অমলেশ বাবু বাজারেই হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করেন।
জামান সাহেবের বাড়িটা বিশাল। টিনের ঘর। ৪ দিকেই ঘর। মাঝখানে উঠান । টিউবয়েল আছে। পাশেই পুকুর। বাড়িটি ঘিরে অসংখ্য গাছ। জামান সাহেবের আগে আরো একটি সন্তান হয়েছিল। কিন্তু জন্মের সময় বাচ্চাটি মারা যায়। তারপর থেকেই তিনি ঠিক করেছেন আর বাচ্চা নিবেন না। তাই সুমনই তার এক মাত্র সন্তান।
অন্যদিকে অমলেশ বাবুর বাড়িটিতে একটি ঘর পাকা দালান আর টিনের ছাদ। মাঝখানে একটি তুলসী গাছ বংশ পরম্পরায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু বাড়িটি জামান সাহেবের বাড়ির মত এতো বড় নয়। অমলেশ বাবুর স্ত্রীর প্রথম সন্তান জন্মের পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তার বললেন আর বাচ্চা নিতে পারবেন না। আর তাই সুব্রত তাদের এক মাত্র সন্তান।
সুব্রত আর সুমন ২ জনই বড় হচ্ছে। এইটে পড়ে তারা। বয়ঃসন্ধি এসে গিয়েছে তাদের জীবনে। জীবনের একটি বিশেষ অধ্যায়ের শুরু হয় এই সময়। মোচের রেখা এবং দাঁড়ি উঠা শুরু করেছে। গলা ভারী হয়ে গিয়েছে। এর মাঝে স্বপ্নদোষ হয়েছে। এসব নিয়ে তারা অস্বস্তিতে থাকে। কিন্তু এই ব্যাপারগুলো নিয়ে কার সাথে আলোচনা করবে। তারপরও যৌন জীবন নিয়ে ২ জনই আগ্রহী হয়ে পড়ে। এক বৃষ্টির রাত। পরীক্ষা শেষ। সুব্রত, সুমনের সাথে থাকবে রাতে সুমনের ঘরে। সারা রাত গল্প করবে। বর্ষা কাল ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির ফোঁটা টিনের ছাদে পড়ছে। ঝুম ঝুম শব্দ হচ্ছে। সে এক মধুর শব্দ। আর এই শব্দ শুনতে শুনতে তারা বিছানায় শুয়ে গল্প করছে। মাটির সোঁদা গন্ধ নাকে এসে লাগছে। হারিকেন জ্বালানো। আলো আঁধারের খেলা। তাদের গল্পের কোন শেষ নেই। গল্প করতে করতে যৌনতা নিয়ে কথা শুরু হল। এই টপিক ইদানিং তাদের খুব প্রিয় টপিক। যৌনতা প্রসঙ্গ আসলে মেয়েদের প্রসঙ্গ চলে আসে। বাংলা সিনেমার নায়িকাদের কথা দিয়ে শুরু হল আর শেষ হল একটি ছবিতে। সুমন বলল,
– একটা ছবি দেখবি?
– কিসের ছবি?
– দাঁড়া দেখাচ্ছি ।
সুমনের একটা ছোট কালো রঙের ট্রাঙ্ক রয়েছে। এখানে তার সমস্ত পড়ালেখার সামগ্রী আর খেলার জিনিস রয়েছে। সুমন তার ট্রাঙ্ক খুলে একটি ছবি নিয়ে আসলো যা সযত্নে ট্রাঙ্কটিতে গোপনে রেখে দিয়েছিলো। ক্লাস টেনের বাবুল ভাইয়ের কাছে এমন অনেক ছবি আছে। তার কাছ থেকেই ১০ পয়সা দিয়ে ছবিটা কিনেছে সুমন। আজ সুব্রতকে দেখাবে। ছবিটি একটি ইংলিশ সিনেমার নায়ক নায়িকার নগ্ন ছবি। ছবিটি দেখে হঠাৎ করেই যেন সুব্রতর মুখ দিয়ে বের হয়ে গেলও একটি কথা।
– বাহ ছেলেটা তো দেখতে দারুণ। এত সুন্দর শরীর।
এই কথা টা বলেই চুপ হয়ে গেলো সুব্রত। এ কী বলল সে। তার অন্যদের মত মেয়েদের ভাল লাগে না। বরং পুরুষের দেহ তাকে টানে। উন্মুক্ত পুরুষ শরীর তাকে নেশাগ্রস্তের মত আকৃষ্ট করে। কিন্তু এই কথা সে সারা জীবন গোপন রাখবে ভেবেছিল। কারণ বাবুল ভাই একবার কথা কথায় বলেছিল এমন কিছু ছেলে আছে যারা পুরুষ হয়েও পুরুষকে ভালবাসে। এদের কে মাইজ্ঞা পুরুষ বলে। এরা আসলে বাইরে পুরুষ হলেও ভিতরে অবলা নারী। এই বলে বাবুল ভাই খুব হেসেছিল। তার সাথে অন্যরাও হেসেছিল। তখনি সে বুঝেছে এই কথা ফাঁস হলে সর্বনাশ। সবাই তাকে একঘরে করে দিবে। তাকে নিয়ে হাসবে। রঙ্গ রশিকতা করবে। কিন্তু সুমনের কাছে ঠিক ফাঁস হয়ে গেল। সুমন তাকে নিয়ে হাসবে না তো ?
এদিকে সুমন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো
– তোর কি আমার মত ছেলে ভাল লাগে? আমি তো ভেবেছিলেম দুনিয়াতে মনে হয় আমি একাই এরকম। জানিস কত রাত ঘুম হয় নাই এই চিন্তায়। মনে হয়েছিল আমার মত আর কাউকে খুঁজে পাবো না। সবাই তো নারী দেহেই মোহাবিষ্ট আর আমি পুরুষ হয়েও পুরুষে। আর আমার বেস্ট ফ্রেন্ডই কিনা এমন। আর সেটা আমি জানি না। হা হা। কাছে থাকতে দূরে গিয়ে মরছি।
সুব্রত বলল
– কিন্তু শোন আমাদের এই ব্যাপারটা গোপন রাখতে হবে। মানুষ জানলে আমাদের এক ঘরে করে দিবে। ঠাট্টা, মশকরা করবে। আমাদের বাবা মায়ের অবস্থা কী হবে চিন্তা কর। সালিশ পর্যন্ত ডাকতে পারে।
– তা তো অবশ্যই। আমার কাছ থেকে কক্ষনো এই কথা ফাঁস হবে না। তুই নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস।
এরপর সারা রাত্র এইসব নিয়ে গল্প চলতে লাগলো। এই কথা গুলো শেয়ার করার পর তাদের মাঝে আন্তরিকতাও মনে হয় বেড়ে গিয়েছে। সেদিন রাতেই তাদের মাঝে যৌনতা, মেয়ে, ছেলে-মেয়েদের জৈবিক ক্রিয়া, সন্তান জন্ম দানের ঘটনা এমন অনেক কিছু নিয়েই আলোচনা হল।
কথা বলার এক পর্যায় প্রচণ্ড ঝড় শুরু হল। ঠাণ্ডা বাতাসে হারিকেন নিভে গেল। সুমন জানলা বন্ধ করতে গেল। এই সময় বিদ্যুৎ চমকাল। এই ক্ষণিকের আলোয় সুব্রত, সুমনের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মনে হল এই ছেলেকে ছাড়া তার জীবন চলবে না। এই ছেলেকে তার জীবনে চাই। সুমন মোমবাতি জ্বালালো। মোমবাতির আলো আধারি তে একজন আরেকজন কে দেখছে। হঠাৎ কি হল। সুব্রত তার হাতের আঙ্গুল দিয়ে সুমনের ঠোঁট স্পর্শ করলো। সুমনের শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল। সুব্রত বলছে,
– জানিস আমি সেই কবে থেকে তোকে ভালবাসি। কিন্তু বলার সাহস পাই নি। তোকে ছাড়া আমার জীবন চলবে না
– আমিও তো। কিন্তু তুই তো জানিস আমি সারা জীবন মুখচোরা। নিজে থেকে কিছুই বলতে পারি না
– তুই আমাকে ছেড়ে কক্ষনো চলে যাবি না তো?
– কক্ষনো না!
সুব্রত, সুমন কে জড়িয়ে ধরলো। ওষ্ঠে চুম্বন করলো। গভীর রাতে বিছানায় ঝড় উঠলো। বন্য নয় কিন্তু খুব প্যাশনেট। এরপর সুমন, সুব্রতের বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে কত কথা বলল। আসলে সঙ্গমের পরবর্তী এই রেশটা অনেক প্রশান্তি এনে দেয়। ভরসা এনে দেয়। বিশ্বাস এনে দেয়।
এরপর থেকেই প্রায়ই একজন আরেকজনের বাসায় থাকতে শুরু করলো। ক্লাস ফ্রেন্ড। পারিবারিক বন্ধুত্ব। কেউ না করে না। অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখে না। সুমনের বাবা জামানের সাথে সুব্রতের বাবা অমলেশের অনেক বন্ধুত্ব। ধর্মের ভেদাভেদ থাকলেও ধর্ম নিয়ে হানাহানি, ঝগড়া বিবাদ তারা করেন না। একজন আরেকজনের ধর্মীয় উৎসবে শুভেচ্ছা জানান। নানা পারিবারিক প্রোগ্রামে তারা সপরিবারে আসেন। সুমনে মা রুনার সাথে সুব্রতের মা নিলার অনেক বন্ধুত্ব। একজন কোন ভাল কিছু রান্না করলে আরেক জনের বাসায় সেটা পাঠান। বিপদে আপদে সবাই একসাথে। গ্রামে সুব্রত আর সুমনের স্বাধীনতার কোন অভাব নেই। গ্রামে এমন কোন জায়গা নেই যে তারা যায় নাই। সবাই এক কথায় জানে সুব্রত আর সুমন কে। স্কুলে ২ জনই অনেক বাঁদরামি করে। তাই শিক্ষকের বেতের বাড়িও খেতে হয়। আবার তারা ভাল রেজালটও করে। তখন আবার শিক্ষকদের আদর পায়। তারা খেলাধুলায় অসম্ভব ভালো। ফুটবল তাদের প্রিয় খেলা। এদিকে দূর্গা পূজা মহা ধুমধামে পালন করা হয় পালইকান্তাতে। এই সময় গ্রামে আসে যাত্রা দল। রাত জেগে ২ জন মিলে যাত্রা দেখতে যায়। চারিদিকে উৎসবের মাঝে বাবা-মা-রাও যাত্রা দেখত আসে।
ঈদে ২ জনরই আনন্দ। জামান সাহেব ২ জনের জন্য ফুলতলা শহর থেকে কাপড় নিয়ে আসেন। নতুন জামা পরে পাড়া প্রতিদের বাসায় ঘুরতে যাওয়া। বিকেলে মেলা বসে। চর্কিতে উঠে চিৎকার করার মজাই তো আলাদা। মেলা থেকে খেলনা, কদমা, খোরমা, খই, বাতাশা নিয়ে আসা। আর জামান সাহবের স্ত্রী রুনার হাতের সেমাইয়ের কথা না বললেই নয়।
মাঝে মাঝে গানের আসর হয়। বাউল গান হয়। সেখানেও দেখা যায় সুব্রত আর সুমনকে। এভাবেই তো দিন চলে যাচ্ছিলো হাসি খুশিতে।
মাঝে মাঝে আসে বায়স্কোপ।
দিন গুলো যেমন হাসিখুশিতে চলে যাচ্ছে তেমনি তেমনি তাদের ভালবাসাও সীমাহীন ভাবে বাড়ছে। একজন কে ছাড়া আরেকজন থাকতেও পারে না। সুব্রত মাঝে মাঝে হেসে বলে,
– সুমন বেশি ভালবাসিস না। যদি ২ জন আলাদা হয়ে যাই? তখন কী হবে?
– তুই আলাদা হয়ে কই যাবি? পৃথিবীর যে প্রান্তে যাস না কেন তোকে ঠিক খুঁজে নিয়ে আসবো
সুব্রত হাসে। আর বলে,
– তুই একটা পাগল।
– হ্যাঁ তুই পাগল করেছিস।
এদিকে অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষা হবে। ২ জন চেষ্টা করছে। পড়ছে। বৃত্তি পেতেই হবে। ২ জনের আশা ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাবে। বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার ঠিক আগে আগে সুমনের জলবসন্ত হল। সুমন পরীক্ষা দিতে পারলো না। সুব্রত পরীক্ষায় খালি খাতা জমা দিয়ে আসলো। সুমন পরীক্ষা না দিলে সেও দিবে না। সুমন বৃত্তি না পেলে তারও বৃত্তির দরকার নেই।
দ্বিতীয় পর্ব
সময়টা ১৯৬৮। আইয়ুব খানের শাসন আমল। পশ্চিম আর পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে তখন ব্যাপক বৈষম্য চলছে। সশস্ত্র বাহিনী, অফিস আদালত, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, রাজনীতি সবই পশ্চিমা দের নিয়ন্ত্রণে। আর পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মাঝে চলছে হতাশা আর ক্ষোভ। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন কায়েম করেন আইয়ুব খান। তবে ৬৪ সালের শেষের দিকে মৌলিক গণতন্ত্রীদের নির্বাচন দেন। যা ছিল একটা আই ওয়াশ। এরপর ৬৬ সালে শেখ মুজিবর রহমান ৬ দফা দাবীনামা উত্থাপন করেন। এই দাবী পূর্ব বাংলার মানুষ সানন্দে গ্রহণ করে। আইয়ুব ভীত হয়ে পরেন। এবং শেখ মুজিবর রহমানকে আটক করেন এবং তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করেন। ৬৮ সালের শেষের দিকে বেজে উঠে আইয়ুবের পতনের ডঙ্কা।
আর এই ১৯৬৮ তে সুব্রত আর সুমন দেখতে দেখতে ক্লাস নাইনে উঠে গেলো। সামনে এসএসসি পরীক্ষা। সুব্রত আর সুমনকে ফুলতলা পাঠানো হল। ওখানে তারা পড়াশোনা করবে। ফুলতলা ছোট শহর। এখানে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন তেমন গড়ে উঠে নাই। তবু চায়ের দোকান গুলো তে রাজনীতি নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠে প্রতিদিন।
আর দশটা মফস্বল শহরের থেকে আলাদা নয় ফুলতলা। সব একতালা আর দোতালা বাড়ি। বেশির ভাগ বাড়ির দেয়ালের রঙ চটে গিয়েছে। কিন্তু বাড়ির মালিকদের সেদিকে লক্ষ্য নেই। হঠাৎ হঠাৎ তিনতলা কিছু রংচঙে বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝাই যায় এই বাড়িগুলো সমাজের বিত্তশালী মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। রাস্তা গুলো ঘিঞ্চি। রাস্তার ২ পাশে ড্রেন পুঁতি গন্ধ ছড়াচ্ছে। একটাই বড় রাস্তা রয়েছে। অসংখ্য রিকশা। প্রাইভেট গাড়ি একদম চোখে পরে না। কিছু অটো রয়েছে। মাত্র কিছুদিন হল বিদ্যুৎ এসেছে এই শহরে।
ফুলতলা জেলা স্কুলের কোন হোস্টেল নেই। জেলা স্কুলটা প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী। ভাল ফলাফলের সুনাম রয়েছে।
ফুলতলা স্কুলের ক্লাস নাইনে সুব্রত আর সুমন ভর্তি হল। তাদের জায়গা হল একটি মেসে। ২ জন মিলে একটি ঘর নিয়েছে। ঘরে একটি ডাবল বিছানা রয়েছে। তাতে রংচটা চাদর বিছানো। একটা মশারিও রয়েছে। আর ২ টা টেবিল আর একটি আলমারি রয়েছে। দেয়ালের রঙ চল্টা খসে খসে পড়ছে। তাও ভাল। ২ টা আলাদা টেবিল তো রয়েছে। সুমন তো মহা খুশি। খুশিতে জড়িয়ে ধরেছে সুব্রত কে। হেসে বলল,
– এখন ইচ্ছে মত প্রেম করা যাবে।
– প্রেম ট্রেম পরে হবে। হাত মুখ ধুয়ে চল স্কুলে যাই। কালকে থেকে ক্লাস শুরু মনে হয়। রুটিন টা নিয়ে আসি।
– তুই না একটুও রোম্যান্টিক না।
– আরে বাবা ওখান থেকে ফিরে তোকে ইচ্ছা মত আদর করবো। এখন চল। আর দেরি করলে স্কুলের গেট বন্ধ হয়ে যাবে।
স্কুল থেকে ফিরে মেসের খাবার খেতে বসলো। খাবার দেখে কান্না পেলো তাদের ২ জনেরই। পানির মত ডাল। তেলে জব জব করছে ছোট ছোট ২ টুকরো মুরগি আর সবজি বলতে করলা ভাজি। কোনমতে তাই নাকে মুখে গুঁজে তারা ঘরে চলে আসলো।
পূর্ণিমা। তাও যে সে পূর্ণিমা নয়। মাঘী পূর্ণিমা। রূপালী থালার মত একটা চাঁদ উঠেছে আকাশে। আর ছোট ছোট হিরকের মতন তারকা তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেই। এই রাত ছিল তাদের জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় রাত। বাড়ি থেকে এত দূরে একা একা ২ জন কক্ষনোই থাকে নাই। নিজেদের এত ঘনিষ্ঠভাবে পাবার আগে কক্ষনো সুযোগ হয় নাই। আজ যেন সব কামনা বাসনা পূরণ হয়ে যাবে। অন্ধকার ঘর। শুধু চাঁদের আলো এসে পরছে। তাতেই ঘর আলোকময়। পৃথিবীর ২ জন পুরুষ নিজেদের কে আলিঙ্গন করার জন্য ব্যাকুল। ওষ্ঠে চুম্বন করতে আকাঙ্ক্ষিত। এক সময় ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো। একজন পুরুষ তার সর্বস্ব দিয়ে ভালবাসলো আরেকজন কে। আরেকজনও তার জীবনের পাঁচটি নীল পদ্ম নিমিষে করে দিল দান। নীল পদ্ম তো ভালবাসারি অন্য রূপ। সে নিজেকে নিঃশেষিত করে ফেললো। আর কাউকে দেবার মত কিছুই আর রইলো না। অবশ্য আর কাউকে কিছু দেবার দরকার কি আছে? স্বর্গীয় সুখ যখন মর্ত্যে নেমে আসে তখন অন্য সব বাসনা, কামনার কি দরকার?
সারা দিনরাত পড়াশোনা করতেই কেটে যায় সুব্রতর। কিন্তু সুমন কিছু পড়াশোনা করে না। আজকাল কিছু নতুন বন্ধু জুটিয়েছে সুমন। বখাটে টাইপের। সুব্রত তাদের কে একটুও পছন্দ করে না। কিন্তু সুব্রত, সুমনের সব কিছুতে নাক গলাতে চায় না। এতে সুমনের ব্যক্তিত্বের বিকাশে সমস্যা হবে। আর বেশি পজেসিভ আচরণ সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকারক। সুমন বেশিরভাগ সময় এইসকল বন্ধুদের নিয়ে ফুলতলা পার্কে বসে সিগারেট খায়। তার বন্ধুরা মেয়েদের কে দেখেলেই নানা তির্যক মন্তব্য করে আর হাসিতে গড়িয়ে পড়ে। সুমন চাইলেই টাকা খরচ করতে পারে। টাকা খরচ করে সিনেমা দেখায়। তাই তারা সুমনকে তাদের দলে নিয়েছে। কিন্তু সুমন তা বুঝতে পারে না। স্বার্থের মার প্যাচ বুঝার মত ম্যাচুরিটি তার আসে নাই।
কিন্তু সুব্রত যখন দেখলো সুমন সিগারেট খাওয়া ধরেছে এবং প্রথম সমাপনি পরীক্ষায় ফেল করেছে তখন সে সিরিয়াস হয়ে উঠলো, সে ভাবতে লাগলো এখন কিছু বলতেই হবে। এভাবে চলতে দিলে সুমনের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে। কিন্তু সুমন তার কথায় পাত্তাই দিল না। বরং মদ খেয়ে এসে বলল
– হু দ্যা হেল আর ইউ? আমাকে উপদেশ দাও। নিজের চরকায় তেল দাও।
এই কথা শুনে সুব্রত হতবাক হয়ে গেল। সুমনের কাছ থেকে এই কথা শুনতে হবে ভাবতেও পারে নাই সে। সে আর একটা কথাও বলল না। সেদিন রাতে সুব্রত ঘুমাতে পারলো না। আর সুমন মরার মত ঘুমালো। সুব্রতর মাথায় শুধু একি চিন্তা বারবার মাথায় আসছে।
– সুমন আমাকে আর ভালবাসে না। সে আর আমার আগের সুমন নেই। এভাবে সে আমার সাথে কথা বলতে পারলো!
পরের দিন ঘুম থেকে উঠে গতদিন রাতের কথা চিন্তা করে সুমন এক জায়গায় কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকলো। তারপর সুব্রতের কাঁধে হাত দিয়ে বলল,
– সুব্রত আমি সরি।
– আচ্ছা ঠিকাছে। নাস্তা রেডি করা আছে। খেয়ে নাও।
– তুই আমাকে তুমি করে বলছিস কেন?
– আমাদের মাঝে অনেক দূরত্ব হয়ে গিয়েছে। তাই তুই শব্দ টা আসছে না মুখে। তাই তুমি বলছি।
এইবার সুমনের চোখ ফেটে কান্না আসলো। বলল,
– সুব্রত আমি মদ খেয়ে কী না কী বলেছি। আর এতেই এত দূরত্ব তৈরি হয়ে গেলো। তুই প্লিজ ভুলে যা সব কিছু। আমি এমন আর কক্ষনো করবো না।
এদিকে সুমনের কান্না দেখে সুব্রতের চোখে পানি এসে গেলো। সুমনকে কষ্ট পেতে দেখলে তারও কষ্ট হয়। তাই জেদ বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। সে বলল,
– সত্যি সব ছেড়ে দিবি? মদ, সিগারেট, কার্ড খেলা?
– হ্যাঁ সব।
সেদিন তারা অনেকদিন পর আবার রোম্যান্স করলো। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই আবার সেই বন্ধুদের পাল্লায় পড়লো সুমন। যা লাউ তাই কদু। বরং এখন আরও বেশি ডেস্পারেট হয়ে গেল। সে মনে মনে ভাবে এই বয়স তো ফিরে আসবে না। যা মজা করা তা এখুনি করে নিতে হবে। সুব্রতর মত সারা দিন বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকতে সে পারবে না। তার জীবন। সুতরাং সিদ্ধান্ত তার। সুব্রত বুঝলো সুমন কে ফেরানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। সেও হাল ছেড়ে দিল। তাদের দুজনের মাঝে একটা অলিখিত দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল। এক বিছানায় শুয়েও তারা যেন যোজন যোজন মাইল দূরে অবস্থান করে। কেউ কাউকে স্পর্শ করে না। অথচ এত টুকু স্পর্শের জন্য ২ জনের মন হৃদয় হাহাকার করছে। কিন্তু ওই যে অহম বোধ । এই অহম বোধ আর সুমনের অসৎ সঙ্গ ২ জন কে ঠেলে দিয়েছে অনেক দূরে।
ভাগ্য আছে। কিন্তু যে তার ভাগ্য পরিবর্তন করতে চায় না স্রষ্টা তার ভাগ্য পরিবর্তন করেন না। সুমনেরও তাই হল। সারা জীবন প্রথম হয়ে আসা সুমন ফুলতলায় এসে এ কী রেজাল্ট করলো! ফুলতলা হাই স্কুলের ক্লাস টেনের উঠার পরীক্ষায় ফেল করলো সুমন। তখন সুমন বুঝতে পারলো সে কী ভুল করেছে। নিজের ঘরে বসে সারাদিন কাঁদল। আব্বা জানলে কী হবে? সারা জীবন সে প্রথম হয়ে আসছে। এখন একেবারে ফেল। এদিকে সুব্রতরও খারাপ লাগছে। আবার ভাবছে আগের অপমান গুলোর কথা। কতবার সে না করেছিল। কিন্তু তার কথা সুমন শুনে নাই। উল্টা অপমান করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাগ জিদের কাছে ভালবাসার জয় হল। সুব্রত যেয়ে সুমনের কাঁধে হাত রাখলো । সুমন বুঝি এই মুহূর্তের জন্যই অপেক্ষা করছিল। সে সুব্রতের বুকে মুখ গুঁজে বাচ্চা ছেলেদের মত কাঁদতে লাগলো। আসলে সত্যিকারের ভালবাসার মানুষের কাছে নিজের দুর্বলতা প্রকাশে কোন লজ্জা নেই। ভালবাসায় অহমবোধ, ইগোকে স্থান দিতে হয় না।
সুমনের বাড়ি তে চিঠি পাঠানো হল। জামান সাহেব আসলেন। সব সময় তার ছেলে পরীক্ষায় প্রথম ছিল আর সুব্রত হত দ্বিতীয়। আর এসে কী দেখলেন? প্রথম তো দূরের কথা একেবারে ফেইল। কিন্তু ছেলে এক বছরে যে এত পরিবর্তন হয়েছে এটা তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। যা নিয়মিত তার অন্যথায় ঘটলে কারো ভাল লাগার কথা নয়। আর যেখানে নিজের ছেলের এই অবস্থা।
এদিকে অমলেশ বাবু আসলেন। সুব্রত হাই স্কুলে প্রথম হয়েছে। প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলে জামান সাহেব বের হতেই দেখেন অমলেশ বাবু কে। জামান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
– কী মশাই কেমন আছেন?
– ভালই। ছেলের রেজাল্ট নিতে আসলেন বুঝি?
– জ্বি দাদা। সুব্রত এইবার প্রথম হল।
– ও। হাতে ঐটা কী?
