
চিত্তি
সিলিং ফ্যানের খটখটে আওয়াজে সকালের ঘুমটা ভেঙে মেজাজটা খিটখিটে হয়ে আছে। ফ্যানে মনে হয় জং ধরে গেছে। এ তো এক নিছক যন্ত্র। যেখানে রক্তে-মাংসে গড়া শরীরে জং ধরে ছারখার হয়ে যায় সেখানে যন্ত্র কিছুই না। আজকেই ছাড়াতে হবে, নয়তো প্রতি সকালে ঘুমটা হারাম করে দিয়ে ছাড়বে। এসব চিন্তা করতে করতে মা রান্না ঘর থেকে চিত্তি! চিত্তি! বলে ডেকে উঠলো। হকচকিয়ে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হলো মা? এমন আতঙ্কিত চিৎকার করছেন কেন?”
তখন মা মুচকি হেসে বলে, “এ তো তোমাকে ঘুম থেকে উঠানোর নিত্য নৈমিত্তিক কাজ।” কেমনটা লাগে এমন করলে সকাল সকাল! এমনিতেই মন মেজাজ ভালো নেই তার উপর মায়ের এই ছেলেমানুষী। মা সত্যি ছেলেমানুষী করে মাঝেমধ্যে। বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাতে নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে স্কুলের মাঠের দিকে ছুটলাম।
প্রচন্ড খরার পর গতরাতে হঠাৎ বৃষ্টি হওয়ায় পরিবেশ কেমন যেন শুনশান লাগছে। ভেজা মাটির গন্ধ শুঁকে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে হাঁটতে লাগলাম। হঠাৎ বৃষ্টির পানি পেয়ে গাছগাছালিও যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
স্কুলের দক্ষিণ পাশের একটি বেঞ্চে বসে সবুজ মাঠের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে এক অপরূপ মায়াভরা দৃশ্য। বৃষ্টির ফোঁটা সবুজ ঘাসের উপর যেন হিরে বসানো অলংকার। অপলক তাকিয়ে থেকে বাবার ধমকে সজাগ হয়ে কুয়ো থেকে বালতিতে পানি নিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলাম।
বাড়িতে পৌঁছামাত্র মায়ের বকুনি শুনতে শুনতে নাস্তা সারলাম। নিজের মতন সেজেগুজে ঠাকুমাকে প্রণাম করে ব্যাগপত্র নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম শহরের উদ্দেশ্যে নতুন ঠিকানার খোঁজে। ওহ, হ্যাঁ! বলা হয়নি, এবছরই অনার্সে ভর্তি হলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সকাল ১০টায় বাস ধরতে হবে এই ভেবে তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে পড়লাম।
মাঝপথে বাবা অপেক্ষা করছিলো আমার জন্যে। বাবার কাঁধে ব্যাগটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাবা অনেক উপদেশ বাণী শুনাতে লাগলেন। ঠিক উপদেশ নয় তবে অনুরোধই বলা চলে। আমি শুধু মাথা নাড়িয়ে যাচ্ছি একের পর এক প্রশ্নের জবাবে। বাবা বিরক্তির সুরে বলে উঠলো, “তুমি কি আদৌ শুনছো আমার কথা?”
