
হিজেক
পৌষের শুরুর দিকে গ্রামগঞ্জে শীতের প্রকোপ একটু বেশিই থাকে। যদি হয় সবুজে ঘেরা পাহাড়ি এলাকা তবে তো কথা-ই নেই। শীত যেন আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন করে সারা গ্রাম তটস্থ করে ফেলে।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা। প্রায় এক যুগ আগেকার তেমনই এক পৌষের সকাল। জেলার তখনকার একমাত্র সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির টেস্ট পরীক্ষার ফলাফলের দিন। রেজাল্ট দেখতে যাওয়ার জন্য খুব একটা উৎসুক না হলেও পরিপাটি হয়ে বের হলো ফাগুন। তখন ফোনের ব্যবহার একেবারে নেই বললেই চলে। তার উপর গ্রামে ওসবের বালাই থাকে না। পরীক্ষায় পাস করবে সে নিশ্চিত। তবু রেজাল্ট দেখতে যাবার একটাই কারণ, অনেকদিন পর বন্ধুদের সাথে দেখা হবে। ঘণ্টাখানেক জার্নি করে কলেজে পৌঁছে যায় সে। গিয়ে জানতে পারে ফলাফল প্রকাশ স্থগিত।
উফফ, আবার আসতে হবে! বলেই আফসোস করতে করতে যেই বের হয়ে আসবে, কী দেখে যেন হতভম্ব হয়ে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ায় সে। বুক ধড়ফর করে ওঠে তার। যেন হুট করে অস্বস্তিকর কোনও পরিস্থিতিতে পড়েছে।
– কী রে!! দেখেও না দেখার ভান করে মুখ ঘুরিয়ে আছ যে? এই কদিনে আমাকে ভুলে গেছ নাকি? এই বলে সাইকেলটা একপাশে লক করে ফাগুনের দিকে এগিয়ে আসে বুয়ের। বুকের ধরফড়ানি দ্বিগুণ হয়ে ওঠে ফাগুনের। মুখ ঘুরিয়ে কাচুমাচু করে বলে ওঠে,
– আরেহ না দোস্ত। খেয়াল করিনি আসলে।
– খেয়াল না করারই কথা। আমি তো আর বসন্তের মতো তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড না।
– কী যে বলো না বুয়ের। তুমি আমার কাছে বসন্তের থেকে কম নও সেটা জেনো। ওহ হ্যাঁ, আজকে নাকি রেজাল্ট দিবে না। কালকে দিবে।
– হ্যাঁ, এই তো মাত্র বিশালের সাথে দেখা হলো রাস্তায়। ও-ই বললো এ কথা।
– জানার পরও আসলে কেন তাহলে?
– ভাবলাম এসেই যখন গেছি ভিতরে গিয়ে দেখি আদৌ সত্যি কিনা। এসে দেখি ভালই হলো। তোমার সাথে দেখা হলো। আর তুমি বলছো যখন আর খোঁজ নিতে হবে না। বলেই মুচকি হাসি দিলো বুয়ের। তার সেই চিরচেনা মনকাড়া হাসি। দেখলেই মনের মধ্যে খুশির জোয়ার এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। যে হাসি কেউ একবার দেখেছে অথচ প্রেমে পড়েনি তার সৌন্দর্যজ্ঞান নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। কথা বলার ফাঁকে ফাগুন জানতে পারে যে বুয়ের বাড়িতে যাবে। ফিরবে তার পরেরদিন সকালে। তাকে সাথে করে নিয়ে যেতে চায় বুয়ের। না বলার উপায় নেই। এমন নাছোড়বান্দা বন্ধু তার।
বুয়ের, কলেজে ফাগুনের ভাল বন্ধুদের একজন। কলেজ পাড়ায় মামা-মামির সংসারে আরেক বালাই। বেশ মার্জিত এবং মিশুক একটা ছেলে। বরং ফাগুনই ওর সাথে মিশতে কিছুটা ইতস্তত করে। সে মিশতে চায় না এমনও নয়। মনে মনে বুয়েরের প্রতি তার অন্যরকম ভাললাগা কাজ করে। এটা ঠিক শরীরের আকর্ষণ নয়, এ একটা অন্যরকম অনুভূতি। তাই মিশতে এত সংকোচ তার।