– বাজার থেকে মিষ্টি নিয়ে আসলাম। শিক্ষক শিক্ষিকাদের খাওয়াবো। সুব্রত প্রথম হল তা উদযাপন করতে।
এই বলে প্যাকেট খুললেন অমলেশ বাবু।
– নিন আপনাকে দিয়ে শুরু করি।
অনিচ্ছা সত্তেও মিষ্টি হাতে নিলেন জামান সাহেব।
– শুনলাম সুমনের রেজাল্ট ভালো হয় নাই? সুব্রত তাই বলল। কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি? ছেলের যত্ন নিন। এই যে দেখেন আমি প্রতি সপ্তাহে যেয়ে দেখে আসতাম সুব্রত পড়াশোনা করছে কিনা।
জামান মনে মনে ভাবছেন। সারা জীবন আমার ছেলে প্রথম হয়ে আসছে। তখন তো তিনি অমলেশ বাবু কে এমন উপদেশ দেন নাই। এখন একবার তার ছেলে খারাপ করেছে আর ওমনি উপদেশ। দেখে নিবো ম্যাট্রিক পরীক্ষায় কার ছেলে ভাল করে।
– আপনি কি রাগ করলেন জামান ভাই?
– আরেহ না। আপনি তো ভাল কথাই বলেছেন। আমারই ভুল হয়েছে। ছেলের খোঁজ প্রতি সপ্তাহে সপ্তাহে নেয়া উচিৎ ছিল। আচ্ছা অমলেশদা আজকে আসি।
জামান সাহেব এই প্রথম বুকে একটা কষ্ট অনুভব করলেন। কেমন জানি অমলেশ বাবুকে খুব হিংসা হচ্ছে যা কখনই হন নাই। নিজকে নিজে বুঝাতে লাগলেন হিংসা খুব খারাপ জিনিস। মানুষকে ধ্বংস করে দেয়।
রিকশাভ্যানে চড়ে বাড়ি ফিরছেন সুমনকে নিয়ে। ভাবছেন এর পর কী করা উচিৎ। ছেলেকে এইভাবে ছেড়ে দিলে আর পড়াশোনা হবে না। ছেলেটাকে বকেছেন। মেরেছেন। ছেলেটার মুখটা কষ্টে শুকিয়ে গিয়েছে। কিন্তু আবার ফুলতলায় রাখবেন না সুমনকে। কিন্তু গ্রামে পড়াশোনার তেমন সুযোগ নেই। একটা বুদ্ধি আসলো মাথায়। সপরিবারে ঢাকা চলে গেলে কেমন হয়। ঢাকায় তার মামাতো ভাইয়ের কাপড়ের ব্যবসা। গ্রামের কিছু জমি বিক্রি করে মামাতো ভাইয়ের সাথে ব্যবসা করলে কেমন হয়? ভাবলো রুনার সাথে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে হবে। ঢাকায় সুমনকে চোখে চোখে রাখলে সুমন নিশ্চয়ই ভাল রেজাল্ট করবে। আর ঢাকার পড়াশোনা সুযোগ সুবিধা অনেক ভালো। অমলেশ বাবুকে দেখিয়ে দিবেন তার ছেলেও কম নয়। পথে বিস্কিট কিনলেন ছেলের জন্য। বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে এলো।
তৃতীয় পর্ব
সন্ধ্যা হয়েছে অনেক আগেই। পাখিরা নীরে ফিরে গিয়েছে কখন। মাঝে মাঝে ২-১টা বাদুর উড়ে যেতে দেখা যায়। গ্রামে একটু সন্ধ্যা হলেই চারিদিক শুনশান হয়ে যায়। ঝিঝি পোকার ডাক শোনা যায় শুধু। জোনাকি পোকারা আলো জ্বালিয়ে যেন অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করে।
এদিকে জামান সাহেব আর সুমনের আসার নাম নেই। হারিকেনটি জ্বালিয়ে রেডিও শুনছেন রুনা। রেডিওটি ২ মাস আগে কিনেছেন জামান সাহেব। কী আজব। এত ছোট একটি বাক্স থেকে অন্য মানুষের কণ্ঠের গান শুনা যায়। রুনা শুনেছেন ঢাকায় নাকি অনেক আজব জিনিস দেখা যায়। ছোট বাক্সের ভিতর জীবন্ত ছবি দেখা যায়। রুনার ঢাকায় যাওয়ার খুব ইচ্ছা। এইতো সেদিন অমলেশ বাবু আর তার স্ত্রী নিলা ঢাকায় ঘুরে এলেন। কিন্তু অমলেশ বাবু গিয়েছিলেন প্রয়োজনে । হোমিওপ্যাথিক ওষুধের উপাদান কিনতে। তখন নিলা অনেক কেনাকাটা করেছেন। নতুন গয়না বানিয়েছেন। এসব ক্ষেত্রে নিলার সাথে সাথে রুনার অনেক রেষারেষি। রুনা নতুন শাড়ি কিনলে নিলাকেও কিনতে হবে। আর নিলা গহনা বানালে রুনাকেও। এছাড়া দুই জনের অনেক মিল। কেউ অসুস্থ হয়ে গেলে সারাদিন রাত সেবা করেন আরেকজন।
এদিকে জামান সাহেব ছেলেকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই দেখলেন রুনা মন খারাপ করে আছে।
রুনা খুব গম্ভীর হয়ে বলল,
– এতক্ষণে আসলে?
– আরে তোমার ছেলে তো ওখানে মহা কাণ্ড বাঁধিয়েছে। প্রথম স্থান থেকেই একবারে ফেইল। আর দেখো অমুদার ছেলেটা প্রথম হল।
– আচ্ছা হাত মুখ ধুইয়ে আসো। অনেকক্ষণ না খেয়ে আছো। খেয়ে নাও পরে আলাপ করবো।
জামান সাহেব বুঝলেন রুনার মেজাজ খারাপ। তিনি আর কিছু না বলে হাত মুখ ধুতে গেলেন। তারপর নামাজ পড়ে খেতে বসলেন। সুমন আগেই খেয়ে নিজের ঘরে চলে গিয়েছে।
রুনা কথা শুরু করলেন।
– জানো আজ নিলা ঢাকা ঘুরে ছেলে কে নিয়ে ফিরেছেন। একটি ঢাকাই কাতান আরেকটি জামদানী আর একটি তাঁতের শাড়ি কিনেছেন। আর একটি জড়োয়া সেট বানিয়ছেন। আমার জন্য একটি জামদানি শাড়ি এনেছেন।
– ভালো তো।
– আমার কপাল খারাপ। নিজে এইসব শাড়ি কিনে দেখলাম না একবার। আর গহনা। আমার শাশুড়ির সেই পুরানা ডিজাইনের গহনা এখন আর কেউ পরে না। ভাবি নিলা কী কপাল নিয়ে এসেছিলেন। কয়েক দিন পরপর ঢাকা যান আর হাল ফ্যাশনের শাড়ি গহনা নিয়ে আসেন। আর আমি ঈদের কাপড় কিনি ফুলতলা থেকে। আমাদের কি বিত্ত বৈভবের অভাব?
– হু
– বলি কী? চুপ কেন?
– কী বলবো?
– সেটাই তো। তুমি কী বলবে। বলি জীবনে কি একবারও ঢাকা নিয়ে যাবা না?
– শুনো মনে হয় একবার না এইবার পাকাপাকি ভাবে ঢাকা চলে যাবো।
– কী বলছো?
– এই গ্রামে থাকলে আমার ছেলে মানুষ হবে না। ফুলতলায় পাঠিয়ে শান্তি পাচ্ছি না। ফেল করলো। এর পরেরবার কী হবে জানি না। ভাবছি ঢাকায় যেয়ে রবুর সাথে ব্যবসা করবো । ছেলেকেও পড়ালাম।
– কী বল এগুলা? বেড়াতে যাওয়া এক কথা আর পাকাপাকি ভাবে চলে যাওয়া আরেক কথা। আমি পারবো না এই গ্রাম ছেড়ে যেতে। কিভাবে বাঁচবো বল? এই যে আমার পুকুর, আমার সবজি বাগান, গোয়াল ঘর। আমার মুরগি হাঁস গুলো। আর ওই ভেড়া। না না আমি যাবো না। আমার শাড়ি কাপড়ের দরকার নাই।
– রুনা বুঝার চেষ্টা করো। আমার ছেলেটার ভাল চাইলে আমাদের ঢাকা যেতেই হবে।
জামান সাহেবের চোখে অমলেশ বাবুর মিষ্টি খাওয়ানোর দৃশ্যটি ভাসছে। না সুমনকে তিনি সুব্রতের থেকে ভাল করে মানুষ করবেন। আবার ভাবছেন ছিঃ এমন ভাবে ভাবছেন কেন। ২ জনই তার পুত্রসম। না এভাবে আর ভাববেন না। তার দায়িত্ব সুমনকে মানুষ করার সেটাই তিনি ভাল মত করবেন।
রুনার চোখ ছল ছল করছে। জামান সাহেব বললেন,
– আরে আমরা প্রতি মাসে একবার করে এখানে আসবো। আসতে হবে। জমি জমার খোঁজ রাখতে হবে না।
একদিন ভোরে ঠিকই জামান সাহেব, রুনা আর সুমন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। গরু ছাগল যা ছিলও সব বিক্রি করে ফেলা হয়েছে। রুনা গহনাগুলো সাথে নিলেন। অনেক দিনের গহনা। শাশুড়ির গহনা, মায়ের গহনা, নিজের কিছু বানানো গহনা, মৃত ননদের গহনা। প্রায় ১০০ ভরি গহনা তো হবেই। এগুলো রুনার প্রাণভোমরা। মরে গেলেও এই গহনা কাউকে নিতে দিবেন না। এমন কী এত গহনা যে তার কাছে আছে সেটা জামান সাহেবও জানেন না। ঘরে আসবাব পত্র রেখে দেয়া হল। প্রতি বছর একবার আসা হবে। কিন্তু তারপরও মন কেমন করছে। বহুদিনের সংসার। কত টুকি টাকি জিনিস পত্র। বাড়ির পিছনের সবজি গাছের যত্ন কে নিবে? বহুদিনের ভৃত্য দুলাল আর খোকা রয়ে গেলো।
যাওয়ার আগে একবার অমলেশ বাবুর বাড়ি হয়ে গেলেন। সুব্রত ময়মনসিংহে। তাই সুমনের সাথে সুব্রতের দেখা হল না। নিলা কে দেখে রুনা আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। ২ জন ২ জনকে জড়িয়ে কাঁদলেন। জামান সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন,
– আরে কী শুরু করলা? দেরি হয়ে যাবে তো। আহা আমরা তো সারা জীবনের জন্য চলে যাচ্ছি না। আসবো তো। প্রায়ই আসবো।
রুনা চোখ মুছে বিদায় চাইলো।
– দিদি আমার ঘর বাড়ি তোমার জিম্মায় থাকলো। দেইখো একটু।
– সে তোমার বলা লাগবে না। আমরা সব দেখে রাখবো।
রিকশা করে ঘাঁট। সেখান থেকে নৌকায় ফুলতলা। আর ফুলতলা থেকে লঞ্চে ঢাকা। তারপর বাসে আজিমপুর। বাসা চায়না বিল্ডিঙের গলি তে। ছোট গলি, ইট, কাঠ, সিমেন্টের দেয়াল। চারিদিকে সবুজের কোন ছোঁয়া নেই। তার উপর সন্ধ্যা বেলা। রুনা ভয় পেয়ে গেল। এই কি সেই স্বপ্নের ঢাকা? একটা তিনতলা বাসার এক তলাটা ভাড়া নিয়েছেন জামান সাহেব। কারেন্ট রাতের বেলা খুব বেশি সময় থাকে না। রাতের অধিকাংশ সময় মোমবাতির আলোয় কাটাতে হয়। আসবাব বলতে কিছুই নেই। ১ টি চৌকি, তোষক, কিছু হাড়ি-পাতিল, বাসন আছে। এইগুলো দিয়ে আপাতত চালিয়ে নেয়া যাবে ভাবলেন রুনা। কিন্তু তার মন ভীষণ খারাপ। এমনিতে থাকার জায়গা পছন্দ হয় নাই তারপর আসার পর থেকেই উপরতলা বাড়ি ওয়ালির বাসা থেকে বাচ্চার চিৎকার আর মেয়ে মানুষের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে। মনে হয় বাচ্চাটিকে ধরে কেউ মারছে।
এদিকে সুমন মন খারাপ করে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে শুয়ে আছে, বাসার ভিতরটা গরম। গ্রামে এতো গরম না। তার উপর মশা। সারাক্ষণ কানের কাছে পিন পিন করছে। সুব্রত কে খুব মনে পড়ছে। কেন যে ফুলতলায় ঠিক মত পড়ালেখা করে নাই। তাহলে আজকে ঢাকায় আসা লাগতো না। সুব্রতর কথাও খুব মনে পড়ছে। এখন যদি এখানে সুব্রত থাকতো তাহলে কী হত। তার মন খারাপ দেখলে নানারকম লেম জোকস বলে হাসানোর চেষ্টা করতো। সুমন ভাবে সুব্রত তাকে কত ভালবাসে। এত কিছুর পরও তাকে ঘৃণা তো করেই নাই বরং আরও আপন করে নিয়েছে। জীবনে তার শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি যদি কিছু হয়ে থাকে তবে তা সুব্রত। ঢাকায় আসার আগে সুব্রতকে অনেক বড় একটা চিঠি লিখেছে সুমন। সুমনের এখন একটাই চাওয়া সুব্রত মেট্রিক পাশ করে যাতে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়। তাহলে আবার আগের মত প্রতিদিন দেখা হবে। ঢাকা কলেজে ভর্তি হলে তারা পুরো ঢাকা টইটই করে ঘুরে বেরাবে। আর ঢাকার কোথায় টাকা উড়ে সেই জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। কারণ তাদের ২ জনেরই ইচ্ছা সারা পৃথিবী ঘুরে বেরাবে। আর তার জন্য দরকার অঢেল টাকা। পলিনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে শুরু করে আফ্রিকার কিলিমাঞ্জারো পর্বত চূড়া। অ্যামাজনের গভীর জঙ্গল থেকে শুরু করে গ্রিনল্যান্ডের এস্কিমোদের দেশে যাবে তারা। কখনো চিনের প্রাচীর আবার কখনো বা মিশরের পিরামিড। এসব নিয়ে তাদের মাঝে কত গল্প হয়েছে। কবে যে দেখা হবে, কথা হবে আবার! ১ বছর বাকি। কিভাবে যাবে এই একটি বছর। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো সুমন নিজেই জানে না। ঘুমের মাঝেই চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। হয়তো কোন দুঃস্বপ্ন দেখেছে।
এদিকে জামান সাহেব ভাবছেন ব্যবসা ঠিক মত করতে পারবেন নাকি লোকসান খাবেন? কালকেই দোকানে যেয়ে বসবেন। নিউমার্কেটে একটা মেয়েদের গজ কাপড়ের দোকান দিয়েছেন তিনি। রবু ভাইয়ের দোকানের কাছেই। তিনি সাহায্য করবেন। বেশ কিছু জমি বিক্রি করে মূলধন নিয়ে এসেছেন তিনি। যাই হোক তিনি চেষ্টা করে যাবেন।
পরের দিন সকাল সকাল জামান সাহেব সুমনকে নিয়ে বের হলেন। স্কুলে ভর্তি করবেন। সকাল সকাল একদম নীরব হয়ে গিয়েছে ঘর। রুনা ঘর বাড়ি গুছালেন। ঝাড়ু মোছা করলেন। পরিষ্কার করলেন। এরপর আর কিছু করার নেই। চুলা নেই। রান্না করবেন কিভাবে।
হঠাৎ দরজার কাছে শব্দ হতে লাগলো। রুনা ভয় পেয়ে গেলো। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ভয় পাচ্ছে । দরজা খুলবে কিনা। হয়তো জামান এসেছে। কিন্তু এত সকাল সকাল। রুনা জোরে জোরে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলো,
– কে?
– আমি তোমাদের বাড়িওয়ালা।
মহিলা কণ্ঠস্বর শুনে রুনার ভয় কমলো। দরজা খুললো। বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন এক স্বাস্থ্যবতী মহিলা। বুঝা যায় বয়সকালে খুব সুন্দরী ছিলেন। পরনে টিয়া রঙের শাড়ি ।
– তোমাদের দেখতে এলাম। সর ভিতরে ঢুকি।
এই বলে মহিলা প্রায় রুনা কে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকলেন।
– একি কিছুই তো গুছাও নাই? চুলা কোথায় ? রান্না করবে কিভাবে।
রুনা বুঝতে পারছে না কী বলবে।
– আচ্ছা খাবার না হয় আজকে আমি পাঠিয়ে দিবো। একি দেখো তোমার নাম জিজ্ঞেস করি নাই।
– আমার নাম রুনা।
– বাহ সুন্দর নাম। আমার নাম দিলরুবা। আমাকে দিলু আপা ডাকতে পারো। আমার ২ টা মেয়ে আর একটা ছেলে রয়েছে। মেয়ে দুইটাই আইএসসি পরীক্ষা পাশ। মেয়েদের বিয়ে দিবো। কিন্তু তার কোন খবর নাই।
– তার?
– আরে বলি। একটু বসে নেই। এক গ্লাস পানি দাও। নাকি সেটাও নাই।
রুনা পানি আনতে গেলো। মনে মনে ভাবছে বাহ মহিলা তো বেশ মজার। অনেক কথা বলে। এমন মানুষের সাথে থাকলেও মন ভাল থাকে। পানি পান করে দিলরুবা বলল,
– কই জানি শেষ করলাম?
– ওই যে কার কথা জানি বলতে গেলেন?
– এই দেখো আমি কেমন ভুলোমনা। আরে আমার স্বামীর কথা বলছি। ওতো করাচি থাকে। ওখানেই তার ব্যবসা। এখন ও আসলেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিবো। দিন কাল তো ভালো না। বুঝোই তো দেশের রাজনৈতিক অবস্থা। এখানেও গণ্ডগোল ওখানেও গণ্ডগোল। যত তাড়াতাড়ি পারি মেয়ে দুইটার বিয়ে দিয়ে দিবো ।
এরপর নানা বিষয়ে কথা হতে লাগলো। দিলরুবা আইএসসি পাশ। তাই সে প্রায়ই রাজনৈতিক আলোচনায় চলে যাচ্ছে। শেখ মুজিব রহমানএর ৬ দফা দাবী নিয়েই অনেকক্ষণ কথা বলল দিলরুবা। শেখ মুজিব রহমানকে সেই রকম পছন্দ করে দিলরুবা। কিন্তু রুনার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব। দিলরুবা বুঝলো যে রুনা কিছুই বুঝছে না। সে রাজনৈতিক আলাপ বাদ দিয়ে অন্য কথা শুরু করলো।
কথা বলতে বলতে দুপুর হয়ে এলো ।
– যাইরে বইন। ছেলেটাকে খাওয়াতে হবে। কোন সমস্যা হলেই উপরে চলে আসবা।
দিলরুবা গল্প শেষ করে উপরে চলে গেলেন। রুনার খুব ভালো লেগেছে দিলরুবাকে। দিলরুবা কত সহজে রুনা কে আপন করে নিয়েছেন। রুনা ভাবছে দিলরুবা তার এই নিঃসঙ্গ জীবনে আলো জ্বালবেন।
চতুর্থ পর্ব
দিন যায়। ঢাকার জীবন যাত্রায় অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে রুনা। জামান কাজে চলে গেলে আর সুমন স্কুলে গেলে বাড়িটা নীরব হয়ে যায়। যদিও উপরতলার দিলরুবার চিৎকার মাঝে মাঝে শোনা যায়। ছেলেকে ধমকানোর চিৎকার । কিন্তু মহিলা ভালো । প্রায়ই রুনার সাথে গল্প করতে আসে। দিলরুবা একটু ঝগড়াটে না হলে মানুষ হিসেবে ভালই বলা যায়।
দিলরুবা রুনাকে পরামর্শ দিলো সময়টা বসে নষ্ট না করে বরং কাজে লাগাতে। রুনা ভাল সেলাইয়ের কাজ জানে। পাড়ার মেয়েদের টুকটাক সেলাইয়ের কাজ শুরু করে দিলো। দিলরুবার একটি সেলাই মেশিন ছিল। এখন সে সেলাইয়ের কাজ করে না। তাই রুনাকে সেলাই মেশিনটা দিলরুবা ধার দিলেন।
সেলাই কাজ করে রুনা যে টাকা পেলো তা সব দিয়ে ছোট ছোট টুকটাক গহনা কিনতে চায় রুনা। কিন্তু ঢাকা শহরের কিছুই সে চিনে না। জামানকে বললে জামান গহনা কিনতে দিবে না। তার কথা হল অযথা টাকা খরচ করবে না। রুনার অনেক গহনা আছে। আর কী দরকার। কিন্তু এই গহনাগুলো যে ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে সেটা বুঝে না।
একদিন রুনা দিলরুবার উপরের বাসায় গেলো। উদ্দেশ্য গহনা কোথায় পাওয়া যায় সেই ব্যাপারে খোঁজ নিতে। দিলরুবার বাসা খুব সুন্দর করে সাজানো। বড় একটা ঝাড়বাতি। একদিকের দেয়ালে বিশাল একটা ঘড়ি। ক্রিস্টালের ফুলদানি কয়েকটা । একটি বড় জাপানি পুতুল। রুনা এদিক সেদিক চেয়ে দেখছে শুধু। দিলরুবা এসে জিজ্ঞেস করল,
– কী গো রুনা? কিছু বলবা?
– দিলু আপা নিচে সময় কাটছিল না। তাই সময় কাটাতে আসলাম।
– তুমি বস। আমি আসছি।
পর্দার আড়াল থেকে রুনা দুটি মেয়ের মুখ দেখতে পেলো। খুব সুন্দরী। রুনা ডাকতেই ওরা চলে গেলো, দিলরুবা এসে বসলো ।
– আমার জমজ মেয়ে দুইটাকে দেখেছো ?
– হ্যাঁ। কিন্তু আমি ডাকতেই ভিতরে চলে গেলো।
– হ্যাঁ ওদের ঘর থেকে বের হওয়া নিষেধ। দেশের যে অবস্থা। ভার্সিটিতেও ভর্তি করলাম না। এইতো আমার স্বামী দেশে আসলেই বিয়ে।
– হঠাৎ দিলরুবার চোখ ছল ছল করে উঠলো। তোমাকে একটি কথা বলি ভাই। কাউকে বলো না।
– না না আপা কাকে বলবো ?
– আমি এই মেয়ে দুইটির মা নই। আমি আমার স্বামীর দ্বিতীয় পক্ষ। আমার স্বামী খুব বড় একটা অন্যায় করতে যাচ্ছে । কিন্তু আমার কিছুই করার নেই।
– কী অন্যায় আপা?
– হঠাৎ দিলরুবা চুপ হয়ে গেলো। আরেকদিন বলবো। তা তোমার হঠাৎ আগমনের হেতু কী?
– আপা আমি ছোট ছোট কিছু গহনা কিনবো।
এইবার দিলুরুবার মুখ হাসি দেখলো রুনা।
দিলরুবা সাজগোজ, গহনা, খুব পছন্দ করে। তার ২ হাতের পাঁচ আঙ্গুলেই আংটি, গলার লকেট চেইন আর হাতে দুই গাছি করে চুরি থাকে সবসময়।
– কী গহনা কিনবা?
– ছোট ছোট গহনা।
– নাকফুল, কানের দুল, আংটি। আমার সেলাইয়ের টাকা জমিয়েছি। তা দিয়েই কিনবো।
– আমার পরিচিত দোকান আছে বায়তুল মকারমে। ওখান থেকে কিনে দিব তোমাকে।
পরের দিনই দিলরুবা রুনাকে নিয়ে বায়তুল মোকাররম মারকেটে গেলো। দিলরুবার গাড়ি আছে। সে নিজেই ড্রাইভ করে। কিন্তু আজকে ড্রাইভারকে নিলো। রুনা বায়তুল মোকাররম মসজিদ দেখে অভিভূত। এতো সুন্দর এতো বড় মসজিদ আমাদের দেশে আছে। পুরো একতলা জুড়ে মার্কেট। কত কী পাওয়া যায়। মার্কেটের বেশ অনেক খানি হেঁটে একটি ছোট গহনার দোকানের সামনে থামলো দিলরুবা।
গহনার দোকানের লোকটি দিলরুবাকে দেখে খুশি হয়ে উঠলো। বুঝা যায় দিলরুবার সাথে বহুদিনের পরিচয়।
– আরে আপা। অনেকদিন পর দেখলাম আপনাকে। আসেন না যে?
– আরে সংসার নিয়ে এতো ঝামেলা আসা হয় না।
– আপা চা দেই?
– দাও। আজকে কিছু কিনবো না। আমার ছোট বোন কিনবে। ফুলতলা থেকে এসেছে। ঢাকায় নতুন। দাম কমায় রাখবা। ও কিন্তু নিয়মিত নিবে তোমার দোকান থেকে।
– আপা আপনার বোন। আমি কি তার থেকে বেশি নিবো। তা হয় কখনো?
– অত কথায় কাজ নাই। ঝুমকা দেখাও।
রুনা চাপা গলার দিলরুবা কে বলল,
– দিলুদি ঝুমকা কিনার টাকা নাই। ছোট কানের ফুল কিনবো।
– আরে দেখো তো।
দোকানদার বেশ কয়েকটা ঝুমকা বের করলো। দিলরুবা মাঝারি সাইজের একটা ঝুমকা দেখিয়ে রুনা কে বলল,
– কেমন?
– খুব সুন্দর। কিন্তু?
