আমার পাপনামা

স্বর্গ মর্ত্য পাতাল

সন্ধ্যায় যখন সূর্যের আলো নিভে যেতে থাকে , পশ্চিম আকাশ লাল হয়ে যায়, মর্ত্যলোকে নেমে আসে  নীরবতা তখন আমি কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে যাই। একটার পর একটা স্মৃতি মনের ঈশান কোনে বাসা বাঁধতে থাকে।

আজকের সন্ধ্যাটা খুব বিষণ্ণ। একটু আগেই বৃষ্টি হয়েছে। পানি জমে আছে রাস্তায়। হেঁটে যাচ্ছি সোডিয়াম বাতির আলোয়। পানিতে আলো পরে   প্রতিবিম্ব তৈরি হচ্ছে রাস্তায়।এলো মেলো হাঁটছি আমি । ভাবছি। ছোট বেলা থেকে শুরু করে পরিণত বয়স পর্যন্ত কত স্মৃতি। 

মর্ত্যলোকে আমাদের অবস্থান আর কত দিনের। কিন্তু এই অল্পদিনেই নাকি নির্ধারিত হয়ে যায় আমাদের অবস্থান হবে স্বর্গলোকে নাকি পাতাললোকে। ধর্মের চোখে মহা পাপী আমি। আমার অবস্থান হবে পাতাল লোকের একদম  গভীর স্তরে। অথবা সডোম নগরীর মত হয়ে যাব ধ্বংস। ধরলাম এসবই মিথ। কিন্তু তারপরও সমাজের চোখে আমার জীবন পঙ্কিল , পাপে পূর্ণ । সেই পাপ নামা লিখছি আজ আমি। 

জীবনের এক একটি ধাপ এক একটি অধ্যায়ে ভাগ করে লিখলাম। প্রথম ভাগ পুতুলের বিয়ে।

পুতুলের বিয়ে

পুতুলের বিয়ে দিতে আমার খুব ভাল লাগতো। পুতুল খেলা আমার ছোটবেলার প্রিয় খেলা। কখনো মায়ের শারি , লিপস্টিক পরে আয়নায় নিজেকে দেখতাম। কিন্তু বয়স যত বাড়তে লাগলো সমাজ প্রতি প্রতি পদে পদে বুঝিয়ে দিতে লাগলো আমি ছেলে। আমার ছেলে হয়ে তথাকথিত মেয়েদের খেলা নিষেধ ।

আমার পরিবার কখনো আমাকে ছেলে মেয়েদের খেলার মাঝে আলাদা সীমারেখা টেনে দেয় নি। সেদিক থেকে আমি ভাগ্যবান বলতেই হয়। আমার ছিল অনেক গুলো পুতুল আর খেলনা হাঁড়ি পাতিল। এর মাঝে কিছু পুতুল আমার নানু আমাকে বানিয়ে দিয়েছিলেন। প্রায়ই তিনি বেরাতে এলে আমার জন্য বাচ্চাদের চুড়ি নিয়ে আসতেন। আমরা ২ জন বসে পুতুলের বিয়ে দিতাম। আরেকটু বড় হলে পাশের বাসার শায়লা আপু দের সাথে খেলতে যেতাম। আমার ভাই এর সাথে শর্ত ছিল আমি তার সাথে ১৫ মিনিট ক্রিকেট খেলবো তাহলে সে আমার সাথে ১ ঘন্টা পুতুল , হাঁড়ি পাতিল খেলবে। এক কথায় আমি বুঝেই উঠতে পারি নি পুতুল খেলা আমার জন্য নয়। কেউ আমাকে মানা করে নি। মাঝে মাঝে ফুপুদের অনুরোধে শারি পরে মাথায় ফুল গুঁজে নেচেও দেখেছি। কেউ হাসে নি । বরং আদর করেছে। আহ্লাদ  দিয়েছে।স্কুলে ভর্তি হবার পর ধীরে ধীরে সমাজ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আমি ছেলে তাই আমার পুতুল খেলা যাবে না।

 দ্বিতীয় শ্রেণী তে থাকতে আমার এক স্কুলের সহপাঠী এক দিন তার মায়ের সাথে আমার বাসায় বেরাতে আসলো। সেই মুহূর্তে সে কিছু বলে নি । কিন্তু স্কুলে যেয়ে সবাই কে বলল আমি এখনো পুতুল খেলি। আমার বাকি ছেলে সহপাঠী রা ব্যাপারটা খুব হাসির বলে ধরে নিল। হোমোফোবিয়ার বীজ সেই ছোট বেলায় তাদের মাঝে বুনে দেয়া হয়েছিল।আমি খুব লজ্জা পেলাম। তার উপর শায়লা আপু রা কেমন যেন আস্তে আস্তে আমাকে উপেক্ষা করতে লাগলো। আমি ছেলে ভেবেই হয়তো আমার সাথে আর খেলতে চাইত না।কফিনে পেড়েক ঠুকলো আমার ভাইএর বন্ধুরা। তারা আমার পুতুল দেখে খুব হাসাহাসি করলো। ভাইয়া আমার সাথে আর পুতুল খেলতে রাজি হল না। পুতুলের বিয়ে আর দেয়া হল না। বরং পুতুল আর হাঁড়িপাতিলের জায়গা হল স্টোর রুমে। মা , বাবা যেন খুশিই হলেন । ছেলে বড় হয়েছে। 

এইভাবেই শিশুকালে বুঝিয়ে দেয়া হয়  যে ছেলে মেয়ে আলাদা। কিন্তু যারা শারীরিক ভাবে ছেলে হয়েও  মেয়েদের সাথে খেলতে,  মেয়েদের মত সাজতে ভালবাসে এবং যারা নিজেদের মেয়ে হিসেবে উপলব্ধি করে তাদের কষ্ট বুঝার কেউ থাকে না। তারা যেমন ছেলে দের সাথে মন খুলে মিশতে পারে না তেমনি মেয়ে দের সাথে বা মেয়েদের খেলা খেলার সুযোগ পায় না। তাদের কে জোর করে ছেলেদের খেলা খেলতে বাধ্য করা হয় যা তারা উপভোগ করে না। তখন তারা নিজেদের কে একা মনে করে এবং শৈশবে সেভাবে  ভাল বন্ধু তাদের  অনেকের ক্ষেত্রে হয়ে উঠে না।

