
ছুদোদটুবি
ওরা কেমন আছে জানো? গহীন বনের গাছপালা, বুনোফুল, পাখির কলরব, জুমে খাবার খুঁজতে আসা চিত্রা হরিণের দল, ইজোরের কোণায় যত্নে বেড়ে উঠা ঝিঙে ফুল, সন্ধ্যেবেলায় গাছের ঝোপে লুকানো জুরগোপেগ (বুলবুলি পাখি), কলকল শব্দে বয়ে যাওয়া ঝর্ণা। ওরা সবাই কেমন আছে? তোমার সাথে কি কখনো কথা হয়?
কতদিন তাদের সাথে দেখা হয় না, কথা হয় না! অথচ একটা সময় তাদের সাথেই সারাটা দিন কেটে যেত। দলবেঁধে পাহাড়ের ঝর্ণাগুলোতে মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি ধরতে যাওয়ার দিনগুলো খুব বেশি মনে পড়ে। বিঝুর সময় ঢিঙিতে বিন্নি চাল গুড়ি করে পিঠা বানানোর সময়গুলো কি আর কখনো ফেরত আসবে না! সিম্পুক, গুমুরো ধরার প্রতিযোগিতাগুলো মনে পড়লে খুব হাসি পায় এখন, আবার আনন্দও লাগে সেসব মধুর স্মৃতিগুলো যখন চোখে ভাসে। যখন বাবা-মা ভাইবোন সবাই কাজে যেত, অথবা বাজারে যেত, বাড়িতে একা থাকার সময়গুলো ছিল খুব রোমাঞ্চকর। আশেপাশে কোন ঘর নেই, মানুষের সাড়াশব্দ নেই, দূর পাহাড়ে একটি মাত্র ঘর, প্রকৃতি আর গৃহপালিত পশুরাই সঙ্গী। মাঝেমাঝে মায়াবী হরিণের দল ঘরের পাশ দিয়ে চলে যায়, বনমুরগি ধানক্ষেতে এসে খেলা করে, দূর থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যায়। ইজোরে বসে বাবা মায়ের জন্য অপেক্ষা করি।
আমি ছুদোদটুবি, পাহাড়ে জন্ম আর পুরো শৈশব ওখানেই কেটেছে। যেহেতু পাহাড়ে কোন স্কুল ছিল না, স্কুলে যাবার জন্য আমার বাড়ি ছেড়ে সদরে আসতে হয়, বাবা-মা ছাড়া ছোটবেলাটা খুবই কষ্টের। ছোটবেলা থেকে আমি একটু আলাদা ছিলাম। সবকিছুতেই ঢিলা ছিলাম, সচরাচর পাহাড়ি বাচ্চারা যেমন টনক হয় আমি ছিলাম ঠিক উলটো, মেয়েদের কাপড় পরার ইচ্ছা হত। বড় বোনের ফ্রক লুকিয়ে লুকিয়ে পরতাম, বাবা-মা কে জোর করতাম একটা ফ্রক বানিয়ে দেওয়ার জন্য। তখন তারা হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছিলেন আমার ব্যপারে তাই কখনই মেয়েদের পোশাক পরতে উৎসাহ দেননি। বড় হয়ে ধীরে ধীরে বুঝতে পারি সমাজে ছেলে হয়ে মেয়েদের পোশাক পরা বড়ই বেমানান, তাই মনকে শক্ত করে নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করতাম । আমার মেয়েলি আচরণের জন্য প্রতিনিয়ত কথা শুনতে হত, প্রতিবারই মনে ধপাস করে একটা বাড়ি দিত, আমি ভেতরে ভেতরে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেতাম। মনে সবসময় একটা ভয় কাজ করত কখন জানি কেউ টিটকারি দেয়। অজানা আশঙ্কায় ঘরের ভেতর থাকতাম বেশিরভাগ সময়, নিজেকে মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে পারতাম না, হাত পা কাঁপত।
অল্প বয়সেই বুঝতে পারি এই সমাজে আমি টিকে থাকতে পারব না। স্কুলে পড়ার সময়ে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই আমাকে দেশের বাইরে গিয়ে থাকতে হবে। কোথায় কীভাবে যাবো তখন কোন ধারণা ছিল না। তবে একটাই চিন্তা, ভালোভাবে পড়তে হবে। পরিবারের অভাব অনটনে বড় ভাইবোনদের সবার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। আমি তখন চিন্তায় থাকতাম কখন জানি আমারও বন্ধ হয়ে যায়। নিয়মিত স্কুলে যেতাম আর ভালো ফলাফল করার জন্য অনেক শিক্ষক আমার পাশে ছিলেন। আর বাবা-মা নিজে না খেয়েও আমার খরচ চালিয়েছেন। কলেজ পর্যন্ত ওনারা আমাকে সাপোর্ট দিতে পেরেছেন, এরপরে আমি আমার নিজের লড়াই নিজে শুরু করি। এই কাহিনী বলতে গেলে হয়ত শেষ হবে না।
আজকে আমি একটি উন্নত দেশে উচ্চশিক্ষা নিতে এখানে অবস্থান করছি। এখানে কেউ কাউকে টিটকারি মারে না, স্বাধীনভাবে সবাই চলতে পারে। মাঝেমধ্যে এখানকার প্রকৃতির সাথে কথা বলি, আমার জন্মভূমি কেমন আছে, হয়ত তারা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে এই ভাবনায়।
ভালো থেকো পাহাড়, ভালো থেকো আমার প্রিয় জন্মভূমি!
[…] পরঙ […]