– কোন কিন্তু নাই। এটা প্যাকেট কর।
– তুই তো ৩০০ টাকা নিয়ে আসছিস? আমাকে দে টাকা গুলো ।
– রুনা টাকা বের করে দিলরুবার কাছে দিলো।
দিলরুবা দোকানদারের হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলল,
– নাও।
– আপা এতো কমে তো হবে না।
– আরে হবে। ও আরো গহনা নিবে। বেশি চাইলে কিন্তু আর নিবে না।
– দিলরুবা প্রায় জোর করে টাকা গুলো দোকানদারের হাতে গুঁজে দিয়ে বের হয়ে আসলো ।
রুনা তো মহা খুশি। ঝুমকা কিনতে পারবে সেই আশাই সে করে নাই।
এই প্রথম ঢাকা শহরের দরদামের সাথে পরিচিত হল রুনা।
সময়টা অস্থির। আইয়ুব খানের শাসনামল। ৬ দফা দাবী থেকে সরে আসার জন্য তিনি শেখ মুজিবর রহমান সহ ৩৫ সিভিল আর সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করেন। এতে শেখ মুজিবর রহমান কে প্রধান আসামি করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ছাত্র কমিটি ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৬৯ এর জানুয়ারী মাসের ২০ তারিখ গভরমেন্ট মুনায়েম খান ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেন। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করে জড় হয়। এই সময় পুলিশের গুলিতে বিদ্ধ হন ছাত্র নেতা আসাদ। ঢাকা মেডিক্যাল এর জরুরি বিভাগের সামনে তিনি শহীদ হন। এরপর সংসদ ভবনের পাশের লাল মাটিয়ার আইয়ুব গেট এর নাম বদলে রাখা হয় আসাদ গেট। আইয়ুব লেখা নাম ফলকটা জনতা ছুড়ে ফেলে দেয় আর সেখানে জ্বল জ্বল করতে থাকে আসাদের নাম,
এমনতর অবস্থায় সুমন আরমানিটোলা গভরমেন্ট হাই স্কুলের নবম শ্রেণীতে ভর্তি হল। স্কুল তার ভাল লাগে না। পড়াশোনা অনেক কঠিন মনে হয়। স্কুলে বন্ধু নেই বললেই চলে। সে নতুন। কিন্তু বাকিরা তো পুরনো। তাদের কথা আড্ডার মাঝে সে ঢুকতে পারে না। তার উপর সে খুব চাঁপা স্বভাবের। একটা কথা আছে মুরগির খোঁয়াড়ে নতুন মুরগি আসলে অন্য মুরগিরা তা সহ্য করতে পারে না। স্কুলেও তা। ক্লাসের বেশির ভাগ ছাত্রই যেন তাকে পছন্দ করে না।
শুধু একটা ছেলের সাথে তার বন্ধুত্ব হল । ছেলে হাল্কা পাতলা, শুকনো, চশমা, পরে। প্রতিদিন স্কুল থেকে আসার পথে ঐ ছেলে তার সঙ্গী হয়। বাসা কাছাকাছি তাই তারা একই রিকশা করে যাওয়া আসা করে। যাওয়ার পথে কখনো আমড়া খায় কাসুন্দি দিয়ে অথবা আঁচার আবার কখনো ঝাল মুড়ি চানাচুর খায়।
ছেলেটির নাম সবুজ। সবুজের বাবা বেশ ধনী। তার বাসায় কত কিছু। তাদের গাড়িও আছে। কিন্তু সবুজের বাবা গাড়ি নিজের অফিসের কাজে নিয়ে রাখেন। ছেলে তো বেশ বড়। এখন তো সে নিজেই আসতে পারবে। গাড়ি কেন পাঠাতে হবে। ছেলেকে স্বনির্ভর হতে হবে। শক্ত সমর্থ হতে হবে। এটাই চান সবুজের বাবা। যাতে কোন কঠিন সংগ্রামে সে হার না মানে।
যেদিন সুমন প্রথম সবুজের বাসায় গেলো সে অবাক হয়ে গিয়েছিল। কী নেই সবুজের। এমন কী পিয়ানো পর্যন্ত রয়েছে। সবুজ খুব সুন্দর পিয়ানো বাজায়। পিয়ানোতে রবীন্দ্র সঙ্গীত যে এত সুন্দর শোনা যায় তা সবুজ পিয়ানো না বাজিয়ে শোনালে সুমনের বিশ্বাসই হত না।
সুমন , সবুজের বাসাতেই এলভিস প্রিস্লির গান প্রথম শুনে। তখন থেকেই সে এলভিস প্রিস্লির ফ্যান। সবুজের কাছে এল্ভিস প্রিস্লির অনেক রেকর্ড আছে। টিভি প্রথম সুমন, সবুজের বাসাতেই দেখে। একটা ছোট বাক্সের ভিতরে মানুষের চলমান জীবন্ত ছবি দেখা যায়। সবুজের মা সুমনকে খুব পছন্দ করে। যখনি যায় যত্ন করে খাওয়ায়। এভাবে সবুজের সাথে সুমনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়ে গেলো।
সবুজ তার বয়সে চেয়েও কিছুটা মানসিক ভাবে পরিপক্ক। এখুনি সে রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা করে। আলোচনা করে। তার মামা রনি সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত। আওয়ামী লীগের একজন বড় নেতা। রনির মুখে অনেক কিছু শুনে সবুজ। সবুজ ভাবে বড় হয়ে সে রাজনীতি করবে। দেশের মানুষের সেবা করবে। রনির কথা শুনে সে বুঝতে পেরেছে যে পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ বাঙালিদের পাকিস্তানের দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ মনে করে। তারা চায় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তাদের অধীনে থাকবে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক পূর্ব পাকিস্তানের সাথে বৈষম্য মূলক আচরণ করে। তারা মনে করে পূর্ব পাকিস্তান যেন পশ্চিম পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ। জাতীয় বাজেটের সিংহ ভাগ বরাদ্দ থাকবে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। শিক্ষা, সেনাবাহিনী, সরকারী চাকুরী সব কিছুতেই পূব পাকিস্তান হল অবহেলিত। এসব কথা যখন সবুজের মনে পড়ে তখনই তার প্রচণ্ড রাগ হয়। ইচ্ছা করে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রনির সাথে আন্দোলনে নেমে পড়তে। কিন্তু রনি তাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে চায়। বলে আগে বড় হতে। পড়াশোনা করতে। পড়াশোনা না হলে কোন কিছুই ঠিক মত করা সম্ভব নয়। সময় হলে ঠিকই রনি তাকে রাজনীতি তে যুক্ত করবে। কিন্তু এখন নয়। এখনো সময় আসে নাই।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথা সুমন প্রথম শুনে সবুজের মুখে। শেখ মুজিবুর রহমান নাকি পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করতে ভারতের আগরতলায় বসে ষড়যন্ত্র করেছেন। তাই তাকে প্রধান আসামী করে গ্রেফতারও করা হয়েছে। কিন্তু সবুজ আর সুমন কেউ তা বিশ্বাস করে না।
আসাদ মারা যাওয়ার পর থেকে ঢাকা শহর হয়ে গিয়েছে মিছিলের নগরী। দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার, ‘আয়ুব তুমি ফিরে যাও’ আর বিভিন্ন স্থানে কালো পতাকা উঠানো হল।
সারা দিন মিছিলের শ্লোগান শুনে রুনার ভয় লাগে। এমন কক্ষনো দেখে নাই গ্রামে থাকতে। এতো মানুষ একসাথে আন্দোলন করতে। উপর তলায় দিলরুবার ৬ বছরের ছোট ছেলেটিও মিছিলের শব্দ শুনে অনুকরন করে শ্লোগান দেয়
– আইয়ুব মনেম ২ ভাই। এক রশিতে ফাঁসি চাই।
– জেলের তালা ভাঙবো । শেখ মুজিবকে আনবো
দিলরুবাও ভয় পায়। ছেলে টা এই বয়সে শ্লোগান দিচ্ছে। ছেলেটি কথা শুনতে চায় না। শ্লোগান দিতেই থাকে। দিলরুবার প্রচণ্ড রাগ উঠে। জোরে চড় মারে ছেলের গালে। ছেলেটি জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।
জামান মাঝে মাঝেই ভাবে ঢাকা এসে ভুল করলো কিনা। এতো আন্দোলন, এতো মিছিল এতো হরতাল কারফিউ সে কখনই দেখে নাই। যখন তরুণ ছিল তখন শুনতো ১৯৫২ সালেও নাকি এমন আন্দোলন হয়েছিলো ঢাকায়। এবং আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা ভাষার অধিকারও ছিনিয়ে নিয়েছিলো তারা। কিন্তু এই বার কী হবে। ব্যবসা লাটে উঠবে কিনা। এই আন্দোলন আর হরতাল ডিঙিয়ে খুব কম মানুষ কাপড় কিনতে আসে। তার উপর মিছিলগুলোতে সুমনের মত ছেলেরাও যাচ্ছে। মিছিলে গুলি হচ্ছে। ছেলেটা না এসবে যোগ দেয়। ভুল করলো নাকি গ্রাম থেকে নিয়ে এসে। রুনা কে সব সময় চোখে চোখে রাখতে বলে জামান।
আজকাল সবুজ শুধু রাজনীতির আলাপ করে। সে প্রতিদিন পত্রিকা পড়ে। একটা নয় দুই-তিনটা। দৈনিক সংবাদ, ইত্তেফাক, পূর্বদেশ। এর মাঝে দৈনিক ইত্তেফাক তার কাছে নিরপেক্ষ মনে হয়। ইত্তেফাক অনেক ঝাঁঝালো শব্দ ব্যবহার করে। পাকিস্তান অব্জারভার সবচেয়ে দুর্বল।
সুমন খুব ভালো শ্রোতা আর সুমনেরও রাজনৈতিক আলাপ ভাল লাগে। সবুজ তার মতামত দেয়। আর সুমন সেগুলো সমর্থন করে। সুমন ধীরে ধীরে সবুজ কে অনেক পছন্দ করে ফেলেছে। সবুজ শেখ মুজিবুর রহমানকেই তার আইডল মনে করে। সে প্রায়ই বলে শেখ মুজিবুর রহমানকে বেশি দিন জেলে আটকে রাখা যাবে না। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যেভাবে আন্দোলনে পথে নেমেছে এই আন্দোলন কে ঠেকনোর মত ক্ষমতা আইয়ুব খানের নেই।
পঞ্চম পর্ব
আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগলো।
একদিন ক্লাসে এসে দেখে সবুজ মুখ গম্ভীর করে বসে আছে। সুমন জিজ্ঞেস করলো,
– কী হয়েছে তোর?
– কী হবে? আমাদের দেশটা আইয়ুব খানের করাল গ্রাসে চলে গেলো অথচ আমরা বসে ক্লাস করছি। ভবিষ্যত প্রজন্ম আমাদেরকে ক্ষমা করবে না।
– কিন্তু কী করবো ? আমাদের কী করার ক্ষমতা আছে?
– কিছু না করি অন্তত প্রতিবাদ জানাবো । বিদ্রোহ করবো।
– কিন্তু কিভাবে।
– আমার একটা চিন্তা মাথায় কাজ করছে।
– কী চিন্তা? আজ থেকে আমরা ক্লাস শেষে মিছিলে যাবো। প্রতিবাদ করবো।
– কিন্তু পুলিশ যদি গুলি করে?
– তোর ভয় লাগছে? তাহলে বরং তুই থাক। আমি একাই যাবো
– না না ভয় লাগবে কেন? ক্লাস শেষে যাবো।
২ জন মিলে ক্লাস শেষে শহীদ মিনারে গেলো মিছিলে অংশ গ্রহন করার জন্য। এই মিছিলে তাদের মত আরো কিশোর রয়েছে। অনেকের হাতেই প্ল্যাকার্ড। কোনটাতে লেখা ‘জনতার সংগ্রাম চলছে চলবে’। আবার কোনটায় লেখা ‘গণতন্ত্র ফিরিয়ে দাও’। আবার কোনটায় ‘পুলিশের নিপীড়ন বন্ধ কর’। যখন মিছিলে শ্লোগান উঠছিলো তখন সুমন আর সবুজেরও রক্তে প্রতিবাদের আগুন জ্বলে উঠছিল। মিছিলের স্রোতে তারা ভেসে যায়। কাঠ ফাটা রোদে ঘেমেও তারা মিছিল করে। অন্তত প্রতিবাদ তো করতে পেরেছে।
বাসায় গিয়ে তারা কেউ কিছু বলল না। মিছিলে গিয়েছে জানলে মার তো আছেই সাথে সাথে বাসা থেকেও আর বের হতে দিবে না। বাসায় যেয়ে বলল তারা স্কুলের পর ফুটবল খেলতে গিয়েছিলো। খেলার কথা উঠলে ২ বাসার কেউ কিছু বলে না। এই বয়সে খেলবে না তো কবে খেলবে ?
এর পর থেকে প্রতিদিন মিছিলে যেতে লাগলো তারা। কিন্তু একদিন ধরা পড়ে গেলো সবুজের মামা রনির কাছে। তাদের দেখে এদিকেই আসছে রনি। এই মুহূর্তে পালাবারও কোন পথ নেই। কোন রকমে মুখ ঢাকার চেষ্টা করলো। কিন্তু ধরা পড়ে গেলো। রনি বলল,
– তোমরা এখানে কী করছো?
সবুজ উত্তর দিল,
– মামা আমরা আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী শাসনের হাত থেকে দেশ কে রক্ষা করতে চাই।
রনি হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিলো সবুজ কে।
– তুমি কোন ক্লাসে পড় ?
– নাইন।
– আন্দোলন কী বুঝো? এই বয়সের কাউকে আমরা এই আন্দোলনে অন্তর্ভুক্ত করতে চাই না। আগে আন্দোলন কী বুঝো, রাজনীতি কী বুঝো তারপর আন্দোলন করবা।
– কিন্তু মামা..
– আর কোন কথা নয়। এখনো তোমাদের আন্দোলন করার মত বয়স হয় নাই। যদি কক্ষনো তোমাদের দরকার লাগে আমি তোমাদের ডেকে নিবো। এখন বাসায় যাও।
সেদিন ২ জনই হতাশ হয়ে বাড়ি গেলো । কিন্তু রাজনীতি নিয়ে তাদের মাঝে আলোচনা চলতেই লাগলো।
আন্দোলন ক্রমশ বাড়তে লাগলো। কারফিউ দিয়ে, মিছিলে গুলি করেও আন্দোলন ঠেকানো যাচ্ছে না। আজকাল সুমন স্কুলে যাচ্ছে না। বাসাতেই থাকে। সবুজের সাথেও দেখা হয় না। খুব একাকি লাগে। সুব্রত নাই, সবুজও নাই। কিন্তু আবার এটাও ভাবে এখন দেশের ক্রান্তি কাল চলছে। এখন এসব ভাবার সময় নয়। নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় নয়। এখন দেশকে নিয়ে ভাবতে হবে।
প্রায়ই তার সবুজের কথা গুলো কানে ভাসে। সবকিছুতেই তারা বঞ্চিত। তাদের পাট রপ্তানি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়া যায় তা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে কল কারখানা চলে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের কোন উন্নতি হয় না। নাহ আদায় করতে হবে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার। আর বঞ্চনা হতে দেয়া যাবে না। পূর্ব পাকিস্তানের বিবেকবান সকল মানুষের মনের মাঝেই সুমনের মত এই চিন্তাগুলো দানা বেঁধেছে।
এর মাঝে চলে এলো ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ভাষা দিবস। এই দিনটা বাঙালিদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ণ দিন। বাঙালি চেতনার দিন। কোন জাতি ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে তার উদাহরণ এক মাত্র অকুতোভয় বাঙালি জাতি।
সরকার ঐদিন বাধ্য হয়ে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছে। সবুজ, সুমনকে প্রস্তাব দিল চল শহীদ মিনারে যাই। ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা করা আমাদের দায়িত্ব। তাদের জন্য আজ বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। তারাই প্রথম বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলে শহীদ হয়েছেন। সুমন বলল,
– কিন্তু সেদিন তো হরতাল।
– এক ফাঁকে বের হয়ে ফুল দিয়ে চলে আসবো।
যা কথা হল তাই। সবুজের বাসায় একটা নোট আনতে যাচ্ছে বলে বের হয়ে সুমন আর সবুজ শহীদ মিনারের বেদীতে ফুল দিয়ে আসলো। সুমনের মনে হলে জীবনে খুব পবিত্র একটি কাজ করে এসেছে আজকে সে।
সময় যায় আন্দোলন চরম আকার ধারনা করেছে। এরপর প্রবল গণ আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা উঠিয়ে নেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবর রহমান কে সংবর্ধনা দেয়া হয় এবং তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ২৪ মার্চ আইয়ুব খান সেনা বাহিনির প্রধান জেনারেল ইয়া হিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
এদিকে সুব্রতের প্রিটেস্ট পরীক্ষা শেষ। ছুটি। বড় একটা ছুটি। সুমনকে কত দিন দেখে না। সুব্রত ঠিক এই ছুটি গ্রামে না কাটিয়ে ঢাকা সুমনের বাসায় বেড়িয়ে আসবে। ঢাকা শহরটাকে ঠিক মত কখনই ঘুরে দেখা হয় নাই। প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো শহর। ৩ বার রাজধানী হওয়ার গৌরব এই ঢাকা শহরের। এখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী শহরটি। একটা টেলিগ্রাম পাঠালো সুমনের কাছে।
এদিকে সুমন তো মহা খুশি। আর রুনাও অনেক খুশি। কিন্তু জামান সাহেব তেমন খুশি হলেন না। আবার অখুশি হলেন তাও না। এতো দিনের পরিচয়। ছেলেটি কত এসেছে তার গ্রামের বাসায়। কিন্তু একটা দৃশ্যের কথা মনে পড়লে বুকে কেমন জানি চিন চিন করে। সেই যে অমলেশ বাবুর মিষ্টি খাওয়ানোর দৃশ্যটি। সুমনকে এইবার ফার্স্ট হতেই হবে।
দেখতে দেখতে সুব্রতের আসার দিন ঘনিয়ে এলো। সদর ঘাঁটে গিয়ে জামান নিয়ে আসলেন সুব্রত কে। রিকশা নিলো ২ জন। সুব্রত ঢাকা শহরে প্রথম নয়। এর আগেও এসেছে। কিন্তু যত বার আসে ততবারই নতুন মনে হয়। রাস্তায় অসংখ্য রিকশা। আর কিছু মুড়ির টিন বাস আর প্রাইভেট গাড়ি চোখে পড়ে। আগে ঢাকার রাস্তায় সে ঘোড়া গাড়ি (টমটম ) দেখেছিলো। এখন তেমন একটা চোখে পড়ে না।
বাসায় সুমন আর রুনা অপেক্ষা করছিলো কখন সুব্রত আসবে। রুনা অনেক কিছু রান্না করেছে। রান্না ঘর থেকে রান্নার ঘ্রাণ আসছে। কতদিন পর দেখবে সুব্রতকে। আসলে পালইকান্তা ছেড়ে আসার পর রুনার গ্রামের কারো সাথেই দেখা হয় না। তাই সুব্রত আসার কথা শোনার পর রুনার মনে হচ্ছে বাপের বাড়ির কেউ বোধ হয় আসছে।
আর এদিকে সুমনের ধৈর্য থাকছে না। গলির ভিতর হাঁটাহাঁটি করছে কখন সুব্রত এসে পৌঁছাবে। কত দিন দেখে নাই তাকে। কতদিন তার কন্ঠ শুনে নাই।
সুব্রত আর জামান সাহেবকে রিকশা করে আসতে দেখলো সুমন। বাড়ির কাছে রিকশা থামাতেই সুব্রত নেমে সুমনকে জড়িয়ে ধরলো। কত দিন পর তাদের দেখা। ভিতরে ঢুকতেই রুনা সুব্রত কে জড়িয়ে ধরে বলল,
– তোকে কত দিন পর দেখলাম। আমার প্রাণ জুড়িয়ে গেল। নিলা দিদি কেমন আছেরে? আর অমলেশদা? তোদের গাছে আম ধরেছে? আর আমার কাঁঠাল গাছটা?
জামান সাহেব বললেন,
– আরে ওরে ছেড়ে কিছু খেতে দাও। কত বেলা হয়েছে? খেয়াল আছে?
রুনা টেবিলে খাবার সাজাতে লাগলেন।
– হ্যাঁ রে সুব্রত তোর মা বাবা কবে ঢাকা আসবে বল তো? আগে তো প্রায়ই ঢাকা আসতেন?
– চাচি, এখন ফুলতলা থেকে বাবা ওষুধ কিনেন। তাই আর ঢাকা আসা লাগে না।
– সুব্রত ব্যাগ থেকে একটি বাক্স বের করে রুনার হাতে দিল।
– এটা কী?
– মা কিছু নাড়ু পাঠিয়েছে। সুমন খুব পছন্দ করে তো।
– ওমা দিদির হাতের নাড়ু সে তো আমিও খুব পছন্দ করি। কতদিন দিদির হাতের পিঠা খাই না। দিদির সব মনে আছে। ঈশ কবে যে পালইকান্তা যাবো। গ্রামটার জন্য, তোদের জন্য পরান পুড়ে।
বাক্স থেকে নাড়ু গুলো একটি পাত্রে রেখে টেবিলে রাখলেন রুনা অনেক কিছু রান্না করেছেন রুনা। মুরগি মসল্লম, পরোটা, হালুয়া, মিষ্টি এনেছেন। অনেক কিছু।
– চাচি এত কিছু রান্না করেছেন। আমি এতো খেতেই পারবো না।
– সব খেতে হবে তোর। পরে দিদি ভাববেন আমি কিছুই খাওয়াই নাই। সে হবে না।
সুমনও পিছন থেকে বলল,
– আম্মুও কিন্তু হালুয়া খুব পছন্দ করে। ওকে আরো হালুয়া দাও। সে লজ্জা পায়। তোমাকে কিছুই বলবে না।
– সে কী বাবা আমি জানি না। সুব্রত-তো আমার ছেলেই।
– আরও হালুয়া আর লুচি তুলে দিলেন সুব্রতের প্লেটে। সুব্রত আঁতকে উঠলো।
– চাচি, আমি তো আরো খেলে পেট ফেটে মারা যাবো।
– তোর মত বয়সে তো তোর চাচা এর দ্বিগুণ খেতো।
ফোঁড়ন কাটলো সুমন।
– তুমি কিভাবে জানলা আম্মু?
– তোর দাদির মুখে শুনেছি। তোর দাদা তো জমিদার ছিলেন। বিশাল পিতলের থালায় খাবার নিয়ে বসতেন। পুরো একটা মাছের মুড়ো একাই খেতেন।
এসব খাওয়া দাওয়ার আদিখ্যেতা আর জামান সাহবের ভালো লাগছে না। তিনি খাবার টেবিল থেকে উঠে পত্রিকা নিয়ে পাশের ঘরে গেলেন। দৈনিক ইত্তেফাক রাখেন তিনি। পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ে তিনি মহা চিন্তিত। দেশটার কী হবে? চায়ের কাপের চুমুক দিচ্ছেন আর পত্রিকা পড়ছেন। রুনা সুব্রতকে জিজ্ঞেস করলো,
– বাবা সুব্রত তোমার লেখা পড়া কেমন চলছে? মেট্রিকের পর কোন কলেজে ভর্তি হবে?
– চাচি চেষ্টা করছি ঢাকা কলেজে ভর্তি হতে। ওদের হোস্টেও আছে।
খাওায়া দাওয়া শেষে তার ঘরে এসে বসলো ২ জন।
– জানিস আমার এই বাসায় থাকতে দম বন্ধ লাগে। ছোট ঘর। চিপা গলি। এখানে সেখানে নোংরা। কোথাও খোলা আকাশ দেখতে পাই না। গ্রামটা অনেক মিস করি রে।
– আমাকে মিস করিস না?
– অনেক।
– তোর স্কুলে কোন বন্ধু হয় নাই?
– হম। হয়েছে একজনের সাথে। সবুজ। তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো ।
– তোর?
– হ্যাঁ হয়েছে। কয়েকজনের সাথে। ক্লাস শেষে আমরা মাঝেই মাঝেই ঘুরতে যাই। নদীর তীরে। আমাদের একটা ফুটবল টিম আছে। আমি সেখানে খেলি। ডিফেন্সে।
– তুই কোন টিম সাপোর্ট করিস রে? আমি মোহামেডান ।
– আমিও মোহামেডান। এইবার তো আমরাই শিরোপা জিতলাম।
খেলার খবর থেকে চলে গেলো পড়াশোনা, সাহিত্য সংস্কৃতিতে। চলে আসলো তাদের প্রিয় সংগীত শিল্পীদের নিয়ে আলোচনা। ফেরদৌসি রহমান, নিলুফার ইয়াসমিন, ফরিদা ইয়াসমিন, মাহমুদুন নবি, আব্দুল আলীম , ফিরোজা বেগম, বশির আহমেদ, শাহনাজ বেগমদের কার কাকে পছন্দ এবং কেন পছন্দ এগুলো নিয়ে আলোচনা করতে করতেই দুপুর গড়িয়ে গেলো।
কিন্তু তারা মনে মনে ২ জন ২ জন কে নিবিড় ভাবে স্পর্শ করার জন্য ভিতরে ভিতরে মরে যাচ্ছে। এত দিন পর দেখা। কিন্তু আজিমপুর বাসাটা ছোট। কোন প্রাইভেসি নেই। চাইলেও আলিঙ্গন করে ঠোঁট কামড়ে নেয়া সম্ভব যে নয় তা ২ জনেই বুঝতে পারছে। সুব্রত ভাবলো সুযোগ একটা পাওয়া যাবে। কিন্তু কখন?