স্কুলে নরকবাস

ক্লাস সেভেন থেকে ক্লাস টেন। আমার বয়ঃসন্ধি র সময়। বয়ঃসন্ধির সময় সবার মানসিক এবং শারীরিক  কিছু পরিবর্তন হয়। আমার শারীরিক পরিবর্তন ঠিক মতই হল। কিন্তু জানি না কেন জানি পুরুষ দেহ আমাকে আকৃষ্ট করতে শুরু করলো। ক্লাসে সব ছেলেরাই মেয়ে দের শরীর নিয়ে আলোচনা করে। আমি খুব ভদ্র ছেলে হিসেবে পরিচিত ছিলাম। তার উপর ক্লাসে আমার বন্ধু বলতে কেউই ছিল না। তাই মেয়ে দের নিয়ে আলোচনা আমার হাল্কা কানে আসতো কিন্তু কখনো কেউ আমাকে নারী পুরুষের জৈবিক রহস্য খুলে বলে নি। কিন্তু সুন্দর পুরুষ দেখলেই আমি উত্তেজিত হতাম। বিশেষ করে টিভি তে খেলোয়াড় বা অভিনেতাদের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতাম। রাস্তায় সুন্দর পুরুষ দেখলেই চোখ চলে যেত। কিন্তু আমি তখনো বুঝি নাই আমি সমকামী। স্কুলে যৌন শিক্ষা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা এখন আমি উপলব্ধি করি। 

কিছু দিন পর বুঝা শুরু করলাম ক্লাসের ছেলে রা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। একসময় শুরু হল অত্যাচার। ক্লাসে যখন শিক্ষক থাকতো না তখন আমার নামে লেখা হত আজে বাজে কথা। আমাকে হাফ লেডিজ নাম দেয়া হল। খাতা লুকিয়ে রাখা নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। আমাকে নিয়ে বুলিং করা মানেই যেন পুরুষত্বের পরিচয় দেয়া। কেউ কেউ পানি ছিটিয়ে দিত। শিক্ষক এর কাছে নালিশ করলে সবাই মিলে আমার নামেই উল্টো  মিথ্যা নালিশ দিয়ে দিত। কিছু কিছু শিক্ষক তো নিজেরাই বুলি করতো । নরক হয়ে গেল আমার জীবন। বাবা মা  কে বললাম। তারা ব্যাপারটা হাল্কা ভাবে নিলেন। আমার প্রতিদিনকার রুটিন ছিল ক্লাসে যেয়ে চুপ করে বসে থাকা। মনে মনে ভাবতাম কারো সাথেই কথা বলবো না। কিন্তু তা হবারও যো ছিল না কারন কিছুক্ষন পরেই কেউ  হয়তো শার্টের পিছনে লেখার চেষ্টা করতো বা চুইং গাম লাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতো।  কিন্তু আমি বুঝতাম না কেন আমার সাথে এমন করা হচ্ছে।আমার সব কিছু নাকি মেয়ে দের মত। হাঁটা, চলা ফেরা, কথা বলার ভঙ্গী সব। কিন্তু আমার কাছে তা মনে হত না।আমার মনে হয় আমার মত যারা কৈশোরে মেয়েলি  ছিল তাদের সবাই কে কম বেশি এরকম অভিজ্ঞতার মাঝ দিতে যেতে হয়েছে। এই বয়সেই পেতে হয়েছে নারীসুলভ হবার শাস্তি। 

একটা সময় যখন বুঝলাম আমি সমকামী তখন খুব একা লাগতো। কেন আমি অন্যদের মত নই এটা ভেবে কষ্ট পেতাম। অন্যদের মত বিষমকামী নই ভেবে আক্ষেপ হত। সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিযোগ করতাম।সমকামিতা সম্পর্কে ধারণা পাই গল্পের বই পড়ে। তখন আমার তেমন কোন বন্ধু ছিল না। একদম ছিল না বললে ভুল হবে। এলাকার কিছু ছেলেরা আমার বন্ধু ছিল। কিন্তু খেলাধুলা ভাল পারতাম না। না ক্রিকেট না ফুটবল। তাই বিকেল হলে খেলতে যেতে লজ্জা লাগতো। তাই তাদের সাথেও বন্ধুত্বের গভীরতা কমে যেতে থাকে। আর ক্লাসে ২ -১ জন যে আমাকে পছন্দ করতো না তা নয়। তারপরও তা ছিল হাতে গোনা কয়েকজন।আর বড় ভাইএর সাথে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল অনেক। কেন জানি না।কি কারণে জানি আমার বড় ভাই আমাকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। হয়তো সে সময় আমার মেয়েলি আচরণের জন্যই। যদিও আমি নিশ্চিত নই। কখনো কিছু বলে নাই আমাকে এই ব্যাপারে।  আর ছোট ভাই এর বয়স ছিল অনেক কম।  তাই বই ছিল আমার সেই সময়ের বন্ধু। আমি অসংখ্য গল্পের বই পড়েছি ছোটবেলায় । সমকামিতার ধারণা  পাই হুমায়ুন আহমেদের এক আত্মজীবনী তে। যদিও তা হোমোফোবিক ছিল। সেখানে উল্লেখ ছিল একজন বাংলাদেশী যুবকের সাথে একজন আমেরিকান যুবকের সম্পর্কের কথা।যা তার মতে বাংলাদেশের জন্য একটা লজ্জার ব্যাপার ছিল।তখন আমি প্রথম বুঝতে পারি ছেলে ছেলে সম্পর্ক হতে পারে।সুনিল গঙ্গোপাধ্যায় এর উপন্যাসে সমকামিতার কথা জেনেছিলাম  ( পূর্ব পশ্চিম)। তারপরও পুরো ব্যাপারটা পরিস্কার ছিল না আমার কাছে। আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন ইন্টারনেট এত এভেইলেবল ছিল না। তাই বই ছিল তথ্য পাবার মূল উপায়।