আঁকাবাঁকা রাস্তায় এপাশ ওপাশ করে সামনে এগিয়ে চলেছে বুয়েরের দ্বিচক্রযান। পিছনের সিটে বসে যাচ্ছে ফাগুন। প্রিয় মানুষের সাথে সাইকেলে চেপে কোথাও যাচ্ছে ভাবতেই ফাগুনের মনে তখন আনন্দের বাঁধ ভেঙে উপচে পড়বে অবস্থা। তার উপর বুয়েরের পারফিউমের ঘ্রাণ তার নাকে এসে আদর করে চলেছে একটানা। চোখ বুজে অনুভব করছে সেই স্বর্গীয় অনুভূতি। যেন মুহূর্তেই কনকনে শীতের মাঘ শেষ হয়ে পত্রপল্লবে সুসজ্জিত ধরায় মনোরম ফাল্গুন এসে হাজির। আহা, বসন্তকাল তুমি থেকে যাও আজীবন এমন মুহূর্ত ঘিরে। হঠাৎ বুয়েরের পিঠে ধাক্কা খেতেই চোখ খুললো ফাগুন। গন্তব্য এখানেই।
সেদিন থেকেই বুয়েরের প্রতি ফাগুনের টান বেড়ে গেল। যোগাযোগটাও যেন হুট করে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকল। নানা খুনসুটি, আদর, আপ্যায়ন আর পত্রমিতালিতে দিনগুলো বেশ ভালই চলছে। ফাগুনের কাছে বুয়ের বন্ধুর থেকেও বেশি কেউ। কিন্তু বুয়ের স্বভাবত বন্ধু ছাড়া বেশি কিছু ভাবতে পারেনি। তা জানা সত্ত্বেও ফাগুন যেভাবে চলছে সেভাবে ভেসে যাচ্ছে নিয়তির স্রোতে।
তারপর, একদিন ফাইনাল পরীক্ষা এসে দুজনের মধ্যে এগোনো সম্পর্কে ফাটল ধরিয়ে দিলো। পরীক্ষার কারণে যোগাযোগটা কমে আসলো। পরীক্ষা শেষে রেজাল্ট বের হলো। দুজনেই পাস। এরপর সংগ্রাম। এদিকে ফাগুনের দিন কাটে ঠিকঠাক স্নাতক পড়তে পারবে কিনা সে চিন্তায়। অপরদিকে মেডিক্যালে পড়বে বুয়ের। তাই কোচিং আর পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত সে। তারপর থেকে একদমই হারিয়ে গেল। যেন বৈশাখ এসে ঝড়ে উড়ে নিয়ে গেল ফাগুনের সেই বুয়েরকে।
বছর দুই পর চট্টগ্রাম শহরে বুয়েরের সাথে ফাগুনের দেখা হয়। ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে বেরিয়ে আসছিল ফাগুন। হুট করে বুয়েরের সামনে পড়ে একদম থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। বুয়েরের ঠোঁট জুড়ে সেই মনকাড়া হাসি। যে হাসি পুরনো সেই স্মৃতি রোমন্থন করিয়ে যাচ্ছে ফাগুনকে। সেই চিরচেনা শক্ত করে ধরে আলিঙ্গন দিয়ে কুশল বিনিময় করল বুয়ের। যেন এর মাঝে কিছুই হয়নি তাদের। নতুন ফোন নম্বর বিনিময় হল। বিনিময় হল ঠিকই কিন্তু সেই দেখা-ই তাদের শেষ দেখা। একদিন ফাগুন সে নম্বরে কল করলে অপরদিক হতে অপরিচিত একজন কল রিসিভ করে বললো- দুঃখিত, রং নাম্বার। তারপর সেই নম্বরে আর কল করেনি ফাগুন। সেই নম্বর থেকেও কল আসেনি কোনদিন।
[…] <ফাগুনো বুয়ের [ফাগুন হাওয়া] f w h fFacebook wTwitter gGoogle+ pPinterest মন্দ্র আর্কাইভ, লুডুঙ – দ্বিতীয় সংখ্যা, Collective Collections […]
শেষ হয়ে গেল কেন? 😭