ষষ্ঠ পর্ব
সুব্রত আসায় বাসাটায় কেমন জানি একটা প্রাণ এসেছে। সারাদিন বাসাটা হইহুল্লর করে মাতায় রাখে সে। এমন কী কিছু কিছু জোকস শুনে গম্ভীর জামান সাহেবও হেসে দিয়েছেন।
সূর্য মধ্য গগনে। গোসল করে আসলো ২ জনই। খেতে বসবে। সকালে এতো খেয়েছে এখন আর কিছুই খেতে ইচ্ছা করছে না তাদের। জামান সাহেব দোকানে গেছেন। ২ জনই বসলো। দুপুরেও অনেক কিছু করেছেন রুনা। পোলাও কোরমা, মাছ ভাজা, চপ, সবজি, সালাদ। খাবারের ঘ্রাণেই সুব্রত খেতে বসলো। সকালে খাওয়ার পরও অনেক খেলো তারা। খাওয়ার পর ২ জনই বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াগড়ি দিলো। বিকেল হতেই বের হলও ২ জন। হাঁটছে আর কথা বলছে। সুব্রত বলছে,
– জানিস অর্পণ নামের একটা ছেলেকে আমি পড়াই। মানে টুইশানি করাই। কী যে কিউট। কী বলবো! মনে হয় তাকিয়েই থাকি। আমি তো মুগ্ধ।
ওহ তাই বুঝি। আমি নাই সেই সুযোগে লাইন মারা হচ্ছে। থাক তুই তোর অর্পণ নিয়ে। আমার সাথে আর তোর আর কোন কথা নেই।
সুব্রত জোরে জোরে হেসে দিল। বলল,
– রাগ করে না বাবু। কিসের অর্পণ ! আমার চোখে তোর থেকে কিউট আর কেউ নয়। আর আমি অর্পণ নামে কাউকে পড়াই না। অর্পণা নামে একজন মেয়ে কে পড়াই।
– তাহলে এমন কথা বললি কেন?
– তোকে একটু জেলাস করলাম। তোকে আমি অনেক ভালবাসিরে। সবাই কক্সেসবাজার গিয়েছে। কিন্তু আমি তো তোর কাছে ছুটে এসেছি। যেদিন তোকে নিয়ে সমুদ্র দেখতে পাবো সেইদিনই কক্সেসবাজার যাব তার আগে নয়।
– আমিও তোকে অনেক ভালবাসি। অনে এ এ এক!
হাঁটতে হাঁটতে গল্প করতে করতে কখন যে তারা বাংলা বাজার এসে পড়েছে তা খেয়ালি নাই।
বাংলা বাজারে অসংখ্য বইয়ের দোকান। সুব্রতের বই দেখলে আর মাথা ঠিক থাকে না। সে বেশ কয়েকটি বই কিনবে। অনেক দোকান ঘুরে ঘুরে বই কিনলো তারা। শরৎচন্দ্র রচনাবলী, রবিন্দ্রনাথের গল্প গুচ্ছ, শামসুর রাহমানের কাব্য গ্রন্থ, বুদ্ধদেব বসু, শরদিন্দু এর ব্যোমকেশ। বই কিনে বের হল তারা। অসম্ভব ভারী। ২ জন মিলেই বহন করতে কষ্ট হচ্ছে। ধারেই চটপটি বিক্রি হচ্ছে। খেতে গিয়ে দেখলো অসম্ভব ঝাল। সুব্রত একদম ঝাল খেতে পারে না। এক গ্লাস পানি খেয়েও ঝাল কমছে না।
সেদিন রাতে এক দুই জন একসাথে ঘুমালো। কিন্তু পাশের ঘরেই জামান আর রুনা। আর দরজা খোলা। এই অবস্থায় সুব্রত আর সুমন কেউ তাদের সীমা অতিক্রম করলো না।
পরের দিন সূর্য উঠতে না উঠতেই সুব্রতের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ধাক্কা মেরে সুমন কেও উঠালো।
– চল ছাদে যাই। দেখি ছাদ থেকে ঢাকাকে কেমন লাগে।
সুমন চোখ রগড়াতে রগড়াতে বলল,
– ছাদে উঠা নিষেধ।
– কেন?
– ছাদে বাড়িওয়ালার মেয়েরা আড্ডা দেয়।
– তাই নাকি? দেখা যাবে?
– আমি ওদের ছাদে কখনো দেখি নাই। দেখার সৌভাগ্য হয় নি। বোরখা পরে।
– ওহ। যাই হোক এতো সকালে কেউ দেখবে না। থাকবেও না। চল যাই।
সুমন ইতস্তত করছিলো ।
– কিন্তু ধরা পড়ে গেলে? এই বাসায় থাকা বন্ধ হয়ে যাবে।
– আরে চল। কিছু হবে না।
তারা পা টিপে টিপে ছাদে উঠলো। পুরো ছাদ জুড়ে কাপড়। শুকানোর জন্য রাখা হয়েছে। রেলিঙের কাছে এসে ঢাকা শহর দেখছে। নিউমার্কেট দেখা যায়।
– আজ নিউমার্কেটে যাবো। টুকটাক শপিং করবো আর চাচার দোকান দেখবো।
একদিকে একটা শাড়ি শুকানোর জন্য পুরোটা মেলে রাখা হয়েছে। সুব্রত সুমনকে টান দিয়ে শাড়ির আড়ালে নিয়ে গেল। এখন ছাদে কেউ উঠলেও দেখতে পাবে না ছাদে শাড়ির আড়ালে কী হচ্ছে। অনেকদিনের ধৈর্য্য পুরো ভেঙে গেল ২ জনেরই। একজন আরেকজনকে পাগলের মত জড়িয়ে ধরলো। সুব্রত সমানে সুমনের গলা, গাল, ওষ্ঠে চুমু দিতে লাগলো। এক সময় দাউ দাউ করে জ্বলা কয়লা ঠান্ডা হয়ে আসলো। আকাশও পুরো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। যে কোন সময় কেউ ছাদে চলে আসতে পারে। তার উপর সুব্রতের পায়ের ঠেলায় দিলরুবার একটা আঁচারের শিশিও ভেঙে গিয়েছে। আর রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না। আবার পা টিপে টিপে ২ জনেই নিচে নেমে গেল।
নাস্তা করেই বের হলও তারা নিউমার্কেট যাবে। রিকশা করে নিউমার্কেট আসলো। কী নেই এখানে? বই থেকে শুরু করে শাড়ি গহনা সব। অনেক খুঁজে নিলার জন্য একটি শাড়ি কিনলো সুব্রত। নীল রঙের সুতি শাড়ি। আর অমলেশ বাবুর জন্য একটা পাঞ্জাবি। সাদা রঙের তাতে নীল রঙের কাজ কাজ। সুমন বলল,
– অর্পনার জন্য পায়েল কিনে নিয়ে যা, বলবি ঢাকা থেকে এনেছিস।
– অর্পনার মা জানলে আমার টুইশানি সেখানেই বাতিল। হা হা।
একটি দোকানে বসে সিঙ্গারা আর চিকেন পেটিস খেলো দুজন। নিউমার্কেটের চিকেন পেটিস খুব বিখ্যাত। খুব ভাল খেতে।
সুমন সুব্রত কে বললো,
– চল কোল্ড ড্রিংকস খাওয়াই তোকে।
একটি দোকানে কোক খেলো তারা। সেখান থেকে জামানের দোকানে গেলো। জামান নেই দোকানে। মাল আনতে গিয়েছে। কর্মচারী বসে আছে। সেখানে থেকে লাভ নাই। সুব্রত প্রস্তাব দিল।
চল ঢাকা কলেজ দেখে আসি।
তাদের ২ জনেই ইন্টারমিডিয়েট ঢাকা কলেজে পড়ার ইচ্ছা। তাই ঢাকা কলেজ তাদের কাছে তীর্থস্থানের মত। দোতালা একটি বিশাল বিল্ডিং। গ্যালারিগুলো অনেক বড়। আছে পদার্থবিজ্ঞান আর রসায়ন ল্যাব। কলেজ বিল্ডিঙের সামনে বাগান। পিছনে একটা বিশাল খেলার মাঠ । মাঠের আরেক প্রান্তে হোস্টেল। যতই দেখছে ততই এখানে পড়ার তীব্র ইচ্ছা জন্মাচ্ছে।
ঢাকা কলেজের উল্টো দিকে বিরিয়ানির দোকান আছে। সেখানে বসে ২ জনের মাঝে আলোচনা শুরু হলও সিনেমা নিয়ে। তখন বাংলা সিনেমা এসেছে খুব বেশি দিন হয় নাই। তাদের মধ্যে আলোচনা চলতে লাগলো কার কোন সিনেমা ভাল লেগেছে। কার অভিনয় কত ভালো। সুব্রত ববিতার ফ্যান আর সুমনের কবরী। আর দুই জনেরই উত্তম সুচিত্রাকে পছন্দ। এই আলোচনা করতে না করতেই খাবার চলে এলো। ২ জনই নিয়েছে মোরগ পোলাও। খাওয়া শেষ হল। কিন্তু মিষ্টি ছাড়া কি মন ভরে? পাশেই মহন চাঁদের মিষ্টির দোকান। ২টা রসগোল্লা আর ২টা চমচম খেয়ে ক্ষান্ত দিলো। আর পারবে না। পেটে আর এক বিন্দু জায়গা নেই। গ্রীষ্মের শহর। ঠা ঠা রোদ। বের হতে ইচ্ছা করছে না। ২ জনই ঠিক করলো সিনেমা দেখবে কিন্তু বাসায় জানানো যাবে না। বলাকায় চলছে নীল আকাশের নিচে সিনেমাটি। অভিনয় করেজেন নায়ক রাজ রাজ্জাক আর কবরী । জমজমাট সিনেমা। সুব্রতের খুব ভাল লাগলো। সিনেমা হল থেকে বের হয়ে গান গাইছে গুন গুন করে।
– নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা চলেছি একা।
– ওই সবুজের শ্যামল ছায়ায় দৃষ্টি দিয়েছে ঢাকা।
এখনো বিকেল। সন্ধ্যা হয় নাই। সুমন প্রস্তাব দিলো,
– সবুজের বাসায় যাই চল। আমার বন্ধু। তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো।
প্রথমে সুব্রত একটু ইতস্তত করছিলো। পরে যেতে রাজি হল। ধানমন্ডি ১ নম্বরে থাকে সবুজ। এক তলা বাসা। খুব ছিমছাম করে সাজানো। সবুজ, সুমন আর সুব্রতকে দেখে খুব অবাক হল আবার খুশিও হল। নিজের ঘরে নিয়ে বসালো ২ জনকে। সুব্রত ঘরের সাজ খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। এতো সুন্দর করে সাজানো ঘর আগে দেখে নাই। অসংখ্য বই রয়েছে। বড় বড় লেখকদের বই। দক্ষিণ দিকে বিশাল একটা জানালা। বাইরে থেকে হাওয়া ঢুকছে। ফ্যান চালানোর দরকার পড়ে না। এক দিকে কারুকাজ করা বিশাল একটি বেলজিয়ান কাঁচের আয়না। কারুকাজ করা বিশাল একটি পালঙ্ক রয়েছে। অনেক পুরনো। এই খাট নাকি সবুজের বড় বাবার আমলের খাট ।
এই কথা সেই কথা হতে হতে এক সময় রাজনীতির কথা চলে আসলো। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগ থেকে শুরু করে ১৯৬৯ এই গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত আলোচনা উঠলো। সবুজ বলল,
– ব্রিটিশ রা এক সময় আমাদের শোষণ করতো এখন পশ্চিম পাকিস্তানইরা।
বলল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের কথা। কিভাবে মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে বাংলার মানুষ রক্ত দিয়েছিলো। আর পশ্চিম পাকিস্তানের এই শোষণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই ৬ দফা দাবী। ১৯৬৬ সালে ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে বাংলার প্রাণপ্রিয় নেতা আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬ দফা দাবি পেশ করেন।
এই সব ইতিহাস জানতো না সুমন আর সুব্রত। আসলে রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা সেরকম ভাবে তারা কক্ষনোই করেনি।
সবুজ আরো বলল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথা। যতই শুনছে সুমন, সুব্রত, মনে ততই ক্রোধ জমাচ্ছে। এগারো দফা সম্পর্কেও কথা বলল সবুজ। এই কর্মসূচিতে একচেটিয়া পুঁজি খর্ব করার জন্য ব্যাঙ্ক, বীমা আর বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ, সকল সামরিক চুক্তি বাতিল করে জোট বহির্ভূত স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরন, কৃষক, শ্রমিকের দাবী তোলা হয়েছিল।
১৯৬৯ সালে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ প্রবল রূপ ধারণ করে। ১৯৬৯ সালের ৪ই জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের এই ঐতিহাসিক ১১ দফা র্কমসূচী পেশ করেন।
এই কথা গুলোর অনেক কিছুই তাদের জানা। কিন্তু তারপর সবুজের মুখে শুনতে ভাল লাগছে। সবুজের প্রতি সুমনের ভক্তি জন্মাতে শুরু করলো। কত কিছু জানে সে। কত কিছু নিয়ে ভাবে।
সবুজ তুই এতো কিছু জানলি কিভাবে?
– পত্রিকা পড়ে, বেতারের খবর শুনে। আমার মামা সরাসরি আওয়ামী লীগের কর্মী। তিনি আমাকে অনেক পছন্দ করেন। অনেক কথা বলেন।
সুব্রত প্রথম যখন সবুজের কথা শুনেছিল তখন হিংসা হচ্ছিলো। সে ছাড়া আর কেউ সুমনের বন্ধু হতে পারে না। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সবুজ যদি তারও বন্ধু হতো।
সন্ধা হয়ে গেলো। সবুজের মা তাদের জন্য কেক, ক্রিম রোল আর বিস্কিট নিয়ে আসলেন। সুব্রতের এগুলো খুব একটা খাওয়া হয় না। কারন ফুলতলায় পাওয়া যায় না। দেখতে দেখতে আটটা বাজে। আর দেরি করা যায় না। এর বেশি দেরি হলে জামানের কাছে মার খেতে হবে।
আকাশ মেঘলা ছিল। যাওয়ার পথে টুপটাপ বৃষ্টি পরা শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর অঝোর ধারায়। গ্রামে তারা প্রায়ই বৃষ্টিতে ভিজতো। আজ তারা রিকশার হুড তুলে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরলো। সাথে সাথে সুব্রত গুন গুন করে গাইছে,
“পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে …।”
সুব্রত ভাল গান গায়। কিন্তু কারো অনুরধে কক্ষনো গাইবে না। কিন্তু কখনো কখনো বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে গান ধরে। এখন তার সেই বিশেষ মুহূর্ত। কারণ এখন তার সবচেয়ে প্রিয় বৃষ্টি স্নাত সন্ধ্যা আর পাশে বসে আছে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি ।
রুনা তাদের এই অবস্থায় দেখে হা হা করে উঠলো। জামান দেখার আগেই তারা কাপড় পাল্টে, তোয়ালে দিয়ে মাথা, মুখ মুছে নিল। নাহলে জামানের কাছে ভীষণ বকা শুনতে হত।
পরেরদিন সকালে সুব্রত চলে যাবে। সুমন গেলো সুব্রত কে নামিয়ে দিয়ে আসতে। কমলাপুর রেলস্টেশনে। যাওয়ার আগে রুনা একটি বাক্সে হালুয়া ভরে দিলো। নিলা খুব পছন্দ করে। সুব্রতকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল রুনা।
– কবে যে তোর সাথে আবার দেখা হবে। কত দিন দেখি না নিলা দিদিকে।
জামান সাহেব বললেন,
– আরে ওকে ছাড়ো এখন। পরে ট্রেন মিস করবে।
– স্টেশন আসতেই সুমনের চোখ ছল ছল করে উঠলো।
– মন খারাপ করিস না আমি আবার আসবো। ঢাকা কলেজে ভর্তি হতে পারলে।
বলতে বলতে সুব্রতর গলাও ভেঙ্গে গেলো। বুঝা যায় কান্না চাপার চেষ্টা করছে। সুব্রত ট্রেনে বসলো। ট্রেন ছেড়ে দিবে। আস্তে আস্তে ট্রেনের গতি বাড়তে লাগলো। একসময় সুমনের চোখের আড়ালে চলে গেলো ট্রেনটি।
সপ্তম পর্ব
পৌষ মাস। ঘুড়ি উড়াবার মৌসুম। ঠাটারি বাজার, শাঁখারি বাজার, রহমতগঞ্জে ঘুড়ি উড়াবার প্রতিযোগিতা হয়। সবুজ খুব ভাল ঘুড়ি উড়াতে পারে। শাঁখারি বাজারে ২ পরিবারের ঘুড়ির লড়াই হবে। সবুজের বন্ধু দীপন সবুজকে ডেকে নিয়ে গেলো তাদের হয়ে ঘুড়ি উড়ানোর জন্য। সুমনও গেলো সবুজের সাথে। সুমন খুব উৎসাহী আগে কখনো ঘুড়ির লড়াই দেখে নাই সে।
শাঁখারি বাজারের বেশির ভাগ পরিবারই হিন্দু আর ঢাকার আদি বাসিন্দা। ঘরের ছাদ থেকে ঘুড়ি উড়ানো হবে। দুই পরিবারের বাড়ি মুখোমুখি। ২ পরিবারই তিনটি করে ঘুড়ি উড়াবে। যাদের সবগুলো ঘুড়ি আগে কেটে যাবে তারাই জিতবে। ছাদে এসে লাটাই, ঘুড়িগুলো রাখা হল। লাটাইয়ে সূতা প্যাঁচানো হচ্ছে। সূতা গুলো অসম্ভব ধারালো। সুমন সূতা স্পর্শ করে দেখছিল। পিছন থেকে সবুজ বলল,
– সাবধান হাত কেটে যাবে।
– সুতা এত ধারালো কেন?
সবুজ বলল,
– অন্য পক্ষের ঘুড়ির সুতা কাঁটার জন্য ধারালো করা হয়েছে। আমাদের দীপন সারা রাত মাঞ্জা দিয়েছে ।
– মাঞ্জা কী?
– এই দীপন ওরে বল মাঞ্জা কি।
দীপন হেসে বলল,
– মাঞ্জা দেয়া খুব সহজ। সুতায় শিরিষ, কাঁচের গুঁড়ো আর রঙ মিশিয়ে মাঞ্জা দেয়া হয় যাতে প্রতিপক্ষের ঘুড়িকে ঘায়েল করা যায়।
বেশ কয়েকটা ঘুড়ি এনে ছাদে রাখা হলো। সব কয়টা ঘুড়ি খুব সুন্দর। দীপন সুমনকে ঘুড়িগুলোর যে সুন্দর সুন্দর নাম রয়েছে তা বলে যাচ্ছে।
দুটো চোখ আঁকা এই ঘুড়িটিকে বলা হয় চোখদার। আর এটা মালাদার।
একটি দুই রঙের ঘুড়ি দেখে সুমন জিজ্ঞেস করলো,
– বাহ এটা তো অনেক সুন্দর। এটার নাম কী?
– এটা দোরাঙ আর একরঙের টা একরাঙ।
ঘুড়ি উড়ানো শুরু হলো। প্রথমে দীপন ঘুড়ি উড়াল। কিছুক্ষণের মাঝেই দীপনের ঘুড়ি গেলো কেটে। তারপর দীপনের বড় ভাইয়ের ঘুড়ি গেলো। অথচ ওই পক্ষের একটা ঘুড়ি যায় নাই। পুরা লজ্জায় পড়ার মত অবস্থা। এইবার সবুজের পাল্লা। কিছুক্ষণের মাঝে প্রতিপক্ষের ২টা ঘুড়ি গেল। সবাই হই হই করে উঠলো। অন্তত লজ্জা পেতে হবে না। এক পর্যায়ে সবুজ একটা ঘুড়ি কাটতে গিয়েও কাটলো না। দীপন গেলো ক্ষেপে,
– কী ব্যাপার এত ভাল সুযোগ নষ্ট করলি?
– আমি ওই ঘুড়ির নাক কাটবো। তাই কাটলাম না।
– পারবি? না পারলে?
– পারবো । আমার উপর ভরসা রাখ।
এদিকে সুমন নাক কাটা মানে কী বুঝতে পারছে না।
দীপন বলল,
-প্রতিপক্ষের সূতার আঘাতে ঘুড়ির মাঝ বরাবর ছিড়ে যাওয়া। এবং এই ছিড়ে যাওয়া খুব লজ্জার ব্যাপার।
এবং শেষ পর্যন্ত সবুজ ঘুড়িটার নাক কাটলো।
সেজে গুজে অনেক মেয়ে ছাদে ঘুড়ি খেলা দেখতে আসছে। এক মেয়েকে দেখলাম বার বার সবুজের দিকে তাকাচ্ছে। তাহলে কি মেয়েরা সবুজ কে পছন্দ করে? সবুজ অবশ্য অনেক কিউট। চকলেট বয় টাইপ।
সেদিন সন্ধ্যায় প্রতিপক্ষে পরিবার তাদেরকে আলাউদ্দিনের দোকানের মিষ্টি খাওয়ালো। সুমন সবুজকে যতই দেখে ততই অবাক হয়। সবুজের কত গুণ। কী পারে না সে? যতই সময় যাচ্ছে সুমন ততই সবুজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে লাগলো। সে জেনে অথবা না জেনে সব কিছুতেই সবুজকে অনুকরণ করতে লাগলো।
এদিকে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিলেন। বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে একটি তিন সদস্যর নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। নির্বাচন কমিশন প্রথমেই পাকিস্তানের সকল নাগরিক যাদের বয়স সর্বনিম্ন একুশ বছর তাদের নাম ভোটার হিসেবে নিবন্ধন করে । আর ১৯৭০ এর মার্চ মাসের ১৭ তারিখ মূল ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়। নির্বাচনের সম্ভবাব্য তারিখ ৫ই অক্টোবর নির্ধারণ করা হয়।
সুমন ক্লাস টেন উঠলো। এই সময়টা কিশোর কিশোরীদের জন্য খুব সংবেদনশীল সময়। তারা বাবা মায়ের আঁচল থেকে বের হয়ে আসে। তৈরি হয় বন্ধু-বান্ধব নিয়ে তাদের নিজের জগত। সেই যে সুব্রত এসে চলে গেলো। আর দেখা হল না। সুমনের খুব কষ্ট হয়। সে এই পর্যন্ত ৩ টা চিঠি পাঠিয়েছে সুব্রতকে। কিন্তু কোন উত্তর নাই। সুমন বুঝে সুব্রত আর তাকে বয়ফ্রেন্ড হিসেবে চায় না। নিশ্চয় তার অন্য কোন সম্পর্ক হয়েছে। তাই সে সুমনকে ভুলে গিয়েছে। তাই তার চিঠির কোন উত্তর নেই। আবার ভাবে অন্য কিছু হল না তো। সে পালইকান্তাতে একটি চিঠি পাঠায়। এইবার অবশ্যই সুব্রত চিঠি পাবে। সুমন অপেক্ষা করে। কিন্তু চিঠির কোন উত্তর আসলো না। সুমন বুঝে সুব্রত তার জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে। এমন কেউ জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া খুব কষ্টের। এই কথা গুলো আপন জন ছাড়া কাউকে বলা যায় না। সুমনের মনে হয় তার বুকে কেউ পাথর বেঁধে দিয়েছে। তার মধ্যেই সুমনের স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে হচ্ছে। কেউ তো বুঝবেনা তার কষ্ট!
দিন যায় সবুজ এখন সুমনকে তার বেস্ট ফ্রেন্ড মনে করে। এদিকে দিন যায়। সুমন আস্তে আস্তে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে সব কিছু থেকে। তার ভাল লাগে না কিছু। যেখানে সুব্রত নেই সেখানে সব কিছুই তার কাছে অর্থহীন লাগছে। ক্লাসে সে পড়াশোনার বাইরে একটি কথাও বলে না। সে ক্লাস শেষেই সোজা বাসায় চলে আসে। আগের মত ফুচকা আমড়া খাওার জন্য অপেক্ষা করে না। কিন্তু সবুজ কিছুই বুঝতে পারে না। হঠাৎ করে কেন সুমন এমন আচরণ করছে। সে সোজা বাসায় চলে আসে। সুমন শরীর খারাপের ভান করে শুয়ে থাকে। কিন্তু কতদিন এইভাবে চলবে। সুব্রতকে তো সুমন ভুলতেই পারছে না। বরং এর তীব্রতা দিন দিন বাড়ছে। এদিকে সবুজও সব জানা না পর্যন্ত ওর পিছু ছাড়বে না।
শেষ পর্যন্ত সুমন ঠিক করে যে সে সব কথা সবুজ কে বলবে। একদিন রমনা পার্কে বসলো ২ জন।
– বল কী হয়েছে তোর ?
– কিছু না।
– তাহলে এমন করছিস কেন?
– কী করলাম?
– তুই বলতে চাইছিস তুই স্বাভাবিক আচরন করছিস?
– সুব্রত ফাঁকি দিয়েছে। এক বছর ওর কোন যোগাযোগ নেই। তাই তো আমার আজ এই অবস্থা। তাকে আমি ভুলতে পারছি না।
– তুই যোগাযোগ করিস নাই?
– ৩টা চিঠি পাঠিয়েছি। কিন্তু উত্তর নেই। আর আমাদের দেশের বাড়িও যাওয়া হয় না এক বছর।
– হম।
– তোকে একটা কথা বলা হয় নাই। আমি জানি না এই কথাটা শোনার পর তুই আমার সাথে বন্ধুত্ব রাখবি কিনা। তুই নিশ্চয় ভাবছিস একজন বন্ধু হারিয়ে গিয়েছে বলে আমি এমন করছি? বন্ধু হারিয়ে গেলে এমন করাটা অস্বাভাবিক তাই না?
