
দিশা
সময়টা বর্ষাকাল। তখন আমি হাইস্কুলে পড়ি। কোনো এক ঝুম বৃষ্টির সকালে ভাইয়া অনেকটা ধমক দিয়েই আমাকে স্কুলের জন্য রেডি হতে বললো। বৃষ্টিমুখর দিনে কারইবা স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে! ভাইয়া বয়সে আমার আট বছরের বড় বলেই হয়তো এমন ভাব করতো যেন আমার জীবনের ভালমন্দের দায়িত্ব একমাত্র তার! যেমন ভালো স্টুডেন্ট তেমন ভালো গান গায় আর ছবি আঁকে। আমার মা-বাবার পারফেক্ট ছেলে। আর আমি ছিলাম মা-বাবার উড়নচণ্ডী মেয়ে। তাই হয়তো কিছুটা হিংসেও হতো। বাবা-মাও নানাবাড়ি। তাই বায়না দিয়ে অজুহাত দিয়ে স্কুলে না যাওয়ার কোনো চান্স পেলাম না। স্কুলে গিয়ে দেখি মাত্র পাঁচজন ক্লাসে এসেছে। বেশ ভালোই গেলো। প্রথম পিরিয়ডে ক্লাস টিচার রোল কল করেই চলে গেলেন। তারপর আমাদের আর পায় কে! পাজামা গুটিয়ে মাঠে বৃষ্টিতে ভিজে বরফ পানি খেলা। নাহ! স্কুলে এসে বেশ মজাই হল আজ। কাঠখোট্টা ভাইয়ার উপর থেকে রাগটাও কমলো। শিক্ষক আর শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির কারণে সেদিন তাড়াতাড়ি শেষ হলো। দিনটা হয়তো ভালোই যেত। কিন্তু মাঝেমধ্যে মানুষের জীবনের এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা গোটা জীবন বদলে দেয়। ওই দিনটিও ঠিক তেমনি।
বাড়ি ফিরে দেখি মেইন গেটের দরজা লাগাতে আবার ভুলে গেছে ভাইয়া! এতো ব্রিলিয়ান্ট একটা মানুষ অথচ এতো ভুলো মন! আমি বেশ নিঃশব্দেই ঘরে ঢুকলাম। জানি এই ভেজা গায়ে ঢুকলে আবার একচোট বকুনি খেতে হবে কাঠখোট্টাটার! হঠাৎ মা বাবার ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় চোখ আটকে গেলো আমার! দেখলাম একজন শাড়িপরিহিতা একটি মেয়ে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে! অন্ধকারে আয়নার ভেতরে মেয়েটার মুখ ঠিকমতো দেখা গেলো না! তবে কি মা-বাবার ভালো ছেলে শেষ পর্যন্ত মা-বাবার অবর্তমানে তার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে এসেছে! এবার তোমাকে বাগে পেয়েছি ভাইয়া! মনে একটা দুষ্টুমি বুদ্ধি নাড়া দিয়ে গেলো। ভাইয়াকে আজকের ঘটনা নিয়ে লেগপুল করার কথা ভাবতে ভাবতে সশব্দে দরজা খুলে ঢুকলাম। আয়নার সামনের নারীমুর্তি আরো স্পষ্ট হয়ে গেলো। আমি আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমার মা-বাবার ভালো ছেলে মায়ের শাড়ি পরে আছে। হালকা মেকাপ আর পরচুলায় কিছুটা মায়ের মতোই দেখতে লাগছে তাকে। আমার মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হলো না। ভাইয়া কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলো। এরপর মায়ের শাড়ি বদলে খাবার টেবিলে খাবার সাজাতে লাগলো।
আমিও চুপচাপ খেয়ে নিজের ঘরে চলে গেলাম। এই নিরবতা চললো কয়েক মাস। আমি বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কিভাবে আমার রিঅ্যাক্ট করা উচিৎ। কয়েকমাস পর আমি জানতে পারলাম আমার পারফেক্ট ভাইয়ের ‘ইম্পার্ফেকশন’-এর কথা। সৃষ্টিকর্তা তাকে পুরুষের শরীর আর নারীর মন দিয়ে পাঠিয়েছেন। ভাইয়াকে আমি এখন আর ভাইয়া ডাকি না। সবার আড়ালে তাকে আমি দিদিভাই ডাকি। এতেই যেন তার রাজ্যের প্রশান্তি। একটু হলেও তার নারীসত্ত্বার কাছে আশা।
প্রথম প্রকাশিত
মন্দ্রপত্র (প্রথম সংখ্যা)
একটি মন্দ্র প্রকাশিত ছোট পত্রিকা