আমি বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম, “বাবা, তোমার ছেলে যে আগের মতন নেই। অনেক কিছু শিখে গেছে, শিখতে বাধ্য হয়েছে।” তখনই বাবা বলে উঠলো, “হয়েছে হয়েছে তোমার এই শিক্ষার কাহিনী।” কিছুটা হলেও বুঝতে পারলাম বাবার আজ মন খারাপ। কেনই বা হবে না? ছেলে আজ শত মাইল দূরে যাচ্ছে। যাচ্ছে তো যাচ্ছে তাও একা থাকতে।
আমি বাবাকে আশ্বস্ত করে বললাম, “চিন্তা করিও না, তোমার সব কথা মেনেই চলব।” অটোরিক্সায় উঠে স্টেশনের দিকে যেতে লাগলাম বাবা আর আমি। বাবার আর আমার চোখে হাজারও স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলেছি গন্তব্যের দিকে। আধাঘন্টা পর স্টেশনে পৌঁছে সোজা উঠে গেলাম বাসে। বাবা ব্যাগগুলো গাড়িতে তুলে দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো, “সাবধানে যেও আর পৌঁছে কল দিয়ে জানিও।” কিছুক্ষণ পর বাবা হালকা শুকনো খাবার এনে হাতে দিয়ে বললো, “খিদে লাগলে খেয়ে নিও।” গাড়ি না ছাড়া পর্যন্ত বাবা স্টেশনে ছিলো ছেলের স্বপ্ন সিঁড়ি ওঠার পথ চেয়ে।
দুপুর ২টার দিকে পৌঁছে নতুন রুমে গিয়ে উঠে দেখি “পহর” অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। জামাকাপড় চেঞ্জ করে গোসল করে বের হয়ে দেখি সবকিছু সাজানো-গোছানো। আমি অবাক হয়ে পহরের দিকে তাকাতেই চোখের ইশারায় সব ঠিকঠাক বুঝালো। তারপর মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি বাবার ১৫টা মিসড কল।
ইশ! বাবা কতবার কল দিলো। তাড়াহুড়ো করে কল দিতে ওপাশ থেকে বলে উঠলো, “ঠিকমতন পৌঁছাইছ? খাওয়া-দাওয়া করেছ?” টানা ছয় সাতটা প্রশ্ন। তারপর বাবাকে একটু থামিয়ে বললাম, “এত চিন্তা করতে হবে না, এখানে সব ঠিকঠাক। এখন রাখলাম, রুমটা গোছানো লাগবে।” কথা বলার মাঝেই আমার রুমের পরিবেশটা পাল্টে গেলো নিমিষেই। পহরকে যেই না কিছু বলতে যাবো তখনই সে বলে উঠলো, “তোমাকে বেশ ক্লান্ত লাগছে। বরং কিছুক্ষণ বিশ্রাম নাও আর আমি এসব গুছিয়ে রাখছি।” চোখ বুজে আসলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। চোখ খুলতেই দেখি ঘোর অন্ধকার। মোবাইল হাতে নিয়ে সময়ের দিকে তাকাতেই চোখ কপালে উঠে গেলো।
একী! রাত এখন নয়টা! তারপর বজ্রকন্ঠে পহরকে বললাম, “এতক্ষণ ঘুমাতে দিলে কেন? ডেকে তুলতে পারলে না?” পহর আমতা আমতা করে বলে উঠলো, “তোমাকে ঘুমের মাঝে বেশ মায়াবী লাগছিলো তাই জাগানোর সাহস হয়নি।”
আমি রেগে থামো থামো বলে বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে আসলাম। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে পহরকে যেই না ডাকতে যাবো তখনই বলে উঠলো, “চিত্তি, খেতে বসো। একসাথে বসে খাবো আজ।” এতক্ষণ খাওনি- বলাতে অভিমানী গলায় বললো, “তোমাকে রেখে কেমন করে খাবো বল তো!” খাওয়ার পর বাইরে গেলাম নিকোটিনের ধোঁয়া ছাড়তে। পিছন পিছন পহর এসে বললো, “তুমি এখনো ছাড়তে পারলে না?” আমি চুপ করে থাকলাম কিছুক্ষণ। তারপর পহর বলে উঠলো, “চিত্তি, আমি বরং আজ আসি। বাসায় গেইট লাগিয়ে দিলে ঝামেলা হবে।” আমি তাও চুপ করে ছিলাম। কাঁধে হাত দিয়ে বললো, “মন খারাপ খুব? আংকেল আন্টির জন্যে কষ্ট হচ্ছে?” আমি তখন একটা লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লাম। তারপর বললাম, “আজকে কেন এখানে থেকে যাও না? বড্ড একা লাগছে। তার উপর নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ।” পহর একটু ভেবে বললো, “ঠিক আছে! চল ভিতরে যাই।”