পাতাললোকের চাবি

এস এস সির রেজাল্ট  এসকল অত্যাচারে খুব একটা ভাল হল না। ভাল হবেই বা কি করে সারাদিন ক্লাসের অত্যাচার সহ্য করে বাসায় এসে পড়া হত না। খুব বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়েছিলাম। কিন্তু তখন আমি জানতাম না যে এটা রোগ। পড়ার টেবিলে বসে ভাবতাম পরের দিন ক্লাসে গেলে কি কি অত্যাচার করা হবে আমার উপর। এইভাবে কি আর পড়া হয়? 

এস এস সি এর পর ভর্তি হলাম ঢাকা কলেজে। ইন্টার পড়ুয়া ছেলে রা কিছুটা ম্যাচুরিটি অর্জন করে। বুলিং কমে এলো। আমার স্কুলের ২ জন খুব ভদ্র ভাল ছেলে ভর্তি হল আমার সাথে। আমি তাদের সাথেই কলেজে বা স্যার দের বাসায় যেতাম। তারা বুলিং এর ধার দিয়েও যেত না। সারাদিন পড়াশোনা নিয়েই থাকতো। আমি যেন দোজখ থেকে মুক্তি পেলাম। ক্লাসে আমরা তিনজন এক সাথে বসতাম। এবার জিদ করলাম যে যেভাবেই হোক এইচ এস সি তে ভাল করতে হবে। অবশ্য ২ – ১ টা নতুন বন্ধুও হল। একজনের কাছে জীবনের গোপন রহস্যের ইতিবৃত্ত জানতে পারলাম। সমকামী শব্দ টার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় সেই প্রথম। আমি পরিস্কার বুঝলাম আমি সমকামী।এরপর সুনিলের ছবির দেশে কবিতার দেশে পড়ে কবি এলেন গিংসবারগ এর কথা জানতে পারি। কলেজে থাকতে খুব একটা বুলিং এর শিকার হই নাই। আমি খুব ভাল ছাত্র ছিলাম । তাছাড়া আমার সাথে যারা ছিল তারাও ঢাকা কলেজের ক্রিম স্টুডেন্ট ছিল। তাই আমাদের কেউ বিরক্ত করতো না। তারপরও একবার আমাকে একজন বুলি করলো। আগে দুর্বল ছিলাম । চুপ থাকতাম। কিন্তু এইবার বুঝলাম চুপ থাকলে  হবে না। সবাই পেয়ে বসবে।  আমিও তার ব্যাগ সিট থেকে ছুৃঁড়ে ফেলে দিলাম। সে আমাকে মারতে আসে এমন অবস্থা। এক উত্তেজনাকর মুহূর্ত। সবাই এসে আমাদের দুইজন কে সরিয়ে নিল। এরপর সে আর আমাকে ঘাটায় নাই । আর কেও আমাকে সেরকম বুলি করে নাই। আসলে সবাই শক্তের ভক্ত , নরমের যম। 

আমাদের বাসায় ইন্টারনেট আসে এই সময়। কিন্তু তা আমার ভাইএর পিসি তে। টেলিফোন দিয়ে কিভাবে জানি কানেক্ট করতে হত। কিন্তু ভাই এর পিসি তার অনুমতি ছাড়া ধরা যেত না। কিন্তু ভাইয়া যখন থাকতো না তখন আমি পিসি ছাড়তাম। একদিন ভাইয়ার পিসি তে নারী পুরুষ এর অন্তরঙ্গের ভিডিও দেখলাম। সেটা আমার প্রথম দেখা টু এক্স ভিডিও। আমি খেয়াল করে দেখলাম মেয়ের দিকে আমার কোন আগ্রহ নাই বরং ছেলেটির নগ্ন শরীরের দিকেই নজর যাচ্ছে। কিন্তু তখন পড়াশোনাই আমার ধ্যান জ্ঞান। এসব নিয়ে ভাবার সময় পেতাম না।তাও কেন জানি সব সময় বিষন্ন থাকতাম আমি।হয়তো সংগী ছিল না কোন তাই।

সত্যি নাকি ভুল

এইচ এস সি বেশ ভাল ভাবে পাশ করলাম। ভর্তি হলাম মেডিক্যাল কলেজে। হঠাৎ  করে আমার আগের স্কুলের সহপাঠী রা আমার সাথে আবার মেলামেশা শুরু করলো । তখন আর কেউ বুলি করতো না। বরং বেশ সমীহ করেই কথা বলতো ।  হয়তো ম্যাচুরিটি এসেছিল তাদের মাঝে। অথবা আমার ভাল রেজাল্ট। আমি মনে রাখি নাই অনেক কিছুই । তাই হয়তো কিছু স্কুলের সহপাঠী সেই সময় আমার বন্ধু হয়ে উঠে। আমি হয়ে উঠি খুব জনপ্রিয়। তাদের সব পার্টি , দাওয়াত আডডায় আমার থাকাই লাগবে। অথচ আগে সেখানে আমার স্থানই ছিল না। সেই সময় সমকামিতা নিয়ে আমার খুব বিরূপ ধারণা তৈরি হয়। আমি বেশ ধার্মিক ছিলাম। সমকামিতা যে মহা পাপ তা জানার পর খুব অপরাধবোধে ভুগতাম। তার উপরের বন্ধুরা সবাই বিষমকামী। একজন সমকামী মানুষও আমার পরিচিত ছিল না। সারা জীবনে একা থাকতে হবে সেই চিন্তায় আমি নিজে স্ট্রেট হবার চেষ্টা করতাম। এমনও হয়েছে আমি জোর করে মেয়েদের নগ্ন শরীরের কথা চিন্তা করে মাস্টারবেট করার চেষ্টা করেছি। যদিও ফলাফল শুন্য। এক সময় মাস্টারবেট না করার চেষ্টা করতাম। ভাবতাম এইভাবে আমি সমকামিতার  দিকে ধাবিত হচ্ছি। যদিও তা নিয়ন্ত্রন করা সব সময় সম্ভব ছিল না। পাপবোধে ভুগতাম খুব। 