– না তা না।
– আমি জানি তুই এটাই ভাবছিস। কিন্তু সুব্রত শুধু আমার বন্ধু ছিল না। ও ছিল আমার সব কিছু। আমার আত্মা। আমার সউলমেট। আমার ভালবাসার মানুষ। হ্যাঁ আমি আর সুব্রত ২ জনেই সমকামী।
– আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলেম এটা। সমকামী হওয়া আমার চোখে দোষের কিছু না। সবারই যাকে খুশি ভালবাসার স্বাধীনতা থাকা উচিত। আমি তোর এই পরিচয় জানার পর তোর প্রতি আমার মনোভাব একটুও পরিবর্তন হয় নি।
– তুই আসলে আমার প্রকৃত বন্ধু। আজকে অনেক হালকা লাগছে। তোকে সব কিছু খুলে বলার পর। অত্যন্ত একটা মানুষ তো আমার পরিচয়টা কে মেনে নিয়েছে।
এই কথোপকথনের পরে এক সপ্তাহ কেটে গেলো। এই কয় দিন সবুজ একদম কথা বলে নাই সুমনের সাথে। সে সুমনকে কেমন যেন উপেক্ষা করছে। সুমনের খুব কষ্ট হচ্ছে। সে ভাবে আসলে সেদিন তার সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন জানার পর পরবর্তীতে সবুজ বোধহয় আর মেনে নিতে পারে নি। তাই কথা বলছে না। কিন্তু তখন এত বড় বড় কথা কেন বলল। খুব অভিমান হয় সুমনের। থাক কথা না বললে না বলবে। সে একাই থাকবে। তার কারো দরকার নেই।
হঠাৎ রবিবার ছুটির দিন সবুজ, সুব্রতকে নিয়ে সুমনের বাসায় এসে উপস্থিত। সুমন যানপরনাই অবাক। এ কিভাবে সম্ভব! সুব্রত কে দেখে সুমন প্রায় অভিমানে, ক্ষোভে কেঁদে দেয় এমন অবস্থা। অবস্থা বেগতিক দেখে সবুজ ভাবল এখানে আর বেশিক্ষণ থাকলে সিন ক্রিয়েট হবে। চাচা চাচি সব জেনে যাবে। তাই পরিস্থিতি ঠিক করার জন্য সবুজ বলল,
– বাড়িতে নয়, বাইরে যেয়ে আলোচনা করি।
বলাকা সিনেমা হলের নিচে বড় একটা ক্যাফে আছে সেখানে যেয়ে বসলো ৩ জন। সবুজ বলল,
– সুমন তোকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য এই কয়দিন তোকে উপেক্ষা করার অভিনয় করেছি। আমি নিজে কন্টাক্ট করে ফুলতলা থেকে সুব্রতকে নিয়ে এসেছি।
– সুমন কিছু বলল না। শুধু হাসার একটা ভঙ্গী করলো। সুব্রত আর সুমন কেউই কথা বলছে না। একদম পিন ড্রপ সাইলেন্স।
প্রথমে অভিমান করে ভাঙা ভাঙা স্বরে কথা বলল সুমন,
– তুই আমাকে চিঠি লেখা বন্ধ করেছিস, ঢাকা কলেজে ভর্তি হস নাই। আমার কেমন খারাপ লেগেছে জানিস।
– একি কথা আমার। তুই আমার চিঠির জবাব দিস নাই।
– আমি তো চিঠি পাই নাই। একটা চিঠিও না।
এইবার সবুজ বাগড়া দিল,
– আমার মনে হয় টেকনিক্যাল ঝামেলা আছে। তোরা বরং আমার ঠিকানায় চিঠি লেখ। আমি তোদের চিঠি পৌঁছে দিব।
এইবার সুমন একটু শান্ত হল। সুব্রতকে বলল,
– কংগ্রাচুলেশন মেট্রিকে পাশের জন্য। ঢাকা কলেজে ভর্তি হলি না যে?
– বাবা বলল একেবারে ইন্টার পাশ করে ঢাকা যেতে। কী করা। আরও ২ টা বছর!
– তুই নাকি রাজনীতি করিস।
– হ্যাঁ এক্টিভলি। আওয়ামীলীগ করি। এখান থেকে জগন্নাথ হলে যেতে হবে। কিছু কাজ আছে।
আরও এক ঘণ্টা ম্যারাথন আডডা চলল তাদের মাঝে, তারপর সুব্রত সবুজ আর সুমনের কাছ থেকে বিদায় নিল। যাওয়ার আগে সুব্রত সুমন কে একবার আলিঙ্গন করলো আর সবুজ কে বলল,
– সবুজ তুমি না থাকলে আমাদের এই সম্পর্ক হয়তো ভেঙে যেত। এতদিন তুমি সুমনের বন্ধু ছিলে। আজ থেকে আমিও তোমার বন্ধু হলাম। কী বল?
-একদম।
জামান আজ সারাদিন বাসায়। আনমনে ঘরের টুকিটাকি কাজ করছে। পাশেই সোফায় বসে ম্যাগাজিন পড়ছে রুনা। চিত্রালি ম্যগাজিন। সিনেমার অনেক খবর পাওয়া যায় এতে। দিলরুবার কাছ থেকে ম্যাগাজিন নিয়ে এসেছে। দিলরুবার কাছে বেগম নামেও একটি ম্যগাজিন আসে। ওতে গল্প থাকে। রুনা আহ্লাদ করে জহিরকে বলে চল না বলাকা থেকে সিনেমা দেখে আসি। জামান খোশ মেজাজে আছে। বলল,
– ঠিকাছে চল। তুমি আর আমি কতদিন প্রেম করি না।
– এই বুড়ো বয়সে প্রেম। হুহ ঢং।
– তাহলে যাবা না তুমি?
– আমি কি না করেছি?
– সেই দিন বিকেলে সাজগোঁজ করে লাল রঙের মাঝে সাদা বল বল একটা জর্জেট শাড়ি পরে রুনা জহিরের সাথে বের হলো। সিনেমা দেখবে। বলাকায় কাঁচ কাটা হিরা সিনেমাটি চলছে।
সিনামা দেখে বের হয়ে নিউমার্কেটে গেলো। কিছু খাবে। হট পেটিস নিলো। কথা বলতে বলতে জহির পালইকান্তার প্রসঙ্গ তুলল।
– আমাদের তো অনেকদিন হলো পালইকান্তা যাওয়া হয় না। জমি জমা বাড়ি ঘর কেমন আছে তাও জানি না। অমলেশ বাবুর উপর সব ছেড়ে দিয়ে এসেছি। আমার ভয় লাগে কবে অমলেশ বাবু আমার জমি জমা দখল করে নেয়।
– কী বলছো এসব? উনি আমাদের ভাইয়ের মত।
– কোন মানুষকে এতো বিশ্বাস কর না রুনা। উনার পরিবারের সবাই ভারতে। কখন উনি জমি সম্পত্তি বেঁচে ভারত চলে যাবে তার কোন ঠিক আছে?
– দেখো আমার কখনই মনে হয় না তিনি এমন করবেন। নিলাকে তো আমি আপন বোন মনে করি।
– আচ্ছা ধরলাম নিলা আর অমলেশ বাবু অনেক ভালো মানুষ। কিন্তু তার ছেলে?
– সুব্রত! সে তো বাচ্চাম
– তোমার চোখে বাচ্চা। কিন্তু সে ইতিমধ্যে রাজনীতি করছে। সে তার এক সিনিওর বন্ধুর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সাথে কাজ করছে। সমানে মিটিং মিছিল করে যাচ্ছে ।
– কী বলো?
– তোমার গুনধর ছেলেকে এই কথা বল না। সুব্রত সুমনকে চিঠি দিয়েছিল। সেটা পড়ে আমি এসব জানতে পেরেছি।
– সেই চিঠি কোথায় ?
– আমি ছিড়ে ফেলে দিয়েছি। সুমন এর কাছ পর্যন্ত চিঠি পৌঁছায় নাই। আর সুমনের চিঠি আমি পোস্ট করি নাই। এই চিঠি পেলেও সে আজ রাজনীতি করতো। আমার ভয় লাগে এখানেই। আমরা যখন থাকবো না তখন তোমার ছেলেকে পটিয়ে সব সম্পত্তি লিখে নেয়।
– সে কী! রাজনীতি !
– ভয় পাচ্ছ ?
– হ্যাঁ। আমার ছেলেকে আমি রাজনীতি করতে দিবো না। চোখের সামনে আমি দেখছি পুলিশের গুলিতে ছেলেরা মারা যাচ্ছে।
– তাহলেই বুঝো? আমি চিঠি না পৌঁছে দিয়ে ঠিক কাজ করছি কিনা?
– হম।
– আমি চাই না সুমনের সাথে সুব্রতের আবার দেখা হোক। তাই আমি আমার ভিটা বাড়ি ছাড়া আর সব জমি সম্পত্তি ছাড়া সব জমি বেঁচে দিতে চাইছি। ঘরটা থাক। বাবার স্মৃতি।
– কিন্তু আমরা আর কোন দিন পালইকান্তা যাবো না?
– কেন যাবো না? সুমন বড় হোক। বিয়ে করুক তারপর তো যাবোই। এই জন্যে তো ভিটা বেচবো না।
– তার আগে একবারও না?
– আপাতত না।
রুনার চোখে পানি এসে গেলো। কিন্তু সত্যি তো সুমন সবসময় সুব্রতকে অনুকরণ করে। সুমন জানতে পারে যদি সুব্রত রাজনীতি করে তাহলে সুমন করবে। নাহ আগে ছেলে পরে গ্রাম। জামান সাহেব প্রস্তাব দিলেন,
– চল স্টুডিও তে যেয়ে ছবি তুলি। এই দিনের স্মৃতি থাকুক।
ছবি তোলার কথায় রুনা খুশি হয়ে উঠলো। তার তো তেমন ছবি নেই। একটা ছবি থাকুক।
অষ্টম পর্ব
এদিকে ৭০ এর নির্বাচনে এক ব্যক্তি, এক ভোটের ভিত্তিতে সদস্য সংখ্যা নির্ধারণ আর ফেডারেল পার্লামেন্টারি সরকার ব্যবস্থা কায়েমের কথা হল। জনসংখ্যার ভিত্তিতে জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মাঝে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাপ্য দাঁড়ায় ১৬২। যা পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে ১৪টা বেশি। বঙ্গবন্ধু আওয়ামীলীগের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করলেন। তিনি ৬ দফা বাস্তবায়নের পক্ষে কথা বললেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু সর্ব প্রথম বাঙ্গালী জাতীয়তাবাধের প্রতীক হিসেবে জয় বাংলা শ্লোগান উচ্চারণ করলেন। এবং তারপর পরই পূর্ব বাংলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত জয় বাংলা শ্লোগানে মুখরিত হল। ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ এই পোস্টার কিন্তু এই সময় তৈরি হয়।
এদিকে ইয়াহিয়া খান কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনুমতি দেয়ার আগে জাতীয় পরিষদে যাতে আওয়ামীলীগ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করতে না পারে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন। আওয়ামীলীগ এর বিজয়ের সম্ভবনা কতটুকু আছে তা জানার জন্য সামরিক এবং অন্য গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। রিপোর্টে আসে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামীলীগ ৪০ শতাংশের বেশি আসন লাভের আশা করতে পারে না। এটা ইয়হিয়া খান এবং তার উপদেষ্টাদের কাছে ছিল পরিতুষ্টির উৎস। কিন্তু বাস্তবে নির্বাচনের ফলাফল কী হল জানা যাবে সামনে।
১৯৭০ ১২ই নভেম্বর।
জামান সাহেব রেডিও কানে নিয়ে বসে আছেন এখন একটাই খবর সাইক্লোন। বাংলাদেশের উপকূলের দিকে সাইক্লোন ধেয়ে আসছে। ১০ নম্বর বিপদ সংকেত দেখানো হয়েছে মংলা আর চিটাগাং সমুদ্র বন্দর সহ উপকূলীয় জেলাগুলোকে।
কিছুক্ষণের মাঝেই খবর আসলো সাইক্লোন উপুকূল স্পর্শ করেছে। জামান সাহেব অবাক হলেন এত দেরিতে তাহলে ওয়ারনিং সাইন দেয়া হল কেন? মানুষ কি নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পেরেছে?
সবুজ আর সুমন তখন সুমনের বাসাতেই। তারা আপডেট জানতে আসলো। এই ভয়াবহ খবর তাদের কেও স্পর্শ করেছে। এর আগেও ১৯৬০ সালে ঘূর্ণি ঝড়ে ১৬০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল। জামান সাহেব সবুজ আর সুমনকে বললেন,
– বাবারা নামাজ পড়। এই দুর্যোগে এখন এক মাত্র আল্লাহ বাঁচাতে পারেন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা কর যেন উপকূলের বাসিন্দারা রক্ষা পায়।
রুনা নামাজে বসে গিয়েছেন। এতো বড় দুর্যোগে তো সবারই দুআ করতে হবে। ঢাকাতেও আবহাওয়া ভাল না। সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছে। রাত এভাবেই কেটে গেলো।
সকালে আবার রেডিও ধরলেন জামান সাহেব। ঘন্টায় ১৪৪ কিলমিটার বেগে ঘূর্ণি ঝড়টি বয়ে গিয়েছে বরিশাল, ভোলা চিটাগাংসহ আরও উপকূলীয় এলাকায়। জলোচ্ছ্বাস হয়েছে ৮-১০ ফিট। কিন্তু ক্ষয় ক্ষতি সম্পর্কে এখনো কোন ধারণা পাওয়া যায় নাই।
সেই দিন বিকেলেই আজিমপুর এলাকার একজন বড়ভাই পাভেল একটা সভা ডাকলেন এলাকার তরুন প্রজন্মদেরকে নিয়ে। সবুজ আর সুমন যোগ দিলো সভাতে। পাভেল ভাই ছোট একটা ভাষণ দিয়ে দিলেন।
আমাদের ঈমানি দায়িত্ব এই ঘূর্ণিঝড়ের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা মোকাবেলায় সেই এলাকার মানুষের সাহায্য করা। সরকারী হিসেবে ক্ষয়ক্ষতি এখনো জানানো হয় নাই কিন্তু বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পাওয়া গেছে ক্ষয়ক্ষতি বিশাল। অসংখ্য মানুষ মারা গিয়েছে। আমরা আজকে এখন থেকেই রিলিফ সংগ্রহের কাজে নেমে পড়বো। তোমাদের উদ্দেশ্যে আমার আহবান তোমরা নিজেদের বাসা আর যার কাছ থেকে পারো সাহায্য জোগাড় কর।
এইবার একজন জিজ্ঞেস করলো,
– কী কী জোগাড় করবো?
– যা কিছু। টাকাপয়সা, চাল, ডাল, শুকনা খাবার, কাপড়, মোমবাতি।
সভা শেষ হলে সবুজ বলছে,
– চল কাজে নেমে পড়ি।
সুমন সায় দিলো।
সেদিন সন্ধ্যার মাঝেই সুমন আর সবুজ অনেক রিলিফ জোগাড় করে পাভেল ভাই কে দিয়ে আসলো।
সবুজ বলছে,
– আজকেই পাভেল ভাই কিছু রিলিফ নিয়ে চলে যাবে ভোলা। আমি ভাবছি আমিও যাবো।
– কী বলিস? কত দূরে জানিস?
– তোর থেকে আমার ভূগোল জ্ঞান ভালো। আমি জানি কত দূর। দেশের এতো বিপদে এটুকু কষ্ট আমি করবো না?
– আমিও যাবো।
– তোর কি মাথা খারাপ? জামান চাচা তোকে যেতে দিবে? তুই বরং এখানেই রিলিফ সংগ্রহ কর। সবাই চলে গেলে রিলিফ সংগ্রহ করবে কে?
– সুমন কথা ভুল বলে নাই। রিলিফ তো সংগ্রহ করতে হবে। আর বাসায় হঠাৎ করে রাজি হবে না। কিন্তু সবুজ যাবে? সবুজ এর জন্য চিন্তা হচ্ছে।
– তুই কথা দে সুস্থ থাকবি। অসুস্থ লাগলেই সোজা বাসায় ব্যাক করবি।
সবুজ হেসে বলল,
– কথা দিলাম।
সেই দিন সবুজ ভোলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
১ সপ্তাহ পার হল সবুজ ভোলা গিয়েছে। এদিকে সুমন তার এলাকার আরো ২ টা ছেলের সাথে রিলিফ সংগ্রহ করে যাচ্ছে। সুমন আজকাল সংবাদপত্র পড়ছে রেগুলার। পাকিস্তান সরকারের আচরণে আর দশটা সাধারন মানুষের মত সে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ । পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এতো বড় দুর্যোগের কথা শুনেও ১৪ তারিখ চায়না চলে গেলেন। ফিরলেন ২ দিন পর। কিন্তু দুর্যোগগ্রস্ত এলাকায় গেলেন না। সাইক্লোনের আঘাত হানারও ২ দিন পর পাকিস্তানি আর্মি ত্রান নিয়ে বিভিন্ন দুর্যোগগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছালো। দুর্যোগের এক সপ্তাহ পর শোক পালন করা হল। রিলিফ সংগ্রহের গতি মোটেও সন্তোষজনক নয়। সারা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সাধারণ মানুষের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হল। এদিকে এক সপ্তাহ পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঘোষণা দিলেন যে নির্বাচন ৭ তারিখে অনুষ্ঠিত হবে। শুধু মাত্র দুর্যোগগ্রস্ত এলাকায় গুলোতে ভোট গ্রহণ পরে অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে তাদের ভুল ধারণা ছিল।
১০ দিন পর সবুজ ঢাকা ফিরলো। সবুজকে আর চিনা যায় না। বড় বড় চুল, দাড়ি। শরীর শুকিয়ে কাঠ। গায়ের রঙ তামা তামা হয়ে গিয়েছে। মাথায় উকুন। সুমন তো দেখে হেসেই খুন।
– তোর এই অবস্থা কেন?
আমার অবস্থা বাদ দে। ওখানকার মানুষের অবস্থা যদি দেখতি। আমার চোখে দেখার মত না। খেতে পারে না। খাওয়া নেই। কাপড় নেই। মেয়েরা কোন রকমে আব্রু ঢেকে রয়েছে। বাড়ি ঘর নেই। এই ঠাণ্ডার মাঝে খোলা আকাশের নিচে অসংখ্য মানুষ। বাচ্চারাও আছে। আর লাশের কথা কী বলবো? চারিদিকে লাশ আর লাশ। মানুষের লাশ। প্রায় ৫ লাখ মানুষ মারা গিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে। লাশের গন্ধে টিকা দায়।
– কী বলিস? এতো??
হুম। ক্ষেতের ধান নষ্ট হয়ে গেছে। হাজার হাজার গবাদি পশুর লাশ। জানিস এক লোকের সাথে কথা হল। তিনি ঝড়ের সময় নারিকেল গাছের মাথায় চড়ে বসে ছিলেন। তিনি বাঁচলেন কিন্তু ঝড় থামলে নেমে দেখেন স্ত্রী পুত্র মা কেউ বেঁচে নেই। এখন তিনি দুনিয়াতে একা। উনার কষ্ট দেখা যায় না। এক রাতেই মানুষের সব স্বপ্ন ভেঙ্গে গিয়েছে।
সবুজের চোখ থেকে পানি পড়ছে।
সুমন পরম মমতায় ঘাড়ে হাত রাখলো,
– জানিস আমার কাছে এখনো এই দিন গুলো দুঃস্বপ্নের মত লাগছে। কেমন ঘোরের মাঝে কাটিয়েছি এই কয়দিন। তাহলে ওদের কাছে কেমন লাগে? তারা তো পরিবার পরিজন সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়েছে।
– সবুজ দেখছিস পশ্চিম পাকিস্তানিরা কিভাবে আমাদের অবহেলা করে? আমাদের মানুষ মনে করে? এতো মানুষ মারা গেলো প্রেসিডেন্ট একবারও দুর্গত অঞ্চলে গেলেন না। বরং একটা কথা রটে গিয়েছে ইয়হিয়ার নামে।
– ভাত না পেলে মানুষ রুটি খাক।
পুরো বিশ্ব জানে এই মানবিক বিপর্যয়ের কথা। অথচ রেডিও পাকিস্তানে কিছুই প্রকাশ করছে না। লন্ডন, পিকিং, ওয়াশিংটন, তেহরান ইত্যাদি বেতার কেন্দ্র এই সর্বনাশা জলোচ্ছ্বাসের কথা তুলেছে সেখানে পাকিস্তানের বেতার, টিভি চুপ।
সবুজ দাঁতে দাঁত লাগিয়ে বলল,
– ইনশাল্লাহ আমরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের জবাব দিবো ভোটে। জানিস কার সাথে ওখানে দেখা হল?
কার সাথে?
– সুব্রত। সে একটা ফুলতলা সরকারি কলেজের দলের হয়ে রিলিফ নিয়ে সাহায্য করতে এসেছে। তোর কথা জিজ্ঞেস করলো।
কথা শুনে সুমনের মুখ মলিন হয়ে গেলো।
– আর বলিস না। কবে যে ওর সাথে দেখা হবে।
– আরে মন খারাপ করিস না পরীক্ষা শেষ হলেই তোকে নিয়ে ফুলতলা বেরাতে যাবো।
সুমন মনে মনে ভাবলও জীবনে সে কোন পুণ্য করেছিলো যে এতো ভালো একটা ছেলের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়েছে।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হল পাকিস্তানের সাধারন নির্বাচন। ন্যাপের মাওলানা ভাশানি নির্বাচন বর্জন করলেন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করে। ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনেই জয় পায় আওয়ামী লীগ। প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনেও আওয়ামীলীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করে। প্রাদেশিক পরিষদের ৭টি এবং জাতীয় পরিষদের ১০টি মহিলা আসনেও আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। সর্বমোট ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করার মাধ্যমে আওয়ামীলীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। অপরদিকে জুলফিকার আলীর পাকিস্তান পিপলস’ পার্টি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৮৮টি আসনে জয়লাভ করে।
নির্বাচনের ফলাফল শুনার পর থেকে সবুজের বাসায় ঈদ। সেই উপলক্ষেই শুক্রবার সবুজের বাসায় ছোট পার্টি। সবুজের আব্বা রশিদ সাহেব বহু আগে থেকে আওয়ামীলীগের সমর্থক। সুমন খবর পেয়ে চলে এসেছে। সেও সেরকম খুশি। মুনা বিশেষ বিশেষ রান্না করেছেন। তার মাঝে আছে মুরগীর রোস্ট আর চিংড়ির মালাইকারি।
খাবার টেবিলে বসে খেতে খেতে রশিদ সাহেব গল্প করছেন। রাজনীতির আলোচনা তিনি ছেলের সাথে করতে পছন্দ করেন। তিনি বলছেন,
– শেখ মুজিবুর রহমান তো ৬ দফার ভিত্তিতেই সংবিধান প্রনয়ন করবেন। ১৯ তারিখ তো তিনি তাই বললেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা কি করতে দিবে তা?
– বাবা আমার মনে হয় পশ্চিম পাকিস্তানীরা কিছুই করতে পারবে না। এখন তো আমরাই সরকার গঠন করবো।
সুমন এইবার মুখ খুলল,
– পিপলস পার্টির ভুট্টো তো ঘোষণা দিয়েছেন তার দলের সমর্থন ছাড়া সরকার গঠন করা যাবে না। ভুট্টো তো এক প্রকার বলেছেই ৬ দফার রাজনৈতিক কাঠামোতে বাঙালি দের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়া যাবে না। এদিকে বঙ্গবন্ধু বলেছেন শাসনতন্ত্র ৬ দফার ভিত্তিতে হবে।
মুনা এসে বাগড়া দিলো,
– তোমরা খাওয়া শুরু করলা না? সব তো ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
খাওয়া শেষে ছাদে রোদ পোহাতে গেলো সবুজ আর সুমন। সবুজ বলছে,
– তোর কি মনে হয় ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু কে ক্ষমতায় বসতে দিবে?
– কেন দিবেন না। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে আওয়ামীলীগ।
– কিন্তু আমার কেন জানি বিশ্বাস হয় না।
– আরে বাদ দে তো। রাজনীতির আলোচনা বাদ দে। চল সিনেমা দেখে আসি। বলাকায় রাজ্জাক, সুচন্দার জীবন থেকে নেয়া চলছে।
– চল দেখে আসি। আমারও সিনেমাটা দেখার খুব ইচ্ছা।
দেখতে দেখতে দিন কেটে যাচ্ছে। টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছে সবুজ আর সুমনের। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি নাই। ইয়াহিয়া খান ১৩ই ফেব্রুয়ারি ঘোষণা দিলেন ৩রা মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। তিনি ১৭ তারিখ বেসামরিক মন্ত্রী সভা ভেঙে দিলেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ ঘটলো অন্য ঘটনা।
জামান সাহেব বসে রেডিও শুনছিলেন। কিন্তু হঠাৎ একটা ঘোষণা শুনে তিনি রাগে ফেটে পড়লেন।
রুনা দৌড়ে আসলেন।
– কী হয়েছে?
– ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেছেন। বলেছেন পূর্ব আর পশ্চিমাঞ্চলের নেতাদের মধ্যে দুঃখ জনক মত বিরোধের কারণে পরবর্তী তারিখ ঘোষণা করা না পর্যন্ত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখা হল।
– কী? তার মানে মুজিব ক্ষমতা পাবে না?
– অনেকটা সেই রকমই।
রুনাও ক্ষোভে কাঁপছে।
– ওরা কী পাইসে? যা খুশি তাই করবে? আমরা মানবো না।
– ঠিক বলেছ এখন আমাদের প্রতিবাদ করার সময় এসেছে।
এই সময় ঘরে ঢুকলো সুমন।
– বাবা রাস্তার অবস্থা দেখেছো ?
– কী হয়েছে?
– হাজার হাজার মানুষ রাস্তায়। লাঠি হকিস্টিক আছে অনেকের হাতে। ইয়াহিয়ার ঘোষণার প্রতিবাদ করছে।
– চল দেখি। আমরাও বের হই। আজ প্রতিবাদ না করলে আমরা মানুষ না।
সবুজও এসে জুটলো তাদের সাথে। রাস্তায় প্রতিবাদরত ক্ষুব্ধ মানুষ। কারো হাতে হকিস্টিক, কারো হাতে লাঠি। ব্যবসায়ীরাও দোকানপাট বন্ধ করে রাস্তায় নেমেছে।
এদিকে আরও শোনা গেল ওই দিন পাকিস্তানী জাতীয় ক্রিকেট টিম এবং এমসিসির মাঝে খেলা চলছিল। বিক্ষুব্ধ জনতা পাকিস্তানের পতাকা স্টেডিয়ামে পুড়িয়ে দেয়।
আওয়ামীলীগ ঘোষণা দিলো ২ আর ৩ তারিখ হরতাল আর ৭ ই মার্চ রেসকোর্সে ভাষণ দিবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বাড়ি যাওয়ার পথে সবুজের হাতে কে জানি একটা প্রচারপত্র ধরিয়ে দিলো। সুমন উৎসুক হয়ে বলল,
– দেখি দেখি কী?