আমার তো ঘুমই আসছে না। এপাশ-ওপাশ করতে করতে আবার বের হলাম নিকোটিনের ধোঁয়া ছাড়তে। বাইরে এসে সত্যি মনটা কিছু প্রশান্তি পেলো। জোনাকির আলোর সৌন্দর্যে ভরপুর হয়ে গিয়েছে বাসার চারপাশ। রুমে গিয়ে শুতে যাবো ঐ মুহুর্তে চোখ পড়লো পহরের মায়াভরা মুখটার দিকে। ছেলেটার আজ অনেক কষ্ট হয়েছে এই প্রতিটি অগোছালো জিনিস গুছিয়ে রাখতে। পহর আমার থেকে বয়সে তিন বছরের সিনিয়র। একজন ভালো বন্ধুও। ঠিক বন্ধু বললেও ভুল হবে। মনের মানুষ বলা যায়। পরিচয়টা ঘটে এক বিজ্ঞান মেলায় প্রতিযোগিতায় গিয়ে। সে গিয়েছিলো সেখানে ভলান্টিয়ার হিসেবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে পারার পিছনে তার অবদান অনেকাংশে। সে না থাকলে আমার মতন অগোছালো, বেপরোয়া ছেলে এমন প্রতিষ্ঠানে আসাটা কখনই হয়তো সম্ভব হতো না। সাহস জোগানো থেকে শুরু করে প্রতি পদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে এতটুক পথ পাড়ি দিতে। একই ক্যাম্পাসে প্রথম বসন্তবরণ থেকে শুরু করে আমাদের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান ফুলবিজু, মূলবিজু আর নুওবজর। দিনগুলো যেতে থাকে চিত্রশিল্পীর গড়ানো চিত্রকর্মের মতন। দিনরাত স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে পহর। আমারও ভার্সিটির জীবন চলতে থাকে ঘাত প্রতিঘাতে। প্রতিক্ষণে অপমানিত হচ্ছি আমার উচ্চারণের কারণে। কত মন খারাপ করে মুখ গোমড়া করে এসেছি ক্লাস থেকে কখনো বা খুশিতে আত্মহারা হয়ে। ব্যবহারিক ক্লাস শেষে বিকেল বেলায় ফিরতাম পরিশ্রান্ত হয়ে তবুও স্বপ্ন বোনা উপেক্ষিত হয়নি। কত স্বপ্ন দেখেছি পহরের হাত ধরে পছন্দের বার্লিন শহরের পথে হাঁটছি। কখনো বা আইফেল টাওয়ারের নিচে চুমু খেতে। কে বা জানতো এসব একদিন ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। স্বপ্ন রেখাগুলো আজ মিলিয়ে গেছে ধূলিকণায়। হয়েছে সবকিছু পরিত্যক্ত, চুরমার। বলছি কারণ সেই নিজের পহর পরিবারের চাপে পড়ে সবকিছু ভুলে, স্বপ্নের দিনগুলোকে দমিয়ে রেখে বিয়ের মণ্ডপে বসেছিল আজ থেকে তিনবছর আগে। তার বলা শেষ কথাটুকু এখনো ডায়েরির পাতায় আছে সযত্নে। বাক্যটি ছিলো এমন- এক্কিন নিধুত্তুক্কি জীংহানী ইরিনেই থিদেব্যর জীংহানী আওজ গুরিজ। বেলও ছদকও দোক্কেন জলজল্লে আর জুনো পহরও দক্কেন গুরি তহ জীংহানী আন বিদি যোক।
(এরকম কোণঠাসা জীবন ছেড়ে স্থির, খোলামেলা জীবন খুঁজে নিও। সূর্যের আলোর মতো উজ্জ্বল অথচ জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলোর মতো স্নিগ্ধ জীবন হোক তোমার)।