এক থারটি ফাস্ট নাইটে হলে ছিলাম আমি।সেই রাতে আমার প্রথম থ্রি এক্স দেখা।ফাস্ট ইয়ার এর স্টুডেন্ট ছিলাম।ভাইরা হলের টিভি রুম ছেড়ে দিয়েছিল আমাদের সেদিন। সন্ধ্যা থেকে শুনছি সিনেমা দেখা হবে টিভি রুমে। ১২ টায় গিয়ে দেখি সবাই মিলে থ্রি এক্স দেখছে।

সেই রাতে মাস্টারবেট করলাম মেয়েটির ছেলেটির ব্লো জব এর কথা কল্পনা করে।অবশ্য মেয়েটির জায়গায় আমি নিজে কে কল্পনা করেছিলাম।পরের দিন অবশ্য ঠিক করেছিলাম আর কোন দিন থি এক্স দেখবো না।আর এসব কল্পনা করে মাস্টারবেট করাই যাবে না।তওবা তওবা। যদিও সেই চেষ্টা সফল হয় নি বলাই বাহুল্য। 

অন্তরজালে 

আমার মোবাইলে নেট ব্যবহার করা শুরু করি থারড ইয়ারের শুরু থেকে। তখন মিগ৩৩ বলে একটা এপ ছিল।সেখানে আমার পদচারণা শুরু হল।মানে চ্যাট করা শুরু করলাম। প্রথমে সব স্ট্রেট ছেলে দের সাথে চ্যাট হত।কিন্তু ছেলে রা কিছুক্ষণ চ্যাট করে আর আগ্রহ পেত না আমার সাথে চ্যাট করতে। বাধ্য হয়ে মেয়ে দের সাথেই চ্যাট করতাম।তখন কিছু মেয়ে বন্ধু হয়ে যায়।তারপরও কিছু ছেলের সাথে বেশ চ্যাট হওয়া শুরু হল।তারপর তাদের মাঝে এক জন আমার কাছে কাম আউট করলো। বলল  যে সে সমকামী। সেই আমার প্রথম সমকামী বন্ধু।সে জানালো মিগ এ গে বাংলাদেশ নামে একটি রুম আছে।সেখানে বাংলাদেশের অনেক সমকামী মানুষ   আসে এবং চ্যাট করে। আমার সামনে এক নতুন জগতের দুয়ার খুলে গেল।আমি যাব না যাব না করে একদিন একটা ফেক আইডি খুলে ঢুকলাম।একবার ঢুকে আর কোন দিন  ঢুকবো  না এই প্রতিজ্ঞা করেই ঢুকেছিলাম।কিন্তু আমার মত আরও অনেক মানুষ আছে।মনে হল নিজের আপন মানুষ তারা।মনে হল এটাই আমার জগত।আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারলাম না। কি এক টানে ঢুকতে লাগলাম নিয়মিত।যদিও মাঝে মাঝেই মনে হত আমি যা করছি তা কি ঠিক করছি?

সেখানে বন্ধু হল।আবার অনেকে ছিল শুধু সেক্স সিকার।টপ কি,  বটম কি ভারসেটাইল কি শিখলাম।প্রথম পরিচয় হয় চট্টগ্রাম এর একটা ছেলের সাথে।অনেক মিশুক ছেলে।খুব বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল তার সাথে।প্রতিদিন চ্যাট হয়,  কথা হয়। এমন অবস্থা।এখন আর যোগাযোগ নেই।কিন্তু এখনো মিস করি তার বন্ধুত্ব।তার কাছ থেকে আমি এই জগতের অনেক কিছু সম্পর্কে জেনেছি।তখন নিজের নাম পরিচয় বলতে খুব ভয় লাগতো।খুব কম মানুষ কে নিজের আসল নাম পরিচয় বলতাম। দেখা করতে আরও বেশি ভয় লাগতো।ছবি দেয়া তো আরও পরের কথা। তখন মোবাইলের ক্যামেরাউ খুব ভাল ছিল না। তারপরও ভয় কাটিয়ে প্রথম দেখা করি একসাথে ২ জনের সাথে।তারা ২ জনও আবার পরস্পরের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল।প্রথম দেখা করবো। উত্তেজনা, উৎসাহ আর ভয়ের এক মিশ্র অনুভুতি।তাদের সাথে খুব ভাল একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। বসুন্ধরা সিটি ছিল তখন দেখা করার একটা নিয়মিত জায়গা।পিসি তে নেট নিলাম।তখন মিগ থেকে ইয়াহু মেসেঞ্জারে চ্যাট করা শুরু করি। ম্যাঞ্জাম আর গেডার বলে ২ টা সাইট ছিল যেখানে অনেক সমকামী মানুষ প্রফাইল খুলত।আমিও খুললাম।পরিচয় হল অনেকের সাথে।মিগের ছোট জগত থেকে ঢাকা শহরের বিশাল সমকামী জগতে প্রবেশ করলাম।

আমি নিজের আইডেন্টিটি খুজে পেলাম।নিজেকে মেনে নিলাম।আমি সমকামী হওয়াতে আগে যে পাপ ভোগে ভুগতাম তা থেকে বের হয়ে আসলাম।আমার এই জগতের তখনকার বন্ধুরা আমাকে সাহায্য করেছে নিজেকে এক্সেপ্ট করার জন্য।