– লিখা ৬ দফা নয় ১ দফা (স্বাধীনতা) চাই।
সবুজ আর সুমন ২ জনের মাথায় একই কথা ঘুরছে। তাহলে কি এখন স্বাধীনতাই লক্ষ্য হওয়া উচিত?
মার্চের ৩ তারিখ থেকে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। ২ আর ৩ তারিখের হরতালে হাজার হাজার মানুষের প্রতিবাদী ঢল নামলো রাস্তায়, বাসার ভিতর থেকেই সুমন শ্লোগান শুনতে পারছে,
“বীর বাঙালি অস্ত্র ধর – বাংলাদেশ স্বাধীন কর”
”ইয়াহিয়া ইয়াহিয়া – নিপাত যাক নিপাত যাক”
“পার্লামেন্ট বন্ধ করা -চলবে না চলবে না”
“ইয়াহিয়ার ঘোষণা- মানি না মানবো না”
“ইয়াহিয়ার গদিতে আগুন জ্বালো এক সাথে”
“তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা”
“ঢাকা না পিন্ডি – ঢাকা ঢাকা”
সুমনেরও শ্লোগান শুনে মিছিলে নেমে যেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু বাসা থেকে দিবে না।
নবম পর্ব
৭ই মার্চ সকালবেলা থেকেই সুমন প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজকে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিবেন রেসকোর্স এর মাঠে। সুমন ভাষণ শুনতে যাবে। জামান সাহেবও যাবে। রুনা যেতে চাইলো। একটা শাড়ি বের করেছে পরার জন্য। জামান সাহেব না করলেন। বললেন,
– তোমার আর যেয়ে কাজ নেই। রেডিও তে শুনাবে। ওখানেই শুনো ।
এদিকে গতকাল পূর্ব পাকিস্তানের ভাইস এডমিরাল আহসান কে সরিয়ে লেঃ জেনারেল টিক্কা খান কে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়েছে। সুমনের প্রশ্ন,
– টিক্কা খান কি আগের গভর্নরের থেকে ভাল হবে?
জামান সাহেব বললেন,
– যা লাউ তাই কদু। উলটা টিক্কা খান বালুচ হত্যাকারি। বালুচিস্তানের কসাই।
ঠিক এই সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। সুমন যেয়ে দরজা খুলল। এ কাকে দেখছে সে? সুব্রত হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটি ট্রাভেল ব্যাগ।
– আরে তুই!
– হ্যাঁ এসে পরলাম বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনার জন্য।
রুনা ছুটে আসলো। সে বলল,
– হ্যাঁ রে সুব্রত এত দিন পর আমাদের কথা মনে পড়লো?
পিছন থেকে জামান সাহেব উঁকি দিলেন। খুব বিরক্ত। বিরক্তে কপালে ভাঁজ পরে গিয়েছে। সে বিরক্তির সাথে বলল,
– বাবা এত গণ্ডগোলের মধ্য ঢাকা আসার কি দরকার ছিল।
রুনা ক্ষেপে গিয়ে বলল,
– তুমি যে কী! ছেলেটা এত দূর থেকে এসেছে! কই ভাল মন্দ ২টা কথা জিজ্ঞেস করবা। না সব উলটা পালটা কথা।
সুমন তখনো বিশ্বাস করতে পারছিল না। সুব্রত কি সত্যি এসেছে। রুনা সুব্রতকে একটা গামছা দিয়ে বলল,
– যা ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি খাবার দিচ্ছি টেবিলে।
সুব্রত গিয়ে ঢুকলো বাথরুমে। সুমনের কেমন জানি ঈদ ঈদ লাগছে। কতদিন পর দেখলো সুব্রতকে। কত কথা বলার আছে! সব কি চিঠিতে লেখা যায়!
এদিকে জামান সাহেব ভাবছেন এই আপদ কতদিন থাকবে। তিনি তো ভেবেছেন চিঠি লুকিয়ে তিনি সুব্রত আর সুমনের সম্পর্ক নষ্ট করে দিয়েছেন। কিন্তু কই! সুমন দেখি সুব্রতকে দেখে কী কী করবে সেই আনন্দে দিশা পাচ্ছে না। আর এদিকে তার মাথা মোটা স্ত্রী রুনাও এত উচ্ছসিত হয়ে পড়েছে যেন তার বাপের বাড়ির লোক এসেছে।
সুব্রত হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলো। পুরোটা সময় রুনা অমলেশ বাবু আর নিলার কথাই জিজ্ঞেস করে গেলেন। রুনা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কতদিন গ্রামে যান না। তার সেই লিচু গাছটা। পুকুর ঘাট। গোয়ালের গরু। সব কিছুই তিনি মিস করছেন।
এদিকে ২ টা বাজে বাজে। জামান তাড়া দিয়ে সুব্রত আর সুমন লকে নিয়ে বের হলেন রেসকোর্স ময়দানের উদ্দেশ্যে। হাজার হাজার মানুষ মিছিল করে রেসকোর্সের ময়দানের দিকে যাচ্ছে। সমাজের সকল স্তরের মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, রিকশা চালক, ছাত্র, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, এমনকি সাদা পোশাকে ইপিআর সদস্য পর্যন্ত। নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু সবাই রয়েছে। তাদের হাতে ব্যানার, বাঁশের লাঠি, নতুন পতাকা পর্যন্ত রয়েছে। সবুজ পটভূমিতে লাল সূর্যের মাঝে সোনালি রঙের বাংলাদেশের মানচিত্র অঙ্কিত পতাকা অনেকের হাতেই শোভা পাচ্ছিলো। লক্ষ লক্ষ মানুষের কণ্ঠে একই বজ্রধ্বনি, ‘জয়বাংলা’।
সুব্রত উত্তেজিত হয়ে সুমন কে বলছে,
– অনেকেই নাকি বলছে আজকে নাকি বঙ্গবন্ধু এই সমাবেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন।
সুমন মাথা নেড়ে বুঝালো কিছু শোনা যাচ্ছে না। আসলে এত মানুষের মাঝে কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।
এদিকে রেসকোর্সে এসে সবুজের সাথে মিলিত হবার কথা ছিল। কিন্তু এত লক্ষ লক্ষ মানুষের মাঝে সবুজকে পাওয়া সম্ভব নয়। সুমন, সুব্রত এবং জামান রেসকোর্স ময়দানের ঘাসের উপর বসে পড়লো। চারিদিকে নানারকম শ্লোগানের শব্দ শোনা যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু যখন মঞ্চে উঠলেন তখন জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠলো। সাড়ে তিনটার দিকে বঙ্গবন্ধু শুরু করলেন তার পৃথিবী বিখ্যাত ভাষণ।
এই ভাষণের একেকটা লাইন শুধু কানে যাচ্ছে তা নয়। সমস্ত শরীরকে আলোড়িত করে তুলছে। সুমন অনুভব করছে তার গায়ের পশম খাঁড়া হয়ে যাচ্ছে। ভাষণের একেকটা বাক্য কবিতার একেকটি লাইনের মত। একেকটা কথাকে বিশ্লেষণ করলে একেক মানে বের হয়। ভাষণের প্রতিটা কথায় ভীষণভাবে উদ্দীপিত হচ্ছিল পুরো সমাবেশ।
বঙ্গবন্ধু যখন বললেন, “বাংলার ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুল, যার যা আছে তা দিয়েই শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে”।
পুরো সমাবেশ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক প্রতি ক্ষোভে ফেটে পড়লো। প্রমাণ করে দিল বাঙালি ভীতু নয়। সময় আসলে অস্ত্র ধরতে বাঙালি পিছুপা হবে না।
সুব্রত পুরাই বিস্মিত। এত বড় সমাবেশ হবে কল্পনাই করে নাই। তার উপর বঙ্গবন্ধুর এই বজ্রধবনি তাকে মোহাবিষ্ট করে ফেলেছে। বঙ্গবন্ধু যখন বললেন,
“রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দিবো, এই দেশের মানুষ কে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ”।
তখন আপনা আপনি হাত মুঠোবন্দি হয়ে যায়। সুব্রত ভিতরে তখন অন্য একটা অনুভূতি জেগে উঠে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছ থেকে যে কোন মূল্যে দেশ কে রক্ষা করতে হবে।
ভাষণ শেষ হবার পর জামান সাহেব পর্যন্ত চুপ। তাদের মনের ভিতর ঝড় চলছে। বঙ্গবন্ধুর বজ্র নিনাদ এখনো তাদের কানে বাজছে।
“এইবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এইবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
বাড়ি গিয়ে দেখে রুনা মন খারাপ করে বসে আছে। রেডিওতে নাকি প্রচারিত হয় নাই ভাষণ।
– সে কি এতবার বলার পরও প্রচারিত হল না। জামান সাহেব বিস্মিত।
সুমন বলল,
– আরে আম্মু মন খারাপ কর না। আমি সব তোমাকে বলছি।
এই বলে সুমন রুনা কে বঙ্গবন্ধু ভাসনে কী কী বলেছেন তা বলতে থাকলো।
সন্ধ্যার দিকে সুব্রত আর সুমন নিউমার্কেটে গেল মনটাকে একটু শান্ত করতে। সুব্রত ক্রিম রোল খুব পছন্দ করে। লাইটের ক্রিম রোল সবচেয়ে ভাল। সেখানে যেয়ে বসলো ২ জন। সুমন বলছে,
– কত দিন পর তোকে দেখলাম।
– আমিও তোকে সেই কবে দেখেছি।
– আমাকে দেখতে তোর মন চায় না
– কে বলেছে
– তাহলে মাঝে মাঝে আসিস না কেন?
– পড়ার চাপ। তার উপর রাজনীতি। আর ঢাকা ভার্সিটি তে ভর্তি হলে তো প্রতিদিন দেখা হবে। একটা বছরের ব্যাপার মাত্র।
– এইবার কতদিন থাকবি?
– কাল চলে যাবো।
– সে কি?
– আমার আসলে ঢাকা ভারসিটিতে একটা কাজ আছে। ওখানে জগন্নাথ হলের এক বড় ভাইয়ের রুমে থাকবো কয়েকদিন।
– কী কাজ?
– হাইলি কনফিডেনশিয়াল। পরে সব খুলে বলবো তোকে।
– আরেকদিন থাক না প্লিজ।
– এইবার না। এরপরের বার অনেক সময় নিয়ে আসবো ।
– প্রমিজ?
– পাক্কা প্রমিজ।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সুমন। সুব্রত এইবার সুমনের থুতনি টা নেড়ে বলল,
– এই যে বাবু তুই ঠিক আগের মতই আছিস। কিউট। বাবু বাবু।
– হয়েছে। এখন এসব বলে মান ভাঙাতে হবে না।
– বুঝেছি ভাল কথা বললেও দোষ।
– আমি অনেক মিস করি রে তোকে।
– আমি কী করি না? বাবা মায়ের পর তুই তো আমার সবচেয়ে আপন মানুষ। দেখবি আমি ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হই সব ঠিক হয়ে যাবে। আর তোর কিন্তু ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি হতে হবে।
সুমন হাসলো,
– এইতো তোকে হাসলে কত সুন্দর দেখায়। তোর গালে টোল পরে। ইচ্ছে করে ছুঁয়ে দেই
– হয়েছে আর পাম্প দিতে হবে না। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। চল উঠি ।
– চল
বাড়ি ফিরে রেডিও খুলে বসলো তারা। ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকেছে ২৫ শে মার্চ। পুরাতন খবর গতকালকের।
সুমন বলল,
– এতবার বলার পরও ভাষণটা রেডিও তে প্রচার করা হল না কেন?
– কী জানি নিষেধ করেছে হয়তো ইয়াহিয়া সরকার।
রাত হতেই কম্বল মুরি দিয়ে শুয়ে পড়লো ২ জন। কিন্তু ঘুম কী আর আসে। কত রাজ্যের কথা জমে আছে। এই গল্প, সেই গল্প। গল্প আর শেষ হয় না। শেষ রাতের দিকে তারা আর নিজদের ভালবাসাকে আর সীমাবদ্ধ করে রাখতে পারলো না। ২ জন গভীর চুম্বনে আবদ্ধ হল।
সকালে নাস্তা করেই জগন্নাথ হলের উদ্দেশ্যে রওনা দিল সুব্রত। সুব্রত বের হয়ে যাবার পর রুনা মন মরা হয়ে রেডিও ছাড়লো। ছাড়তেই চিৎকার শুরু করলো।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করা হচ্ছে শুনছো ?
চিৎকার শুনে সুমন আর জামান ছুটে আসলো। আরে তাই তো গত কালকের ভাষণ প্রচার করা হচ্ছে। খুশিতে চিৎকার করে উঠলো সুমন।
– পুরো বাংলাদেশের মানুষ এখন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে পাচ্ছে।
হঠাত দরজায় ধাক্কা। সুমন দরজা খুলল। দিলরুবা দাঁড়িয়ে আছে। দিলরুবা বলল,
– তোমাদের একটা খুশির খবর দিতে এলাম। ২৪ তারিখ আমার দুই মেয়ের বিয়ে। তোমাদের দাওয়াত করলাম আর কী।
রুনা বলল,
– দিলু দি ভিতরে এসে বসেন।
– না আজকে আর বসবো না রে। আমি পরে এসে সব বিস্তারিত বলে যাবো রুনা। তখন কথা হবে।
দিলরুবা চলে গেলে রুনা একা একাই গজ গজ করছে।
– এই গণ্ডগোলের মাঝে বিয়ে। আহারে মেয়ে ২টার কপাল খারাপ। দিলুদিকেও একটুও খুশি মনে হল না। না দিলুদির সাথে কথা বলতে হবে। আর কিছু গহনাও কিনতে ইচ্ছা হচ্ছে। সেটাতেও পরামর্শ দরকার।
২ দিন পরের কথা।
দিলরুবা বসে আছে রুনার সামনে। চোখ মুখ বসে গিয়েছে। বুঝাই যাচ্ছে মন খারাপ। কান্নাও করেছেন তিনি।
– বুঝলা রুনা, মেয়ে ২টা আসলে আমার না। আমি সৎ মা। কিন্তু মেয়ে ২টাকে নিজের মেয়ের থেকে কম কিছু ভাবি নাই। আজ এই মেয়ে ২টার এত বিপদ আমি কিছুই করতে পারছি না।
রুনা দিলরুবাকে কাঁদতে দিলেন কারণ তাতে বুকটা হালকা হবে। এক গ্লাস লেবুর শরবত করে আনলো রুনা দিলরুবার জন্য। দিলরুবা ঢক ঢক করে শরবতটুকু খেয়ে নিলেন।
– আরও দিবো দিলুদি?
– দাও।
রুনা আরেক গ্লাস করে আনলো। দিলরুবা এইবার একটু শান্ত হলেন তারপর আবার বলতে লাগলেন।
– আমার মেয়ে ২টাকে টাকার লোভে এই ভাবে ২ বিহারির সাথে বিয়ে দিবে আমি কল্পনাতেও কক্ষনো ভাবি নাই। আমাদের সাথে কি বিহারি দের মিলে? আমার মেয়ে ২টা কি অমন পরিবারে যেয়ে বাঁচতে পারবে? দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। তাদের সংস্কৃতি আর আমাদের সংস্কৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। শুধু ধর্ম এক এই দোহাই দিয়ে বিয়ে দিলেই কি বিয়ে সুখের হয়?
– আপনি ভাইজানকে বুঝান। এখনো সময় আছে।
– আর কিছু বুঝানোর নেই। এই বিষয়ে কথা বললে এখন সে আমার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলে। একটা অমানুষ হয়ে গিয়েছে।
– এখন আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়েছি। শোনো, বিয়ের সময় আমাকে একটু সাহায্য কইর। সব কাজ এক হাতে করতে পারবো না। এখন তাহলে উঠি।
দিলরুবা চলে গেলে রুনা ভাবছে বাবা এমন পশুর মতন হয় কিভাবে। টাকার লোভে বিহারি পাত্রের সাথে বিয়ে দিচ্ছে। সত্যি কথাই তো তাদের সাথে আমাদের কিছুই মিলে না। কিভাবে মেয়ে দুইটা মানিয়ে নিবে ওই সংসারে?
দশম পর্ব
আলোচনার নামে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করলেন। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তা মেনে নিল না। তারা অসহযোগ আন্দোলন করতে লাগলো। ১৬ই মার্চ, ১৭ই মার্চ ইয়াহিয়ার সাথে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক হল। কিন্তু আলোচনা ফলপ্রসূ হল না। জনগন ইয়াহিয়াকে আর বিশ্বাস করতে পারছিল না। ২২ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আবার জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলেন।
২৩শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের ঘরে ঘরে লাল সবুজ পতাকা উড়লো। সেদিন ছিল পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস। কিন্তু পাকিস্তানের পতাকা উড়লো না ঘরে ঘরে।
সবুজ আর সুমনও ব্যাতিক্রম নয়। তারা লাল, সবুজ আর হলুদ কাপড় জোগাড় করে সবুজের বাসায় বসে পতাকা বানাতে বসলো। সবুজ আর লাল কাপড় জামানের গজ কাপড়ের দোকান থেকে সংগ্রহ করেছে সুমন। আর হলুদ কাপড় সবুজের বাসাতেই ছিল। অনেকক্ষণ লাগিয়ে ২টা পতাকা তৈরি করলো তারা। যদিও লাল সূর্যের মাঝখানে হলুদ রঙের বাংলাদেশের মানচিত্র খুব একটা সুন্দর হল না।
চল ছাদের যেয়ে উড়িয়ে দেই।- প্রস্তাব দিল সবুজ।
ছাদে এসে পতাকা উড়ানোর পর তাদের ২ জনেরই খুব গর্ব অনুভূত হতে লাগলো। মনে হল দেশের জন্য কাজ করার এই সূচনা হল।
সুমন ভাবছে দিলরুবা কি তার ছাদে পতাকা উড়াতে দিবে? সেখানে তো বিয়ের আসর বসেছে। সারা বাড়িতে উৎসব। লাল , নীল মরিচ বাতি দিয়ে সাজান হয়েছে পুরো বাড়ি। সুমনকে চুপ থাকতে দেখে সবুজ বলে উঠলো,
– এই কী ভাবছিস?
– আরে কিছু না। চল বাইরে যেয়ে দেখি সবাই কেমন পতাকা উড়ালো।
রাস্তায় নামতেই দেখা যাচ্ছে মানুষের হাতে এই নতুন পতাকা। রাস্তার ধারে প্রায় সব বাড়িতে পতাকা উড়ছে। কোন কোন বাড়িতে সাথে সাথে কালো পতাকাও উড়ছে। রাস্তায় পাকিস্তানের পতাকা জ্বালানো হচ্ছে। সাথে জিন্নাহর কুশপুত্তলিকাও।
শহীদ মিনারে যেয়ে বসলো সবুজ আর সুমন। বাদাম খেতে খেতে কথা বলছে তারা। সবুজ বলছে,
– আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু তুই। তোর মত একজন বন্ধু আমার জীবনে আসবে আমি কখনোই ভাবি নাই। তুই আসার আগে আমি একদম একা ছিলাম। তুইই আমার জীবনে আলো আনলি। তোকে আমি অনেক অনেক …
তারপর চুপ হয়ে গেল সবুজ। সুমন জিজ্ঞেস করলো,
– অনেক অনেক কী?
– কিছু না রে
– হঠাৎ এসব বলছিস?
– কেন জানি মনে হচ্ছে বলি। পরে যদি সময় না পাই। আমার সিক্সথ সেন্স খুব প্রবল। যা ইন্টিউশন করি তার অনেকটাই ফলে।
– কী যে বলছিস। সময় পাবি না কেন? আমি কি আজই মরে যাব? আর তুইও আমার জীবনে কত গুরুত্বপূর্ণ তা তুই জানিস না। তুই না থাকলে সুব্রতের সাথে আমার সম্পর্ক আর জোড়াই লাগতোই না।
– সব ক্ষেত্রে সুধু ঐ সুব্রত। কেন আমার নিজেস্বত্বা বলে কিছু নাই?
– কী বললি? বুঝলাম না।
– আরে কিছু না। বাদ দে।
তারপর চুপ হয়ে গেল সবুজ। সুমন দুশ্চিন্তায় পরে গেল। কী হল সবুজের। কী বলছে। মাথা মুন্ডু নেই। সুমন সবুজকে জিজ্ঞেস করলো,
– কী ব্যাপার চুপ হয়ে গেলি যে?
– এমনি। আমি আসলে সুব্রতকে হিংসা করি। তুই সুব্রতকে ভালবাসিস। আমাকে না।
– এসব কী বলছিস। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তোর জায়গা আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সুব্রতের স্থান এক জায়গায়, তোর স্থান আরেক জায়গায়।
– কিছু আমি সুব্রতের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তো নয়। যাক সিগারেট ধরানো দরকার।
– এই বাজে অভ্যাসটা করলি কেন?
– এখন গুরুজনদের মত জ্ঞান দিস না। আমি উঠি। তুই থাক।
এই কথা বলে উঠে দাঁড়ালো সবুজ। তারপর কোন কথা না বলে হন হন করে সামনে হেঁটে চলে গেলো ।
পিছন থেকে সুমন কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এই সব কী কথা বলে গেলো সবুজ। সুমন ভাবলো পরের দিন সবুজের বাসায় যেয়ে সব কিছু পরিষ্কার করে আসতে হবে। কিন্তু পরের দিন যে সুমন মাইগ্রেনের ব্যাথায় বাসা থেকে বের হতে পারবে না তা কি আর আগে থেকে জানতো? আর সেই যে কথা হল আর কী কথা হবে??
সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরেই সুমন দেখলো কিছু বিহারি বাড়িতে ঢুকছে। কালো কুর্তা পাজামা পরা। সুমন বুঝলো এরা বরপক্ষের লোকজন। তাদের চোখের দিকে তাকালেই কেমন নিষ্ঠুর মনে হয়। তার হাতে পতাকা দেখে কেমন ক্রুদ্ধ চোখে তাকাচ্ছিল একজন। সুমন দ্রুত বাড়িতে ঢুকলো।
রুনা, সুমন কে দেখে চিৎকার করে উঠলো
– কই ছিলি সারাদিন?
– কই আবার সবুজের বাসায় ছিলাম।
– সারা দিন সবুজের বাসায়। কেন তোর নিজের বাসা নাই? দেশের অবস্থা ভাল না। এত বাইরে ঘুরাঘুরি কিসের?
সুমন এসব কথার জবাব দেয় না। কোন কথা না বলে নিজের ঘরে চলে গেল সে। সুমন ভাবছে বিহারি লোকটার কথা। তার দিকে এইভাবে তাকালো কেন? অবশ্য বিহারিরা কখনোই বাঙালিদের বন্ধু ছিল না। তারা সবসময় পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথেই আছে।
পতাকা লাগানো এখন ঠিক হবে না। আর লাগাতে দিবে বলেও মনে হয় না। বিয়ে বাড়িতে ঝামেলা করার কোন মানে হয় না। পতাকা টেবিলের উপর রেখে শুয়ে পড়লো সুমন। সবুজের কথাগুলো ভাবছে। সবুজ কি তাকে ভালবাসে? কিন্তু কখনো তো প্রকাশ করে নাই। আজ কী হল তার। এসব ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো সুমন।
রুনা একমনে সেলাই করছিল। হঠাৎ দরজায় ধাক্কার শব্দ। এত রাতে কে এলো । দরজা খুলতেই দেখলো দিলরুবা দাঁড়িয়ে আছে।
– দিলুদি আপনি?
– চল শাড়ি, গহনা দেখবে। বরপক্ষ পাঠিয়েছে।
দিলরুবাও আজ কম সাজে নাই। নীল কাতান শাড়ি, বড় ঝুলানো হার। টিকলি। নাকে সোনার নথও পরেছে। হাতে বড় বড় বালা, কানে লম্বা লম্বা ঝুলানো কানের দুল। খোঁপায় পরেছে রজনীগন্ধা। খুব সুন্দর লাগছে দিলরুবা কে।
রুনারও বিয়ের শাড়ি গহনা দেখার ইচ্ছা হল। দিলরুবার সাথে উপরে গেল। সারা বাড়ি হলদে গাঁদা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। মেঝেতে আলপনা। ২ জমজ মেয়ে কে দেখা গেল হলুদ রঙের জামদানি শাড়ি পরে আর ফুলের গহনা পরে বসে আছে। আর ২ জন মেয়ে তাদের হাতে মেহেদি লাগিয়ে দিচ্ছে।
রুনাকে নিয়ে দিলরুবা নিজের ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে একটা সুটকেস রাখা। সেখান থেকে এক এক করে শাড়ি বের করতে লাগলো দিলরুবা।
সবগুলো শাড়ি দামি। বিয়ের শাড়ি ২টা অত্যন্ত জমকালো। অনেক দামও হবে। কিন্তু রুচিতে মনে হয় কিছু ঘাটতি রয়েছে। যে কিনেছে সে মনে হয় দাম দেখে কিনেছে। কিন্তু তার রুচিবোধ নিয়ে সন্দেহ আছে।
গহনাগুলো খুব ভারি। এত ভারি ভারি গহনা পরে মেয়ে ২টা এতক্ষণ কিভাবে থাকবে?
কেমন করে থাকবে কে জানে। একটা গহনা বেশ সুন্দর। একটা সিতা হার। রুনা উলটে পালটে দেখছিল। হঠাৎ দিলরুবা রুনার কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
– মেয়েদের বাঁচানোর উপায় পেয়েছি। কাল তোমার সাহায্য লাগবে।
রুনা ঢোক গিলল। ভয় পাচ্ছে কী সাহায্য চাইবে রুনা। সে জিজ্ঞেস করলো,
– কী সাহায্য আপা?
