অব্যক্ত অভিজ্ঞতা

ড্রিম পিনাকল

প্রায় ২০০৯/১০ এর কথা, তখন আমি সদ্য এইচ এস সি শেষ করে ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। তখনই কম্পিউটার ফেসবুক নিয়ে ঘাটাঘাটি করতাম। এর আগে, নিজেকে ভাবতাম আমিই হয়তো পৃথিবীতে একজন যার মন মানুষিকতা সবার চেয়ে আলাদা আমার মত মনে হয় আর কেউ নেই। তবে ফেসবুক গুগল ঘেটে কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, যাক আমি ছাড়াও অনেকেই আছে আমারই মত,  যাদের ইন্টারেস্ট সেম জেন্ডারের প্রতি। নিজেকে আর একা মনে হত না। যাই হোক তখন গুগলে BOB (বয়েজ অব বাংলাদেশ) এর নাম জেনে ছিলাম। আর তখনই জুলহাজ মান্নান নামটা সবার আগে দেখতাম, ভাবতাম বাংলাদেশেও এগুলো নিয়ে কেউ কাজ করে! এই ট্যাবুর সমাজে এটা আসলেই আমাকে উৎসাহিত করতো। সেই থেকে অনেক সময় গড়ালো! ২০১৪ সালের পহেলা বৈশাখে রেইনবো প্যারেডটা দেখে মনটা ভরে গিয়েছিলো, ভেতরে ভেতরে আনন্দিত হয়েছিলাম, যাক! বাংলাদেশের মানুষের মন মানুষিকতা হয়তো পরিবর্তন হচ্ছে, হয়তো সামনে এই ব্যাপারগুলো মানুষ পজিটিভলিই নিবে! কিন্তু প্যারেডের ফেসবুক পোস্টে তথাকথিত সুস্থ-ধর্মীয় মন মানুষিকতার মানুষের কমেন্ট দেখে শিহরিত হয়েছিলাম। যেমন কেউ বলছে, এদের আগুনে পু*য়ে ফেলা হোক, কেউ বলছে ফা* দেয়া হোক ব্লা ব্লা। অথচ এই ভদ্র মানুষ গুলোর অনেকেই বাড়িতে বউ রেখে পতিতালয়ে সময় দেয়, দূর্নীতি করে, চুরি করে, হজ করে এসেও সম্পত্তির লোভে মানুষ খুন করে! কি আজব ভন্ডামী তাই না। সমকামীতার সুযোগ পেলে এদের ৮০% ই কোন না কোন সময় এটা এনজয় করেছে।  আর এরাই বিদ্ধেষ ছড়াচ্ছে!  তবে অনেকেই এটা পজিটিভলিও নিয়ে ছিলো, যদিও তাদের সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন সংখ্যাগরিষ্ঠ দের মতই।  তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম। 

যাইহোক, তার পরের বছর নিউজে শুনলাম পহেলা বৈশাখে রেইনবো প্যারেড নাকি পুলিশ করতে দেয় নি।  তারপরেও আশ্বস্ত হয়েছিলাম, হয়তো নিরাপত্তা জনিত কারনে পুলিশ এটা করতে দিচ্ছে না, লুকানো হায়েনারা তো খুব সহজেই মানুষ খুন করতে পারে।  যদি কিছু করে ফেলে! থাক ঠিক আছে হয়তো!

তারও অনেক পরে, ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে তনয়ের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিলো গুলশানের একটা পোগ্রামে। তার পোশাক পরিচ্ছদ ওভারওল গেটআপে একটা ম্যাসেজ ছিলো। এখনো মনে আছে! কপালে বড় কালো টিপ, কালো শাড়ি,  পুরুষালী মোছ, ঠোঁটে আবার লিপস্টিক, এ যেনো তার শিল্পের মাধ্যমে নিজের পরিচয়ের বহি:প্রকাশ। প্রথম দেখাতেই তার হাসিটা আমার এখনো চোখে ভাসে। অনেক অমায়িক ছিলেন ভদ্রলোক।  সেদিন অনেকক্ষন তার সাথে কথা হয়েছিলো। তার সাথে মিট হওয়ার ১ সপ্তাহ পড়েই শুনি BOB এর জুলহাজ মান্নানের সাথে নাকি তিনিও খুন হয়েছেন। খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম,  এমন সফট মনের মানুষকেও কেউ কুপিয়ে মারতে পারে! তখন অনেকটা ভন্ড স্ট্রেইটদের প্রতি ঘৃনা কাজ করতো।এখনো করে! অথচ সমকামীতা কোন মানষিক রোগ নয়, এটার পিছনে ব্যক্তির কোন হাত নেই। এই দেশের তথাকথিত স্ট্রেইটরা যেই সৃষ্টিকর্তাকে মানে এরা সেই সৃষ্টি কর্তারই সৃষ্টি। অথচ আমি মসজিদের হুজুরকে শুনেছি সমকামী দের পুড়িয়ে মারার নাকি বিধান আছে! অথচ মজার ব্যাপার যারা দূর্নীতিবাজ, চোর, বাটপার, প্রতারক তাদের নিয়ে এতো কঠোর কথা শোনাই যায় না। তখন থেকেই এই কমিউনিটি নিয়ে একটা ভয় কাজ করা শুরু, যেটা এখনো আছে। এই দেশের কিছু মানুষ এতোটাই ধর্মান্ধ বিবেকভোধহীন যে তারা সেম জেন্ডারে আকৃষ্টতাকে যে চোখে  দেখে সেই চোখে যদি দুর্নীতি, হত্যা, চুরি, বাটপারি, মানুষের অধিকার হরন ইত্যাদি খারাপ কাজগুলোকে দেখতো দেশটা হয়তো অনেক সুন্দর হতো। এটলিস্ট হিউম্যান রাইটসটা এনশিউর হতো। যাইহোক অনেক দিন পর তনয় এবং জুলহাজ মান্নানের ছবি দেখে অনেক কথাই মনে পড়ে গেলো সবতো আর লেখা যাচ্ছে না। তাদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখকের অনুভুতি, অভিজ্ঞতা এবং মতামত একান্তই নিজের। ‘মন্দ্র’ এর অনুমতি ছাড়া এই লেখা পুনঃপ্রকাশ করা যাবে না।

বিক্ষিপ্ত অনুভূতি একটি তনয়-জুলহাজ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত মন্দ্র আর্কাইভ সংকলন । এই সংকলনে কমিউনিটির বিভিন্ন মানুষ ঘটনা সম্পর্কিত নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.