আমার জীবনের প্রথম সমপ্রেম মিগ এর দিন গুলোতেই হয়।যদিও তার স্থায়িত্ব খুব কম ছিল।২ মাস হয়তো। তারপরও প্রথম প্রেম।এখন তার সাথে কোন যোগাযোগ নেই।কিন্তু আমি মাঝে মাঝে প্রফাইল স্টক করতাম।সে বিয়ে করেছে। বাচ্চাউ হয়েছে।দেশের বাইরে আছে।সে আমাকে কখনোই বলে নি সে বাই সেক্সুয়াল।কিন্তু আমি বুঝি পরিবারের চাপে পরে তার বিয়ে করতে হয়েছে।কারন তার পরিবার ছিল বেশ রক্ষনশীল। পহেলা বৈশাখ এ সেবার ধুতি পরেছিলাম।ও ধুতি পরিয়ে দিয়েছিল।এরকম বেশ কয়েকটি সুন্দর স্মৃতি রয়েছে তার সাথে। তার জন্য অনেক শুভ কামনা। 

 বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সমকামী হয়ে বিয়ে করাটা খুব কমন একটা ব্যাপার।কিন্তু আমার মতে বেশিরভাগ মানুষ সুখি হয় না তাতে।পরিবারের চাপে বিয়ে করে ঠিকই কিন্তু বিয়ের পরেও দেখা যায় শারীরিক সুখের জন্য গ্রাইন্ডারে বসে আছে।এ শুধু সংগীর সাথে প্রতারণা নয় নিজের সাথেও প্রতারণা বটে।

কাম আউট 

 এই সময় আমি পরিবারে কাম আউট করি।আমার মা এই ব্যাপারটায় খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখান নাই। অনেকের মা বাবার মত আমাকে ডাক্তার দেখানোর চিন্তা ভাবনা করেন নি।আমার মা ছিলেন আমার অন্যতম ভাল বন্ধু।তাই তার কাছে এই ব্যাপার শেয়ার করতে পেরেছিলাম অকপটে।মা স্বাভাবিক  ভাবেই নিয়েছিলেন।আমার আব্বাও ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। বরং তার কোন এক বন্ধুর কথা বলে আমার সাথে গল্প করেছেন। সব মিলিয়ে এই ব্যাপারে পরিবারে আমার তেমন কোন চাপ অনুভূত হয় নি।বাবা মা যত দিন বেঁচে ছিলেন ততদিন বিয়ের জন্য কখনো চাপ দেন নি।আমার সমকামী বন্ধুদের অনেককে তারা চিনতেন।এবং তাদের অনেকের সাথে আমার বাবা মা-এর বেশ ভাল সম্পর্ক ছিল।বন্ধুরা আসলে নিয়মিত আপ্যায়ন করতেন মা।আমি আসলেই ভাগ্যবান ছিলাম।

পরবর্তী তে আমার বড় ভাই এবং ভাবি ব্যাপার টা জানতে পারেন।কিন্তু এখনো তারা ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক  ভাবে নিয়েছেন।এমন কি আমার কোন বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা তাও জানতে চেয়েছেন তারা।তারা বরং চান আমি একা না থেকে যেন একজন পারটনার খুঁজে  নেই।এই দেশ সমকামী দের জন্য খুব একটা সেফ প্লেস না বলে তারা আমাকে দেশের বাইরে যাবারও পরামর্শ দেন।

পরবর্তী তে আমি কিছু স্ট্রেট বন্ধুদের কাছে কাম আউট করেছি।তারা খুব সাভাবিক ভাবেই নিয়েছে।আবার কিছু হোমোফবিক বন্ধু রয়েছে যাদের কাছে কাম আউট করার সাহস পাই না এখনো। 

তবে এই দেশে কাম আউট করার আগে ভাল মত চিন্তা ভাবনা করে কাম আউট করা উচিৎ। সবার বাবা মা এক রকম নয়।অনেকেই মেনে নিতে পারে না। তারা তাদের সন্তান দের উপর করেন শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার। কখনো কখনো তারা তাদের সমকামী  সন্তান কে জোর করে কাউন্সেলিং বা সাইক্রিয়াটিস্ট এর কাছে নিয়ে যান। আর আরও বেশি ভয়াবহ ব্যাপার হল অনেক ডাক্তারই এখনো সমকামিতা যে ন্যাচারাল তা মানতে পারে না বা জানে না। ফলে এসকল ডাক্তার রা চেষ্টা করে সমকামিতা কে রোগ মনে করে করে তার চিকিৎসা করতে। ভয়াবহ সহ উপদেশ দেন তারা। অথচ অনেক আগেই সমকামিতা কে who  রোগ এর তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে।আর ধর্মের ধব্জাধারী রা তো রয়েছেই।তাই আমার মতে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পরই কাম আউট করা উচিৎ। 

এই ভাগ শেষ করছি এক বন্ধুর ঘটনা দিয়ে।তার বাবা মা তার সমকামিতার কথা জানার পর তাকে ভারত থেকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়।তাদের ধারণা ছিল বাংলাদেশে এভাবে সমকামী রা আত্মপ্রকাশ করে নি।কিন্তু এটা তাদের ভুল ধারনা ছিল বলাই বাহুল্য 