– কালকেই বলবো। একটু ধৈর্য্য ধর।
রুনা সেদিনের মত দিলরুবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরলো ।
২৪ মার্চ। আজ রাতে দিলরুবার ২ মেয়ের বিয়ে। রুনা আগে থেকেই রেডি হয়ে আছে। সেজেগুজে উপরে যেতে হবে বিয়ের দাওয়াত খেতে। মনটা অবশ্য খারাপ। মেয়ে ২টা এত সুন্দর। অথচ বিয়ে হচ্ছে কেমন পরিবারে। শাড়ি গহনা দেখেই তাদের রুচি বুঝা হয়ে গিয়েছে রুনার। হঠাৎ দরজা ধাক্কানোর শব্দ। কে এলো রাতের বেলা। দরজা খুলতেই দেখলো দিলরুবা দাঁড়িয়ে আছে। মুখ কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। আর চিন্তিত মনে হচ্ছে। পাশে আপাদ মস্তক বোরখা পরা ২ টা মেয়ে দাঁড়ানো। দিলরুবা ফিস ফিস করে বলছে,
– তাড়াতাড়ি ঢুকতে দাও। কেউ দেখে ফেলার আগেই।
রুনা সরে দাঁড়ালো। দিলরুবা আর ২ জন মেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে গেল। তারপর দিলরুবা দ্রুত সদর দরজা বন্ধ করে দিল। রুনাকে দিলরুবা বলল,
– শোন মেয়ে দুইটাকে তোমার কাছে রেখে গেলাম। তোমার কাছে আমার আমানত। আধা ঘণ্টা পর তুমি এদের নিয়ে গলির মোড়ে যাবে। সেখানে দেখবা একটা কাল ভক্স ওয়াগন গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সেই গাড়িটা আমার বোনের। সেখানে আমার বোনও থাকবে। তুমি সহ এই ২ জন গাড়িতে উঠে যাবা। ১০ -১৫ মিনিট পর তুমি বকশীবাজারের মোড়ে নেমে যাবা। সেখান থেকে কিছু কিনবা। পরে বোরখা খুলে ফেলে বাজার সদাই নিয়ে রিকশা করে বাসায় ফেরত আসবা। তাহলে কেউ তোমাকে সন্দেহ করবে না।
এতক্ষণ মন্ত্র মুগ্ধের মত শুনছিল সব রুনা। তার কাছে পুরো ব্যাপারটা একটা সিনেমার দৃশ্য মনে হচ্ছে। রুনা ভীত গলায় বলল,
– কিন্তু ওরা যদি আমার বাসায় খুঁজতে আসে তাহলে তো ধরা পরে যাব।
– এত তাড়াতাড়ি ওরা টের পাবে না। এখন ওরা মদ্য পান করতে ব্যস্ত। আর তোমার বাসায় ওরা লুকিয়ে আছে এটা ওরা ভুলেও ভাববে না না।
– গাড়ি ওদের নিয়ে কই যাবে?
– কমলাপুর স্টেশনে। সেখান থেকে ময়মনসিংহ। প্লিজ বইন এই কাজ টা কর। আমি চির কৃতজ্ঞ থাকবো আর শোন তুমি কিন্তু ৯ টার মাঝে সেজেগুজে আমার বাসায় দাওয়াত খেতে আসবে। তুমি তো আপাতদৃষ্টিতে জানো না যে পাত্রী ২ জনেই পালিয়ে গিয়েছে।
– কিন্তু আমি কি পারবো ?
– পারবে। তোমাকে পারতেই হবে।
দিলরুবা চলে যাবে। মেয়ে ২ টার সেই কী কান্না। কোন সৎ মায়ের জন্য কেউ এত ভালবাসা দিতে পারে তা রুনার ধারণার বাইরে ছিল।
দিলরুবার চোখেও জল।
– আরে কাঁদিস কেন? অল্প কিছুদিনের মাঝেই তোদের সাথে ময়মনসিংহতে আবার দেখা হবে।
– দিলরুবা চলে গেল।
রাত বাজে ৮ টা। ঘড়িতে ঢং ঢং আওয়াজ জানিয়ে দিচ্ছে তা। মেয়ে ২ টা কে ঠিক মত গাড়িতে উঠিয়ে বকশীবাজার হয়ে কিছু বাজার সদাই নিয়ে বাড়ি ফিরেছে রুনা। মেয়ে ২ টার কান্না ভেজা কৃতজ্ঞ চোখ এখনো তার চোখে ভাসছে। মনে হচ্ছে একটা পূণ্য করে এসেছে। বাড়ি ফিরে আবার সাজগোজ করে রুনা সুমন সহ গেল দিরুবার বাসায়। কিন্তু সেখানে তখন ভীষণ গণ্ডগোল। ২জন পাত্রি পালিয়েছে এটা জেনে গিয়েছে মেয়ের বাবা এবং পাত্র পক্ষ। দিলরুবা এমন ভাব করছে যে সে কিছুই জানে না। রুনা উপরে উঠতেই দিলরুবা চোখের ইশারায় জানতে চেয়েছে সব ঠিক আছে কিনা? রুনাও চোখের ইশারায় সব জানালো যে সব ঠিক আছে, এদিকে বিহারি পাত্রপক্ষ খুব ঝামেলা করলো। ওরা উর্দু ভাষায় ভীষণ গালিগালাজ করে গাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছে। আর হুমকি দিয়ে গেল যে তারা এই অপমানের শোধ নিবে।
রাত বাজে ১০ টা।
দরজায় ধাক্কাধাক্কির শব্দ। রুনা গিয়ে দরজা খুলল। আপন মনেই বলছে এত রাতে কে এলো। এ আর কেউ নয়। দিলরুবা। হাতে খাবারের ট্রে।
– তখন তো গণ্ডগোলের মাঝে তোমাদেরকে ঠিক মত খাওয়াতে পারি নাই। তাই খাবার দিতে এলাম।
– এসবের কী দরকার ছিল আবার!
এইবার দিলরুবা খাবারের ট্রে-টা রেখে রুনার ২ হাত ধরে ফিসফিস করে বলছে,
– আসলে তোমাকে ধন্যবাদ দিতে এলাম। ধন্যবাদ দিলেও তোমাকে ছোট করা হয়।
– দিলুদি কাজটা করে আমার ভাল লেগেছে । মনে হল একটা পূণ্য করলাম জীবনে। কিন্তু ওরা ঠিকমত ময়মনসিংহ পৌঁছতে পারবে তো?
– সে নিয়ে তুমি চিন্তা কর না। ঠিক মতই পৌঁছে যাবে। আমার বোন এক্সপার্ট এসব ব্যাপারে। দেশের ঝামেলা মিটুক। আমি বেশ কিছুদিনের জন্য ময়মনসিংহ যাবো। সেখানে যেয়ে খুঁজে পেতে তাদের ২ জনকে ২ টা ভাল বিয়ে দিতে হবে। আমার উপর দায়িত্ব পরে গেল। আহা কত দিন যাই না আমার গ্রামে।
দিলরুবা কেমন জানি আবেগ আপ্লুত হয়ে গেল। হাত দিয়ে চোখ মুছে বলল,
– আচ্ছা আমি আসি।
দিলরুবাকে বিদায় জানিয়ে দরজা বন্ধ করতেই কারেন্ট চলে গেল।
একাদশ পর্ব
২৫শে মার্চ ১৯৭১
সেই যে কারেন্ট গিয়েছে আর আসে নি। হঠাৎ করে ১২ টা বাজার একটু আগে থেকেই গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ভয়ে রুনা, জামান আর সুমন, দিলরুবাদের ফ্ল্যাটে উঠে এসেছে। দিলরুবার পরিবার রীতিমত আতঙ্কিত। দিলরুবার ছোট বাচ্চাটি গুলির শব্দ শুনলেও কাঁদছে। জামানের সাহস একটু বেশি। সে ছাদে যেয়ে দেখতে চাইলো কী হচ্ছে আশেপাশে। সবাই না করছে যেতে। রুনা কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে।
– এমন পরিস্থিতি তে তুমি ছাদে যেও না।
– আমি আরে যাব আর আসবো।
জামান কারো কথা না শুনে ছাদে গেল। আর সাথে সাথে গোলাগুলির শব্দ মনে হয় বেড়ে গেল। কিছুক্ষণের মাঝেই জামান নিচে নেমে এলো। তার সমস্ত শরীর কাঁপছে ভয়ে। সে আতঙ্কিত কণ্ঠে বলছে,
– চারিদিকে শুধু আগুন আর আগুন। মিলিটারিদের ট্যাংক দেখা যাচ্ছে। আর মানুষের আর্তনাদ। আগুনের গোলার মত কী জানি ছুটে যাচ্ছে। সম্ভবত কামানের গোলা।
দিলরুবার হাসবেন্ড রবি বলল,
– তাহলে কি মিলিটারি সাধারণ মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো?
– আমি জানি না। কিছু জানি না।
তখনি দরজা ধাক্কার শব্দ। সবাই চুপ। পিনপতন নীরবতা। রবি দরজা অর্ধেক খুলল। দরজা খুলতেই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলো রবির ছোট ভাই হাবিব। হাবিবের চেহারা আতঙ্কগ্রস্ত। মনে হয় ভুত দেখে এসেছে। সমস্ত শরীর ঘরমাক্ত। হাঁপাচ্ছে জোরে জোরে। হাবিব আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ধপাস করে সোফায় বসে পড়লো। হাবিব, দিলরুবা কে বলল,
– ভাবি এক গ্লাস পানি দাও।
রবি, হাবিব কে জিজ্ঞেস করলো,
– কী হয়েছে? বাইরে কী হচ্ছে কী?
– বাইরে গণহত্যা হচ্ছে। সারা ঢাকায় কারফিউ।
– মানে? কী বলিস?
– মিলিটারি সামনে যাকে পারছে তাকেই মারছে। বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে। জগন্নাথ হল গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। একজন ছাত্র মনে হয় বেঁচে নেই। বাকি হল গুলোতেও একি অবস্থা। ছাত্রদের ধরে ধরে মারছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে হলগুলো।
কথা গুলো সুমনের বুকে যেয়ে আঘাত করলো। আজকে তো সুব্রতর জগন্নাথ হলে থাকার কথা। সুমন হাবিবকে জিজ্ঞেস করলো
– আপনি নিশ্চিত ?
– আমি দূর থেকে দেখেছি। কোন রকমে পালিয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে। ওরা মনে হয় একজন ছাত্র কেও বাঁচতে দিবে না। রাজারবাগ পুলিশ লাইনেও প্রচুর গোলাগুলি চলছে। হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা গুলোতে নাকি বেশি এটাক হচ্ছে। যেমন শাঁখারী বাজার, তাঁতি বাজার।
সুমনের চোখ থেকে ঝর ঝর করে পানি পরতে লাগলো। সে রুনা কে জড়িয়ে ধরে বলল,
– আম্মু আজকে তো সুব্রতের জগন্নাথ হলে থাকার কথা। তাহলে তো সে বেঁচে নেই।
– বাবা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা কর। এক মাত্র আল্লাহ আমাদের বাঁচাতে পারেন।
ঠিক এই সময় আরেক দফা গোলাগুলি শুরু হল। এখন মনে হচ্ছে বোমার শব্দ শোনা যাচ্ছে। দিলরুবা নামাযে বসে পড়লো। আজকে সারা রাত জায়নামাজেই থাকবে দিলরুবা। সেও নামাযের মাঝে গোলাগুলির আওয়াজে কেঁপে কেঁপে উঠছে। সুমন এক কোণে মাথা নিচু করে ভাবছে। সবুজও তাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো। সে কেমন যেন নির্লিপ্ত হয়ে গিয়েছে। কোন কিছুতেই যেন এখন কিছু আর তার যায় আসে না। বিভীষিকাময় এই রাত যেন আর শেষ হতে চাচ্ছে না। অবশেষে ফজরের আযান শোনা গেল। গোলাগুলির আওয়াজ থেমে গিয়েছে। নতুন একটা দিন , নতুন আশা।
রবি কোথা থেকে রেডিও নিয়ে এসে রেডিও পাকিস্তান ছাড়লেন। রেডিওতে দেশাত্মবোধক গান হচ্ছে। সারে নয়টার দিকে একটা ঘোষণা আসলো রেডিওতে। পরবর্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত কারফিউ থাকবে। আর কারফিউ ভঙ্গ করার শাস্তির কথাও বলা হল। আর জানানো হল মার্শাল ল জারি করা হয়েছে।
২৭ তারিখ কারফিউ তোলা হল। আর দলে দলে ভীত মানুষ ঢাকা শহর ত্যাগ করতে লাগলো। জামানের পরিবার তার ব্যাতিক্রম নয়। জামান সাহেব, রুনা আর সুমন যাবে পালইকান্তা। দিলরুবা যাবে অন্যদিকে। বাড়িতে শেষ বারের মত বিদায় নেয়া হল রুনা আর দিলরুবার। দিলরুবা, রুনাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলল,
– তোকে বোনের মতই দেখেছি। চেয়েছিলাম এক সাথে থাকতে। কিন্তু কপাল! ভাল থাকিস বোন। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে।
– দিলুদি তুমিও ভাল থেকো । সারা জীবন তোমার কথা মনে থাকবে। তোমার মত ভাল মানুষ আমি আর একটিও দেখি নাই।
রবি আর জামান হ্যান্ডশেক করলেন। বললেন,
– ভাইজান যাই। আমাদের জন্য দুয়া করবেন যেন ঠিক মত পৌঁছতে পারি।
– আপনারাও আমাদের জন্য দুয়া কইরেন।
এরপর আর দেরি করা গেল না। জামানরা বের হয়ে গেল। তাদের তিন জনের হাতেই পুটলি। কাপড়, খাবারের পুটলি। রুনার কাছে তার গহনার পুটলি। বাক্স থেকে বের করে কাপড়ে বেঁধে নিয়েছে গহনাগুলো। রাস্তায় তাদের মত হাজার হাজার মানুষ। সবাই পালাচ্ছে। আবালবৃদ্ধবনিতা যে যেভাবে পারছে পালাচ্ছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হল রাস্তা ঘাটে মানুষের লাশ। পচা গলিত লাশ। কুকুরের টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেই লাশ। ঘর বাড়ি পুড়ে ছাই। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মিলিটারি। তাই গলির ভিতর দিয়েই বেশি যাওয়া হচ্ছে। যাত্রা পথে সুমন বির বির করে কী যেন বলছে। সে তো সুব্রতকে হারিয়েছেই। আপাতত সবুজের কোন খবর পাওয়া যাবে না। সেও তার কাছে মৃত ব্যাক্তির মত। সুমন সেই কবিতা আওরাচ্ছে,
“হারাধনের ৩ টি ছেলে ধরতে গেল রুই
একটি মরলো পানি তে ডুবে, রইলো বাকি দুই
হারাধনের ২ টি ছেলে মারতে গেল ভেক
একটি মরলো সর্প দংশনে রইলো বাকি এক
হারাধনের একটি ছেলে কাঁদে ভেউ ভেউ
মনের দুঃখে বনে গেল রইলো না আর কেউ।”
সুমনেরও ভেউ ভেউ করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। একদিনে সব কিছু কেমন ওলট পালট হয়ে গেল। একদিনের ব্যবধানে সে সম্পূর্ণ একা হয়ে গেল।
ডেমরা ঘাটে পৌঁছে যেতে বেশি সময় লাগলো না। ঘাঁটে লোকে লোকারণ্য। নৌকা পাওয়া দুর্লভ হয়ে পড়েছে। তারপরও কোন মতে একটা নৌকায় উঠতে পারলো তারা। অসংখ্য নারী, বৃদ্ধ, বাচ্চারা নৌকায় উঠার জন্য একদম যুদ্ধ করছে। এক অশীতিপর বৃদ্ধার কষ্ট দেখে সুমন তাকে ধরে নৌকায় তুলে দিল। নৌকায় উঠার পর জামানের আতঙ্ক একটু কমলো। নদীর ওপারে পৌঁছায় কিভাবে যাওয়া যাবে সেই চিন্তা অবশ্য আছে। ভাগ্য ভাল একটা বেবি ট্যাক্সি পাওয়া গেল। সেটা আকাশচুম্বি দাম হাঁকছে। জামান তাতেই রাজি হয়ে গেল। তিন জন মানুষের খুব সহজেই জায়গা হয়ে গেল। বেবি ট্যাক্সি তাদের নরসিংদী ঘাট পর্যন্ত পৌঁছে দিল। সেখান থেকে লঞ্চে উঠলো অনেক ঠেলাঠেলি করে। সবাই ভীত । ঢাকা থেকে এসেছে। অনেকের স্বজন মারা গিয়েছে বা কোন খোঁজ নেই। মানুষ কাঁদছে। এটা এখন এখানকার খুব স্বাভাবিক দৃশ্য হয়ে পরেছে। কেউ কাউকে চিনে না। তারাপরও একজন আরেকজনকে সমবেদনা জানাচ্ছে, সান্ত্বনা দিচ্ছে। লঞ্চ অভার লোডেড। আল্লাহর নাম নিয়ে লঞ্চ ছাড়লো। যাত্রাপথে আর কোন সমস্যা হল না। লঞ্চ তাদের পৌঁছে দিল ফুলতলা পর্যন্ত। সেখান থেকে বৈঠার নৌকায় পালইকান্তা। অবশেষে নিজ গ্রামে এসে পৌঁছে গেল জামান সাহেব, রুনা আর সুমন। নিজ গ্রামে আসার পর রুনার মনে হচ্ছে দোযখ থেকে বেহেস্তে পৌঁছে গিয়েছে তারা। কিন্তু তারা তিন জনেই মানসিক এবং শারীরিক ভাবে প্রচণ্ড বিপর্যস্ত।
দুলাল আর খোকন ভিটাবাড়ি খুব ভাল মতই দেখে রেখেছে। পাশের বাসা থেকে নিলা তাদের দেখে উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে এলো। রুনা কে বলল,
– দিদি তোমরা এলে ?
– হ্যাঁ গো।
– কিন্তু জানো আমার সুব্রত ফিরলো না, বাবা সুমন তুমি জানো সুব্রত কোথায় ?
সুমন আর কী বলবে। তার চোখ থেকে এই প্রথম বার সুব্রতের জন্য ঝর ঝর করে পানি পড়তে লাগলো। সুব্রতের এক বন্ধুর মাধ্যমে ইতিমধ্যে নিলা খবর পেয়ে গিয়েছে তার ছেলে ২৫ তারিখের গণহত্যায় শহীদ হয়েছে। কিন্তু নিলা কিছুতেই বিশ্বাস করেনা। যেই বাড়ির পাশ দিয়ে যায় তাকেই উদ্ভ্রান্তের মত সুব্রতের কথা জিজ্ঞেস করে ।
এদিকে অমলেশ বাবুও একদম ভেঙ্গে পরেছে। কিন্তু নিলার মত অদ্ভুত আচরণ করছেন না, তিনি ঘর থেকে বের হয়ে আসলেন। জামান সাহেবকে নমস্কার জানালেন। তিনি জামান সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন
– ফিরলেন তবে।
– হুম্ম
– আপনারা রেস্ট নেন। আমি নিলাকে ঘরে নিয়ে যাচ্ছি।
অমলেশ বাবু নিলা কে বললেন,
– লক্ষ্মী সোনা চল যাই ঘরে।
– না যাবো না। সুব্রত না আসলে যাব না।
– ঘরে সুব্রত আছে।
– তাই? ঠিকাছে তাহলে আমি যাব।
অমলেশ বাবু জোর করে নিলাকে ঘরে নিয়ে গেলেন। জামান ইতিমধ্যে ঘরে ঢুকে গিয়েছে। রুনা একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। ছেলেটাকে সেই জন্মের পর থেকে দেখে আসছে। রুনার কাছেও সুব্রত কত আবদার করতো। রুনা সুব্রতকে নিজের ছেলের মতই দেখতেন। রুনার কেমন জানি বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এতক্ষণ আতঙ্কের মাঝে ছিল বলে এই অনুভূতি তাকে গ্রাস করতে পারে নাই। নিলাকে দেখার পর থেকে রুনার খুব কষ্ট হচ্ছে। সুব্রতের কথা মনে পড়ছে। ছেলেটা তার হাতের হালুয়া কত পছন্দ করতো। শবে বরাতের সময় কত বায়না থাকতো এই হালুয়া বানাও, ওই হালুয়া বানাও। সেই ছেলে আর কোন দিন তার কাছে হালুয়া খেতে চাইবে না। মজার মজার জোকস শুনাবে না। রুনা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকে গেল।
সুমন উঠানেই বসে আছে। সে কাঁদতে পারছে না। মাঝে মাঝে ২ ফোঁটা জল গড়িয়ে পরে নাই তা নয়। কিন্তু তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। সবুজকেও নিয়েও চিন্তা হচ্ছে। ও যেমন বিপ্লবী চেতনার অধিকারী কখন কোন পাকিস্তানি তার কোন ক্ষতি করে।
যুদ্ধ পুরদমে শুরু হয়ে গিয়েছে। মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়ে গিয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা নামের এক নিভৃত আম বাগানে বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হল। বিভিন্ন দেশের প্রায় ৫০ জন সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের নাম অনুযায়ী জায়গার নাম রাখা হয় মুজিবনগর। মুজিবনগর সরকারে ছিলেন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান, উপ রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ এবং অর্থ মন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান। বঙ্গবন্ধু জেলে থাকায় সৈয়দ নজ্রুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। কর্নেল (অবসর প্রাপ্ত) এম এ জি ওসমানী কে বাংলাদেশ বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ নিয়োগ করা হয়। আর এই মন্ত্রীসভা মুক্তি বাহিনীকে আরও উৎসাহিত, উজ্জীবিত করে। ১১ টা সেক্টরে ভাগ হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ শুরু করেছে।
দ্বাদশ পর্ব
পালইকান্তা আসার পর থেকে জামান সাহেবের মাঝে অভূতপূর্ব পরিবর্তন হল। তিনি লম্বা দাঁড়ি রাখা শুরু করলেন। এক সময় তিনি ছিলেন আওয়ামীলীগের সমর্থক। বঙ্গবন্ধুকে নিজের নেতা মনে করতেন। কিন্তু পালইকান্তা আসার পর তিনি সাচ্চা পাকিস্তানি হয়ে গেলেন। অমলেশ বাবু ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার থেকেও তিনি দূরে সরে গেলেন। এখন আর তাদের মাঝে কথা হয় না বললেই চলে। দুই পরিবারের মাঝে সম্পর্ক টিকে আছে রুনা আর সুমনের মাধ্যমে। জামান সাহেব আজকাল রেডিও পাকিস্তান ছাড়া আর কোন চ্যানেল তিনি শুনেন না। এই রেডিওর কথা বার্তাই যেন তার কাছে বেদ বাক্য।
তার স্ত্রী রুনা তেমন শিক্ষিত না। তারপরও সে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ঘৃণা করে। ২৫ মার্চের সেই ভয়াল রাত এখনো তাকে আতঙ্কিত করে। রুনা, সুব্রতের মৃত্যুর কথা ভুলতে পারে নি। নিলার অবস্থা, রুনাকে প্রায়ই খুব কষ্ট দেয়। কী প্রাণোচ্ছল এক মহিলা ছিল নিলা। নিলার উপস্থিতি ছাড়া কোন অনুষ্ঠান জমতো না। আজ তার এই অবস্থা। সব তো ঐ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কারণে। রুনা জামান সাহেবকে যত দেখে আর ততই অবাক হয়। মানুষটা তো এমন ছিল না। বিয়ের রাতে সে কী লজ্জা জামানের। আর সে নরম, বিনয়ী জামান এসব কী করছে। জামান তো সেই গণ হত্যা দেখে এসেছে তারপর কিভাবে সে এই ব্যাপারকে সমর্থন করে? তার কি বিবেক বলতে কিছু নাই? বুদ্ধি তো কম হবার কথা নয়। তাহলে বলতে হবে তার বিবেক বোধ নেই। রুনার আর জামানের সাথে এক বিছানা ঘুমাতে ইচ্ছা করে না। মাঝে মাঝে সে সুমনের সাথে ঘুমায়। সুমনের সাথে ঘুমাতে রুনা পছন্দ করে। কারণ সারা রাত্র ধরে মা ছেলেতে কুটুর কুটুর করে গল্প করে ।
এদিকে সুমনও তার বাবার বিরুদ্ধে খুব ক্রুদ্ধ আর বিরক্ত। সে তার বাবার সম্পূর্ণ বিপরীত। সে রেডিও পাকিস্তান শুনে না। কিন্তু, আকাশবাণী, স্বাধীন বাংলাবেতার কেন্দ্র, বিবিসি শুনতে তার ভাল লাগে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সুমনের প্রিয় অনুষ্ঠান হল চরম পত্র, ঐকতান আর বজ্র কন্ঠ। সুমন পশ্চিম পাকিস্তানের মিলিটারি বাহিনিকে ঘৃণা করে। সে চায় স্বাধীন বাংলাদেশে নিঃশ্বাস নিতে।
জামান সাহেবের সাথে সুমনের এই ব্যপারগুলো নিয়ে প্রতিদিন লাগে। ঢাকা শহরে এত মৃত্যু দেখে এসেও জামান সাহেব মানতে চান না দেশে কোন গণ হত্যা হয়েছে। বরং মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি মনে করেন সন্ত্রাসী, দেশদ্রোহী। তারাই নাকি অরাজক পরিবেশ সৃষ্টি করছে। মুসলমান ভাই ভাই। এই মুসলমানদের মাঝে ব্যবধান তৈরি করছে। এসব কিছুই নাকি ভারতের ষড়যন্ত্র। এসব কথা শুনলে সুমনের থুথু মারতে ইচ্ছা করে। জামানকে এখন সে মনে প্রাণে ঘৃণা করে। মাঝে মাঝে তো মনে হয় এই হিপক্রেট লোকটাকে খুন করে ফেলতে। তারপর যতই হোক জন্মদাতা বাবা। খুন তো আর করা যায় না। কিন্তু সে জামান সাহবের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল।
মিলিটারি ফুলতলা পর্যন্ত চলে এসেছে। জামান সাহেব মহা উৎসাহী। তিনি শুনেছেন মিলিটারি গ্রামে আসলে একটা রাজাকার বাহিনী গঠন করে। সেই বাহিনীর প্রধান অনেক সুযোগ সুবিধা পায়। জামান সাহাবের এসব শুনলে খুব লোভ হয়। তিনি রাজাকার বাহিনীর প্রধান হতে চান।
অমলেশ বাবু হিন্দু দেখে সম্পর্ক শেষ করার আরেকটা কারণ হল রাজাকার হওয়া। তিনি চান না তার পরিবারও অমলেশ বাবুদের সাথে কোন সম্পর্ক রাখুক। কিন্তু সুমন আর রুনা কোন কথাই শুনে না। তারা অমু বাবুর বাসায় যায় নিয়মিত নিলাকে সান্ত্বনা দিতে। এখন নিলার অবস্থা আগের থেকে ভাল। কিন্তু ছেলের মৃত্যু শোক কোন মায়ের পক্ষে ভুলা সম্ভব নয়। কিন্তু এখন নিলা মোটামুটি স্বাভাবিক আচরণ করেন। সুমনকে দেখলে কিছুক্ষণের জন্য হলেও সুব্রতকে ভুলে যান নিলা। তাই সুমন দিনের একটা বড় সময় অমু বাবুর বাসায় কাটায়। জামান সাহেবের এতে ঘোর আপত্তি আছে। কিন্তু রুনা স্পষ্ট ভাবে বলেছে এই ব্যাপারের যেন জামান সাহেব মাথা না ঘাটায়।
এক কাক ডাকা ভোরে জামান সাহেব উঠে উঠানে পায়চারি করতে লাগলো। তিনি সাধারণত বড় কোন সিদ্ধান্ত নেবার আগে এমন করেন। সুমনের ভোরে উঠে যাবার অভ্যাস। জামান সাহেবের মতিগতি তার ভাল লাগছে না। নাস্তা খাবার পর জামান সাহেব সাজগোজ শুরু করলেন। পাঞ্জাবি, পাজামা, আতর লাগিয়ে তিনি বাড়ি থেকে বের হলেন। সুমন পিছন পিছন যাচ্ছে। জামান সাহেব অমলেশ বাবুর বাড়ির দিকে যাছে। সুমন জামান সাহেব কে ফলো করতে লাগলো। দেখা যাক কী হয়।
অমলেশ বাবু তো জামান সাহেবকে দেখে অবাক এবং সাথে সাথে চিন্তায় পরলেন, এত দিন পর জামান সাহেব কী মনে করে তার বাড়িতে পা রেখেছে। অমলেশ বাবু আন্তরিকতার সাথে তাকে বৈঠকখানা তে বসালেন। অবশ্য আন্তরিকতা আসলেই ছিল না ফেক তা আল্লাহ জানেন।
জামান সাহেব প্রথম কথা বলা শুরু করলেন,
– নিলা বউদি কেমন আছেন?