প্রিয় বন্ধু

বেশিরভাগ মানুষের জীবনে বেস্ট ফ্রেন্ড এর ভুমিকা অপরিহার্য। বেশিরভাগ মানুষের বেস্ট ফেন্ড হয় ছোট বেলার বন্ধু বা ইউনিভার্সিটির বন্ধু।কিন্তু আমাদের জীবনে মনে হয় সমকামী বন্ধুরাই সেরা বন্ধু হয়।কারণ আমাকে বুঝার জন্য আমার আইডেন্টিটি কে এক্সেপ্ট করতে হবে।আর এক জন সমকামী মানুষ আমাকে পুরোপুরি এক্সেপ্ট করতে পারবে।তার মানে এই নয় যে স্ট্রেট কেউ বেস্ট ফ্রেন্ড হতে পারে না।হয় হয়তো। আমার এই জগতের আসার আগে যাদের কে সেরা বন্ধু ভাবতাম তারা আমার ভাল বন্ধু ঠিকই কিন্তু সেরা বন্ধু হিসেবে তাদের কে আক্ষ্যা দেয়া যায়না।আমি খুব ভাগ্যবান যে আমার জীবনে এমন একজন মানুষ কে পেয়েছি যে সত্যি আমাকে ভালবাসে। অনেক আগে একবার তার সাথে আমার দেখা হয়। কিন্তু তখন তার সাথে বন্ধুত্ব ছিল না। আমাদের বন্ধুত্বের সূচনা হয় ইয়াহু মেসেঞ্জারে। গে ডার থেকে তার সাথে পরিচয়।রাত জেগে তখন চ্যাট করতাম।চ্যাট করতে করতে কবে যে আমরা খুব ভাল বন্ধু হয়ে গেলাম তা আমরা নিজেও জানি না।অবলীলায় সব কিছু শেয়ার করতাম।কোন গোপনীয়তা ছিল না আমাদের মাঝে।পরিবার, প্রেম সব কথা আমি তাকে বলেছি।সেও বলত।আমার গোপনীয়তা সে সব সময় রক্ষা করত।এরপর দেখা হতে লাগল নিয়মিত।এক সময় নিজেদের আবিস্কার করলাম সেরা বন্ধু হিসেবে।নানা বিপদে আমি তাকে পাশে পেয়েছি।ভবিষ্যতেও পাব আশা করি।একটা বন্ধুত্বের মূলে রয়েছে শ্রদ্ধা,  ভালবাসা আর পারিস্পারিক সহযোগিতা।আমাদের মাঝে  এই ৩ টা ব্যাপারই রয়েছে। যখন বন্ধুত্বের সূচনা হয় সেই সময়টা খুব সুন্দর ছিল।মাত্র যৌবনে পা দিয়েছি।নতুন বন্ধু পেয়েছি।সে এক স্বপ্নের সময়।আমরা আজও আমরা আমাদের প্রথম দেখা করার দিন টা পালন করে থাকি।

জুলহাজ ভাই

জুলহাজ ভাই এর কথা না বললে তার প্রতি অন্যায় করা হবে। আমার জীবনে তার ভূমিকা অনন্য।মূল কমিউনিটি তে প্রবেশ তারই হাত ধরে বলা যায়।এর আগে হাতে গুনা কয়েকজনের সাথে আমি দেখা করেছি।চ্যাট হয়তো হয়েছে অনেকের সাথে। কিন্তু তেমন মেলামেশা হয় নি।দেখা সাক্ষাৎ হয় নি। জুলহাজ ভাই এর স্মৃতি চারন করলে সবাই তার বিপ্লবী জীবন নিয়েই কথা বলে।তার কলাবাগানের বাসার কথা বলে। কিন্তু তার সাথে আমার পরিচয় তারও অনেক আগে।তখন তিনি আমাদের মতই খুব সাধারণ। তিনি থাকতেন তখন শ্যামলী তে।তখনো ইউ এস এম্ব্যাসির চাকুরী পান নি তিনি।ফ্রি ল্যান্সিং করতেন।সেই সময় গে ডার এ তার সাথে আমার পরিচয়।প্রায় প্রতি দিনই চ্যাট হত।পরে ইউ এস এম্ব্যাসির চাকুরী পাওয়া উপলক্ষে একটা  পারটি দিলেন।সেই পারটি তে যাওয়ার মাধ্যমে প্রথম কমিউনিটির গেট টুগেদার এ আমি অংশ গ্রহণ করি।আমি খুব সাধাসিধে ছিলাম।এরকম পারটি আগে কখনো এটেন্ড করি নি।অন্য রকম ভাল লাগা ছিল।নাচ,  গান সব মিলিয়ে খুব জাঁক জমক পূর্ণ  একটা পারটি ছিল।সেই যে কমিউনিটির প্রোগ্রাম গুলি তে যাওয়া শুরু করলাম। এর পর সব ধরনের প্রোগ্রাম, পারটি তে জুলহাজ ভাই আমাকে দাওয়াত করতেন বা নিয়ে যেতেন।আর আমিও খুব উপভোগ করেছি সেই সময়টা।কেমন যেন বাঁধনহারা একটা সময়।তখন বব বলে একটা অরগানাইজেশান ছিল।এটা মূলত একটা ইয়াহু গ্রুপ ছিল প্রথমে।পরে তার অনেক অফলাইন এক্টিভিটি করা শুরু করে।যেমন পারটি,  ওয়ান ডিশ,পিকনিক ইত্যাদি। ববের পারটি খুব বড় আকারে হত।পারটি আসার আগে পারটি তে কি পরে যাওয়া যায় সেটা নিয়েই এক মাস আলোচনা হত।পারটি গুলো তে থাকত নাচ, গান, ডিযে,  পারফরম্যান্স ইত্যাদি। তখন কমিউনিটি তে মানুষের সংখ্যা অনেক কম ছিল।তাই পারটি গুলো তে সবাই মোটামুটি পরিচিত মুখ ছিল।বব পরবর্তী তে এক্টিভিসম এ অবদান রাখে।

পরবর্তী তে একটা অহেতুক কারণে অভিমান করে জুলহাজ ভাই থেকে একটু দূরে সরে গিয়েছিলাম।তারপরও দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার।বেশি করে মনে পড়ছে রূপবানের প্রকাশনা উৎসব এর কথা।যতই আমি দূরে সরে যাই জুলহাজ ভাই আমাকে অনেকদিন টানা বিভিন্ন প্রোগ্রামে দাওয়াত করেছেন।পরে এক সময় যোগাযোগ আর না থাকার মতই হয়ে যায়।কিন্তু তার পারসোনালিটি,  এক্টিভিসম,  সবাই কে ভালবাসা দেয়ার অপরিসীম ক্ষমতা আমাকে সব সময় মুগ্ধ করতো। তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কখনো কমে নি।

আঁড়ালে 

এরপর আমি মূল কমিউনিটি থেকে কিছুটা দূরে সরে যাই।ফেসবুকে আমার ফেক আইডি নষ্ট হয়ে যায়। তার উপর বডি ডিস্মরফিয়া ডেভেলপ করে আমার। আমি অনেক মোটা হয়ে যাই।অনেক বডি শেমিং এর শিকার হই আমি।তাই অনেকের থেকে কিছুটা আঁড়ালে চলে যাই।কিছু অভিমানও ছিল।নিজের কিছু বন্ধুবান্ধব ছিল। তাদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল আমার মেলামেশা।সেই গন্ডিতেই আমি সাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম।কমিউনিটির প্রোগ্রামে গুলো তে খুব কম এটেন্ড করতাম।এর মাঝে অনেক কিছু হয়ে যায়। রূপবান ম্যাগাজিন বের হয়। রেড পারটি, পিংক পারটি সহ অনেক প্রোগ্রাম হত যেগুলো তে আমার যাওয়া হয় নি। রেড পারটির কথা মনে আছে। এটা একটা রিসোরটে হয়েছিল ৷র‍্যালি হল পহেলা বৈশাখ এ।কিন্তু আমি ছিলাম না সেখানে। প্রজেক্ট ধী নামে একটি প্রজেক্ট এর কথা শুনতাম। একটা সমপ্রেমী কমিক্স প্রকাশ করে তারা। সেই কমিক্স এর প্রকাশনী উৎসব এ অবশ্য গিয়েছিলাম আমি।

আমি পরে একটা ফেক আইডি খুলি। সেখানে প্রচুর মানুষের  সাথে চ্যাট হত। কিন্তু মিট হত না খুব একটা ।তাও কয়েকজন এর সাথে যে মিট করি নি তা নয়।কিন্তু নিজের ফিগার,  চেহারার জন্য হীনমন্যতায় ভুগতাম।গ্রাইন্ডার এপ টার সম্পর্কে জানলাম এই সময়ে। খুব একটা নিয়মিত ছিলাম না সেই সময় এই এপে।কারণ একটাই বডি শেমিং।আমার মনে হয় আমাদের কমিউনিটি তে বডি শেমিং খুব বেশি হয়।ছবি দিলে অনেক সময় নানা বাজে কথা শুনতে হয়। কিংবা কোন কথা না বলেই ব্লক দিয়ে দেয়।অবশ্য আমি নিজেও নিজে কে একসেপ্ট করতে পারি নি। যার জন্য বডি ডিস্মরফিয়া তে ভুগতাম।আমরা যে যেরকম নিজেকে সেই ভাবেই এক্সেপ্ট করতে হবে।কনফিডেন্ট থাকতে হবে।সবারই কোন না কোন ভাল লাগার মত দিক আছে।

সেই সময় আমার খুব লেখালিখি করা হত। আমি ফেসবুকের পেজ গুলো তে অনেক গল্প,  উপন্যাস লিখেছি ।আমার প্রথম লেখা উপন্যাসের নাম ছিল দুই ভুবন।যেটা সমপ্রেম পেজে প্রকাশিত হয়। এখনো এই পেজ টা রয়েছে।যখন লিখতাম চরিত্রের সাথে মিশে যেতাম।মনে হত এটাই আমি।তাই লিখতে এত ভাল লাগতো। লিখালিখি শুরু করার পর বেশ কয়েকজনের সাথে খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়।তার মাঝে চট্টগ্রাম এর একজন আমার সাথে দেখা করতে ঢাকা এসেছিল।লিখালিখি করার ক্ষমতাটা আমার জন্য আশীর্বাদ ছিল।আমি আবার আমার কনফিডেন্স ফিরে পাই।

দুঃস্বপ্ন 

সেই সময় জুলহাজ ভাই ২০১৬ সালে তৃতীয় বারের মত র‍্যালির আয়োজন করেন পহেলা বৈশাখ এ।সেই সময় ফেক আইডি তে দেখলাম অনেকেই সেই র‍্যালি তে যোগ দেয়ার জন্য ঢাকার বাইরে থেকে আসছে।কিন্তু আমি তখন একদম এসব থেকে দূরে ছিলাম।তাই আমার যোগ দেয়া হয় নি। পরে শুনলাম র‍্যালিটি আর হয় নি পুলিশের বাধার কারনে।যাই হোক সে সময় আমি এই ব্যাপারে আর তেমন কিছু শুনি নাই কিন্তু হঠাৎ করে একটা খবর জানলাম ২৫ এ এপ্রিল  সন্ধ্যায় যে জুলহাজ ভাই আর নেই।একজন বন্ধু যার সাথে গল্প লেখার সুত্রে ফেক আইডি তে পরিচয় সে ফোন করে জানাল জুলভাই আততায়ীর হাতে খুন হয়েছেন।সাথে আরেকজনও খুব হয়েছেন।তাকে আমি ব্যাক্তিগত ভাবে চিনতাম না।কিন্তু তার নাম শুনেছিলাম। তার নাম তনয়।আরেক জন বাথরুমে লুকিয়ে ছিলেন বলে বেচেঁ যান।সব কিছু মনে হচ্ছিল দুঃস্বপ্নের মত।দুঃখের সাথে সাথে ভয়ের একটা মিশ্র অনুভূতি।আমি জুলহাজ ভাই এর ফেসবুক আইডি তে ঢুকলাম।কেউ কেউ কমেন্ট করছে যে জুলহাজ ভাই ঠিক আছে কিনা।কেউ কেউ মেনে নিতে পারছে না।পরবর্তী তে একটা জংগী সংগঠন ঘটনার দায় স্বীকার করলো।ইউ এস এম্ব্যাসির থেকে  শোক প্রকাশ করা হয়।টিভি, পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করা হয়। সব চেয়ে খারাপ লাগছিলো ফেসবুকের নিউজের নিচে মানুষের কমেন্ট।নিজেকে কীট পতংগের মত মনে হচ্ছিল হোমোফোবিক মানুষের উল্লাস দেখে।ধীরে ধীরে সব কেমন জানি হয়ে গেল।অনেকেই ফেক আইডি ডিসেবল করে দিল।শুনলাম কেউ কেউ দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছে।অনেকে গোপন স্থান এ আশ্রয় নেয়।শুনেছিলাম বেশ কয়েকজন কে নাকি হুমকি দেয়া হয়েছিল। ফেক আইডি তে মানুষের আনাগোনা অনেক কমে গেল।গল্প,  উপন্যাস লেখা বন্ধ হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল আমরা আর বোধ হয় আগের মত মেলামেশা করতে পারবো না। আগের মত কিছু হবে না।সব শেষ হয়ে গেল।