– ভগবানের দয়ায় আগের থেকে অনেক ভাল।
– আলহামদুলিল্লাহ। শুনেছেন তো ফুলতলায় মিলিটারি এসেছে।
– জ্বি।
– পালইকান্তায় আসবে আসবে করছে। তা আপনি কী ঠিক করলেন?
– কী ঠিক করবো মানে?
– দেশে থাকবেন নাকি ভারতে চলে যাবেন?
– আমার সব কিছু দেশে আমি কেন ভারতে যাবো?
– সব কিছু আর কোথায়? সন্তানই তো নাই।
অমলেশ বাবু চুপ হয়ে গেলেন। চোখ কেমন যেন ছল ছল করছে।
জামান সাহেব ড্যাম কেয়ার। বলেই চলেছেন,
– আপনার শালা এবং শালিকা নাকি ভারতে থাকে?
– জ্বি।
– ওখানে চলে যান। বাকি দিন গুলো আত্মীয় স্বজনের সাথে কাটান, তারপর মিলিটারি যদি এসে পরে। তারা হিন্দু শুনলেই প্যান্ট খুলায় তারপর গুলি করে মেরে ফেলে।
– ওখানে যে যাবো তার টাকা পাবো কই?
– আপনার অনেক জমি। জমি বিক্রি করে দেন।
– এই দুঃসময়ে জমি কে কিনবে?
– আমি কিনবো। আর দুঃসময় বলছেন কেন? সব কিছু ভাল চলছে।
– আপনি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী তাই উপকার করতে চাইছেন।
– দেখেন আপনি জমি বিক্রি না করলেও হিন্দু বলে আপনার জমি কিন্তু মিলিটারি এসে ঠিকই দখল করে নিবে। তার থেকে বিক্রি করে দেন।
অমলেশ বাবু একটু ভাবলেন। ভেবে বললেন,
– আপনি তো আর আমাকে কম দিবেন না। এত দিনের সম্পর্ক আপনার সাথে আমার। পারিবারিক বন্ধুত্ব বলা যায়। আমি নিজে সুব্রত আর সুমন কে আলাদা দেখি নি, তবুও যদি বলতেন কত দিবেন?
জামান সাহেব একটা এমাউন্ট বললেন তাতে সুমন পর্যন্ত হা হয়ে গেল। অর্ধেকের থেকেও একটু কম বললেন,
– এটা কী বললেন জামান সাহেব? এটা তো অর্ধেক দামও হল না।
– এই সময়ে এর থেকে বেশি দাম কেউ আপনাকে দিবে না। আপনি চিন্তা করুন। কিন্তু সময় বেশি নাই। মিলিটারি এসে যাচ্ছে। আপনি রাজি হলে কাল রাতেই আপনাদের আমার লোকরা সহি সালামতে ভারতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করে দিবে।
সুমন এই অন্যায় মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু কার কাছে জামান সাহেবের এই অপরাধের প্রতিকার চাইতে যাবে? কিন্তু তার বুকটা ভার হয়ে আছে। তার নিজের বাবা। সে ভাবতেই পারছে না। এত নিচে নেমেছে তার বাবা। সুমন রুনাকে সব খুললে বলল। রুনা রণমূর্তি ধারণ করলো। জামান সাহেব ঘরে ফিরতেই তাকে জিজ্ঞেস করলো,
– তুমি নাকি অমলেশদার সম্পত্তি কিনে নিচ্ছ?
– হুম।
– কিনে নিচ্ছ ভাল কথা। কিন্তু এত কম দামে? আল্লাহ কি তোমাকে কম দিয়েছে?
– তুমি দামের কী বুঝো? তুমি মেয়ে মানুষ। মেয়ে মানুষের মত থাকো।
– এমন তো ছিলে না কখনো তুমি? তোমার কি বিবেক বলতে এখন আর কিছু নাই?
– মানুষ বদলায়। কারণে, অকারণে বদলায়। আমি বদলেছি একটা কারণে। আমি সারা জীবন এক কাপড়ের ব্যবসা করবো না। আমি বড় হতে চাই। তার জন্য যা যা করা দরকার করবো আমি।
– হ্যাঁ তুমি বদলেছ এবং বদলে একটা অমানুষ আর স্বার্থপর হয়েছ।
জামান সাহেব আর সহ্য করতে পারলেন না। গালে চড় মেরে বসলেন। রুনা এক পাশে এক দলা থুথু ছিটিয়ে বের হয়ে গেল। সব দেখলো সুমন।
দুপুরে খাবার পর একটা অলস সময় পার হয়। বাইরে রোদ। বের হতে ইচ্ছা করে না। সুমন নিজের ঘরে এসে পড়ছে। আর আজকের ঘটনার কথা গুলো ভাবছে। রুনা কে যখন জামান সাহেব মারলো তখন সুমনের ইচ্ছা হচ্ছিলো জামানের গলা টিপে ধরতে। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছে। এদিকে সবুজের কোন খোঁজ পাচ্ছে না সুমন। এখানে এসে একটু সামলে নেয়ার পর সুমন সবুজকে চিঠি লিখেছিল। কিন্তু কোন জবাব আসে নাই সেই চিঠির। তারপরও আরেকটা পাঠিয়েছে। সেটারও কোন জবাব আসে নাই। তাহলে কি সবুজের কোন বিপদ হল? সবুজও কি সুব্রতের মত সারা জীবনের জন্য তাকে ছেড়ে চলে গেল।
এসব ভাবলে এক দলা কষ্ট এসে গলায় আটকে থাকে। বুকে ব্যাথা হয়। ভারি ভারি লাগে। জোরে জোরে কাঁদতে ইচ্ছা করে।
সুমনের মাঝে মাঝে পাগল মনে হয় নিজেকে । এই দেশের জন্য সে কিছু করতে পারছে না। বয়স কম। তার উপর বয়সের তুলনায় তাকে ছোট দেখায়। সে গোপনে মুক্তিযোদ্ধা বাবুল ভাইয়ের সাথে কন্টাক্ট করেছিল। কিন্তু তারা তার বয়স কম দেখে যুদ্ধে তাকে নিয়ে যেতে রাজি হয় নাই।
দুপুরের কাজ শেষে সব সময় রুনা কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়। আজকে সে না ঘুমিয়ে সুমনের ঘরে আসলো। বলল,
– বাবা আজকে তোর ঘরে আমি একটু ঘুমাবো। ঐ অমানুষের মুখও আমি আর দেখতে চাই না।
– আচ্ছা আম্মু তুমি ঘুমাও।
– শোন কালকে দুপুরে আমাকে তোর নানা বাড়ি দিয়ে আসবি। আমি তোর আব্বুর সাথে সম্পর্ক রাখবো না।
– আচ্ছা রেখো না। এখন একটু মাথা ঠান্ডা করে ঘুমাও তো।
– আমার মাথা ঠাণ্ডা। আমি অনেক ভেবে চিনতে এই কথা বলছি। শুধু সকালে একটা কাজ আছে। নাহলে সকালেই চলে যেতাম। দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম না।
– কী কাজ?
– আছে কাজ। পরে বলবো। এখন ঘুম আসছে। ঘুমাই।
গভীর রাত
রুনা তার গহনার পুটলি খুলে বসেছে। বৈঠকখানায় হারিকেনের আলোয় গহনাগুলো দেখছে। কত বছর হয়েছে বিয়ের? তাও ২০ বছর। কত বছরের জমানো গহনা। হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করছে গহনাগুলো। এই গহনা গুলো তার কলিজার মত। প্রায় ১০০ ভরি গহনা রয়েছে। মা, শাশুড়ি, মৃত ননদ আর নিজের কেনা গহনা এগুলো। কিছু কিছু গহনা পরে দেখছে সে। অনেক গহনা আছে সে কক্ষনো পরেই নাই। আসলে গহনাগুলো জমিয়েছিল ভবিষ্যতে যদি দরকার পরে যাতে গহনায় হাত দেয়া যায়। আজ অনেক দরকার। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি গহনা গুলোর প্রয়োজন হবে ভাবে নি সে। সে শুধু একটা গহনা আলাদা করলো। শাশুড়ির দেয়া। বংশের বউকে এই হারটা দেয়া হয়। সুমনের বিয়েতেও দিতে হবে। এখন পুটলি তে গহনা গুলো রেখে সে বৈঠকখানা তে শুয়ে রইলো। কিন্তু ঘুম আসছে না। সারা রাত শুধু এপাশ ওপাশ করলো সে। তার বাপের বাড়িতে কোন সমস্যা হবে না তা সে জানে। তার একটা মাত্র ভাই। বিয়ে করে নাই। আর বাবা মা। বাকি জীবনটা একাই কাটায় দিতে হবে। সে ভাবছে একটা সেলাইয়ের দোকান খুলতে হবে। নিজের কিছু আয় দরকার। এমন নানা ভাবনা আসছে মাথায়। এভাবে ভাবতে ভাবতে কখন ফজরের আযান দিয়ে দিল। ভোর হয়ে গিয়েছে।
ত্রয়োদশ পর্ব
কাক ডাকা ভোর। মাত্র সূর্য উঁকি মেরেছে। বাসার সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এই অবস্থায় রুনা পুটলিতে স্বর্ণ গুলো বেঁধে রওনা দিলেন অমলেশবাবুর বাড়িতে। অমলেশ বাবুও চিন্তায় ঘুমান নাই সারা রাত। তিনি উঠানেই বসে ছিলেন। রুনাকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। অমলেশ জিজ্ঞেস করলেন,
– ভাবি এত সকালে? আপনি এই সকালে কষ্ট করে এলেন কেন? আপনি একটা খবর দিলেই আমি চলে যেতাম।
– কোন মুখে আমি আপনাকে ওই বাসায় ডাকবো ?
– কেন ভাবি?
– আমি সকল ঘটনাই শুনেছি। সুমনের বাপ এত কম দামে আপনার সকল সম্পত্তি কিনে নিচ্ছে তা আমি মেনে নিতে পারছি না।
– কী করবো ভাবি? ভাই তো তাও কিছু দিচ্ছে। অন্যরা পারলে দখল করে নেয়।
– ভাই নিলা আমার বোনের মত। আমরা একই মায়ের পেটে জন্ম নেই নি ঠিকই। কিন্তু সে আমার অন্য মায়ের পেটে জন্মানো বোন।
আমি চাই না কলকাতায় সে কষ্ট পেয়ে চলুক। তাই এই সামান্য উপহার। হয়তো তেমন কিছু নয়। আমার সাধ্যে যা ছিল…
– এই পুটলির মাঝে কী আছে?
– খুলে দেখুন।
অমলেশ বাবু পুটলি খুললেন। সূর্যের আলো পরে ঝিক ঝিক করে উঠলো স্বর্ণ।
– ভাবি এটা আমি নিতে পারবো না।
– কেন?
– আপনার শখের জিনিস। আমরা জানি কত তিলেতিলে আপনি জমিয়েছেন এগুলো।
– যে জিনিস কক্ষনো কাজে আসবে না তা জমিয়ে লাভ কী?আর আপনি না করার কে? উপহার দিয়েছি আমি আমার বোন কে। আর বড় বোন, ছোট বোনের জন্য এটুকু করবে না?
এইবার অমলেশ বাবুর চোখে পানি এসে গেল।
– জামান ভাই যে টাকা দিয়েছে তা দিয়ে আমরা কলকাতায় চলতে পারতাম না ভাবি। কিন্তু আপনি যে স্বর্ণ দিলেন তা দিয়ে আমরা মাথা গোঁজার ঠাই ঠিক পেয়ে যাবো। ভাবি আপনি সাক্ষাত দেবী। আমি আপনাকে অনুমতি দিলে একবার প্রণাম করতে চাই।
– না না ভাই। আমি বরং ক্ষমা চাইছি আমার স্বামীর হয়ে। আজকে আমি বাপের বাড়ি চলে যাবো। আর হয়তো দেখা হবে না। ভাল থাকবেন ভাই। একবার নিলা কে দূর থেকে দেখে চলে যাবো। কাছে গেলে আবেগাপ্লুত হয়ে যাবো, এতে নিলার সমস্যা হবে।
মধ্য দুপুর জামান সাহেবের বাড়ির সামনে একটা গরুর গাড়ি ডেকে আনা হয়েছে। রুনার ট্রাংক, সুটকেস সব তোলা হল। রুনা এসে উঠলো গাড়িতে। পাশে লাগেজ নিয়ে এসে বসলো সুমন। রুনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো
– তুই কোথায় যাস?
– নানা বাড়ি। এই অমানুষের সাথে এক বাড়িতে থাকা আমার পক্ষেও সম্ভব না।
জামান সাহেব একবারও বের হলেন না। তার চিন্তা ভাবনা এমন যেন আপদ বিদায় হয়েছে। এখন তার কাজ কর্মে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। আর কয়দিন বাপের বাড়ি থাকবে। আবার যখন আসতে চাইবে তখন কঠিন শর্ত দিয়ে আনতে হবে যে তার কোন কাজে কোন রকম প্রশ্ন করা যাবে না।
গরুর গাড়ি চলছে। হেলে দুলে। এক সময় পালইকান্তা পার হয়ে নবাবগঞ্জে ঢুকল গাড়ি। রুনার বাপের বাড়ি নবাবগঞ্জ।
নয় মাসের যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল সীমান্তে ও দেশের অভ্যন্তরে আনাচে কানাচে। সর্বত্রই পাকিস্তানি বাহিনি মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃসাহসী আক্রমণের শিকার হয়ে পিছু হটছিল। তাদের হাতের মুঠো থেকে ক্রমেই বেরিয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ফলে তাদের দুরবস্থা বাড়ছিল। ক্রমেই বেশি সংখ্যক এলাকায় উড়ছিল বাংলাদেশের পতাকা। এদিকে মুক্তিযুদ্ধকে একটি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা চলমান ছিল। তারই পরিণতিতে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জিওসি লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নেতৃত্বে গঠিত হয় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড। ভারতের সশস্ত্র বাহিনি পরিচিত হয় মিত্রবাহিনি নামে।
৬ই ডিসেম্বর সর্ব প্রথম ভুটান বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দান করে। ভারত ছিল দ্বিতীয় দেশ হিসেবে স্বীকৃত প্রদানকারী দেশ।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাকিস্তানী বাহিনী ১৬ই ডিসেম্বার যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেদিন ঢাকার কেন্দ্রস্থলে রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের পক্ষে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। তিনি যৌথবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর উপ-সর্বাধিনায়ক ও ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খোন্দকার উপস্থিত ছিলেন।
সুমন তার মামার সাথে যুদ্ধে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু একই কথা বয়স কম ( এমনিতেও বয়সের তুলনায় অনেক ছোট দেখায়। কেউ বিশ্বাস ই করতে চায় না এই বছর তার মেট্রিক দেয়ার কথা ছিল।), কিন্তু সেও মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছে, সে নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে নবাবগঞ্জ স্কুলের আশে পাশে যেয়ে অনেক তথ্য সংগ্রহ করে দিয়েছিল। বয়স কম দেখে মিলিটারি তাকে কিছুই বলে নাই এবং সন্দেহ করে নাই। কিন্তু এই তথ্য গুলো মুক্তিবাহিনীর খুব কাজে লেগেছিল। এছাড়া সুমন ক্লাস থ্রি নবাবগঞ্জ স্কুলে পড়েছিল। কারণ রুনা খুব অসুস্থ থাকায় এক বছর বাপের বাড়ি ছিলেন। সেই সময় সুমনও নানা বাড়ি ছিল, মানে নবাব গঞ্জে। নবাবগঞ্জ স্কুলের ম্যাপ তৈরি করতে সে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক সাহায্য করেছে। নবাবগঞ্জ স্কুল ছিল মিলিটারিদের ঘাঁটি। মুক্তিযোদ্ধারা এই নবাবগঞ্জ স্কুলকে মিলিটারি মুক্ত করে ছাড়ে। আর তাতে সুমনেরও এইভাবে অবদান রয়েছে। তাই তার মামা তাকে পিচ্চি মুক্তি যোদ্ধা বলে। সুমনও ভাবে সে কিছু হলেও দেশের জন্য করতে পেরেছে।
রুনা ১ মাসের মধ্যেই একা এক দিনের জন্য পালইকান্তা গিয়েছিল। ইচ্ছা ছিল থাকার। স্বামীকে না দেখে এত বেশি দিন কক্ষনো থাকেন নাই। তার মন চাচ্ছিল। মনকে তো আর বেঁধে রাখা যায় না। কিন্তু কিছু একটা দেখে সেদিনই সে ফিরে এসেছে। কী দেখেছে সে কাউকে বলে নাই। শুধু প্রায়ই কান্না কাটি করতো। সুমন অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে কান্নার কারণ। কিন্তু রুনা বলেন নাই। একদিন সকালে রুনা কে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কিটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করেছে।
যুদ্ধ চলাকালে জামান প্রথমে পালইকান্তা গ্রামের রাজাকার বাহিনীর প্রধান হয়। এবং পরবর্তীতে তার আনুগত্য দেখে তাকে পাকিস্তানী মেজর ফুলতলা জেলার রাজাকার বাহিনীর প্রধান করে। তার নৃশংসতা অনেক নিষ্ঠুর রাজাকারদেরকেও হার মানিয়েছিল। একটা মানুষ কিভাবে টাকা আর ক্ষমতার লোভে দানব হয়ে উঠে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ জামান। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে তরুণী মেয়েদের ধরে এনে ধর্ষণ পর্যন্ত করেছে। তার কথা ফুলতলা ছাড়িয়েও ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছায় যায়। আর তাকে ডাকা হত জামু রাজাকার নামে। যুদ্ধ শেষ হবার ১ সপ্তাহ পর এক দল মুক্তিযোদ্ধা তাকে হত্যা করে ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে যায়।
সুমন তার বাবার জানাজায় যায় নি। এখন সে বেশিরভাগ সময় মামার বাসায় থাকে। ঘর থেকে বের হয় না। লজ্জা গ্লানি তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে। তার বাবা বিখ্যাত রাজাকার ছিল এই গ্লানি সে কোথায় রাখে। এদিকে একদিন সুমনের মামা হাসিব একটি চিঠি এনে সুমনকে দিল। চিঠি পালইকান্তার ঠিকানায় এসেছে। কিন্তু পোস্ট মাস্টার জানে যে চিঠির মালিক মুক্তিযোদ্ধা হাসিবের বাসায় থাকে। তাই চিঠিটা হাসিবের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। সুমন চিঠি পেয়ে খুশি হবে না কাঁদবে তা বুঝতে পারছে না। সবুজের চিঠি। সবুজ মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। তাই সে আগের চিঠি গুলো পায় নি। এখন সে যুদ্ধ থেকে ফিরে চিঠি লিখলো। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হল সে তার এক পা হারিয়েছে যুদ্ধে। সে ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারে না। আর এই চিঠিতে সবুজ সরাসরি বলেছে সে সুমনকে ভালবাসে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে যেন ঢাকায় আসে। তাকে দেখার জন্য সে অস্থির হয়ে আছে।
কিন্তু সুমন আর চিঠির জবাব দেয় না। এমন না যে তার সবুজকে দেখতে ইচ্ছা করছে না। খুব ইচ্ছা হচ্ছে। তার কাছে যেয়ে পাশে যেয়ে বসতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু সবুজ যখন জানবে সে বিখ্যাত জামু রাজাকারের ছেলে তখন কী হবে সে তো তাকে ঘৃণা করবে। তার বাসার মানুষ জন ঘৃণা করবে। সবুজের চোখে তার প্রতি ঘৃণা সে সহ্য করতে পারবে না। তার থেকে চিঠির জবাব না দেয়াই ভাল। হয়তো সবুজ ধরে নিবে সে মৃত। কিছুদিন হয়তো সবুজ কষ্ট পাবে, তারপর তো সব ঠিক হয়ে যাবে। তার জীবনে নিশ্চয় আর কেউ আসবে।
হাসিব সুমনের মানসিক অবস্থা বুঝতে পারছে। সুমন অপরিচিত মানুষের কাছে গেলে সে ভয় পায় এই বুঝি তাকে কেউ তার বাবা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে অপমান করবে। ঘৃণার চোখে তাকাবে। হাসিবের চাচাতো ভাই রুমন থাকে ব্রিটেনে। চাচাতো ভাই হলেও আপন ভাইয়ের থেকে তাদের সম্পর্ক কম না। হাসিব ঠিক করলো সুমনকে ব্রিটেনে রুমনের কাছে পাঠিয়ে দিবে। রুমনকে প্রস্তাব দিল হাসিব। সে এক কথায় রাজি। সুমনও এই দেশ থেকে চলে যেতে পারবে শুনে খুশি হল। ওখানে যেয়ে অন্তত সে বাঙালিদের মাঝে থাকবে না সে তা ঠিক করে ফেলেছে। কারণ সে একজন রাজাকারের ছেলে। বাঙালিরা তাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখবে। এর থেকে ভিনদেশী মানুষের মাঝখানে থাকাই ভাল। সুমন ব্রিটেন চলে গেল ১৯৭৩ সালে। তারপর আর কোন দিন দেশে ফিরে নি।
সবুজ এক পর্যায়ে জানতে পারে সুমন বেঁচে আছে। সে প্রচণ্ড শকড হয়। সে এটা ভেবে কষ্ট পায় সুমন তাকে এমন মনে করে যে তার বাবার কাজ কর্ম দিয়ে সে তাকে বিচার করবে। যেখানে সুমন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে। এতটুকু ভরসা তার উপর ছিল না সুমনের। সবুজের বাবা, মা দুই জনেই যুদ্ধে মারা গিয়েছেন। বাবা মিলিটারি কাস্টডি তে মারা গিয়েছেন। সবুজের খবর জানার জন্য তার উপর অনেক অত্যাচার করা হয়। এক পর্যায় মেরেই ফেলা হয়। মা এই কথা শুনে স্ট্রোক করে মার যান। এই কথা গুলো সে চিঠিতে লিখে নাই। ভেবেছিল সামনাসামনি বলবে। কিন্তু এখন সে একাকী বন্ধুহীন পঙ্গু জীবন যাপন করছে। এই সময় সুমনকে তার সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল। আর সুমন তার সাথে একবার দেখাও করলো না। সে জানে একদিন ঠিক সুমনের সাথে দেখা হবে সেদিন সবুজ শুধু একটাই প্রশ্ন করবে
“আমি পঙ্গু। তাই তোকে খুঁজে বের করতে পারি নাই। কিন্তু তুই কেন আমার কাছে এলি না? এত বছরে তুই আমাকে এই চিনলি। এই আমাদের বন্ধুত্ব ছিল?”
পরিশিষ্ট
দিলরুবাকে বিহারিরা ধরে নিয়ে যায়। তারা তার মেয়েদের ঠিকানা জানার জন্য তার উপর অমানুষিক নির্যাতন করে। কিন্তু দিলরুবা মুখ খুলে নাই। পরে তাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়।