 আগে থেকেই ভাবতাম বাংলাদেশ সমকামী দের জন্য সেফ প্লেস না। তখন ধারণা আরও পাকাপোক্ত হয়।এদেশের মানুষ কখনো সমকামিতা কে মেনে নিবে এটা ভাবতেই আজব লাগতো। এখনো হতাশ বোধ করি।পাশের দেশে ৩৭৭ ধারা বাতিল হয়েছে৷আমাদের দেশে কি কখনো হবে? জলাশয় কত দূরে? 

পরবর্তী তে আস্তে আস্তে আবার কেউ কেউ মিট করতে লাগল। আমার মনে আছে এক ভাই এর বাসায় প্রায় মিট করা হত। কমিউনিটির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হত।আমি মাঝে মাঝে গিয়েছি সেই সকল আলোচনায়।ভয় দূর করে আবার নতুন করে পথ চলা শুরু হল। নতুন করে কমিউনিটি কে সাজানো শুরু হল।কিছু সংগঠন জন্ম নিল।আবার এক্টিভিসম শুরু হল।নতুন আশা নিয়ে আবার সব কিছু শুরু হল।কভিডের সময় আবার সব কিছু থিতিয়ে গেলেও অনলাইন এ যোগাযোগ হত।আড্ডা হত। এরপর বেশ কিছু প্রকাশনা হয়।এর মাঝে ছোট গল্পের সংকলন ছিল, ছিল চিঠির সংকলন। 

কোন প্রিয় নামে ডাকি

আমার জীবনে   প্রেম একবার নয় বেশ কয়েকবার এসেছে।কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী প্রেম ছিল একটি।৪ বছর ছিল তার স্থায়িত্ব কাল। কোন এক বৃষ্টির দিনে প্রথম দেখা হয়েছিল আমার তার সাথে।অসংখ্য মধুর স্মৃতি যেমন আছে তেমন অসংখ্য তিক্ত স্মৃতি রয়েছে।৪ দিনের জন্য কক্সেসবাজার গিয়েছিলাম আমরা। কি স্বপ্নময় দিন ছিল সেগুলো। এক সাথে অসংখ্য সিনেমা দেখা হয়েছে। অনেক বেরানো হয়েছে তার সাথে। এক জন আরেক জন বিপদে আপদে অনেক সাপোরট করেছি। প্রতি দিন কথা হওয়া ছিল নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। আবার মনোমালিণ্য এবং ভুল বুঝাবুঝিও হয়েছে অনেক।রয়েছে অনেক তিক্ত স্মৃতি। তারপরও সব কিছু পেরিয়ে চারটি বছর এক ছিলাম আমরা।কিন্তু একটা সময় আমরা ২ জনেই জীবনের নানা সংগ্রাম এর কারণে এক জন আরেক জন কে আগের মত সময় দিচ্ছিলাম না।বেশ দূরেই সরে গিয়েছিলাম।প্রায়ই বিশ্রি ঝগড়া হত।ঝগড়া গুলো খুব বাজে ভাবে শেষ হত। মনে হত কেউ কাউকে যেন সহ্য করতে পারছি না। দেখাও হত না আগের মত। শেষ যেবার ঝগড়া হল বুঝলাম এই সম্পর্ক আর থাকবে না। আরও হয়তো তিক্ত ভাবে শেষ হবে যদি সম্পর্ক আরও  কিছু দিন থাকে। এর থেকে এখানেই সম্পর্কের ইতি টানা উচিৎ। তাতে হয়তো ২ জনের মাঝে শ্রদ্ধাবোধ থাকবে।আমাদের ৪ বছরের সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়।কখনো কখনো খুব মিস করেছি।মনে হত যদি আবার ফিরে যাওয়া যেত। কিন্তু সম্মান ইগো এগুলোর কথা ভেবে আগাইনি। পরে জানলাম ওর একটা সম্পর্ক হয়েছে। এরপর আর ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই।এক্স এর সাথে বন্ধুত্ব থাকে না। এটা খুবই সত্য মনে হয় আমার কাছে। হয়তো তিক্ততা থাকে না সামনাসামনি।কিন্তু বন্ধুর মত মধুর সম্পর্কউ থাকে না।যার সাথে এত দিন কাটিয়েছি তার প্রতি অনেক অভিযোগ থাকবেই। স্বাভাবিক। কিনতু  যে ভালবাসা, সমর্থন পেয়েছিলাম তার কাছ থেকে তা আমি ভুলে যাই নি।তাই তার শুভাকাঙ্ক্ষী এখনো আমি।তার ভাল হোক। 

শেষ অধ্যায়

ভাবতে ভাবতে কখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। আবার বৃষ্টি নেমেছে। স্রষ্টা শান্তির স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছেন এই ধরাধামে।এখন বৃষ্টি তে ভিজতে ইচ্ছা করছে।বৃষ্টির ধারায় সব পাপ ধুয়ে মুছে যাক।কিন্তু সাত সমুদ্রের পানি দিয়ে ধুলেও একটা পাপ নাকি কখনো মুছা যাবে না।তা হল আমার মনের আর শরীরের কামনা যাতনা।থাক তাহলে এই কলংক টুকু নাহয়। চাঁদের কলংকের মত আমার কাছে তা অনেক গৌরবের, অনেক অহংকারের।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.